তার শয্যার পাশে
শুয়ে আছে একজন নিরিবিলি ভোরের শয্যায়
শীত-গোধূলির শীর্ণ শব্দহীন নদীর মতন
শিথিল শরীর তার লেগে আছে ফ্যাকাশে চাদরে,
দেয়ালে আলোর পরী। খোলা দরজা। ঘরে ঠাণ্ডা হাওয়া
খেলা করে, ঝরনা-হাওয়া ঝরে,
ঝরে একমাথা চুলে, ঝরে
করুণ ক্লান্তির ভারে বুজে-থাকা চোখের ওপর।
পাখা নেড়ে, শিস দিয়ে হলদে পাখি উড়ে গেল মেঘে
নির্জন বারান্দা থেকে। সারা ঘরে শান্তি স্তব্ধতার,
কখনো হঠাৎ তার নিমীলিত শুকনো গলা শুনি
ছায়া-ছায়া-আলো-স্বর-হয়তো ডেকেছে জল দিতে।
শিরশিরে হাওয়ায় কাঁপে শরীরের মেরুন র্যাপার।
চৈতন্যের আলো পড়ে ঘুম-পাওয়া সত্তার পাপড়িতে,
সূর্যের চুমোয় লাল পাণ্ডু গাল। টেবিলের দুটি
তরুণ কমলালেবু চেয়ে আছে দূরের আকাশে,
চিকন সোনালি রুলি ম্রিয়মাণ শঙ্খশাদা হাতে
যেন বেদনায় স্থির-মনে হল-সেই দুটি হাত
মায়াবী নদীর ভেজা সোনালি বালিতে আছে প’ড়ে!
ফ্লাস্কে দুধ। শিশি। ওডি-কলোনের ঘ্রাণ উন্মীলিত
সারা ঘরে। পেশোয়ারি বেদানার ফিকে-লাল রস
কাচের গেলাশে ভরা- গোধূলি-মদির।
কাল সারারাত ছায়া-অন্ধকারে প্রতি পলে পলে
মোমের শিখার মতো ইচ্ছা তার জ্বলেছিল এই
ভোরকে পাওয়ার। চোখে ছিল
গাঢ় প্রার্থনার ভাষা, বুকে
উজ্জ্বল আকাঙ্ক্ষা প্রীত জীবনের, সৌন্দর্যের সাধ।
কে যেন তারার মতো কাল রাতে ডেকেছিল তাকে
মূক ইশারায় দূরে তবু সেই একজন জানি
ভোরকেই চেয়েছিল উন্মথিত রক্তের ভিতর
যেমন সে পেতে চায় প্রেমিকের চুমোর আদর
রাত্রির জঠরলগ্না। ছায়াচ্ছন অপদেবতার
অমর্ত্য চোখের নিচে রাত তার কাটে হরিণের
করোটির ছবি নিয়ে, সারাক্ষণ জেগে থেকে কাল
শুনেছে ধূসর ধ্বনি অবচেতনার অন্ধকারে।
এখন সে শুয়ে আছে ক্লান্তপ্রাণ সম্রাজ্ঞীর মতো
ভোরের আলোয় নেয়ে, ডুবে আছে মসৃণ আরামে।
জেগে উঠে হাত নেড়ে, সোনালি রুলির শব্দ করে
গোধূলি-মদির শান্ত বেদানার রস নিল চেয়ে,
হাসির আশ্চর্য জ্যোৎস্না তার
ঠোঁট চুয়ে ঝরে গেল (হায়,
অপদেবতার ক্রোধ) ঝরে গেল ভোরের শয্যায়।
অতল হৃদয় বেয়ে উঠল গান, শান্ত শব্দহীন,
চোখে তার উপচে-পড়া অপরূপ জয়ের উল্লাস।
ভোরকেই চেয়েছিল উন্মথিত রক্তের ভিতর।
সেই একজন।
তিনশো টাকার আমি
আখেরে হলাম এই? আর দশজনের মতন
দৈনিক আপিস করা, ইস্ত্রিকরা কামিজের তলে
তিনশো টাকার এই পোষমানা আমিকে কৌশলে
বারোমাস ঝড়ে জলে বয়ে চলা যখন-তখন?
এই আমি? এবং প্রভুর রক্তনেত্র সারাক্ষণ
জেগে রয় ঘানিটানা জীবনের চৌহদ্দিতে; ফলে
ঠাণ্ডা চোখে ঠুলি এঁটে দশটা-পাঁচটার জাঁতাকলে
অস্তিত্বকে চেয়ে দেখি নিখুঁত গোলাম, নিশ্চেতন।
আমিও নিজেকে দেখি করেছি ঢালাই মাঝারির
স্পষ্ট ছাঁচে। যদি না অকালে ফস্কে যায় কিস্তি বিনে,
জীবনবীমাই জানি হে পান্থপাদপ মরুপথে।
তা চলে আমিও টেড়িকাটা ছা-পোষা বিজয়ী বীর?
