ক্ষমাপ্রার্থী
লতিফ তোমার কাছে হাঁটু মুড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করি।
এখনও এখানে আছ, মনে হয়, এই বারান্দায়,
বৈঠকখানায় কিংবা ছমছমে সিঁড়ির আঁধারে।
লতিফ তোমার হিমশীতল নিঃশ্বাস
আমার জুলফি ছুঁয়ে যায়। কড়িকাঠে,
দেওয়ালে চৌকাঠে কুলুঙ্গিতে,
যেদিকেই তাকাই তোমার
চক্ষুদ্বয় জলের ফোঁটার মতো ঝুলে থাকে বিষম নাছোড়।
না, তুমি অমন করে আমাকে দেখো না,
দেখো না লতিফ।
একদা তোমাকে আমি বড় বেশি ঈর্ষা করতাম;
তোমার সোনার সিগারেট কেস, সুট-টাই, আসবাব দেখে
কেমন টাটাত চোখ, সেসব ব্যসন
করতলগত
করার নচ্ছার লোভ লুকিয়ে শার্টের অন্তরালে,
বুকের তলায়,
আমি হাসতাম, তুমি ‘নাও, সিগারেট খাও’ বলে
সুদৃশ্য সোনালি কেস দিতে খুব ব্যগ্র-হাতে নিপুণ বাড়িয়ে।
অলীক দেরাজ থেকে তোমার বিশদ জীবনের
নীল-নকশা চুরি করে, নিজে ব্যবহার
করতে চেয়েছি কতদিন বস্তুত কাঁথায় শুয়ে।
লতিফ তোমার কাছে হাঁটু মুড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করি।
এই তো তোমাকে আমি কালকেও প্রবল
ঈর্ষা করতাম, আজ সেই
বিচ্ছিরি কুটিল পোকাটাকে নির্দ্বিধায়
দিয়েছি বিদায়।
নিজে বেঁচে আছি বলে তৃপ্তি। আজকেও,
যখন আমার বুক বোমা-ধ্বস্ত শহরের মতো
হুবহু হওয়ার কথা, বৈরাগ্যে অরণ্যে
মুখ লুকানোর কথা আজকেও আমি
আয়নায় নিজের পরিপাটি প্রতিচ্ছবি দেখে সুখে
ঈষৎ হেসেছি; স্ত্রীর সাথে খুনসুটি
করে কিছুকাল গলিত গলির মোড়ে
তোফা ধরিয়েছি সিগারেট।
তুমি আজ সব ঈর্ষা দ্বন্দ্ব সব কলহের পরপারে। তুমি
নিস্পন্দ তোমার খাটে। মনে হয় হয়তো চোখ মেলে
এক্ষুণি এগিয়ে দেবে তোমার সোনালি কেস আমার দিকেই
অবলীলাক্রমে, বলবে, ‘নাও, সিগারেট খাও।‘ নাকি
রয়েছ দাঁড়িয়ে ঝুলবারান্দায় কিংবা বাথরুমে
ধুতে গেছ বাসি মুখ। ইতিমধ্যে তোমার রোরুদ্যমানা স্ত্রী-র
ব্লাউজ-উপচে-পড়া কম্পমান স্তন আড়চোখে
নিলাম বিষম দেখে, অবাধ্য অসভ্য রক্তে ডাকে বার-বার
লালচক্ষু তৃষিত কোকিল।
লতিফ তোমার কাছে হাঁটু মুড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করি।
চেগুয়েভারার চোখ
যেখানেই যাই, অলিতে-গলিতে,
গ্রন্থবিতানে, কাফেটারিয়ার ভিড়ে
কী যেন তীব্র, অপ্রতিরোধ্য
জ্বলজ্বল করে আমার সত্তা ঘিরে।
চুরুট রঙের সন্ধ্যায় মনে
ভেসে ওঠে শুধু দূর বোলিভিয়া-বন।
ভাবি উচাটন বিশ শতকেও
ঈশ্বরহীন সন্ত শহীদ হন।
সন্তের চোখ, শহীদের চোখ
কে যেন দিয়েছে হৃদয়ে আমার সেঁটে,
রক্তাপ্লুত একটি শরীর
