বিরস গান
ইচ্ছা আর অনিচ্ছায় জীবনভোর কলম ঠেলে
হায়রে তুমি কী-ইবা পেলে?
দিনরাত্রি পুঁথির শত পাহাড় খুঁড়ে দেখলে শেষে
পোড়া কপাল! মূষিক মেলে।
কালের মেঘে অকাল সাঁঝ নিমেষে এল হঠাৎ ভেসে
দেখলে শেষে যৌবনের পরম গতি নিরুদ্দেশে।
প্রেতের মতো একাকিত্বে সব পন্থা খুইয়ে এসে
কন্থা গায়ে বলবে কাকে মহান প্রভু?
যাকেই বলো হারানো গান পাবে না তবু।
কঠিন পথে আশার রথ তাড়িয়ে দ্রুত কোথায় এলে?
কার সে হাতে আত্মা সঁ’পে,
জীবনভোর ভীষণ সেই নামটি জ’পে
মনের যত হঠকারিতা গুঁড়িয়ে ফেলে
হায়রে তুমি কী-ইবা পেলে?
ব্যবধান
আজও কি সেখানে যাও, যেখানে মায়াবী একদার
স্বর্ণমৃণ দেখা না-দেখায় মেশা? হয় কি সময়?
হয়তো সেখানে আজ নন্দিত, প্রোজ্বল ফুল নয়,
বল্মীক ও রুক্ষ আগাছায় ছেয়ে গেছে চারধার।
তোমার সত্তার দীপে আজ আর আমার আঁধার
হয় নাকো দীপান্বিতা; শুধু মনে রাখার বিস্ময়
নিয়ে বেঁচে থাকি আজ। ইতিমধ্যে হয়ে গেছে ক্ষয়
রৌদ্র-ঝড়-জলে কত লঘুপক্ষ বছরের ধার।
পুনর্মিলনের সূর্য যেন না-ই জ্বলে দু’জনের
গোধূলি আকাশে আর; তুষারের তীক্ষ্ণ শুভ্রতায়
বাসনার শতদল যাক ছিঁড়ে-বিষাদের দান
সন্তপ্ত হৃদয়ে গেঁথে গাব গান নির্মোহ প্রাণের।
এই ভালো-তুমি আর আসো না যে চারু, মৃদু পায়,
কেননা দুর্লঙ্ঘ্য এই নির্দয় কালের ব্যবধান।
মনে মনে
জানি না কী করে কার মমতার মতো
শান্ত-শুভ্র ভোর এসে ঝরে
জানি না কী করে এত নীল হয় রোজ
ধ্রুপদী আকাশ। ঘাসে এত রং, রোদে
জীবনের সাড়া, বিকেল হাওয়ায় এত নির্জন ভাষা
(জানল না কেউ) তবু কী করে যে বেঁচে আছে তারা!
ভালোলাগা রং নিয়ে
সাধারণ-অপরূপ
কত ছবি আঁকলাম
নগরে ও বন্দরে
হিতকথা বুদ্ধের
শিখলাম, যত পাখি
সন্ধ্যার-জানলাম।
আমার কি সব তবু ঠিক জানা হল?
শিশুর চোখের বিস্ময়-আঁকা মায়াবী দৃষ্টি যার
প্রসারিত এই জীবনের গাঢ় মানচিত্রের রঙে,
সুদূর গাঁয়ের কুয়োতলা আর শহরের কোনো পার্কের মৃদু ঘাস,
পৃথিবীর কত রহস্যময় সোনালি রুপালি দ্বীপ
আবরণ খুলে জীবনের মানে এখনও জানায় যাকে
সে কি তবে তার মুখের ওপর বন্ধ দরজা দেখে
ফিরে যাবে একা, ভুলে যাবে গান, বলো?
হারিয়েছি কত বিকেলের মতো নারী,
বহুবার আমি হারিয়ে ফেলেছি
পাখির দেহের রঙে ঝিলমিল, স্নেহে-ছাওয়া ঘর;
হারাইনি তবু সুরের নূপুর, ভুলিনি আমার গান।
এখনও তো লুট করে আনে মন দিনের প্রবাল,
রাতের হীরের হার,
এখনও হাজার সহজ খুশির
নিবিড় ঝরনা-আলো,
এতটুকু ভালোলাগা
কুড়িয়ে ছড়িয়ে সহস্র ভিড়ে ডুবে যাই, ভেসে উঠি।
ফুলের মতন তারারা যখন অন্ধকারের স্রোতে
ভাসে, কাঁপে, জ্বলে-মনে পড়ে তার মুখ,
মনে পড়ে তার মুখ।
রাতের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যায়।
যে আছে দাঁড়িয়ে অতিদূর পাড়াগাঁয়ে
দীপ হাতে সেই অভাবের সংসারে
সত্যিমিথ্যে যদি ফিরে যাই হঠাৎ সেখানে তার
বিবর্ণ খেলাঘরে
সে কি আর ভাঙা পুতুল কুড়োবে
কাক-ডাকা রাতে একা?
