কবির জীবন
কবির জীবন নয় পুষ্পছাওয়া পথ, পেরেকের
মতো কাঁটা সর্বত্র ছড়ানো, এমনকি অগ্নিময়
পথ অতিক্রম করে তাকে বহুদূর যেতে হয়
বিপদের সঙ্গে লড়ে, অন্তহীন কায়ক্লেশ, ঢের
মনোকষ্ট সয়ে, সাপ ফুঁসে ওঠে গহন বনের
ছায়াচ্ছন্ন ছমছমে পথে আর ক্ষণে ক্ষণে ভয়
সমুখে হাজির হয় নানা রূপে। এ বিপত্তি জয়
করতে ব্যর্থ হলে তাকে টেনে নেবে কালি পাতালের।
এঁদো ডোবা প্রায় ফুসফুস, মেটে রঙ কফ, জ্বর,
উচ্চ রক্তচাপ, স্মৃতিবিভ্রম ইত্যাদি নিয়ে কবি
খাতাকে পরাবে রত্নহার বারবার, এ প্রত্যাশা
অনেকের; ব্যর্থ হোক সব নিন্দুকের বাক্যঝড়
উপেক্ষায়, প্রশংসায় নির্বিকার আঁকবে সে ছবি,
অর্ফিউস-এর ছিন্ন মস্তকের গান হবে ভাষা।
২.৫.৯৬
কলঙ্ক
কেন তুমি এত দেরি করছ বলো তো? পরদেশ
থেকে কোনো টেলিগ্রাম কিংবা এক টুকরো চিঠি তুমি
পাঠাওনি, পাইনি তোমার টেলিফোন, মনোভূমি
বড়োই তৃষিত, রুক্ষ, কিন্তু আমি পুষি না বিদ্বেষ।
রুগ্ন ফুসফুস আর কতটা টানবে দীর্ঘশ্বাস
এতদিন? ডিপ্রেশনে কাতর সম্প্রতি; চাতকের
মতো চেয়ে থাকি প্রতিক্ষণ, কাটে না যে বিরহের
দিনরাত্রি, পরদেশে ভালো আছো, আমার বিশ্বাস।
তোমার ফেরার আগে যদি আয়ু ফুরায় আমার
তা হলে কী হবে গৌরী? অনুশোচনার ক্লান্ত ভেলা
ভিড়বে সে কোন্ ঘাটে? যাক ভাবতাম কবিতার
কবুতর উড়িয়ে তোমাকে আগে ভাগে ভোরবেলা
আনতে পারবো ঠিক এ শহরে। ব্যর্থতার গাঢ়
কলঙ্ক বইছি কবি রূপে, দেরি করো যত পারো।
২২.২.৯৬
কাঁদতে পারি না
‘এমন বিমর্ষ কেন তুমি’, আমাকে সওয়াল করে
আমার ঘরের বাতি। জানলার পর্দা কাঁপা কাঁপা
স্বরে প্রশ্ন করে, ‘কবি তোমার নিষ্প্রভ চোখ দু’টি
এমন কাতর কেন আজ?’ বারান্দার বুলবুলি
বলে, ‘কোন্ কাঁটা এসে তোমার হৃদয় অবেলায়
এমন জখম করে?’ ফ্লাওয়ার ভাসের ফুলগুলি
প্রশ্নাকুল, ‘কোন্ কীট তোমার অন্তর কুরে কুরে
খাচ্ছে আজ? আমার লেখার খাতা বড়ই নিশ্চুপ।
এসব প্রশ্নের আমি কী দেবো জবাব? বলব কি
একজন নারী, যে আমার দয়িতা, না বুঝে এই
ছন্নছাড়া বেঢপ আমাকে নিজে খুব কষ্ট পেয়ে
যন্ত্রণার ক্রূর তটে করেছে নিক্ষেপ তার প্রিয়
কবিকে? বিষণ্ন কেন আমি আজ নিজেই বুঝি না;
বুক ঠেলে কান্না আসতে চায়, কিন্তু কাঁদতে পারি না।
৪.২.৯৬
কাক কাহিনী
একজন কাকের কাহিনী এ শহরে অনেকেই
জানে, গাঁও গেরামেও তার কিছু পরিচিতি আছে
বলে শুনি একদা প্রভাবশালী এই কাক খুব
