সহজে আসে না কেউ
সহজে আসে না কেউ আজকাল আমার নিকট,
একদা আসত অনেকেই। তথ্যে তত্ত্বে কিংবা গল্পে
কেটেছে প্রচুর বেলা, সারা ঘরে কখনো সমৃদ্ধ নীরবতা।
এখন আসে না কেউ, বড় ব্যস্তবাগীশ সবাই-
কেউবা পতিতালয়ে, কেউ মত্ত তাসের আড্ডায়,
মাতায় পাঁচটি পাড়া পিটিয়ে নিজের ঢাক কেউ,
কেউ কেউ গ্রন্থদাস, কেউ রাজনীতির কুমার
রাখছে সোনার কাঠি সন্তর্পণে বঙ্গের শিয়রে।
সহজে আসে না কেউ আজকাল আমার নিকট,
যেন আমি চিহ্নিত চাঁড়াল। দৃষ্টিপথে দেয়ালের
ছবি, ঘড়ি, আসবাবপত্র সব ম্লান হয়ে এলে
চোখ বুজে বসে থাকি। কখন একটি খাপছাড়া
সারস তারার মতো করে, আমি উচ্ছ্বসিত পালক নিকুঞ্জে
তার জ্বলজ্বলে নগ্নতায় করি চকিতে প্রস্থান।
অত্যন্ত বরদ হ্রদ আছে এক, যেখানে পাখির বংশাবলি
পালক ঝরিয়ে গেছে যুগে যুগে, সেখানে শব্দেরা
ধ্যানী, জাতিস্মর, আমি তার বুকে কাটবো সাঁতার
এবং পুলিনে তার পাতবো আসন সিদ্ধার্থের।
আমার হ্রদয় ফুঁড়ে জেগে ওঠে জলজ প্রাসাদ,
চিত্রিত মিনারে যার বয় শুধু বাতাসের স্বর,
ঝরে নীল। শূন্যে গাছ, শূন্যে টেলিগ্রাফ তার, ভুরুর সাঁকোয়
ক্ষুধিত পাখিরা শুধু নিরুপম সূর্যাস্তকে খায়,
নিঃসঙ্গতা অবিরাম আমাকে গভীর করে চায়।
সাঁকো
বাঁধতে পারিনি কোনো সাঁকো,
যখনি উদ্যমে থরোথরো আমি সাঁকো
বাঁধতে গিয়েছি ফাঁকা জায়গায় কখনো
সাজ-সরঞ্জামে টান প’ড়ে গেছে সকল সময়।
বানর অথবা কাঠবিড়ালির পাইনি মদদ
কোনোদিন। সাঁকো
নিপুণ বাঁধতে গিয়ে আমি শুধু ব্যর্থ হয়ে যাই,
বার বার ব্যর্থ হয়ে যাই।
বাঁধতে পারিনি কোনো সাঁকো
অথচ আমার আশেপাশে
সাঁকো নেই বলে আমি মূক হয়ে থাকি,
নিজেকেই প্রিয়-সম্ভাষণে করি প্রীত, নিজের হাতেই
হাত রাখি। কিন্তু শুধু অয়নায় নিজের মুখ দেখে,
নিজের সঙ্গেই মেতে কথোপকথনে
নিজেকে আদর করে চাদরে সর্বাঙ্গ ঢেকে সকল সময়
থাকা দায়। অন্য কারো হাত
ছোঁয়া চাই, শোনা চাই অন্য কারো স্বর-
মানে সাঁকো থাকা চাই।
অথচ বাঁধতে গিয়ে সাঁকো
আমি শুধু ব্যর্থ হয়ে যাই,
বার বার ব্যর্থ হয়ে যাই।
উদাস ডাকছি আমি বিপন্ন গলায় বারবার,
যদি কেউ ছুটে আসে, কথা বলে অন্তরঙ্গতার
প্রশস্ত সুচারু রোদে চেয়ারের মসৃণ হাতলে হাত রেখে
অথবা পা নেড়ে মৃদু হেসে।
বুঝব কি তার ভাষা?
সে আমার কথার গলির
পাবে কি হদিশ কোনো? দ্রুত খুলে যাবে কি জানালা সবদিকে?
