শিখা
জানলাম
পোড়ায় সে নগর ও গ্রাম,
শক্রর শিবির আর মিত্রের পাড়ায়
সমান প্রতাপ তার। অলক্ষ্যে কখন কী হারায়
পৃথিবী, কে জানে-
হাওয়ায় ঘোরান ক’টি শুকনো পাতা, অথবা সভ্যতা, তার মানে
নিয়েছি নিজের মনে খুঁজে;
দেখি চোখ বুজে
সে যায় অনেক দূরে বনের হাওয়ায়
এবং মোমের মৃদু শিখা হয়ে কাঁপে তার খোলা জানালায়।
সুন্দরের গাথা
যেখানে সূর্যের তলে আকাঙ্ক্ষিত সুন্দরের গাথা
নিসর্গে মধুর মতো, ফুলের পাপড়ির মতো ঝরে
অথবা যেখানে গাঢ় চন্দ্রবোড়া সঙ্গিনীর শাখায় আকুল,
ঋতুর মধুর রণে পরাক্রান্ত, সেখানে আমার অভিলাষ
অভিসারী। পিছনে থাকুক পড়ে অনেক দূরের
অনচ্ছ তারার মতো লোকালয়, তাকাব না ফিরে।
যে-চেতনা ভ্রমরকে মেখে দেয় ফুলের যৌবনে,
বসন্তের তরুণ গাছকে
দেয় মেলে অনাঘ্রাত নীলের আকাশে,
সমুদ্রের ঢেউয়ে আনে পাখিদের উদ্বেলিত বুক,
নিঃসঙ্গ কবিকে দেয় জীবনের গাঢ় মদ-শব্দের প্রাসাদ,
যে-চেতনা তৃষ্ণার্ত যাত্রীকে আনে ফের
স্মৃতির সৌগন্ধে ভরা শীতল ঝরনায়,
তারই প্রজ্বলনে
সমস্ত দুপুর ভরে জলের আলোর নিচে দেখলাম তাকে
সঞ্চারিণী জলজ উদ্ভিদ যেন। এবং স্ফুরিত
অধরে রক্তিম মাছ, ফলের পূর্ণতা তার সমস্ত শরীরে।
সহসা উঠল ভেসে গভীর জলের সেই নারী
এবং সহজে তার করতলগত
নন্দিত ফুলের ঝাড় দিল সে বাড়িয়ে
আমার চোখের নিচে। দুর্লভ মণির মতো স্তন
ঘন হল বাসনার তাপে, যেমন গ্রীষ্মের ফল
গাঢ় হয় সূর্যের চুম্বনে। দেখলাম জনহীন তীরে সব
উৎকণ্ঠা উজিয়ে এসে প্রবীণ কচ্ছপ অকাতরে
তাপ নিল খুঁজে তার রৌদ্রের মসৃণ বালাপোশে।
সূর্যের জাহাজডুবি হলে সে-নারীকে বললাম,
‘আমার জীবনে তুমি খেয়াল-খুশির প্রস্রবণে
প্রতিদিন যে-কুসুম দিয়েছ ছড়িয়ে,
সুতীব্র আনন্দে তার গড়েছি বাগান লোকোত্তর।
আমার ত্বকের নিচে অলৌকিক যে-কীট খেলায়
সারাক্ষণ মগ্ন তাকে ভুলে গিয়ে চেয়েছি তোমাকে,
যেমন মৃত্তিকা চায় সজীব গাছের ফল, সুপক্ব-সোনালি।
ভেবেছি বিঁধর তাকে সহসা কৌশলে, অথচ সে
নিরুত্তর অধরে রক্তিম মাছ নিয়ে
স্বপ্নের চেয়েও আরও অধিক অতলে
গেল ডুবে নবতর কেলির তৃষ্ণায়।
তখন রাত্রির পূর্ণ আকাশে হঠাৎ এল চাঁদ-
অমূল্য, অপ্রাপনীয় মুক্তো। আর একটি শুয়োর
ইতস্তত পথ শুঁকে এসে গেল জ্যোৎস্নায়, যেখানে
তারার বুদ্বুদে ফোটে আকাঙ্ক্ষিত সুন্দরের গাথা।
মুছে গেল দৃশ্যাবলি চারদিকে, অনন্তর একা
আমি আর অকূল শূন্যতা।
সে
প্রেম তাকে করে না আকুল। উদয়াস্ত তার প্রাণে
একটি মরুর জ্বালা উন্মোচিত-যেন সে দুর্জ্ঞেয় কোনো যন্ত্রণার গানে
ধুলোর বিজনে যাত্রী মোহাবিষ্ট আর হলদে পাতার বালিশে
মাথা রেখে অভীষ্ট সহজ গাঢ় ঘুমে যায় মিশে
ক্লান্তির মন্থর শ্লোকে,
অভিভূত হঠাৎ কখনো
ফুলের পাপড়ির মতো আকাশকে বলে, ‘ঐ শোনো
কার যেন বাঁশি বাজে, স্পন্দিত পৃথিবী!’-শুধু তার মনে হয়
কোথাও অলক্ষ্যে কোনো নিঃসঙ্গ ফলের মতো একটি হৃদয়
গড়ে ওঠে। সারাক্ষণ ভাবনার কত ছায়া ঝরে,
সে কার স্পর্ধিত মাথা লোটে আজ ব্যথার পাথরে?
