বহু কিছু থেকে ছুটি
বহু কিছু থেকে ছুটি নিতে পারি কখনো-সখনো।
আপিসের কাজকম্ম, রক আর সরব রেস্তোরাঁ,
রাস্তার অথই ভিড়, মনোহারি দোকান, ব্যাংকের কাউন্টার,
ইয়ারবকসির আড্ডা, আত্মীয়-স্বজন, প্রিয়তম শব্দাবলি
রেডিও, টেলিভিশন, ব্রিজ থেকে বক্তৃতার মঞ্চ কিংবা কবিতা পাঠের
স্মার্ট আসরের শোভা; সিনেমা সার্কাস
ইত্যাদি ইত্যাদি থেকে ছুটি নিতে পারি নির্দ্বিধায়;
অথচ তোমার কাছে আজীবন ক্ষণিক ছুটির
দরখাস্ত পারব না করতে দাখিল।
একদা শৈশবে গাঢ় গোধূলি বেলায় কোনো রঙিন মেলায়
একটি পুতুল থেকে কিছুতেই বহুক্ষণ ফেরাতে পারিনি
দুটি চোখ, এত ভালো লেগেছিল। এবং তোমার ভাবনায়
নিমগ্ন হলেই, হে স্বদেশ; সেই পুতুলের মুখ মনে পড়ে।
তোমার রূপের খ্যাতি পরাক্রান্ত প্রবাদের মতো
এখনও ছড়িয়ে আছে হাটে মাঠে ঘাটে; এখনও তোমার মুখ,
সর্ষে ক্ষেতের মতো মুখ,
সোনলী আঁশের মতো চুল,
জেলের ডিঙির মতো ভুরু,
মেঘনার মতো কালো টলটলে চোখ
আনন্দ জোগায় মনে এবং জীবনানন্দ তোমার সংসর্গ
ছেড়ে অন্য কোথাও চাননি যেতে। এমনকি আধুনিক তুখোড় কবির
উচ্ছল রক্তেও বাজে অপরূপ তোমার নূপুর মাঝে মাঝে।
তোমাকে নিবিড় ভালোবাসে অনেকেই।
সংখ্যায় ক’জন তারা? কী লাভ বলো-না এই হিসেব-নিকেশে?
কেউ তারস্বরে; কেউ মৃদু
মনে মনে তোমাকেই জপে; সঁপে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল
তোমার একান্ত ঘাটে। অনেকের মতো
আমিও সহজে পারি হাজার হাজার শব্দে, জ্বলজ্বলে শব্দে
তোমার স্ততির মালা গেঁথে দিতে। কিন্তু আমি শুধু
নিঃশ্বাসের মতো লৌকিকতাহীন মা বলে ডাকতে
ভালোবাসি তোমাকেই হে দেশ আমার।
তোমাকে দেখলে মন আজকাল হয় উচাটন।
তোমার সুদীর্ঘ চুল ভাসে জলে, তুমি ভাসো সরলা সুন্দরী,
কখনো অত্যন্ত মৃদু সুরে গাও গান, স্তব্ধ হও কখনোবা,
যেন ওফেলিয়া ।
বারবার ফিরে আসে
বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট,
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে, ঘোরে হাতে-হাতে,
মিছিলে পতাকা হয় বারবার রক্তাপ্লুত শার্ট।
বিষম দামাল দিনগুলি ফিরে আসে বারবার,
বারবার কল্লোলিত আমাদের শহর ও গ্রাম।
আবার আসব ফিরে’ বলে সজীব কিশোর
শার্টের আস্তিন দ্রুত গোটাতে গোটাতে
স্লোগানের নিভাঁজ উল্লাসে
বারবার মিশে যায় নতুন মিছিলে, ফেরে না যে আর।
একটি মায়ের চোখ থেকে
করুণ প্লাবন মুছে যেতে না যেতেই
আরেক মায়ের চোখ শ্রাবণের অঝোর আকাশ হয়ে যায়।
একটি বধূর
সংসার-উজাড়-করা হাহাকার থামতে না থামতেই, হায়,
আরেক বধূর বুক খাঁ-খাঁ গোরস্থান হয়ে যায়,
একটি পিতার হাত থেকে কবরের কাঁচা মাটি
ঝরে পড়তে না পড়তেই
আরেক পিতার বুক-শূন্য-করা গুলিবিদ্ধ সন্তানের লাশ
নেমে যায় নীরন্ধ্র করবে।
বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট,
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
উনিশ শো ঊনসত্তরের
তরুণ চিৎকৃত রৌদ্রে যে-ছেলেটা খেলত রাস্তায়,
বানাত ধুলোর দুর্গ, খেত লুটোপুটি নর্দমার ধারে
বিস্ময়ে দেখত চেয়ে ট্রাক, জিপ,
রাইফেল, টিউনিক, বেয়োনেট, বুট, হেলমেট,
এখন সে টলমল পদভরে শরিক মিছিলে।
লজনম্র যে-মেয়েটি থাকত আড়ালে সর্বক্ষণ,
যে ছিল অসূর্যম্পশ্যা, এখন সে ঝলসায় মিছিলে মিছিলে।
তাদের পায়ের নিচে করে জ্বলজ্বল নীল-নকশা নব্য সভ্যতার।
বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট,
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।
হতাশাকে লাথি মেরে, ভয়কে বেদম লাঠিপেটা করে
সবখানে স্লোগানের ফুলকি ছড়াই।
বারবার আমাদের হাত হয় উদ্দাম নিশান,
বারবার ঝড়ক্ষুব্ধ হই আমরা সবাই।
আমাকেই হত্যা করে ওরা বায়ান্নোর রৌদ্রময় পথে,
আমাকেই হত্যা করে ওরা
ঊনসত্তরের বিদ্রোহী প্রহরে,
একাত্তরে পুনরায় হত্যা করে ওরা আমাকেই,
আমাকেই হত্যা করে ওরা
পথের কিনারে
এভেন্যুর মোড়ে,
মিছিলে, সভায়-
আমাকেই হত্যা করে ওরা, হত্যা করে বারবার।
তবে কি আমার
বাংলাদেশ শুধু এক সুবিশাল শহীদ মিনার হয়ে যাবে?
বিচ্ছন্ন
এখন তোমরা কেউ আমার কথায় করবে না কর্ণপাত।
এখন তোমরা কবিতার লেজ ধরে
আছড়াতে আছড়াতে অলৌকিক বিস্ফোরণ চাও
রুটিন মাফিক।
এখন তোমরা কেউ আমার কথায় করবে না কর্ণপাত।
এখন তোমরা সব পাড়ায় পাড়ায়
ক্রোধের আগুন জ্বেলে কেবলি উঠছ মেতে গার্হস্থ্য কলহে,
মস্তানি হননে
ফেলে যাচ্ছ রক্তাপ্লুত লাশ
প্রকাশ্যে রাস্তায়।
এখন তোমরা কেউ আমার কথায় করবে না কর্ণপাত।
এখন তোমরা তোমাদের ভুবনকে
দুগ্ধপোষ্য কিন্ডারগার্টেন করে ধূর্ত কোনো হেডমাস্টারের
ছত্রচ্ছায়া চাও।
‘ডালপালা, লতাপাতা, কীটপতঙ্গকে কাছে ডাকে
বলেই না তারা রাঙা আমন্ত্রণ রক্ষায় তৎপর
হয়ে ওঠে ভোর-সন্ধে বুকে নিয়ে’-আমার এ অসমাপ্ত বাক্য
কাঁপে থরথর। ‘থামো হে গাড়ল’ বলে
আমাকে নিক্ষেপ করো গার্বেজ ডাম্পের অন্ধকারে।
আড়ালে হাঙর জেগে ওঠে নানাবিধ,
মাংস কণ্টকিত।
এখন তোমরা কেউ আমার কথায় করবে না কর্ণপাত।
গেরেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে
ছুটছ করুণা প্রেম প্রমুখের পেছনে পেছনে,
সোৎসাহে পরাচ্ছ হাতকড়া কল্যাণকে
ফাঁসি-মঞ্চে লটকাচ্ছ বিবেককে, শান্তিকে করছ একঘরে।
দূরের আকাশ থেকে আসে হাঁস, তাকে
টেনে নিয়ে বুকে ভাবি, বরং শেখাব
ভালোবাসী হয়ে যাবো দূর যৌথ স্মৃতির মায়ায়; বৃক্ষ দেখে
জাগবে নিবিড় ভ্রাতৃভাব।
হায়,
পাথর, পতঙ্গ, গাছ, পশুপাখিদের যা বলি বোঝে না তারা,
তারাও বলে না কিছু আমাকে কখনো।