খুঁজি ক্ষুব্ধ অনুরাগে
স্বদেশে এসেছি ফিরে অবসন্ন আট দিন পর
আপন শহরে আজ। যতটা আনন্দ পাবো বলে
সম্যক ধারণা ছিল, বিমান বন্দর থেকে দলে
বলে স্মিত বেরিয়ে এসেই মন লাশকাটা ঘর!
এ কেমন শহর দেখছি অপরাহ্নে? যেন ঝড়
মুড়িয়ে ফেলেছে একে, রেখে গ্যাছে ধ্বংস চিহ্নগুলি
ইতস্তত। নিসর্গ বিষাদগ্রস্ত; শ্যামা, বুলবুলি
কারো কণ্ঠে গান নেই, ফুটপাথ বিমর্ষ, ধূসর।
ফের গৃহপ্রবেশের পরেও খুশির কোনো ঢেউ
হৃদয়ে করে না খেলা। সব কিছু ছায়াচ্ছন্ন লাগে,
রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা মাংস, সব্জির ঘ্রাণ
আকর্ষণহীন আর বই, কবিতার খাতা, কেউ
টানে না তেমন, কাকে যেন খুঁজি ক্ষুব্ধ অনুরাগে
চৌদিকে; কুয়াশা ঘন হয়, অশ্রুপাত করে প্রাণ।
২০.২.৯৬
গদ্য সনেট: ১
ক’দিক সামলাবো আর? একটি মাত্রই ঘর, তা-ও আবার
গর্ত ফোকরময়; এদিক থেকে গন্ধমূষিক,
ওদিক থেকে ঢোকে ইঁদুর। নড়বড়ে ঘরের ছাদ ভাঙা,-
পূর্ণিমা-রাতে মেঝেতে জ্যোৎস্নার আলপনা
আর বর্ষার দিনে ঘর থৈ থৈ বিল, থালাবাসন
ভাসে পানিতে। এই ঘর নিয়ে কী আর করি? এ গর্তের
মুখ বন্ধ করতে উদ্যোগী হই তো সেই ফোকর
জলহস্তীর মুখের হাঁ। জংধরা আঙটায় ঝুলে থাকে বাদুড়।
একটি মাত্র ঘরে হাওয়ার ঝাপ্টা সয়ে দু’টি পিদিম
টিম টিম জ্বলছে রুক্ষ আন্ধারে, কখন যে
দপ করে নিভে যাবে, জানি না। মাঝে-মাঝে
লক্ষ্মীছাড়া ঘরটা রক্তবমনে হয়ে ওঠে
অপ্রতিরোধ্য। গৌরী, তুমি বেহাল আমাকে শক্ত হাতে হাল
ধরতে বলো; আমি যে আর ভাঙা নাও বাইতে পারি না।
২৩.২.৯৬
গদ্য সনেট: ১০
সেদিন পথে যেতে বিরানায় চোখে পড়ল
এক ধ্বংসস্তূপ তার ক্ষয়াটে শোকগ্রস্ত
অস্তিত্ব ঘোষণা করছে নিস্তব্ধ দীর্ঘশ্বাস
এবং হাহাকার ছড়িয়ে। তার বুকে
গুচ্ছের বুনো ঘাসের দাপট।
হঠাৎ কোথা থেকে একটি শঙ্খচিল
উড়ে এসে বসলো সেই ধ্বংসস্তূপে, ওর চোখের
তীক্ষ্ণতায় সংগ্রামী মানুষের অদম্য জেদ।
ঘরে ফিরে এসেও দৃষ্টিতে ভেসে উঠছিল
ধ্বংসস্তূপটির ছন্নছাড়া চেহারা, বুঝিরা আমার
বিগত জীবন আর সেদিনই যখন তুমি বললে, ‘তোমাকে
ভালোবাসি, ভালোবাসি যে, তক্ষুণি দেখলাম, ধ্বংসস্তূপে
অজস্র ফুলের বাহার আর একটি রামধুন নিবিড়
আলিঙ্গনরত, যেন খাজুরাহোর মিথুনমূর্তির বিমূর্ত রূপ।
১৬.৩.৯৬
গদ্য সনেট: ১১
একটা লোক নিয়মিত আমার বাড়ির দিকে
আড়চোখে খানিক তাকিয়ে রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে
খোলা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। অবাক কাণ্ড,
সে যখন যায়, তখন গলিতে কাছে ধারে
কাউকে আমি দেখি না; এমন জনশূন্যতা রোজ কী করে হয়,
ভেবে পাই না। লোকটার হাতে কিংবা ঠোঁটে জ্বলন্ত
সিগারেট দেখিনি কোনোদিন; মৃদু হাসির রেখাও
ফোটেনি মুখে কখনো, শুধু পাথুরে কাঠিন্যের প্রাধান্য।
লোকটা আমার বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে,
যখন আমি যে কাজই করি-চুপচাপ বসে থাকি, বইয়ের
পাতা ওল্টাই, চিঠি লিখি, কবিতার খসড়া তৈরি করি,
অথবা চা খাই, আমার গায়ে কাঁটা দেয়,
হাত-পা কেন জানি হিম হয়ে আসে, চোখের পিদিম নিভে যেতে চায়;
লোকটা যেদিন এ-পথে হাঁটবে না, সেদিন আমি থাকব না।
১৫.৪.৯৬
গদ্য সনেট: ১২
হায়রে মন, না জেনে আমি, আপন খবর
তালাশ করি চেতন গুরু; আন্ধারে হোঁচট খেতে-খেতে
জনমভর দেখলাম না লালনেরে। হঠাৎ
কীসের ঝলক দিলো দিলে, শুনি গাঢ় মেঘের
আড়াল থেকে লালন কয়, ‘পাঠাস নাই তুই আমার
নামে পত্র কোনো; অনেককাল হেলার কাদায়
রেখেছিস ফেলে। কোতায় পাবো অচিন ডাকটিকিট?
