দোলনা নয়
দোলনায় নয় কিংবা নয় মুখরিত খেলাঘরে,
পেয়ারা গাছের নিচে কাজল মাটিতে আছে প’ড়ে,
যেনবা পুতুল কোনো, ফেলে যাওয়া। নখভরা ধুলো,
হয়তো মাটির কাছে চেয়েছিল স্নেহকণা। হুলো
বেড়াল দেখলে অকস্মাৎ পেত ভয়, কিংবা কোনো
পেঁচার আঁধার-চেরা ডাকে কেঁদে উঠত কখনো।
অথচ এখন তার বেয়নেট-বিদ্ধ শরীরের
লোভে ঝোপ থেকে ক্ষিপ্র বেরুচ্ছে শেয়াল। খোকা টের
পাচ্ছে নাকো কিছুতেই। কে জানত এমন অনড়
হয়ে যাবে এই রাঙা চঞ্চলতা? শূন্য সারা ঘর,
সারা গ্রাম, শক্ত মৃত্তিকায় শুধু সে রয়েছে প’ড়ে।
তার তো থাকার কথা সস্নেহ কবোষ্ণ মাতৃক্রোড়ে।
না, আমি উন্মাদ নই
না, আমি উন্মাদ নই, বিড়বিড় করছি ভাবেন
সর্বক্ষণ? এ আমার মুদ্রাদোষ, বন্ধুরা বলেন।
দেখুন সযত্নে আজও কামিয়েছি দাড়ি, আফটার
শেভ লোশনের ঘ্রাণ গণ্ডময়; দুটো চ্যাপটার
গোগ্রাসে গিলেছি আজও বাস্তবিক আগাথা ক্রিস্টির।
আমি তো জনৈক স্টাফ রিপোর্টার, ধ্বংসের সৃষ্টির
বিচিত্র সংবাদ আহরণে অতিশয় দক্ষ, তাই
নানান মহলে খ্যাত। প্রায়শ এয়ারপোর্টে যাই
ভিআইপি-দের বাণী টুকি কিংবা এঁদো মফস্বলে
ছুটি সংবাদের লোভে কালেভদ্রে। ঝিলে কি জঙ্গলে
খবর শিকার করি। কখনো জমাই পাড়ি জেটে…
রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সোভিয়েতে।
কখনো নেতার ঘরে, কখনো দুর্গত এলাকায়
খবরের ঘ্রাণ শুঁকে আমার অনেক বেলা যায়।
এবারও গেলাম যথারীতি ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড
উপকূলে; কত চরে, জনপদে, অতি দূর গণ্ড-
গ্রামে খুব শান্ত গ্রামে দৈনিক পত্রের লোভী পাতা
ভরিয়ে তুলবো বলে, কিন্তু খাঁ-খাঁ করে ঝানু খাতা।
যে বাতাস সাগ্রহে মানুষ টেনে নেয় বুকে তার,
যে জলে ডোবায় গলা, আঁকে নকশা, কাটে সে সাঁতার
ছিটিয়ে জলজ ফুল, নৌকা যায়, জাল ফ্যালে; হায়
হঠাৎ দারুণ রোষে তারাই জল্লাদ হয়ে যায়।
কোথায় এলাম আমি? পোড়া চোখে একি দেখলাম?