কী করে বানাব সাঁকো শূন্যে
এক লহমায়?
আমি তো ম্যাজিকঅলা নই।
বর্ণমালা শব্দাবলি দিয়ে চমৎকার স্বপ্নময়তায় সাঁকো
বাঁধা যায় হাসতে হাসতে,
কুলকুচো করতে করতে।
নিপুণ বাঁধতে গিয়ে সাঁকো তবু আমি
ব্যর্থ হয়ে যাই,
বার বার ব্যর্থ হয়ে যাই…
সাধ
ওষুধের শিশি, থার্মোমিটার ইত্যাদি অপসৃত
আমার শিয়র থেকে। রৌদ্রের বার্নিশে ঝকমকে
সারা ঘর, ছাদের কার্নিশে পরগাছা, কী প্রফুল্ল,
ছড়ায় আপন শোভা। খবরের কাগজের পাতা
টেবিলে দিয়েছে মেলে সারা বিশ্ব। হাওয়া ফিসফিসিয়ে
বলে কানে কানে, ‘তারপর কী খবর? যাক, ফাঁড়া
এ যাত্রা কেটেছে তবে। সাদা পাঁউরুটির মাংসের
ভেতরে প্রবেশ করে রোদ, করে হৃদয়ে আমার।
স্মিত কাঁচা-পাকা চুল কুড়ায় আদর চিরুনির
মধ্য-দিনে, আয়নায় দেখছি সদ্য-রোগমুক্ত মুখ,
পথ্য-সমর্থিত। কী একটা শব্দ হল অকস্মাৎ,
হয়তো পাশের ঘরে। সজনে গাছের কাছে কেউ
দাঁড়িয়ে রয়েছে বুঝি। মাঝে মধ্যে দ্বৈত গুনুনের
ঢেউ ছোঁয় আমার সত্তাকে আপাতত নিরিবিলি
নিজেকে রেখেছি মুড়ে কবিতায় আপাদমস্তক
‘কাল ধর্মঘট হবে’, কখনো মাইকে র’টে যায়,
কখনোবা মিছিলের কলরব রাস্তার ওপারে।
হঠাৎ তোমাকে দেখি, নিবিড় দাঁড়িয়ে আছ একা,
শরীরে মোহন ঋতুরাজ; হয়তো তোমার ঘাটে
এখনও বসেনি কেউ, ভরেনি আঁজলা রাঙা জলে
উল্লসিত ব্যগ্রতায়। এখন তোমাকে দেখে ফের
সদ্য-যুবকের মদির সাহস পেতে সাধ জাগে।
সাধারণ বাড়ি
কাকপক্ষী, প্রজাপতি, পারাবত, পেলব বেড়াল
ইত্যাদির প্রতি আমি ঈর্ষান্বিত, কেননা তোমার
বাড়িতে তাদের গতি উন্মুক্ত অবাধ; কিন্তু আমি
সেখানে পারি না যেতে নির্দ্বিধায় যখন-তখন
হলেও ইচ্ছায় সকাতর। ইচ্ছা কুকুরের মতো
লোভী আর এমন সুদৃঢ় চেন, বকলস নেই
যা দিয়ে বাঁধবো তাকে, রাখবো স্ববশে। ইচ্ছা হয়,
ভারি ইচ্ছা হয় যাই তোমার বাড়িতে বার বার।
সেখানে ড্রইংরুমে নেই সুশোভন টিভি,
দামি আসবাবপত্র কিছু নেই, এমনকি হায়
চায়ের বাটিও ঠুঁটো, ডানাভাঙা নিঃসঙ্গ মৃন্ময়ী
পরী তাকে, যেনবা বালিকাবধূ সংকোচে দাঁড়ানো।
তবুও তো সে-বাড়ির চতুঃসীমা, কৃপণ উঠোন,
সংকীর্ণ বিবর্ণ ঘর বড় ভাল লাগে, বার বার
চৌকাঠে দাঁড়াতে চাই, ব্যাকুল দেখতে চাই তুমি
হাসলে কেমন হাসো, কাঁদলে বালিশ কতটুকু
ভিজে ওঠে ব্যথাবাষ্পে, মেজাজের তেজিমন্দি তো-ও।
আমার ইচ্ছাকে আমি কিছুতেই পারি না দমাতে।
