নির্জন দুর্গের গাথা
মানিনি জীবন সমুদ্র সন্ধানে
চোরাবালিতেই পরম শরণ নেবে।
আশার পণ্যে পূর্ণ জাহাজ সে-ও
ডোবা পাহাড়ের হঠকারিতায় ঠেকে
হবে অপহৃত-ভাবিনি কখনো আগে।
দিনের সারথি বল্গা গুটিয়ে নিলে,
যখন রাত্রি কৃষ্ণ কবরী নেড়ে
আনে একরাশ তারা-ফুল থরথর
দু’হাতে সরিয়ে শ্যাওলার গাঢ় জাল
চম্কে তাকাই আমিও মজ্জমান।
ভবিষ্যতের ঝাঁপিয়ে অন্ধকারে
যা-কিছু রয়েছে আমার জন্য শেষে
সবি নিতে হবে দৈবের দয়া মেনে?
ব্যঙ্গ-দৃষ্টি আড়ালেই ঝলসায়।
নির্জনতার কারাগারে সঁপে প্রাণ
আত্মদানের মহৎ দুর্গ গড়ি।
যদি সে প্রাকার-বিরোধী অশ্বখুরে
অচিরাৎ তার দৃঢ় নির্ভর ভোলে,
যদি দর্পের দর্পণ হয় গুঁড়ো,
ঝড়ের সামনে ভাগ্যের শাখা মেলে
কাকে পর ভেবে কাকে-বা আপন জেনে
সাধের শ্রমের দিব যে জলাঞ্জলি।
যদি হ’ত ঐ তারাদের মতো চোখ
তারার মতন নিবিড় লক্ষ কোটি
দু’দিনের ঘরে হয়তো পেতাম তবে
বেলা না ফুরাতে তাকে এই চরাচরে
চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে দেখার সুখ।
অবুঝ আমার আশা উদ্বাহু তবু।
বিরূপ লতার গুচ্ছে জড়িয়ে শিং
কালো রাত্তিরে তৃতীয় প্রহরে একা
কাঁদে প্রত্যহ হরিণ-হৃদয় যায়
তাকে নেব চিনে প্রাণের দোসর সে-যে।
সম্মুখে কাঁপে অমোঘ সর্বনাশ।
দিনের ভস্ম পশ্চিমে হয় জড়ো,
অনেক দূরের আকাশের গাঢ় চোখে
রাত্রি পরায় অতল কাজল তার।
এমন নিবিড় স্মৃতি-নির্ভর ক্ষণে
বলি কারো নাম, হৃদয়ের স্বরে বলি।
জ্বলি অনিবার নিজেরই অন্ধকারে।
এতকাল ধরে আমার আজ্ঞাবহ
ঘাতক রেখেছে তীক্ষ্ণ কুঠার খাড়া,
সেই যূপকাঠে নিজেই বলির পশু।
উঁচু মিনারের নির্জনতায় মজে
ভেবেছি সহজে বিশ্বের মহাগান
আমার প্রভাতে সন্ধ্যায় আর রাতে
ঝরনা-ধারায় আনবেই বরাভয়।
সেই বাসনার প্রভুত জাবর কেটে
শূন্যে ছুড়েছি দুরাশার শত ঢিল।
প্রতিপক্ষের কূটচক্রের তান
পশেনি কর্ণে, ওদের বর্ণবোধে,
সান্ধ্য ভাষায় করিনিকো দৃক্পাত।
কবন্ধ যারা নিত্য জন্মাবধি
অন্ধের মতো তাদের যষ্টি ধরে
দ্বন্দ্বের ঘোরে ছুঁইনি গতির বুড়ি।
পিতা
প্রাণে গেঁথে সূর্যমুখী-উন্মখতা খুঁজি আজও তাঁকে
সর্বত্র অক্লান্ত শ্রমে। স্বপ্নের মৃণালে মুখ তাঁর
জ্যোতির্ময় কল্যাণের মতো ফুটে অভ্র-শুভ্রতার
অতল সমুদ্রে ডোবে-খুঁজি আজও বিদ্রোহী পিতাকে।
অজ্ঞাত, বিরূপ এই রুক্ষ দেশে মৌন বাসনাকে
নক্ষত্রের মতো জ্বেলে চাই তাঁকে দুর্নিবার
আতঙ্কের মুখোমুখি, যেমন সে মৃগতৃষ্ণিকার
নিঃসঙ্গ পথিক চায় পান্থপাদপের মমতাকে।
তিনি নন জন্মদাতা, অথচ তাঁকেই পিতা বলে
জেনেছি আজন্ম তাই মুমুক্ষু কালের অস্তরাগে
সমর্পিত তাঁরই কাছে। জীবনের সব মধুরিমা
করেছি নিঃশেষ শুধু অশেষ সন্ধানে জ্ব’লে জ্বলে।
তিনি নন বিধাতা অথচ ব্যাপ্ত সত্তার পরাগে-
তবে কি উপমা তাঁর চৈতন্যের ভাস্বর নীলিমা?