কোথায় তেমন নীল ডাকরাক্স? কোথায় আপনি সাঁই?
দোতারায় আলো-কুসুম ফুটিয়ে লালন
বলেন উদাস কণ্ঠস্বরে, ‘ফোটাতে চাস আনন্দকুসুম
শূন্য ডালে? তবে কেন একলা এলি আমার সন্ধানে জেল্লা-অলা
পোশাক পরে? হৃদয়রতন কোথায় রেখে এসেছিস কোন্
ঝরা পাতাদের কবরে? গৌরীকে ফেলে এসে সামান্যে
তারার হাটে, ওরে ক্ষ্যাপা, তুই অসামান্যের সুর বাজাবি?’
১৫.৪.৯৬
গদ্য সনেট: ১৩
অনেক কাল আগেকার দিঘিটা নিঝুম ঘুমোচ্ছে, লাল
শাপলা ফুলদের স্বপ্নের নানা স্তরে
ভেসে-যাওয়া। পাশের ঘন পাতাময় গাছের
তন্দ্রাচ্ছন্নতা চিরে বেজে ওঠে দোয়েলের মেদুর শিস।
আড়মোড়া ভাঙে প্রাচীন দিঘি, শাপলা
ফুলগুলোর চোখে আঠা ধুয়ে যায় শিশিরে; গাছতলায়
গেরুয়া আলখাল্লা-পরা বাউল মেঘের দিকে
তাকিয়ে দোতারায় অলীক ভোরের সুর জাগায়।
গ্রাম্যবধূ এদিক ওদিক তাকিয়ে যৌবনকে
দিঘির জলে ভাসায়। ভোরের টাটকা রোদ ওর ভেজা
যৌবনকে চুমোয় চুমোয় রক্তিম করে; বাউলের গান স্নানার্থিনীর
শরীরে পিছলে যেতে থাকে, খয়েরি বাছুর ঢুঁ মারে শাদা গাভীর ওলানে,
কৃশকায় চাষি লাঙল কাঁধে আলে হেঁটে যায়, দিঘির ধার ঘেঁষে
সাইকেল চালিয়ে মাঠে যাচ্ছেন এনজিও মহিলা কর্মী।
১৫.৪.৯৬
গদ্য সনেট: ১৪
সে-রাতে তোমার বাড়িতে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে
আমিও ছিলাম একজন, ঈষৎ দূরত্ব আর নৈকট্যের
নানা কোণ থেকে তোমাকে দেখে আমি আতশবাজি, সরোদের ঝংকার।
তখন মুক্ত কণ্ঠে বলতেই তো পারতাম,
তোমার সৌন্দর্যধারায় স্নাত আমি,
বলতেই তো পারতাম, তোমার কথার লাবণ্যে
আমার হৃদয়ে ফুটছে নানা রঙের ফুল, অথচ
আমার মুখ ছিল যেন কুলুপ-আটা।
মগজে জ্যোৎস্না পুরো সোফায় নিশ্চুপ বসেছিলাম এক কোণে;
কখনো স্যান্ডেলিয়ারের দিকে, কখনো
দেয়ালের বিমূর্ত পেন্টিং-এর দিকে তাকিয়ে তোমার সঙ্গে
কথা বলার প্রবল ইচ্ছের মুখ সেলাই করে রেখেছিলাম আর
সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, কোনো নিষাদ কোকিলের কণ্ঠে
তীর বিদ্ধ করলে গায়ক পাখিও হয়ে যায় রক্তাক্ত, মুক।
১৭.৮.৯৬