সে-বাড়িতে তুমি থাকো বলে অতি দরিদ্র উঠোন
নিমেষে উদ্যান হয়, ক্ষয়রোগীর মুখের মতো
কাঠের দরজা রাজ-তোরণের স্বপ্নময়তায়
কথা বলে অলৌকিক এবং কলের বিন্দু বিন্দু
জল কৃশ সাধকের জপমন্ত্র; সমস্ত বাড়িটা
জ্যোতিষ্কের বর্ণকৃতি পেয়ে যায়, দূর থেকে দেখি।
স্কুটার ড্রাইভার
স্কুটার চালানো কাজ। মিটারের ওঠা-নামা খিস্তি-
খেউড়, বচসা, দৌড় ইত্যাদি নিয়েই বেলা যায়।
নিত্য ওঠে কতজন আমার স্কুটারে, ক্ষণিকের
অতিথি সবাই। ভাড়া চুকিয়ে যে যার ঠিকানায়
নেমে পড়ে-পার্কে, মাঠে, সিনেমায়, রাস্তায়, দপ্তরে
কেউবা পাড়ায় কেউ বেপাড়ায়। কারুর গন্তব্য
নিয়ে মাথা ঘামাই না কোনো দিন। পকেট উজ্জ্বল
হলেই আমার দিন আহ্লাদিত, রাত্রি উছ্বসিত।
কখনোবা একেকটি মুখ খুব মনে গেঁথে যায়,
কিছুতেই পারি না ভুলতে। রগরগে ফিল্মে হর-
হামেশা যেসব মেয়ে নাচে গায় বাগানে পাহাড়ে
রুপালি ঝর্নার ধারে, এমনকি গোরস্থানে-যেন
তাদের মতোই কেউ আমার স্কুটারে ফিসফিস
কথা বলে উদ্বেল সঙ্গীর কাঁধে ঢ’লে। হাবুডুবু
খাচ্ছে প্রেমে হয়তো দুজন। সত্যি প্রেম? নাকি শুধু
বিছানায় একসাথে ঘুমোনোর জন্যই এমন
ঢলাঢলি, এত খুনসুটি? বাদ দিন, আমি ছাই
কী বুঝি প্রেমের? ইতরামি, খচরামি, মাজাকির
সমাহার এ জীবন। কখনো বিবির পান-রাঙা
ঠোঁট রক্তে জাগায় বলক, ছোট্র মেয়েটার হাসি
আমার ক্লান্তির কালি করে সাফ, দোস্তের দরাজ
দিল বুকে কেমন ভরসা দেয়, ফিল্মি গান গাই।
স্কুটার চালানো কাজ। শালা, দুনিয়াটা নাট আর
বল্টুর সংযুক্ত কেরামতি। কোনো দিন একজন
বুড়ো-সুড়ো যাত্রী, দেখি, ভীষণ চিন্তিত, জীর্ণ-প্রায়
জুতোর সোলের মতো গালের খোঁচা খোঁচা পাকা দাঁড়ি,
চশমাটা নাকের ডগায়, তার ছোঁড়া পাঞ্জাবিটা
চোখে পড়তেই ফের ঘরের বেড়ার কথা মনে
হল; বিড়বিড় করে লাঠি হাতে নামলেন তিনি
কেমন অন্যমনস্ক। একদিন একটি মহিলা,
কান্না-ভেজা চোখ তার, হাত নেড়ে ডেকেও স্কুটারে
ওঠেননি; বিরক্তিতে পাড়লাম গাল। বুঝি তার
কনস্কামনার ভীরু হরিণ হারিয়ে গেছে এই
শহরের ভিড়ে; মাঝে-মাঝে বিছানায় শুয়ে ভাবি-
নানা মুখ ভিড় করে আসে চোখের সম্মুখে, যেন
মেলায় ঘুরছি আমি। ওরাও ঘুরছে সর্বক্ষণ
ক্ষণিক অতিথি সব, যদি পারতাম সবাইকে
সব সমাধানের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে কোনো দিন।