সকল সময় কী ঋজু যাচ্ছে হেঁটে।
আমার প্রহর হাঁটু মুড়ে বসে
অবাধ জাগর তাঁর জীবনীর পাশে।
কবিতায় ছুঁই হাত দুটি তাঁর,
আত্মার ঘ্রাণ টেনে নিই নিঃশ্বাসে।
তিনি মৃত তবু জীবিতের চেয়ে
অনেক সজীব এবং কান্তিমান।
ভবিষ্যতের জন্যে হেলায়
দিয়েছেন ছুড়ে আপন বর্তমান।
চোরকুঠরির বাসিন্দা
তার মগজের কোষে মধু নেই ঝরবে যা মৃদু ফোঁটা ফোঁটা
শহরের ঠোঁটে।
পায়ে তার স্পর্শ নেই নক্ষত্রের, দেখামাত্র চমকে ওঠার
মতো নয় কিছু, স্মার্ট সুমসৃণ, রকজ-দুরস্ত
জামা গায়ে, পায়ে চোখা চকচকে জুতো-
প্রফুল্ল পড়শি বলে মনে হবে কিংবা কোনো সুদূর স্বজন।
প্রত্যহ কামায় দাড়ি, বাস স্টপে দাঁড়ায় কখনো,
কখনোবা ঘোরে বাণিজ্যিক এলাকায়, ট্যাক্সি চেপে
হাওয়া খায়, যায় সিনেমায়।
‘এবার শহরে বেশ গোলাপ হয়েছে…ভদ্রলোক
আখের গুছিয়ে নিয়ে ধ্যানস্থ এখন…মাড়ি ফুলে
গেছে ভায়া… মাতাহারি রমণীয় গোয়েন্দা ছিলেন…
সর্দি সারছে না কিছুতেই…
এসব কথার মাছ কেলিরত তারও
মুখের পুকুরে।
কখনো সে স্বপ্ন দ্যাখে-অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে
নিজে নেমে যায় ক্রমে। চোরকুঠরির শীতলতা
মজ্জায় প্রবেশ করে। দরজা, জানালা বন্ধ সবি;
গোলকধাঁধায় ঘোরে, ফ্যাকাশে মুখের
ভিড় চতুর্দিকে।
প’ড়ে যায় ঊর্ণাজালে, যেন সে বিপন্ন
মাছির চেয়েও ক্ষুদ্র, অসহায়। কখনো বিস্তর যাত্রাশেষে
পৌঁছে যায় ভুল ঠিকানায়, কখনোবা
ঘুমায় অস্পষ্ট কৌচে মেদুর চাদর মুড়ি দিয়ে।
তীক্ষ্ণ ছোরা তার বড় শোণিতপিপাসু আর তার
পিস্তল ধোঁয়ায় ঘন ঘন।
অথচ আবার সে-ও টববন্দি রজনীগন্ধার
চোখে রাখ চোখ,
কুকুরছানার মুখে দেয় পেতে সুখে
দুধের পাত্তর।
জাল
খুব কালো জাল পড়েছিল ঠিকই চতুর্দিকে, আমি
আটকা পড়িনি ভাগ্যবলে। বোকা হাবার মতন
বেঁচে আছি অপ্রস্তুত। মৃত্যুর প্রতীক্ষা সর্বক্ষণ
জুড়ে রয় চেতনায়। মৃত্যুর আতঙ্কেরই অনুগামী।
এখনও তো বেঁচে থাকাটাই হাস্যকর ভয়ানক।
কখন যে দৃষ্টি থেকে পৃথিবীর সমস্ত আলোক
মুছে যাবে, দেহ থেকে তাপ। কাকের মতোই চোখ
বন্ধ করে জীবন গচ্ছিত রাখি ফাটলে নিছক।
তুমি অন্তর্হিতা
তুমি অন্তর্হিতা, আমি যেন সেই নিঃসঙ্গ ঘোটক,
রিল্কে যাকে সন্ধ্যায় দেখেছিলেন স্তব্ধ রাশিয়ায়।
তুমি অন্তর্হিতা, আমি মানিকবাবুর হারু, সন্দিগ্ধ শেয়াল
মরা শালিকের বাচ্চা মুখে নিয়ে যাচ্ছে ছপছপ,
কিছুই পাচ্ছি না টের। তুমি অন্তর্হিতা,
ঘরপোড়া মানুষের মতো আমি রৌদ্রবৃষ্টি, বাতাসের কুরুণার পাত্র,
একেবারে আর্ত আর নগ্ন।
