- বইয়ের নামঃ ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাটা
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অবসর
যদি কোনো মধ্যরাতে আমার বিস্মিত জানালার
ভেতরে গলিয়ে গলা ফিসফিসিয়ে কেউ
হঠাৎ ফিগ্যেস করে, ‘তোমার কি আছে অবসর’,
আমি কি থাকবো নিরুত্তর?
আমার কিসের অবসর
এই জ্যোৎস্নাহীন স্তব্ধ মধ্যরাতে? আমি তো যাবো না
এখন তারার ডাকে অথবা বৃক্ষের ডাকে; আমি
এমন মুহূর্তে ঘর ছেড়ে
বেরিয়ে পড়ার লোভ বুক-পকেটের
গহ্বরে গচ্ছিত রেখে নিশ্চিন্তের তাঁবুর ভেতর
একটু ঘুমোতে চাই। স্বপ্ন এলেবেলে
খেলুক আমার সঙ্গে অথবা আড়াল থেকে জেব্রা
ছুটে গেলে একপাল, স্তব্ধতার কাছে
কৃপা ভিক্ষা করে নেবো। তবে কি আমার
তেমন সৌন্দর্যবোধ নেই?
কোন ডাকঘর থেকে কোকিল এনেছে টেলিগ্রাম
এত রাত? টেলিগ্রামে ডালপালা উদ্ভিদের ঘ্রাণ,
পলাশের ছোপ
লেগে থাকে কিংবা অলৌকিক
সিলমোহরের ছাপ? আমার শৈশব
কোথায় যে রইলো কুয়াশা জড়ানো কোন্
বকুলতলায়? খুব বেশি পথে পদচিহ্ন আঁকিনি কখনও,
তবু কোনো কোনো পথ শৈশবের কেমন
চিহ্ন হয়ে থাকে।
আমার কিসের অবসর
এই জ্যোৎস্নাহীন স্তব্ধ মধ্যরাতে? শৈশবে ফেরার?
মনিং স্কুলের ঘণ্টা শুনতে শুনতে
বাক্সের ভেতরকার বাঁশিটির জন্যে মন কেমন করার?
অথবা শিরায়
বখাটে ছোকরার মতো রক্ত শিস দিলে
কান পেতে শোনার গোপন অবসর?
স্বর্ণপদকের লোভে বিচারবোধের চিতা জ্বেলে
কোটাল আমার অবসর চুরি করে
বানায় রাজার বাড়ি। হাওয়াই বাড়ির নিধিরাম সর্দারেরা
আমাকে অবধ্য দূত ভেবে খুব হেলায় প্রান্তরে রেখে আসে।
অভিশাপ দিচ্ছি
না, আমি আসিনি
ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রাচীন পাতা ফুঁড়ে,
দুর্বাশাও নই,
তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে
অভিশাপ দিচ্ছি।
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে,
মগজের কোষে কোষে যারা
পুঁতেছিলো আমাদেরই আপনজনের লাশ
দগ্ধ, রক্তাপ্লুত,
যারা গণহত্যা
করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে,
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক
পশু সেই সব পশুদের।
ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের
সারিবদ্ধ দাঁড়
করিয়ে নিমেষে ঝাঁ ঝাঁ বুলেটের বৃষ্টি
ঝরালেই সব চুকে-বুকে যাবে তা আমি মানি না।
হত্যাকে উৎসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে
ক্যাম্পাসে বাজারে
বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভৎস গন্ধ দিয়েছে ছড়িয়ে,
আমি তো তাদের জন্যে অমন সহজ মৃত্যু করি না কামনা।
আমাকে করেছে বাধ্য যারা
আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত
সিঁড়ি ভেঙে যেতে
ভাসতে নদীতে আর বনবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে,
