ম্যাজিক
হচ্ছে, হতে থাকবে দিনের পর দিন, এইমতো,
কখনো ভিন্ন রকম।
লোকটা চায়ের দোকানে বসবে, চা খাবে, সঙ্গে
দুটো খাস্তা বিস্কুট,
ওল্টাবে খবরের কাগজ, দেখবে ম্লান হাতঘড়ি।
তরতাজা তরকারি নিয়ে ছুটবে মুটে, কাক
খুঁটে খুঁটে খাবে ইঁদুর।
সিঁদুর-রাঙা শার্ট-পরা একজন যাবেন এই পথে
রোজকার মতো,
যার কাছে দিন আর রাত্রির ব্যবধান লুপ্ত, সময়
অচিহ্নিত, তার
মনের ভেতর নানান মন্টাজ। এখানে ফাটবে
টিয়ার গ্যাসের শেল, গুলির শব্দ হবে,
মন্ত্রোচ্চারণের মতো
কণ্ঠ থেকে কণ্ঠে ফিরবে স্লোগান। কেউ
মুখ থুবড়ে পড়বে রাস্তায়,
কারুর স্যান্ডেল যাবে ছিঁড়ে হঠাৎ চিৎকারে
চমকিত গলির মোড়ে।
হচ্ছে, হতে থাকবে দিনের পর দিন, এইমতো,
কখনো ভিন্ন রকম।
কাঁদবো,
কাঁদাবার লোক থাকবে বিপুল বেরাদরিতে।
হাসব,
হাসাবার লোক থাকবে বিপুল বেরাদরিতে।
আমার শহরে, আগে যেখানে ছিল মাঠ কিংবা
কালো জঙ্গল,
এখন সেখানে আলিশান দরদালান, পিঠাপিঠি।
আমার পাড়ায়, আগে যেখানে ছিল গ্রন্থবিতান,
এখন সেখানে হেয়ার-কাটিং সেলুন,
সস্তা রঙিন শাড়ির মতো
সাইনবোর্ড দাঁত কেলিয়ে হাসে সর্বক্ষণ।
আমার মা, আগে, বহুদিন আগে, সংসার
নিকিয়ে বিকেলে
চুল আঁচড়াতেন হাড়ের কাঁকই দিয়ে।
এখন তিনি
প্লাস্টিকের চিরুনিতেই অভ্যস্ত।
আমার মাথার বস্তিতে আগে ছিল কালোর
একচ্ছত্র আধিপত্য,
এখন সেখানে ওড়ে সাদা নিশান।
টেবিলে প্রাচীন একটা মুখোশ-কোথাকার
কবেকার, কে জানে-
একবার দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায় পুনরায়।
আমার চেনা এক ভদ্রলোক, একদা ছিলেন
দীক্ষিত অহিংসায়,
এখন তাঁর মুখে শুনি ‘হিংসা ইতিহাসের ধাত্রী’
ইত্যাকার বাণী।
মনের গভীরে জোনাকি-অচেতন,- দেখি
প্রাচীন এক শয্যায়
আছেন শুয়ে এক রাজা, অসুস্থ,
হীনবল আর বুড়ো।
বদলে যাচ্ছে, পাল্টে যাচ্ছে অনেক কিছু-
পায়রাময় স্টেজ,
স্টিকের ডগায় টকটকে গোলাপ কখনোবা
মাটিতে কিশোরের
মুণ্ড, কাঁধ থেকে বিচ্ছিন্ন, আবার লাগে জোড়া।
ম্যাজেশিয়ান
কী ম্যাজেস্টিক বলে দিচ্ছি হাততালি। হঠাৎ
স্টেজের পর্দা আসবে নেমে
বন্ধ হবে চেল্লানি, হাততালি, সিটি ইত্যাদি
যাবে থেমে,
থেমে যাবে, থেমে যাবে, থেমে যাবে সব ম্যাজিক।
রাজহংসী
একজন রাজহংসী, যেন সে ডেসডেমোনা, এলো
আমার অত্যন্ত কাছে। শুনল কাহিনী অগণিত
বললাম যেসব তাকে। শব্দ গেঁথে গেঁথে বানালাম
তার জন্যে ত্র্যাডভেঞ্চারের এক অলৌকিক ভোজ।
রইল চেয়ে মুগ্ধতায়; গাছের পাতারা গান গেয়ে
ওঠে, পাখি হয় ফুল, চতুর্দিকে গহন উদ্যান
বহু জায়গা জুড়ে রয়। কী করে দস্যুর জাহাজের
নিশান ছিঁড়েছি কিংবা শুনেছি সমুদ্রে বরফের
নেকড়ে-চিৎকার-জানালাম তাকে সবি একে একে।
বাড়ালো মদির চঞ্চু রাজহংসী, জড়াল আমাকে
গাউনের মতো ফুল্ল ডানায় ডানায়। আমি তার
বুকে মুখ রেখে রাঙা উষ্ণতায় হলাম মাতাল।
হঠাৎ একটি কাক, ধূর্ত আর বেজায় হিংসুটে,
স্নিগ্ধ রুমালের মতো সবচেয়ে সুন্দর পাতাটি
ছিঁড়ে নিয়ে গেল উড়ে। ‘আমারই রুমাল’ বলে আমি
দারুণ চিৎকারে নৈঃশব্দকে করলাম তছনছ;
যেন মস্ত হল-এ ঝাড়লণ্ঠনের দীর্ণ হাহাকার!