শহরের সব রাস্তা, লেন-বাইলেন, কী চিত্তির বিচিত্তির
দোকানপাটের ফুল্ল রঙিন সাইনবোর্ড, যাবতীয় সামগ্রী, পোস্টার,
দিনের ট্রাফিক আর রাতের নিয়নমালা, স্বপ্নের মতন বিজ্ঞাপন
সবাই বলছে সমস্বরে?-
তুমি অন্তর্হিতা।
সমস্ত শহর আমি স্যান্ডেলের আঘাতে আঘাতে
বিক্ষত করছি শুধু, হাঁটছি হাঁটছি সঙ্গীহীন।
যে-লোকটা এইমাত্র আমার পাঞ্জাবি ঘেঁষে গেল,
তাকে দেখে মনে হল (হয়তো বা অকারণ এই মনে-হওয়া)
কখনো রবীন্দ্রনাথ লেখেননি এক ছত্র কবিতা অথবা ঋদ্ধ বড়ে
গোলাম আলীর কণ্ঠে কোনো দিন জ্বলজ্বল করেনি খেয়াল
নানা বর্ণে। যে-মহিলা ধাঁধিয়ে অনেক চোখ গটগট হেঁটে
মোটরে আহ্লাদী এক বেড়ালের মতো
বসলেন, তাঁকে দেখে মনে হলো গর্ভপাতে অতীব নিপুণা।
অন্ন চাই, বস্ত্র চাই বলে এক ঝাঁঝালো মিছিল শহরের
প্রধান সড়ক আলো করে এগোচ্ছে কেবলি;
‘তুমি অন্তর্হিতা’, এক নতুন স্লোগান তুলে সেই
মিছিলে শামিল হতে ভারি ইচ্ছে হল।
পোস্টারে পোস্টারে আর প্রতিটি ব্যানারে দেখলাম,-
বড় বড় রক্তাক্ত অক্ষরে আছে লেখা
তুমি অন্তর্হিতা, তুমি অন্তর্হিতা, তুমি অন্তর্হিতা।
ভাদ্রের আকাশ ছিঁড়ে, মাটি খুঁড়ে ভদ্দর লোকের
শৌখিন বাগানে ঢুকে ফুলের গহন অভ্যন্তরে
দৃষ্টি মেলে, দৃষ্টি মেলে আপেলের ত্বকের ভেতর,
গাছতলা, পুকুরের ঘাটে, সতেজ মাছের পেটে,
শহরের প্রতিটি বাড়ির কড়া নেড়ে,
এরোড্রামে, যে-কোনো মার্কেটে,
সকল ঘুপটি কোণ তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখতে অত্যন্ত
লোভ হল। স্বচক্ষে দেখতে চাই তুমি আছো কি না
অন্তরালে লুকিয়ে কোথাও।
ঘরে ফিরে দেখি বন্ধ দরজায়, খোলা জানালায়,
টেবিলে দেয়ালে আছে লেখা
তুমি অন্তর্হিতা।
সমস্ত রহস্য নিয়ে তার রবরবা রাত্রি এলে
পুরোনো টেবিলে ঝুঁকে খাতার পাতার জনপথে
কখনো হোঁচট খাই, থমকে দাঁড়াই দেখে শত হিজিবিজি।
কবিতা রচনাকালে প্রতিটি পংক্তির ফাঁকে ফাঁকে খামোকাই
কে যেন লিখিয়ে নেয় অবিরত, তুমি অন্তর্হিতা।
আমার বর্বর ক্রোধ উঠোনে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ানো খয়েরি
পোষা হাঁসটাকে
হঠাৎ মারলো ছুড়ে ঢেলা, হাঁস খোঁড়াতে খোঁড়াতে
যেন তীব্র অভিমানে তাকাল আমার দিকে, লুকাল সভয়ে
মর্চে-পড়া টিনের আড়ালে!
পরমুহূর্তেই আমি তাকে খুঁজে নিয়ে
দিলাম ব্যান্ডেজ বেঁধে আর্ত লাল পায়ে,
অথচ আমার ক্ষত র’য়ে যায় অন্তরালে শুশ্রূষাবিহীন।
সে-ক্ষতের প্রতি রক্তবিন্দু ঝরে ঝরে
বলে বারবার-
তুমি অন্তর্হিতা,
তুমি অন্তর্হিতা,
তুমি অন্তর্হিতা…