ক্ষত এবং ধনুক
বহুদূরে লোকালয় উন্মীলিত মাধবীর মতো।
অস্পষ্ট আঘ্রাণ তার স্মৃতিকে জোগারে আমরণ
নিভৃতে উচ্ছিষ্ট মধু আর আমি দ্বৈপায়ন, রণ-
ছুট আজ, স্বেচ্ছাবন্দি; লোনা জলোচ্ছ্বাসে অবিরত
মেলাই বিষাদ-গাথা। চেয়ে দেখি সহযাত্রী কত
ভাসিয়েছে সহস্র উজ্জ্বল তরী; আমার চরণ
কৃমি-প্রসূ কাদায় প্রোথিত বলে নিয়েছি শরণ
পশুর দঙ্গলে আর জ্বলে শটিত আমার ক্ষত।
ক্ষতের দুর্গন্ধে ভীত পশু, দূরে মরালের বুক
স্বচ্ছ নীলিমায় খোঁজে স্বর্গসুখ; আর আমি এই
দুর্গম কণ্টকাবৃত বনে মাল্লার গানের প্রতীক্ষায়
জ্বলি শুধু হাতে নিয়ে যৌবনের মতন ধনুক।
জানি ঘৃণ্য প্রোজ্বল আমার ক্ষত, তবু নিমিষেই
অক্ষয় ধনু জ্বলে সবার উদ্বাহু আকাঙ্ক্ষায়।
খাদ
সেখানে গভীর খাদ আছে এক কুটিল, ভয়াল
অতিকায় সিংহের হাঁয়ের মতো অদ্ভুত শূন্যতা
চতুর্দিকে ব্যাপ্ত তার, আদিগন্ত বিভ্রমে বিহ্বল।
অতল গহ্বরে সেই আছে শুধু পাঁক, পুঞ্জীভূত
আবর্তিত ক্রুদ্ধ ক্রূর অন্ধ পাঁক, শুধু পাঁক।
আকাঙ্ক্ষিত ফুলদল, লতাগুল্ম, পদ্মের মৃণাল
অথবা চিকন মৃগ কিছুই হয় না প্রত্যাখ্যাত
গলিত শবের কীট, কৃমিপুঞ্জ-ঘৃণিত জটিল-
কিছুই জন্মে না তাতে, মৃত্যু ছাড়া জন্মে না কিছুই।
অপটু ডানার শীর্ণ পাখির শাবক, বুড়ো কাক,
মাঠের নিরীহ গোরু, দিনান্তের তৃষিত মহিষ
অথবা চিকন মৃগ কিছুই হয় না প্রত্যাখ্যাত
অতল গহ্বরে সেই। অতর্কিতে হয়তো কখনো
বিভ্রান্ত পথিক কোনো রাত্রির মোহিনী অন্ধকারে
পাঁকের আবর্তে ডোবে নিরুপায়, ব্যর্থ আর্তনাদ,
তিলে তিলে নিমজ্জন, যথারীতি অন্তিমে বিলোপ।
এবং আমিও আজ নিমজ্জিত অন্তহীন খাদে।
দুর্গন্ধের সুতীব্র পীড়নে রাত্রিদিন বিভীষিকা
সমপরিমাণে; ক্রমাগত কেবলি জড়াই পাঁকে।
নিঃশ্বাসে নরক ফোঁসে, আমার অধীর আত্মা সে-ও
গরলের বিন্দু হয়ে ঝরে সারাক্ষণ, আর দেখি
আকাশে নক্ষত্র-গুচ্ছ, আমি শুধু মরালের মতো
অন্তিম গানের ধ্যানে প্রজ্বলিত, গুঞ্জলিত খাদ।
গোষ্পদ এবং মন
এখানে সমুদ্র নেই, আছে শুধু অন্ধ এঁদো ডোবা,
উইঢিপি সগৌরবে জুড়ে রয় পর্বতের স্থান,
আর ক্ষিপ্ত বায়সের গণ্ডগোলে কোকিলের গান
ডোবে অকস্মাৎ, দূরে ভাঙা চাঁদ একমাত্র শোভা।
এবং জ্ঞানীর পার্টে মূর্খ ভাঁড় কুড়োয় বাহবা
প্রতিদিন দ্বিধাহীন; নিমেষেই সাধের বাগান
ভরে ওঠে সকণ্টক ফণিমনসায়, অফুরান
দুঃস্বপ্নের প্রেত করে আনাগোনা; চেয়ে থাকি, বোবা।
অর্থাৎ কিছুই নেই, র’য়ে গেছে একখানি মন-
যেখানে গহ্বর অতল সমুদ্র জেগে রয়
পাশাপাশি, হাঙরে প্রবালে দ্বন্দ্বময়। কী ফসল
ফলবে সেখানে কল্পনার মন্বন্তরে? সারাক্ষণ
জপেছি প্রথম পাঠ জীর্ণ টোলে-জেনো সুনিশ্চয়,
আশার মৃণালে জ্বলে জ্বীনের সুবর্ণ কমল।
ছিল সে-ও
ছিল সে-ও ধুলোর নিঃসঙ্গ পথে, ছিল কোলাহলে
সমর্পিত চিরদিন। দিঘি তাকে চেয়েছিল বলে
সোনার শরীর নিয়ে ব্যর্থ হল নারী।
ডুবিয়ে পায়ের পাতা, সহচরী শাড়ি
ডুবিয়ে নিঃসঙ্গ জলে নামল যখন-
ঝাপসা চোখ, মেঘ হল মন।
অত শান্ত জলের কুহকে তার সমাজ সংসার হবে লীন
কেই তাকে বলেনি সেদিন।
মাচায় অর্পিতা লতা জানে যার প্রীত পরিচয়,
ভুলব কি তার নাম? দূরে কাছে একই হাওয়া বয়?