পুরোনো তৈলচিত্র
পৃথিবী ঘুরছে নিত্য, ডিঙিয়ে শীতের বেড়া বসন্তের শিশু
প্রথামতো হানা দেয় উড়িয়ে নিশান।
ফিরতি-পথে ফুল কিনে সন্ধ্যার পথিক
কড়া নেড়ে দরজায় যাকে পায় তার
আঁচলে প্রদীপ কাঁপে, প্রাণের হাওয়ায়
জানা কবিতার
উন্মীলিত ধ্বনি,
সামান্যের জিত
দু’দণ্ড পুণ্যের জলে ডুবোও হৃদয়,
ধুয়ে নাও নরকের কালি।
তুমি আর পারবে না দাঁড়াতে সেখানে
জীনের মুখর সারিতে
স্থানাভাবে,
দেয়ালেই আপন পৃথিবী।
বুক-ডোবা শান্ত জলে পাখি মেরে সূর্যাস্তের পরে
নিত্যসঙ্গী কুকুরের গলার শিকল শ্রান্ত হাতে
সুন্দরবনের রাতে ধোঁয়া-ওঠা তাঁবুর আরামে ফিরে আসা,
রহস্যসিরিজে ডুবে কাঁটা আর চামচের বিতর্কে উৎসুক
প্রহর কেটেছে যার জায়াপুত্রকন্যার সংসারে
অথবা চিল্কায় ছুটি সিমলায় ফগে আর পাহাড়ি হাওয়ায়
পত্নীর অভ্যস্ত প্রেমে তৃপ্ত মন (আপাতদর্শনে)
ব্যাঙ্কের অঙ্কের স্ফীতি ছিল যার স্বর্গ-সিঁড়ি, তার
প্রস্থানের নেপথ্য নাটকে
সে কি তবু জেনে গেছে পৃথিবীর শেষ কোনো শ্লোক,
স্বপ্নে তাকে করেছে কি তাড়া চন্দ্রবোড়া, অন্তরালে
কে জানে হৃদয়ে তার ছিল কি না কীটের উৎসব।
পূর্বরাগ
জেনেছি কাকে চাই, কে এলে চোখে ফোটে
নিমেষে শরতের খুশির জ্যোতিকণা;
কাঁপি না ভয়ে আর দ্বিধার নেই দোলা-
এবার তবে রাতে হাজার দীপ জ্বেলে
সাজাব তার পথ, যদি সে হেঁটে আসে।
যদি সে হেঁটে আসে, প্রাণের ছায়াপথ
ফুলের মতো ফুটে তারার মতো ফুটে
জ্বলবে সারারাত, ঝরবে সারারাত।
জেনেছি কাকে চাই, বলি না তার নাম
ভিড়ের ত্রিসীমায়; স্বপ্ন-ধ্বনি শুধু
হৃদয়ে বলে নাম, একটি মৃদু নাম।
প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে
(পূর্বলেখ)
এই সেই পৃথিবী অপার মাটি যার এতকাল
সুপুষ্ট স্তনের মতো ফল আর ফাল্গুনের ফুল
করেছে উৎসর্গ নিত্য সন্তানের শ্রম প্রজ্ঞা প্রেমে
পূর্ণ হয়ে দীর্ণ হয়ে? এই সেই পৃথিবী সাবেকি?