দু’জনের কত গহন দুপুর
চলে গেছে সেই যোজন-যোজন দূরে।
যদি ফিরে যাই জামতলা আর পারুলডাঙার মাঠে,
যে যাবে সঙ্গে তার কথা কিছু জানি!
মর্মর প্রাসাদ শুধু
মর্মর প্রাসাদ শুধু ধসে যায়, সারি সারি থাম
মোমের মতন যায় গ’লে আর অজস্র জন্তুর
বিক্ষুব্ধ গর্জনে ব্যাপ্ত নৃত্যনাট্য সমূহ ধ্বংসের;
পথে পথে ঘোরে নিত্য লক্ষ্যহীন কবন্ধের দল।
আমিও নগরেও এই মত্ত কোলাহলে
ক্রুশবিদ্ধ চেতনায় নিজেকে মেলাতে চাই
স্মৃতির পরম অধীশ্বরে।
এবং পাপড়ির মতো মুখ মনে পড়ে
সময়ের আঁধার অলিন্দে, যতবার সর্বনাশা
গোলকধাঁধায় ঘুরি অবিরাম ভবিষ্যৎহীন।
মৃত্যুকে লালন করে গহন সত্তায় রাত্রিদিন
দুঃস্বপ্নের নারকী বলয়ে ভ্রাম্যমাণ পথিকের
আজও তো তোমাকে
স্মরণ করার মতো মন বেঁচে আছে।
এবং কী দীর্ঘ এই প্রতীক্ষা আমার।
কতদিন স্নান জনস্রোতে রেখেছি অধীর চোখ
তোমার সন্ধানে, তবু দেখিনি তোমাকে আর সেই
লোকশ্রুত অনন্য সাঁকোর ধারে। অথচ তুমিই
আমার ধ্যানের
সুনীল আকাশে কত পারিজাত হয়ে
জ্বলো সর্বদাই।
এ-নগরে কোলাহলে চেয়েছি একটি স্বর শুধু
ঝরুক ঝরনার মতো-সে পুণ্য ধারায়
নিশ্চল পাথর হোক প্রাণ, হে নায়িকা,
আমি চাই তোমার উজ্জ্বল আবির্ভাব।
একদা তোমার আবির্ভাব জানি ক্ষণিকের অপরাহ্নে সেই
চকিতে দিয়েছে জ্বেলে অলৌকিক প্রভা।
সত্তার নিহিত
কস্তুরীর ঘ্রাণ
তোমাকে উন্মন করে শরীরে তোমার
অলক্ষ্যে করেছে সৃষ্টি স্বপ্নচিত্র শাশ্বতীর।
ভাবিনি কখনো আগে
অন্ধ নিয়তির মতো নিশ্চিত, অপ্রতিরোধ্য, দ্রুত
পতন নির্মম, আর আমি তো চেয়েছি
মোহন মোমের ডানা মেলে নীল, বিশাল আকাশে
গর্বিত পাখির মতো অন্ধ করে দিতে
সূর্যের অনল-চোখ, কিন্তু সেই ডানা
তরল জ্যোৎস্নার মতো গেল শুধু গ’লে
অগ্রজের বিস্মিত দৃষ্টির নিচে শেচনীয় সৌন্দর্যের মতো।
দিনগত পাপক্ষয়ে কাটে
দারুণ দুঃস্বপ্ন-গাঁথা প্রহর আমার,
তারপর হয়তো কখনো
স্বপ্নে-দেখা অপ্সরীর মতো নেমে আসে
মোহিনী সৌজন্যময়ী রাত্রি, আর
তখনও তোমার শেষ দৃষ্টি
হীরের মতন জ্বলে মনের খনিজ অন্ধকারে।
মৃন্ময়
অনেক কিছুই জানা নেই আপন এ পৃথিবীর।
বিতরিত হতে পারে হাটে-মাঠে-এমন নিবিড়
আলো নেই আমার তামস করতলে,
অথচ নিত্যই দেখি নির্বিকার জোনাকিরা জ্বলে
ছায়ার প্রহরে আর মসৃণ স্তনের মতো ফলে
স্তব্ধ গাছ, শব্দ শুনি মৌমাছির অধীর ডানার।
কখনো খড়ের বিছানার
উষ্ণতায় মজে দেখি যায় বেলা যায়
গোলাপি আকাশ ক্রমে হয় ফিকে, কাঁপি প্রত্যাশায়।
কারো শুভ্র মালা ছিঁড়ে করি না বড়াই
কোনো দিন আর রাজরাজড়ার লড়াই
বাঁধলে ঘেঁষি না তার ত্রিসীমায়, জানি না কোথায়
বাঘ-মোষ এক ঘাটে জল খায় কিংবা ইতিহাসের পাতায়
কারা কুশীলব,
তাদের বৈভব
আনে না বিভ্রান্তি মনে। শুধু জ্বেলে রাখি
ইচ্ছা-ব্যাকুলতা যেন তাকে নিয়ে থাকি
দুর্জ্ঞেয় কান্নার পাকে, অভিন্ন হাওয়ার ধ্যানীক্ষণে
দু’জনের আপন ধুলোয় এই শান্তিনিকেতনে।