যেদিকে দু’চোখ যায় শুধু শব; কার কী যে নাম
জানি না কিছুই; নয় ওরা শব নয়; রাশি রাশি
ভারা ভারা গলিত ফসল যেন। ভীষণ আগ্রাসী
শক্তি উন্মত্ত তাথৈ নাচে সব মিসমার। ভগ্নী-ভ্রাতা,
পিতা-মাতা, বরবধূ আছে পড়ে, নেই কোনো ভ্রাতা।
বধূটির মেহেদির রঙ তখনো হয়নি ফিকে,
ভেলায় ভাসছে কত গলিত বেহুলা চতুর্দিকে।
বয়েসী পিতার লাশ থেকে ক্ষিপ্র ছিনিয়ে কাপড়
লজ্জা ঢাকে বেবস্তর উদ্ভ্রান্ত সন্তান সকাতর।
আমি তো জনৈক স্টাফ রিপোর্টার; জনহীনতার
কণ্টকিত বিস্ময়কে মগজের কোষে পুরে তার-
বার্তা কিছু পাঠাই সংবাদপত্রে; এবং পুনরায়
এ শহরে আসি ফিরে; ভিড়ে মিশি, সময় গড়ায়
যথারীতি। না, আমি উন্মাদ নই, হয়তো বেল্লিক,
কে যেন কলার চেপে বলে শুধু ধিক, তোকে ধিক।
না, আমি উন্মাদ নই; আজো সুস্থদের মাঝে ঠাঁই
রয়ে গেছে, শব্দ লিখি অফুরান, আশ্চর্য এটাই।
পালা
আমরা সবাই দেখি, গ্রাম্যজন, ক্ষিপ্র নাগরিক,
সবাই প্রত্যহ দেখি একই পালা। চির-চেনা সব
কুশীলব, পোশাকের বেবাক ভাড়াটে জেল্লা আর
স্টেজময় পায়চারি, মুখভঙ্গি, কোমরে ঝুলন্ত
তলোয়ার, সিংহাসন ইত্যাদি ইত্যাদি দেখে দেখে
এমন মুখস্থ হয়ে গেছে সব-কে কোথায় কত
উঁচিয়ে-নামিয়ে পর্দা গদ্যে-পদ্যে জুড়বে সংলাপ
কতক্ষণ, ঠিক বলে দিতে পারি আমরা সবাই।
বস্তুত সবাই দেখি দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের
পালা রোজ। কেউ দিই শিস, কেউ ফুঁকি খাকি বিড়ি,
হাই তুলি মাঝে-মাঝে। বিশ্রামের ঘণ্টা বাজলেই
বাইরে বেরিয়ে এসে কখনো ফুলুরি কিনি, খিস্তি
খেউরে ভীষণ মাতি, প্রস্রাব ছিটিয়ে ঝোপেঝাড়ে
ফিরে আসি, পুনরায় একই পালা বাদ্যসহকারে
শুরু হয়, বস্ত্রহরণের পালা। এই পালা আর
বেশিদিন, বুঝেছ হে অধিকারী, দেব না চলতে
বলে গনগনে কেউ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পুড়ে বুক
টান করে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিস্ফারিত চোখে দেখি
লোকটাকে, মনে হয়, দুঃশাসন পালাবে এক্ষুণি।
পাশাপাশি
চুপচাপ ব’সে আছি শোভিত ড্রইংরুমে একা
এবং স্নানের ঘরে তুমি
শাওয়ারের নিচে নগ্ন। কব্জি-ঘড়িটার দিকে চোখ
বারবার রাখছি ব্যাকুল, আমি নিজের মনের
একপ্রস্থ খসখসে পোশাক খুলেই
সার্কাস দেখার মজা পেলাম পেল্লায়।
শো-কেসে গান্ধারা মুণ্ডু, জাপানি পুতুল, একজন
ব্রোঞ্জ মূর্তি, দেবী-টেবী হবে, হয়তোবা
মহেঞ্জোদারোর নটী কোনো।
কতদিন এইরূপ ছিমছাম পরিবেশে বসবার সুযোগ পাইনি।
হয়তো স্নানের ঘরে নিজেকে দেখছ অনাবৃতা,
জানালার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টিভেজা নর্তকীর মতো
গাছটিকে তীব্র দেখছিলাম তখন।
সাবানে ঘষছ তুমি বগলের সবুজাভ ভূমি
সরার মতন স্তন, নাভিমূল, ঊরু
এবং ত্রিকোণ মাংসপিণ্ড, কী মঞ্জুল।
আমি কাল সারা রাত জেগে লেখা কবিতার কিছু
অত্যন্ত বিরক্তির, ক্লান্তিকর পংক্তি
তুমুল মার্জনা করে নিচ্ছিলাম মনের ভেতর।
যখন আঁটছো তুমি ব্রেসিয়ার, আমি
আমার দারুণ নগ্ন ইচ্ছাকে আবৃত
করার চেষ্টায় ক্লান্ত হচ্ছিলাম বড়।
যখন সুদীর্ঘ চুল বাঁধছিলে তুমি চূড়ো করে,
এলোমেলো ভাবনাগুলোর মধ্যে দ্রুত
ধবল চিরুনি চালাচ্ছিলাম কেবল।
তুমি এলে গুনগুনিয়ে, সারা ঘরে বিদেশী পারফিউম; বললে,
বলো তো কখন থেকে ব’সে আছ? তারপর
সোফায় বসলে চমৎকার, শাড়িতে সবুজ লতা,
খোঁপায় গোলাপ টকটকে, চলে হার্দিক সংলাপ; এরই মধ্যে
হঠাৎ পড়লে মনে, স্যান্ডেল বগলদাবা করে
বন্যার আবিল জল ঠেলে যেতে হবে, যেতে হবে বহুদূর।