‘কী করে পেল সে ওই আমার নিজস্ব রুমালের
অধিকার?’ বলে রাজহংসীটির দিকে তাকালাম,
আমার দু’চোখ জুড়ে সবুজ আগুন। অকস্মাৎ
সাঁড়াশির মতো চেপে বসে রাজহংসীর গ্রীবায়
আমার দু’হাত আর ছিন্নভিন্ন নিজেরই হৃৎপিণ্ড
অদৃশ্য বর্শায়; দেখি, কী দারুণ নীল গলা তার,
চোখে নিদ্রা তীব্র এঁটে দিয়েছি, গাউন ছেঁড়াখোঁড়া।
শয্যায়
তাসের তাঁবুর মতো ঘরের দেয়ালগুলি খসে,
আমাদের শয্যা যায় উদোম উঠোনে, শহরের
শীর্ষে চুরুটের আগুনের মতো নক্ষত্রবাসরে।
একটি কেমন সাপ, তুমি শুয়ে চিত্রবৎ খাটে।
মেঘময়তায় দেখি ঝুঁকে তোমার মুখের দ্বীপে,
আমার তন্ময় চক্ষুদ্বয় হয় নব্য ক্রুসো; তুমি
এমন উদ্যান এক যেখানে পাখিরা সহজেই
নির্ভয়ে আশ্রয় পারে নিতে, মৃদু ঠোঁটে খড়কুটো
সযত্নে সাজাতে পারে। সুগভীর গীত জেগে ওঠে
অকস্মাৎ, লয়-তানে ঝংকৃত স্নায়ুর ঝোপঝাড়।
কান পেতে শুনি, ভাবি, তোমার শরীর সেই গীত-
উত্থিত সংগীতে বেজে উঠি, কভুবা সাঁতার কাটি
বিস্ময়-জাগানো সুরে, সেই গীত টেনে নেয় দ্রুত
আমাকে তোমারই দিকে। যুগগলবন্দিতে ক্রমাগত
শিশিরের সৃষ্টি হয় আর অবগাহনকালীন
তুমি তো মাংসল পুণ্য ক্রুশে বিদ্ধ, যিশু হও নারী।
সফেদ পাঞ্জাবি
শিল্পী, কবি, দেশী কি বিদেশী সাংবাদিক,
খদ্দের, শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবিকা,
নিপুণ ক্যামেরাম্যান, অধ্যাপক, গোয়েন্দা, কেরানি,
সবাই এলেন ছুটে পল্টনের মাঠে, শুনবেন
দুর্গত এলাকা-প্রত্যাগত বৃদ্ধ মৌলানা ভাসানী
কী বলেন। রৌদ্রালোকে দাঁড়ালেন তিনি, দৃঢ়, ঋজু,
যেন মহাপ্লাবনের পর নুহের গভীর মুখ
সহযাত্রীদের মাঝে ভেসে ওঠে, কাশফুল-দাড়ি
উত্তুরে হাওয়ায় ওড়ে। বুক তাঁর দক্ষিণ বাংলার
শবাকীর্ণ হু-হু উপকূল, চক্ষুদ্বয় সংহারের
দৃশ্যাবলিময়; শোনালেন কিছু কথা, যেন নেতা
নন, অলৌকিক স্টাফ রিপোর্টার। জনসমাবেশে
সখেদে দিলেন ছুঁড়ে সারা খাঁ-খাঁ দক্ষিণ বাংলাকে।
সবাই দেখল চেনা পল্টন নিমেষে অতিশয়
কর্দমাক্ত হয়ে যায়, ঝলছে সবার কাঁধে লাশ
আমরা সবাই লাশ, বুঝিবা অত্যন্ত রাগী কোনো
ভৌতিক কৃষক নিজে সাধের আপনকার ক্ষেত
চকিতে করেছে ধ্বংস, প’ড়ে আছে নষ্ট শস্যকণা।
ঝাঁকা-মুটে ভিখিরি, শ্রমিক, ছাত্র, সমাজসেবিকা,
শিল্পী, কবি, বুদ্ধিজীবী, দেশী কি বিদেশী সাংবাদিক,
নিপুণ ক্যামেরাম্যান, ফিরিঅলা, গোয়েন্দা, কেরানি,
সমস্ত দোকান-পাট, প্রেক্ষাগৃহ, ট্রাফিক পুলিশ,
ধাবমান রিকশা ট্যাক্সি, অতিকায় ডবল ডেকার,
কোমল ভ্যানিটি ব্যাগ আর ঐতিহাসিক কামান,
প্যান্ডেল টেলিভিশন, ল্যাম্পপোস্ট, রেস্তোরাঁ, ফুটপাত
যাচ্ছে ভেসে, যাচ্ছে ভেসে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বঙ্গোপসাগরে।
হায়, আজ একী মন্ত্র জপলেন মৌলানা ভাসানী!
বল্লমের মতো ঝল্সে ওঠে তাঁর হাত বারবার
অতি দ্রুত স্ফীত হয়, স্ফীত হয়, মৌলানার সফেদ পাঞ্জাবি,
যেন তিনি ধবধবে একটি পাঞ্জাবি দিয়ে সব
বিক্ষিপ্ত বেআব্রু লাশ কী ব্যাকুল ঢেকে দিতে চান।