কবর-খোঁড়ার গান
মদের নেশা খাঁটি সারা জাহানে,
বাকি যা থাকে তার বেবাক ঝুট।
বাঘিনী যেন সেই মেয়েমানুষ,
যার আঁধারে কাল কেটেছে রাত।
যার আঁধারে কাল কেটেছে রাত
নেশার মতো তার স্মৃতির জ্বালা।
আলিঙ্গনে তার দুনিয়াদারি
নিমেষে ভুলে যাই অতল মোহে।
নিমেষে ভুলি সাধ অতল মোহে।
মোহিনী ও-মুখের মিথ্যা বুলি
সত্য সার ভাবি, এবং আমি
ধারি না ধার কোনো মহোদয়ের।
ধারি না ধার কোনো মহোদয়ের
আমরা তিনজন খুঁড়ছি গোর।
নিপুণ বিদ্রূপে অন্তহীন
দূরের আসমানে জ্বলে দিনার।
দূরের আসমানে জ্বলে দিনার।
কোদালে অবহেলে উপড়ে আনি
মাটির ঢেলা আর মড়ার খুলি।
শরিফ কেউকেটা কী করে চিনি?
শরিফ কেউকেটা কী করে চিনি?
মাটির নিচে পচে অন্ধ গোরে
হয়তো সুন্দরী কুরূপা কেউ।
কোরো না বেয়াদাবি বান্দা তুমি।
কোরো না বেয়াদবি বান্দা তুমি।
বাদশা নেই কেউ, গোলাম সব,
বেগম চায় পেতে বাঁদীর সুখ
আউড়ে গেছে কত সত্যপীর।
আউড়ে গেছে কত সত্যপীর
সমরকন্দ্ আর বোখারা তার
রূপসী মাশুকের যোগ্য নয়।
সেসব ছেঁদো কথা, মস্ত ফাঁকি।
সেসব ছেঁদো কথা, মস্ত ফাঁকি।
বিবেক বিলকুল লক্ষ্মীছাড়া,
মনের পশুটাও চশমখোর।
আমরা তিনজন খুঁড়ছি গোর।
আমরা তিনজন খুঁড়ছি গোর।
হয়তো রুটি আর গোলাপ-কুঁড়ি
যুগ্মতায় জ্বলে চাওয়া-পাওয়ায়,
নেশার মতো খাঁটি নেই কিছুই।
নেশার মতো খাঁটি নেই কিছুই,
সাচ্চা শুধু এই দেহের দাবি।
মানতে নয় রাজি বেয়াড়া মন
দীন ও দুনিয়ার ধাপ্পাবাজি।
কাব্যতত্ত্ব
গনগনে চুল্লির আলোর খইয়ের মতো কথা ফোটে
অন্তর্লোকে, রাশি রাশি। আর আমি
তাদের ছড়িয়ে দিই ঢেউয়ের ফেনায়, সপ্তর্ষিমণ্ডলে,
পাহাড়ের চূড়ায়, উইয়ের ঢিবিতে, যেখানে খুশি।
গাছের সতেজ পাতায়, রৌদ্র-লাগা, বৃষ্টি-মোছা দেয়ালে,
ঘরের উন্মুক্ত কপাটে, রুটির বাদামি গড়নে,
শুকনো ফলে, অলিন্দে চড়ুইয়ের বুকে গাঁথা সেসব কথা
নক্ষত্রের অভিযাত্রার মতো বিন্দুতে বিন্দুতে
কম্পমান, মুহূর্তের অধীশ্বর। সেই মুহূর্তে
মাতাল ছাড়া কী-ই আর হতে পারি আমি?
রাত্রির পীড়নে উন্মথিত আমি নক্ষত্রের ঝড়ের মতো
শব্দপুঞ্জ থেকে ছিঁড়ে আনি কবিতার অবিশ্বাস্য শরীর
-সৌন্দর্যের মতো রহস্য-ঢাকা, নগ্ন আর উন্মীলিত।
আমার সেই নির্মাণে মাননীয়, পক্বকেশ পণ্ডিত
হন্তদন্ত হয়ে খোঁজেন গ্রিক পুরাণের উল্লেখ,
দেশী কিংবা বিদেশী কবির প্রভাব শুঁকে বেড়ান তাঁরা
নিপুণ গোয়েন্দার মতো, আর না-চাইতে বিলিয়ে দেন
ঝুড়ি ঝুড়ি মূল্যবান কথা,
হায় রে মূল্যবান কথা!
বলতেই হয় তাঁরা বুদ্ধিমান, মগজওয়ালা দামি মানুষ,
তাঁদের ভয়ানক বিদ্যের স্কেল দিয়ে মেপে দেখেন
সৌন্দর্য, কিন্তু কী মূঢ় তাঁদের বিবেক!
জানি সেই বুদ্ধির চত্বরে কোনো দিন ছিটিয়ে পড়বে না
প্রেমের মতো সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস, জন্ম নেবে না
আগুনের শিকার মতো
রাশি রাশি অফুরন্ত সবুজ ঘাস, ভুলেও কোনো দিন
তাদের চোখে, মনে উড়বে না তারার ঝড়ের ধূলি,
এতই সাবধানি তাঁরা, এতই বিবেকী!