সোনার শিকল পায়ে পারেনি পরাতে কেউ তার
ত্রিলোকের ত্রিসীমায়। একটি অরূপ নদী প্রাণে বয় যার,
সে যায় চলার ধ্যানে, জনহীন বনে সে-ও পথভ্রষ্ট, জানে সব দিক
নির্দয় কালোয় মাখা, তবু এক তৃষ্ণা তাকে করেছে পথিক।
এবং অভ্যাসবশে
উদাসীন সে-ই আসে ফিরে
সাতপুরুষের জীর্ণ ভিটের তিমিরে
মাঝে-মাঝে, আলোর দাক্ষিণ্য নেই, তবু কিছু তুলে নিতে বাসনার ফুল
পুরোনো পিদিম জ্বালে। মনে পড়ে ছিল কার কালো চুল সুগন্ধে আকুল।
সে জানে নিজের কিছু পরিচয়, জানে তার বয়সী কপালে
ক্রটির তিলক কাটা, একা-একা তাই শুধু জ্বালে
ব্যথার আগুন মনে। কোনো দিন অপরের দীপ্ত গুণে, জয়ে
হয়নি অসূয়া-দীর্ণ, তারও চোখ রূপ খোঁজে, অথচ আপন মুখ ভয়ে
কখনো দেখে না ভুলে। তাকে আর কে দেবে অভয়?
একটি অরূপ নদী (জানে সে-ও) প্রাণে তার বয়।
সেই ঘোড়াটা
আস্তাবলে ফিকে অন্ধকার, ঝুলছে নিষ্কম্প স্তব্ধতা,
আর সেই বেতো ঘোড়াটা অনেকক্ষণ থেকে ঝিমোচ্ছে
নিঃশব্দে কোনো আফিমখোরের মতো, মাঝে-মাঝে শুধু
ফোলা-পা নাড়ছে ঘাড় ঝাঁকিয়ে।
আস্তাবলে ধারে নোংরা নর্দমা, তার পিছল জলে
একটা থ্যাঁতলানো ইঁদুর ক্রমাগত ধুয়ে-ধুয়ে
রূপান্তরিত বিলীয়মান সমাতন স্বপ্ন-স্মৃতি যেন
মঞ্জরিত ওর বিকল্প অস্তিত্বে।
বিশাল আকাশে ফুটেছে পারিজাতের মতো চাঁদ,
হলদে খড়ের শয্যায় বুড়ো সহিস ঘুমিয়ে আছে সেখানে
ক্লান্ত দেহে, নিঃসন্তান, বিপত্নীক-নিদ্রিত
কাঠের নকশা যেন অবিকল।
ঘোড়াটাও ঝিমোচ্ছে, কিন্তু তার ক্ষত-নিঃসৃত মদিরা
মাতালের মতো অধীর আগ্রহে বুঁদ হয়ে পান করছে তিনজন মাছি;
এক কোণে নিস্তেজ কুপিটা কোনো প্রেমিকের বিলুপ্ত প্রেমের মতো
জ্বলছে এক বিষণ্ন আচ্ছন্নতায়।
এই তো এখানে নর্দমার ধারে কিছুক্ষণ আগে কয়েকজন প্রৌঢ়
মাটির ভাঁড়ে ঢক্ ঢক্ শব্দ করে গিলেছে তাড়ি,
সব অনুতাপ হাওয়ায় উড়িয়ে, জ্যোৎস্নায় ভেজা ঠোঁটে
পান করেছে পূর্বপুরুষের স্মৃতি-বিষ!
আর রাত্রির তারাময় আঁধারে তারা হাতের মুঠোয়
কামনা করেছে অপ্সরীর স্তন, তারপর বিষাক্ত কোনো বাষ্পে
স্ফীত হয়ে ট’লে-ট’লে চলে গেছে যে যার গণিকার ঘরে।
এখন এখানে শূন্যতার ভার।
আস্তাবলে সেই বেতো ঘোড়াটা নিমেষে
তন্দ্রার ঘোর কাটিয়ে উঠল, আশ্চর্য এক ফুল হয়ে
জন্ম নিল তার ইচ্ছা, শিরায় শিরায়
সঞ্চারিত হল সে ফুলের সৌরভ।
চকিতে নোংরা নর্দমা হয়ে ওঠে অপরূপ সরোবর,
খড়কুটো, ছেঁড়া ন্যাকড়া থ্যাঁতলানো ইঁদুর, ফুলের তোড়া মণিরত্ন হয়ে
ঝলসে ওঠে ওর চোখে, আর সে নিজে উড়ে গেল
মেঘপুঞ্জে, নক্ষত্রগুচ্ছে, শূন্যের নীলিমায়।
মুহূর্তে মুছে গেল সময়ের সব ব্যবধান,
মেঘের বৈভবে সে ফিরে পেল তার অবলুপ্ত কান্তি,
আর ভেসে চলল আকাশ থেকে আকাশে অকান্ত গতিতে
কবির মতো নিঃশঙ্ক, সহজ একা।