অভিশাপ দিচ্ছি আজ সেই খানে-দজ্জালদের।
অভিশাপ দিচ্ছি ওরা চিরদিন বিশীর্ণ গলায়
নিয়ত বেড়াক বয়ে গলিতে নাছোড় মৃতদেহ,
অভিশাপ দিচ্ছি
প্রত্যহ দিনের শেষে ওরা
হাঁটু মুড়ে এক টুকরো শুকনো রুটি চাইবে ব্যাকুল,
কিন্তু রুটি প্রসারিত থাবা থেকে রইবে
দশ হাত দূরে সর্বদাই।
অভিশাপ দিচ্ছি
ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার
কানায় কানায় রক্তে উঠবে ভরে, যে রক্ত বাংলায়
বইয়ে দিয়েছে ওরা হিংস্র
জোয়ারের মতো
অভিশাপ দিচ্ছি
আকণ্ঠ বিষ্ঠায় ডুবে ওরা অধীর চাইবে ত্রাণ
অথচ ওদের দিকে কেউ
দেবে না কখনও ছুড়ে একখণ্ড দড়ি।
অভিশাপ দিচ্ছি
স্নেহের কাঙাল হয়ে ওরা
ঘুরবে ক্ষ্যাপার মতো এপাড়া ওপাড়া,
নিজেরই সন্তান
প্রখর ফিরিয়ে নেবে মুখ, পারবে না
চিনতে কখনও;
অভিশাপ দিচ্ছি এতটুকু আশ্রয়ের জন্যে, বিশ্রামের
কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে
দ্বারে দ্বারে ঘুরবে ওরা প্রেতায়িত
সেই সব মুখের ওপর
দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে পৃথিবীর প্রতিটি কপাট।
অভিশাপ দিচ্ছি।
অভিশাপ দিচ্ছি,
অভিশাপ দিচ্ছি…
অস্থি
একটি বিকট পাখি প্রতিদিন তার জানালায়
আস্তে-সুস্থে অস্থি রেখে যায়,
মৃত্যুর মতন বিষম সঙ্গীতময় কিছু
অস্থি রেখে যায়।
মাথার ভেতর কোলাহল ফুটন্ত জলের, বুকে
দ্রুত ধাবমান ট্রেন, সবুজ নিশান
বাদুড়ের মতো
ঝোলে বর্ণলতায় সন্ধ্যায়। ফিরে যাও,
ফিরে যাও দৃশ্য
জরায়ুর অন্ধকারে বলে সে মেঝেতে
হাঁটু গেড়ে বসে।
চাবির ফোকর তার কাছে
কামানের মুখ, চায়ের বাটিতে নৌবহর,
দেয়ালের পোকা ট্যাঙ্ক, মশা
হঠাৎ আকাশ কালো-করা
বোমারু বিমান।
ঘরময় উল্লুকের বমি; ব্যবহৃত পোস্টকার্ড
কারাগার-দেয়াল শেয়াল
নাকে-মুখে উদ্ভিদের ঘ্রাণ নিয়ে নতুন অতিথি
তার পাশে; সন্ন্যাসীর চিম্টে বাজে,
ধুনুচি বখাটে ছোকতা যেন,
কোমর দোলায়, শিস দেয়;
অদূরে উড়ন্ত গুনচট।
সফেদ অস্থির ব্যালে, প্রতিচ্ছায়া সোয়ান লেকের।
অস্থি মানে একদা-যুবক,
অস্থি মানে একদা-যুবতী
অস্থি মানে একদা-কৃষক,
অস্থি মানে একদা-শ্রমিক,
অস্থি মানে একদা-বালক,
অস্থি মানে একদা-শ্রমণ
অস্থি মানে একদা-নাবিক।
মহিষাসুরের খুরে ছত্রভঙ্গ অস্থি-র জনতা!
দরজা জানালা বন্ধ করে বসে, হতে ইতিহাস-
বংশাবলি, সিংহাসন, যুদ্ধ, গণহত্যা,
যৌনতা, পতন
সুন্দর, যমজ মলাটের মধ্যে এখন শীতল
ছাগলের মাংসের মতন।
চকিতে অক্ষরগুলো পাত থেকে দ্রুত
তুমুল বেরিয়ে পড়ে, বুঝি
জঙ্গি ট্রাক থেকে ঝুপঝাপ
লাফিয়ে নামছে সৈন্যদল।
একটি বিকট পাখি ইস্পাতি চঞ্চুর ঘায়ে, ক্রুর
নখরের আঁচরে আঁচরে
জানালা ঝাঁঝরা করে। সে তলিয়ে যায়,
অস্থির স্তূপের
শ্বেত নিচে, নিচে, বহু নিচে কেবলি তলিয়ে যায়,
যাচ্ছে, যায় যায়-