কান্না
আমারই কাঁটার ঘায়ে গৌরী তুমি কেঁদেছ সে-রাতে
নিজেকে অকূল নদী করে; সে কান্নার রুদ্ধ জল
অকস্মাৎ রাত্রির হৃদয় জুড়ে করে ছল ছল,
স্তব্ধতা ছাপিয়ে ওঠে, মিশে যায় তিমির-প্রপাতে।
আমি নিজে নিরন্তর অন্তরের নির্দয় সংঘাতে
বিপর্যস্ত, নিজেকেই ছিঁড়ি-খুঁড়ি, তোমাকেও কষ্ট
দিই খুব জানি না কিসের জন্যে। হায়, আমি নষ্ট,
বিবেচনাহীন লোক, অহেতুক যে ভাঙনে মাতে।
যখন তোমার বুক চিরে অসিত পাথর-চাপা
কান্নার দুর্বার জল নিমেষে বেরিয়ে পড়ে আর
তুমি থর কাঁপো অন্তর্গত শীতে, অসহায়
লাগে বড়ো নিজেকে তখন; আজ কোনো লুকোছাপা
নয়, সরাসরি বলা যাক-আমাদের মনোভার
ঘুচে যাবে, গৌরী শোনো, আহত পাখিও গান গায়!
৫.৭.৯৬
কারো দণ্ডে
কারো দণ্ডে দেশান্তরী হইনি, তবুও মনে হয়
সর্বক্ষণ নির্বাসনে আছি। কোথাও দেখি না কোনো
চেনা মুখ; যাদের কাছের লোক বলে জানতাম
এতকাল, তারাও কেমন অচেনার আবরণে
উপস্থিত হয় পথে। এখন ব্যাপক অগ্নিঝড়
পাড়ায় পাড়ায়, কী সহজে দিনের আলোয় দিব্যি
খুন হয় আদম-সন্তান আর রক্ষক ভক্ষক
হয়ে যায় মসনদে খুব জেঁকে বসবার মোহে।
এরকম ডামাডোলে, উৎপীড়নে, ধোঁয়ায়, লাঠির,
বন্দুকের কর্কশ চিৎকারে ত্রস্ত দিনরাত এই
কসাইখানাকে আজ কী করে স্বদেশ বলে ভাবি?
প্রিয়তমা, এখন তুমিও নেই এ শহরে, সব
স্থানে অমাবস্যা ছেয়ে আছে, এই দিশেহারা কবি
নির্বাসিত জনের বেদনা বয়ে একা, জীবন্মৃত।
১১.২.৯৬
কিছু ঘুড়ি
আকাশে ওড়াই ঘুড়ি নানা রঙের ধাঁচের প্রায়
প্রতিদিন অনুরাগে; ওরা কোথায় যে চলে যায়
পরিযায়ী পাখিদের মতো, কোনো সন্ধান রাখি না
স্বভাববশত। একজন প্রবীণ সমাজতত্ত্ববিদ
অধ্যাপক হেঁটে যেতে যেতে ভাবেন আমাকে দেখে-
কী অবাক কাণ্ড, লোকটা এ বয়সেও এই মতো
ছেলেখেলা নিয়ে মেতে আছে সারাবেলা আর ক’টি
যুবকও আঠার মতো দিব্বি তার সঙ্গে আছে লেগে।
কখনো দিই না কান কারো কোনো মন্তব্যে, কেবল
ঔদাস্যের ভেলা বেয়ে চলি। গুণীজন লিপ্ত নানা
সমাজ-কাঁপানো কাজে, এই ব্যর্থ অকর্মণ্য আমি
নিজস্ব খেলায় মগ্ন। কখনো জ্বরের ঘোরে দেখি,
ইতস্তত পড়ে-থাকা আমার নির্মিত কিছু ঘুড়ি
মাঘের জ্যোৎস্নায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে আগামীর কবি।
৬.২.৯৭
কী করে বোঝাবো?
কত না জায়গায় চলে যাই, কত বেগানা শহরে,
শহরতলীতে ঘুরি, অথচ যাই না দীর্ঘকাল
পিতৃপুরুষের গ্রামে। সেখানে ঘুমন্ত পিতামহ,
মাতামহ এবং আমার পিতা, স্বল্পায়ু আত্মজ,
আরো অনেকেই পারিবারিক কবরস্থানে। ভাবি,
কবরের স্তব্ধতাকে প্রায়শই ঈষৎ বিব্রত
করে ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর আন্ধারকে বুঝি চম্কিয়ে
দেয় জোনাকির দল, ঘাসগুলো দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে।
কোনো কোনো মধ্যরাতে মনে হয়, দূর থেকে ভেসে
আসে গাঢ় কণ্ঠস্বর, ‘আমার কেমন পুত্র তুই
এখানে আমার পাশে দাঁড়াবার সময় হয় না
তোর?’ আর একটি সবুজ জলমগ্ন কণ্ঠ ‘বাবা’
বলে থেমে যায় অভিমানে। আমি এই নাগরিক
জীবনঘানিতে বাঁধা দিনরাত, কী করে বোঝাবো?
