আমার ভালোবাসা
সমস্ত নৈরাশ্যের গলায় পা রেখ আনিমার প্রতারণায় ভ্রূক্ষেপ না করে
শিরায় শিরায় লক্ষ তারাময় রক্তের দোলায় আন্দোলিত হয়ে আমি বলছি
আমি বলছি লেখার টেবিল ঘরের চৌকাঠ সাক্ষী রেখে বলছি ঘুরঘুট্রি
অন্ধকারে হাজার পিদিম জ্বালিয়ে বলছি এই সময়ের পাঁকে
ফুটুক আমার ভালোবাসা ফুটুক কালো কারাগারের
দেয়াল ফুঁড়ে খুব হল্লা করে বসন্তের কাঁধে
যারা পেতেছে মেশিনগান তাদের হেলমেট
ফুঁড়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক
সিগন্যালে সাইনবোর্ড বস্তির
জীর্ণ চালায় কবরের কাঁচা
মাটিতে হাসপাতালের নিঃশব্দ
ছাদে হাসপাতালের ঝাঁ ঝাঁ রোদ্রে
বিনোদের শব্দে আমার
সূর্যমুখী ভালোবাসা
নবজাতকের মতো
চিৎকার করে
অম্লান ফুটুক ফুটুক ফুটুক ফুটুক ফুটুক ফুটুক
আমার ভালোবাসা সবুজ পাতার মতো গান গায় গান গায় গান গায়
আসুন আমরা আজ
আসুন আমরা শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করি আজ,
আমরা সবাই যারা কেমন দৈবাৎ বেঁচে গেছি;
আসুন আমরা আজ নীরব দাঁড়াই যথারীতি
সকাতর কিছুক্ষণ লক্ষ লক্ষ মৃতের সম্মানে,-
আমাদের বহুকাল এমন দাঁড়াতে হবে বুঝি!
চলুন শামিল হই আজ শোক-মিছিলে সবাই,
পথে মেলি কালো বস্ত্র ‘ভিক্ষা দাও পুরবাসী’ বলে-
শহরে উঠুক বেজে শোকাতুর হারমোনিয়াম।
খোলা ছাদ, কবুতরময় মসজিদের গম্বুজ,
জীর্ণ বাস, গার্বেজের ডাম্প আর পোস্টার, ব্যানার,
নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো, পুরোনো পাঁচিল শোক নয়,
জ্যোৎস্নারাত, ফুটপাত, ডাকবাক্স, পিয়নের খাকি
জামা, নদী-নালা কিংবা পিয়ালের ডাল শোক নয়,
কচুরিপানাও নয়, বাবুইপাখির বাসা, সর্ষেক্ষেত,
নৌকোর নয়ন, ডুরে শাড়ি, অথবা নয়ানজুলি
শোক নয়; শোক জানি বাস্তবিক অবয়বহীন।
তবু শোক হয়ে যায় অকস্মাৎ অনেক কিছুই।
মাঝে-মাঝে মনে হয়, আমার একান্ত ছায়াখানি
শোক হয়ে ব’সে থাকে এক কোনে, পথ হাঁটে আর
হাতের তালুতে বারবার দেখে নেয় জলোচ্ছ্বাসে
কর্দমাক্ত দ্বীপপুঞ্জ, জনপদ, উদগ্র শকুন।
চাদ্দিকে সতেজ ঘ্রাণ কাফনের; অনেক জায়গায়
দাফনের জন্যে কোনো লোক নেই। আমার পকেটে
দুটি মৃত গ্রাম্য শিশু, গলায় ঝুলছে যুব-লাশ,
আঙুলে জড়ানো লজ্জাবতী বিবস্ত্র বধূর চুল।
আমার হৃদয় হয় অগোচরে রুক্ষ মরুভূমি,
যোজন যোজনব্যাপী অতিশয় উদার শ্মশান।
ভোরে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর সংবাদ প’ড়ে
আর ফটোগ্রাফারের একান্ত বাস্তবপ্রীতি দেখে
রেডিওতে কবিতা আবৃত্তি করে ডবকা দুপুরে
পঁয়ত্রিশ টাকার একটি সবুজাভ চেক নিয়ে
সিনেমার বিজ্ঞাপন, নির্বিকার ভিড় দেখে বাড়ি
ফিরি একা প্রতিশ্রুত চকোলেট ছাড়াই উদাস।
খেতে বসি, রাত হলে শুতে যাই, অভ্যাসবশত