হরলিক্স মিল্ক আর হাক্সলির নয়া বই কিনে
সাধের মানবজন্ম ধন্য করি তবু কোনোমতে।
তোমাকেই বলি
ছায়া-করে-আসা দূরের পথের
সাঁকো পেরোবার ধীর-মুহূর্তে
পাশাপাশি শুধু হেঁটেছি দু’জন;
স্তব্ধ ছিলাম সারাবেলা তবু
দ্বিরুক্তি তুমি করনি কিছুই।
মনের কথাটি বলতে যাবার
লগ্নে আমার হৃদয়ে আজও তো
শত-পাখি-স্বর ফোটে নির্জনে,
সেই কাকলির তাড়ায় মধুর
আপন কথাটি কোথায় হারায়।
হয়তো ভেবেছ কোনো দিন কেউ
সেই ঢেউ মেখে হয়নি উতল
যার উতরোল ফেলার শীর্ষে
জ্বলছে আমার ভাষার মুক্তো।
দিনরাত্তির ভাবনার জাল
ফেলে শেষে তুমি কতটুকু পাবে
হৃদয়ের সেই অতল আমায়?
নতুন কথার অপরূপ মণি
তোমাকে যে দেব কৌটোয় তুলে
এমন আশায় কখনো জ্বলিনি।
প্রাকৃতিক মহাদানের মতোই
তোমার গানের শান্ত-মধুর
পুরানো কলিটি নতুন যেমন
-প্রতিবার বলি হৃদয়ের কাছে-
মনের কথাটি তেমনি আমার
তোমাকেই চাই, তোমাকেই চাই।
নক্ষত্র-বিন্দুর জন্যে
কেন আমি নিমেষেই সর্পমুগ্ধ শশকের মতো
হয়ে যাই আবির্ভাবে তার? কেন শুধু উন্মুখর
একটি অনুরণনে প্রতি রক্তকণা হয় নক্ষত্র-চেতন?
শব্দের মোহন সুরে ঘর ছেড়ে নির্দয় সূর্যের
তৃণহীন প্রান্তরে হারাই পথ, চোরাবালিতেও
পা ঠেকে কখনো আর অরণ্যের জটিল বিভ্রমে
চুল ছিঁড়ি, মুহূর্তে মুহূর্তে মজি মৃগতৃষ্ণিকায়।
যখন মজুর মিস্ত্রি সান্ত্রী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই
ক্লান্তিহর আদিম নিদ্রায় মগ্ন অকাতরে, আমি কেন শুধু
শয়তানের মতো একা বন্ধ ঘরে করি পায়চারি?
অশান্ত জ্বলন্ত গুপ্ত, নিষ্করুণ জ্বরের মূর্ছায়
নিজেকে খনির মতো কেন খুঁড়ে আনি আজও শব্দের সম্ভার?
এমনকি নিদ্রার ঘোরেও করি কত দেবদুর্লভ প্রগাঢ়
উচ্চারণ, অথচ স্বগৃহে বহু বিবেকী মানুষ
সুখ-পরিমল পান করে কাটায় প্রহর কত
উজ্জ্বল রেশম যব আর তিসির হিসেবে।
তবে কেন, কেন আমি
এমন উত্তাল হই, এমন অধীর
ভূতে-পাওয়া মানুষের মতোই সুদূর আর প্রতিধ্বনিময়
আশৈশব সামান্য মিলের আর ছন্দের সংরাগে?
মাঝে-মাঝে নিরাপদ স্বর্গের মসৃণ অধিবাসী
আমাকেও বিদ্ধ করে দ্বিধাহীন ঘৃণার ত্রিশূলে,
যেমন সদলবলে তারা খাঁচার পশুকে তার
স্বপ্ন থেকে কৌতুকে খুঁচিয়ে তোলে অবলীলাক্রমে
প্রচ্ছন্ন হিংসায় মেতে গরাদের নিশ্চিন্ত আড়ালে?
দান্তে কি উন্মাদ তবে, বোদলেয়ার মাতাল শুধুই?
জেনেছি আমার পথ নয় কিছু নির্বিঘ্ন, সরল;
উপরন্তু সর্বনাশা ঘুঁটির নিহিত পরিণামে
বুকের নক্ষত্র ছিঁড়ে নিয়ে গেছে দুর্জয় শয়তান।