৪.২.৯৭
কেবলি তলিয়ে যাচ্ছি
মনে হয়, কেবলি তলিয়ে যাচ্ছি কূলকিনারার
পাচ্ছি না সন্ধান, কাছে ধারে খড়কুটো তা-ও চোখে
পড়ছে না কিছতেই। এ কেমন ঘূর্ণি টেনে নিতে
চায় শুধু বুভুক্ষু অতলে? কে আমাকে ভুল পথে এনে
ফেলেছে এমন দুর্বিপাকে? সঙ্কট কখনো আসে
ভয়ঙ্কর রূপে, কখনোবা খুব মোহনীয় বেশে
অকস্মাৎ; আখেরে পরমা এল ভেবে অনুরাগে
ক্লান্ত গোধূলিতে কুহকিনীকেই করি আলিঙ্গন।
ক্রূর কত জলজ প্রাণীর কোলাহলে সারাক্ষণ
হাবুডুবু খাচ্ছি, তবু সবাই নিষ্পৃহ অতিশয়;
এখন আমার দিকে এমন কি মায়াময়ী সে-ও
বাড়িয়ে দেয় না হাত। কী এক দহনে দগ্ধ হয়ে
নিজের প্রকৃত রূপ অন্তরালে রেখে প্রতিশোধ
নিচ্ছে আজ আমার ওপর নাকি নিজেরই উপর?
৫.২.৯৭
কোকিলের ডাক
বহুদিন পর আজ কোকিলের ডাক শুনলাম
বন্ধুর সৌজন্যে টেলিফোনে কথা বলার সময়।
তার রিসিভার থেকে আচানক মাদকতাময়
কুহু কুহু স্বর এলো ভেসে কানে, যেন শূন্য জাম
ভরে ওঠে সাকীর সুরায়, আমি ওমর খৈয়াম
যেন, বুঁদ হয়ে যাই। শ্যামলীতে কখনো শুনিনি
কোকিলের ডাক, অন্য পাখিদের কাছে আমি ঋণী
সর্বদাই, যেহেতু এখানে ওরা আসে ছিমছাম।
নিঃসঙ্গ কোকিল কী ব্যাকুল ডাকে সন্ত্রস্ত শহরে
বারবার। কাকে ডাকে? কাকে তার খুব প্রয়োজন
এ মুহূর্তে ভূতুড়ে দুপুরে? আমার ভেতরকার
একজন তারই মতো ডেকে যাচ্ছে প্রতিটি প্রহরে
অন্তরতমাকে। এ ভয়ার্ত নগরকে, বলে মন-
সুন্দর করেনি ত্যাগ, যতই বাড়ুক অন্ধকার।
১৮.৩.৯৬
ক্ষ্যাপার মতোই ঘুরি
এখন প্রত্যূষ, ফিকে অন্ধকার, হৃদয়ে শ্রাবণ
অবিরাম; বসে আছি, নির্ঘুম কেটেছে সারারাত,
দু’চোখে মরিচ-গুঁড়ো, এই প্রভাতী হাওয়ার হাত
বুলোয় প্রলেপ কিছু, তবু শুধু হু হু করে মন।
যে আমার স্থৈর্য, নিদ্রা অগোচরে করেছে হরণ,
তাকেই সঁপেছি মনপ্রাণ, তারই উদ্দেশে কবিতা
লিখি নিত্য ভূতগ্রস্ততায়; সে-যে প্রজ্ঞাপারমিতা
কষ্ট দেয়, তবু তারই কাছে চাই সর্বদা শরণ।
ক্ষ্যাপার মতোই ঘুরি ফুটপাতে, পার্কে নদীতীরে
তার টানে, যে আমাকে হাতছানি দেয় বারবার।
আমিতো মুখশ্রী তার খুঁজে ফিরি এই ঘেমো ভিড়ে,
কখনো মাতাল ক্লাবে, কখনো সিঁড়িতে সিনেমার
ক্লান্তিতে ভীষণ ডুবে। দেখা দিয়ে চকিতে মিলায়,
আমি অসহায় একা; শুয়ে আছে সে তার ভিলায়।
৩০.৭.৯৬