প্রসারিত ধুলোয় নিঃসঙ্গ পথ-রেখা;
কাকে দেখে ঘুরে ঘুরে উঠানে কুকুর কাঁদে একা?
খাঁচার পাহাড়ি পাখি সে-ও যেতে চায়
অজানা কোথায়-
গাছে-গাছে মূর্ত ভাষা, পৃথিবীর সমস্ত আকাশে
বেলা প’ড়ে আসে।
জর্নাল, শ্রাবণ
১
তুমি আসবে না
নিঃশব্দে নিঃসঙ্গ এই চেনা
বাগানের দরজা খুলে ফাল্গুনের বিহ্বল দুপুরে বাগানের দরজা খুলে ফাল্গুনের বিহ্বল সিঁড়ির নির্জন বাঁক ঘুরে
এসে শিশিরের মতো স্বেদকণা মুছে মিহি রুমালে, হাওয়ায়
প্রীত তুমি মৃদু টোকা দেবে না দরজায়;
গানের গুঞ্জনে আর উঠবে না ভরে
দক্ষিণের শূন্য ঘর প্রহরে প্রহরে।
যে-চোখে ফুলের ঝাড়, ফলের গুচ্ছের ভার দেখি
সেই চোখ চোখই থাকে অনাদি,, সাবেকি;
যখন তোমার দিকে চাই, চোখ আর চোখ নয়,
থরথর কম্পিত হৃদয়।
দুপুরের ছায়া মনে হালকা পর্দা তুলে
তুমি এসে দাঁড়ালে কি পিঠ-ছাওয়া চুলে?
শুধু ভুল ভেঙে দিতে ঘরময় বয়ে গেল বেনামি নিঃশ্বাস।
বাতাসের ঘূর্ণি নাচে বাগানের শুকনো পাতা ওড়ে পথে, পিচে-
তরতর সিঁড়ি বেয়ে সূর্য নামে পশ্চিমের, দোতলার নিচে
মশকের ভারে কুঁজো ভিস্তি, জলোচ্ছ্বাস। ভেজা ঘাস।
যাকে ভুলি, যোজন-যোজন দূরে যে যায় হারিয়ে
তাকে হাতড়িয়ে
আনা ফের স্মৃতির রোদ্দুরে-
অবিকল যেন ফুল হয়ে যাওয়া ভ্রমরের সুরে।
দূরত্বের তটরেখা ব্যাপ্ত জাগরণে
এই চরাচরে- সব ব্যবধান ঘুচে যায় মনে,
জানি ঘুচে যায়
অরণ্য মর্মরে দূরে স্বপ্নের ছায়ায়
একই স্রোতে গ’লে গিয়ে, একই কামনার সুরে ভেসে
দু’দিকের অভিসারী দুই নদী মেশে।
পাখির মতন কেউ বলে-
‘অজস্র তারার ধূলি যাবে শিশিরের জলে
ঘুমহারা জানালার রাত শেষ চলে।
সন্ধ্যার হাটের মেলা ভেঙে গেলে যার
ভয় থাকে কিছু হারাবার
সে-ও অনুরাগে হাত ছোঁয় কত চেনা ও অচেনা
পথিকের-ভোরের স্বপ্নের ডালে।
তুমি আসবে না।
২
পৃথিবী শেখায় বহু তত্ত্বকথা, সব টুকিটাকি
আশ্চর্য খবর জানা যায় গ্রন্থকীট সেজে ব’সে;
যেখানেই থাকি
কোথাও আকাশ থেকে দূরে তারা খ’সে
গেলে টের পাই;
সাংহাই জ্বলেছে কবে, কার চোখে ট্রয় জ্ব’লে পুড়ে হল ছাই,
রুশের বিপ্লবে কারা করতালি পেয়েছে প্রচুর,
জীবনের নানা ছলাকলা আর দূর
আকাশের পরপারে যা রয়েছে লেখা
একদিন সবি যায় শেখা
শিল্পের জটিল সূত্র উন্মীলিত হয়,
রবীন্দ্রনাথের গান সময় সময়
হাওয়া দেয়, হাওয়া দেয় সত্তার গভীরে,
তবু জানি, মেয়ে, এত আলো মেখে মনের তিমিরে
কী আশ্চর্য আজও মনে হয়-
তোমার হাতের স্পর্শ, কপালের টিপ,
তোমার কণ্ঠের মৃদু গুনগুন ধ্বনি, হাসি, কালো
চুল আর অতল চোখের দুটি শিখা দিতে পারে যত আলো
তত আর দেয় নাকো অন্য কোনো জ্ঞানের প্রদীপ।
৩
জানি না রাত্রির কানে কার নাম প্রার্থনার মতো
বলো তুমি ঘন-ঘন অন্ধকার নিঃশ্বাসের স্বরে,
পুবের জানালা খুলে গুনগুন গান গেয়ে শেষে
যখন শয্যায় জ্বলে দেহ, কার মুখ ভেবে-ভেবে
তোমার চোখের হ্রদে নামে সব ঘুমের অপ্সরী,
কার স্বপ্ন দেখে, কার তীব্র চুম্বনের প্রতীক্ষায়
তোমার যুগল স্তন স্বর্গ হয় রাত্রির নরকে;
জানব না কার কোলে মাথা রেখে অন্তিম বিদায়,
শেষ ক্ষমা চেয়ে নেবে পরিচিত পৃথিবীর কাছে
কোন ক্ষণে জানব না কোনো দিন, কোনো দিন তবু।