দেখেছি সমুদ্রতীরে অস্তরাগে একদা হাওয়ায়
নর্তকী-শিখার মতো সফেদ তরুণ ঘোড়া এক
মেতেছে খেলায়-মনে পড়ে পিছনে এসেছি ফেলে
উজ্জ্বল হরিণ-দিন, উন্মুখতা সজীব গাছের।
এতদা যে-নদী নীলিমাকে ভালোবেসে চেতনায়
নিপুণ শিল্পীর মতো গড়েছে নিবিড় দুই তীর,
তাকে আর পাব নাকো দৃষ্টির রেখায় দীপ্ত, প্রাণে
হবে না মুখর ঝরনা বসন্তের বিফল সম্ভাষে।
যে-চেতনা এল ফিরে দুঃস্বপ্নের কুয়াশাকে চিরে
জীবনে আবার অন্ধ নিয়তির মতো দুর্নিবার
চাইনি এমন আলো অভিসন্ধি যার নিমেষেই
নরকবিলাসী শুধু লুব্ধ এক তৃষিত কোরাসে।
এখন যে-অগ্নিকুণ্ড দাহ আনে কে তাকে নেভাবে
প্রসন্ন রুপালি জলে? সূর্যহীন হয়েছে এখন
যে-হৃদয় অনেক অজ্ঞাতবাসে, অন্ধকারে তার
শুধুই প্রেতের গান-নেই কোনো সমুজ্জ্বল মুখ।
অন্ধকার ভয় ব্যাপ্ত রক্তের ভিতর, সাড়া নেই
লোকালয়ে, এমনকি পাখির চিৎকারে অতর্কিতে
কাঁপে না হাওয়ার ঢেউ, ভয়াবহ স্তব্ধতা পথের।
‘দাঁড়িও সেখানে তুমি’-বলেছিল কেউ-মনে পড়ে,
নিঃশব্দে যেখানে শত হৃতদীপ্তি আত্মার মিছিল
রক্ত আর হলুদ পুঁজের ভাণ্ড তুলে ধরে মুখে।
দারুণ দুঃস্বপ্ন-বিদ্ধ বিকারের ঘোরে তমসায়।
ভুলতে-না-পারা অগণিত স্মৃতির করাল চিহ্নে
কণ্টকিত তাদের বিশীর্ণ সত্তা; দাঁড়িও সেখানে-
তারপর চলে যেও একা তুমি, কোরো না যাচাই।
এ-দৃশ্যের বোধ যাকে পায় সে কি মৃত্যু নয় তবে,
মৃত্যু নয়, মৃত্যু নয়, মরণের অন্য মানে আছে?
মনে হয় আমি যেন সেই লোকশ্রুত ল্যাজারস,
তিনদিন ছিলাম কবরে, মৃত-পুনর্জীবনের
মায়াস্পর্শে আবার এসেছি ফিরে পৃথিবীর রোদে।
পোশাকের জেল্লা তবু পারে না লুকাতে কোনোমতে।
বিকৃত দেহের ক্ষত, লোবানের ঘ্রাণ সহজেই
ডুবে যায় প্রাক্তন শবের গন্ধে; নীল আঙুলের
প্রান্তে বিদ্ধ তিনটি দিনের ক্ষমাহীন অন্ধকার।
ভাস্করের অসম্পূর্ণ মূর্তির মতন ঘুরে ফিরি।
উল্লোল নগরে কত বিলোল উৎসবে; কিন্তু তবু
পারি না মেলাতে আপনাকে প্রমোদের মোহময়
বিচিত্র বিকট স্বর্গে। বিষাক্ত ফুলের মতো কত
তন্ময় রহস্য জ্ব’লে ওঠে আজও দু’চোখে আমার।
সত্তায় এনেছি বয়ে অন্তহীন আশ্চর্য বিষাদ।
সেহেতু সে-বিষাদের বৃন্তে ফোটে আতঙ্কের ফুল,
আমার সান্নিধ্যে কেউ ঘেঁষে না সহজে, ভয়, পাছে
তাদের শিরায় নামে লিথির বিষণ্ন জলধারা।
স্বর্গদীপ্ত প্রাণ নিয়ে এসে এ কোথায় কোন দেশে
হারিয়ে ফেলেছি রূপ পশুর রোমশ অন্ধকারে?
এখানে মরার খুলি ধুলোয় গড়ায় চারদিকে,
খেলার ঘুঁটির মতো অসহায়, ভবিষ্যৎহীন।
মাঝে-মাঝে কৃষ্ণকায় বিকট পাখির লৌহচঞ্চু
মাংস ছিঁড়ে নিতে আসে-আমি তাকে পারি না ফেরাতে।
আর চেয়ে দেখি মৃত্তিকায় করোটিতে জ্যোৎস্না জ্বলে
বিষণ্ন স্মৃতির মতো, দ্বিতীয় মৃত্যুর ধ্বনি ভাসে।