নিবিড় জড়াই ক্লান্ত গৃহিণীর নিদ্রাপ্লুত গলা।
অকস্মাৎ খাঁ-খাঁ কাফনের ঘ্রাণে স্বপ্নের মধ্যেই
মেলায় হারিয়ে-যাওয়া বালকের মতো কেঁদে উঠি।
ইলেকট্রিকের তার ছেড়ে
ইলেকট্রিকের তার ছেড়ে গেলে কাক কম্পনের
সৃষ্টি হয়, অতিবর্ষণের পর পথে জমে জল,
কিংবা মিষ্টান্নের ঘ্রাণ পেলে যূথচারী পিপীলিকা
বহুদূর থেকে আসে সম্ভাবনাময় আহরণে,
অথবা পুরোনো কড়িকাঠে প্রজাপতি থাকে সেঁটে
রঙিন কাগজবৎ-এই দৃশ্যাবলির সহিত
তোমার সম্পর্ক আছে? তবুও তো শুধু তোমাকেই
মনে পড়ে, ভেসে ওঠো প্রত্যেকটি প্রত্যঙ্গ সমেত,
তোমাকে ভাবার জন্যে উদ্যমের প্রয়োজন নেই।
গহন রাত্রির পর যেমন ভোরের প্রসন্নতা
আসে অনায়াসে, তুমি তেমনি জেগে ওঠো
বক্ষের একান্ত কক্ষে। আহারের পর হাত ধুয়ে
শোঁকার সময় মৃদু যে-ঘ্রাণ উত্থিত হয়, তারই
অনুরূপ যেন স্মৃতি; কেমন আচ্ছন্ন হয়ে যাই।
অলৌকিক কাউন্টারে গিয়ে চাই একটি টিকিট
হাত পেতে; তুমি থাকো দূরে, আমি ভূতগ্রস্ততায়
ঘুরে মরি দিগ্ধিদিক। আমার জীবনে তুমি আজও
ঠিক হৃৎস্পন্দনের মতোই অপরিহার্য, তুমি।
এক মহিলার ভাবনা
কোনো কোনো মধ্যরাতে কিছু ঘাস, কিছু কালো মাটি
কারুর জীবন্ত অবয়ব হয়ে আমাকে জড়ায়,
মুঠোয় সজোরে ধরে চুল, গালে গাল ঘষে, আমার পাহাড়ে
অরণ্যে উপত্যকায় ঘোরে মাতাল বেঘোর।
একমাত্র মেয়ে
করছে স্বামীর ঘর, ছেলেটা কখন আসে, আবার কখন
ফেরে ঘরে টের পাওয়া দায়। কাছে ধারে কেউ নেই। ‘ওগো’ বলে
ডাকে না এখন কেউ আর। যার সঙ্গে সহবাসে
ছিলাম একান্ত ডুবে বিশটি বছর, হাড় তার
এখন মাটির নিচে ভয়ানক ধবধবে হয়ে গেছে বুঝি
আমার শাড়ির মতো। হায়, যদি পারতাম হতে
লাশবাহী ভেলার বেহুলা!
শয্যায় লাগে না পিঠ কোনো কোনো রাতে,
কখনো বুলোই চোখ বইয়ের পাতায়, জানালার বাইরে তাকাই,
কখনো ফ্লাওয়ার-ভাসে রাখি গাল, কখনো মরুর
মতো সরু বারান্দায় করি পায়চারি, অঙ্গে অঙ্গে
জ্বলে যে অঙ্গার তার দাহ নিরীহ করার ছলে
নির্জন স্নানের ঘরে যাই বার বার। দেয়ালের
ছবিটার দিকে রাখি উষ্ণ দৃষ্টি, আমার স্বামীর
ফটোগ্রাফ কী শীতল, কী সুদূর; এইমাত্র সবুজ পোকার
লোভে বালিরঙ টিকটিক ওঁর প্রজাপতি-গোঁফ ছুঁয়ে গেল।
এ নীরন্ধ্র ঘরে আমি উঠি বসি বসি উঠি, কখনো দাঁড়াই,
কখনো এলিয়ে পড়ি কৌচে, বয়সকে বড় বেশি ঘেন্না করি,
যেমন বিক্ষুব্ধ চাঁদ সদাগর মনসাকে। এ ঘরের অন্ধকার
অথবা বাল্বের অত্যধিক আঁচ-দেয়া দুধের মতন আলো
পারে না কি হতে মানবিক?
সে কেন আমার পুত্র আসে না আমার কাছে, কেন
রাখে না সবল হাত, মুখ তার আমার যুগল থরোথরো
ঊরুর সোফায়? কেন উদ্বেল আমার স্তন তার
মুঠোয় দেয় না ঢেকে, ঢাকত যেমন
শৈশবে আমার পাশে শুয়ে, আমি গাঢ় ঘুমোতাম!