লোকে বলে বিজ্ঞজন সহস্রচক্ষু, অথচ প্রিয়তমা,
কী আশ্চর্য, কিছুতেই তাঁরা দেখতে পান না
আমার কবিতায় অর্পিত তোমার চুলের ছায়া,
নিঃশ্বাসের সুগন্ধি তাপ, আর আমার হৃৎস্পন্দন।
কোনো একজনের জন্যে
এতকাল ছিলাম একা আর ব্যথিত,
আহত পশুর অনুভবে ছেঁড়াখোঁড়া।
দুর্গন্ধ-ভরা গুহায়িত রাত নিষ্ফল ক্রোধে দীর্ণ,
শীর্ণ হাহাকার ছাড়া গান ছিল না মনে,
জানি প্রাণে ছিল না সতেজ পাতার কানাকানি
-এমনকি মরুভূমির তীব্রতাও ছিল না ধমনিতে,
স্বপ্ন ছিল না,
ছিল না স্বপ্নের মতো হৃদয়।
এই উন্মথিত সময়ের আকাশ চিরে যাব
-এমন সাহসী ডানা ছিল না আমার।
রাত্রিময় আকাঙ্ক্ষাগুলো বেড়ে ওঠেনি সজীব গাছের ছন্দে,
দমকা বাতাসের আনন্দে নেচে ওঠেনি বুকের তারা।
শুধু রূঢ় অনিশ্চয়তার পাথরে
এতকাল ধরে ক্ষয়ে গেছে দিনগুলি, রাতগুলি।
মৃত্যুপ্রতিম স্মৃতির সরীসৃপ নিয়ে
আমি বিব্রত, বিপজ্জনক।
বিশ্বাসের কোনো ঐন্দ্রজালিক তারা
আলো বিলোয়নি সত্তায়, তবু
উদ্ধারের বাসনায় গ’লে প্রার্থনা হয়েছি কতদিন।
অনিদ্রার বিভীষিকায় তুমি এলে
-অনন্তের একবিন্দু আলো-
বাহুতে উজ্জীবনের শিখা,উদ্ধারের মুদ্রা উন্মীলিত।
দমকা বাতাসের আনন্দে কেঁপে উঠল বুকের তারা;
শশকের উৎকণ্ঠা নিয়ে তোমাকে দেখলাম,
রুপালি ঊর্ণাজালের শক্রতা সাধল
দুরন্ত উদ্দাম একরাশ চুল।
কে জানত এই খেয়ালি পতঙ্গ, শীতের ভোর,
হাওয়ায় মর্মরিত গাছ,
ঘাসে-ঢাকা জমি, ছায়া-মাখা শালিক
প্রিয় গানের কলি হয়ে গুঞ্জরিত হবে
ধমনিতে, পেখম মেলবে নানা রঙের মুহূর্ত।
কে জানত লেখার টেবিলে রাখা বাসি রুটি
আর ফলের শুকনো খোসাগুলো
তাকাবে আমার দিকে অপলক
আত্মীয়ের মতো?
কোনো পরিচিতাকে
জানতাম একদা তোমার চোখে জারুলের বন
ফেলেছে সম্পন্ন ছায়া, রাত্রির নদীর মতো শাড়ি
শরীরের চরে অন্ধকারে জাগিয়েছে অপরূপ
রৌদ্রের জোয়ার কত। সবুজ পাতায় মেশা টিয়ে
তোমার ইচ্ছার ফল লাল ঠোঁটে বিঁধে নিয়ে দূরে
চরাচরে আত্মলোপী অলীক নির্দেশে। শাশ্বত সে
বৃক্ষের গৌরবে তুমি দিয়েছ স্বামীকে দীপ্ত কামের মাধবী
শিশুকে সুপুষ্ট স্তন। দাম্পত্য প্রণয়ে সোহাগিনী
প্রেমিকার মতো হৃদয়ের অন্তহীন জলে, ঢেউয়ে
খর বাসনাকে ধুয়ে দান্ত সাধকের ধ্যানে তবু
গড়েছ সংসার। প্রত্যহের দীপে তুমি তুলে ধরো
আত্মার গহন নিঃসঙ্গতা, নকশি-কাঁথা-বোনা রাতে
স্বপ্নের প্রভায় জ্বলো। তোমার সত্তায় কী উজ্জ্বল
নিঃশঙ্ক অপ্রতিরোধ্য ফল জ্বলে, স্বর্গের সম্ভার।
এবং এখন জানি করুণ কাঠিন্য ভরা হাতে
আত্মায় নিয়েছ তুলে নগরের ফেনিল মদিরা,
আবর্তে আবর্তে মত্ত কাম, প্রাণে স্থির অন্ধ গলি।
হে বহুবল্লভা তুমি আজ কড়ায় ক্রান্তিতে শুধু
গুনে নাও নিষ্কাশিত যৌবনের অকুণ্ঠ মজুরি।
রূপের মলম মেখে সুচতুর মোমের ঊরুর
মদির আগুনে জ্বেলে পুরুষের কবন্ধ বিনোদ
কখনো জানিনি আগে এত ক্লান্ত, এত ক্লান্ত তুমি।