সাধ করে একটি কোকিল হতে চেয়েছিল, ফলে
চাতুর্য শানিয়ে বোকা বানিয়ে গায়ক পাখিদের
সহজে তাদের ঝানু পুরোহিত সেজে গেলো আর
তার তাঁবেদারি করবার কোকিলের অনটন
হলো না কোথাও, দেখি তার জমজমাট প্রসার।
অথচ কাকের খাসলত আগের মতোই থাকে
নোংরা ঘাঁটে, আঁস্তাকুড়ে ঘোরে দিনরাত
ভীষণ কর্কশ ডাকে যথারীতি; প্রতিপত্তি কমে
যাওয়ার দরুণ আজ কোকিল, দোয়েল শ্যামা পাখি,-
যাকে পায় তাকেই ঠোকর মারে তীব্র হিংস্রতায়;
তবুও হয় না বন্ধ সুরমও পাখিদের গান।
কাকে ভালোবাসবে
আমার ভেতরে করে বসবাস অচিন মানব
একজন; আহার্য, পানীয় কোনো কিছু তার কাছে
মোটেই জরুরি নয়। বড়ো নিরালায় থাকে, নাচে
মাঝে-মধ্যে, সুর ভাঁজে অন্তরালে, কখনো-বা শব
সাধনায় মেতে ওঠে। অকস্মাৎ করে কলরব,
শূন্যে ছোঁড়ে প্রাচীন করোটি, তার শীর্ণ দুটি হাতে
সাপ ক্রীড়ামগ্ন আর নির্জন নিথর মধ্যরাতে
ঠোঁটে তার ঘন ঘন স্পন্দমান তন্ত্রের উৎসব।
যে-আমি স্নানের পরে চুলে সিঁথি কাটি, দাঁত ব্রাশ
করি ভোরে, রাতে ঘুমোবার আগে, বই পড়ি, হেসে
কথা বলি অতিথির সঙ্গে, সাহিত্য সভায় যাই,
তোমার উদ্দেশে গড়ি তারাচূর্ণ শব্দ, যে সন্ত্রাস
শাসক ছড়ায় দেশে, তাকে তীব্র ধিক্কার জানাই-
এ-আমিকে না কি সেই তান্ত্রিককে যাবে ভালোবেসে?
১৩.৩.৯৬
কাজ
তুমি কি কলেজ স্ট্রিটে ঘুরছ এখন? নাকি নিউ
মার্কেটে করছ বেশ কেনাকাটা প্রিয় বান্ধবীর
সঙ্গে ঘুরে ঘুরে খর রোদে? কলকাতায় বড়ো ভিড়,
তোমার কি ভালো লাগে দম আটকানো কোনো ভিউ?
এই যে এখানে তুমি নেই, এখন আমার কাছে
চিরচেনা এ শহর বড়ো জনশূন্য নিষ্প্রদীপ
মনে হয়, যেন ঢাকা আজ পরেনি কপালে টিপ
শোকে; ফুল নয়, অশ্রুবিন্দু ফুটে আছে সব গাছে।
কোথাও যাবার নেই; সময় পাথর হয়ে চেপে
আছে বুকে, মাকড়সা জাল বোনে দু’চোখে আমার
ক্রমাগত, প্রায় ধৃতরাষ্ট্র হওয়ার আশঙ্কা আজ
তোমার অভাবে। খবরের কাগজে হৃদয় ছেপে
তোমারই বন্দনা গাই; এলো বুঝি পাতালে নামার
সময়, তোমার প্রতীক্ষায় মগ্ন থাকাটাই কাজ।
১০.৩.৯৬
কাঠের ঘোড়া
এ বয়সে একটি কাঠের ঘোড়া স্বপ্নের ভেতরে
নিরিবিলি চলে আসে। চমৎকার এই খেলনার
কাছে বেশ কিছু শিক্ষণীয় আছে, সে বাংলা ভাষার
দেহে স্বপ্নগুঁড়ো ছড়াবার পর রীতির শেকড়ে
দেয় টান; ছিঁড়ে ফেলে প্রথার নির্মোক মত্ত ঝড়ে
নিরালম্ব যুক্তিহীনতায় ফুল্ল স্বেচ্ছাচারিতার
দীপ জ্বালে এলোমেলো। নানাবিধ বস্তুর আঁধার
হননের পর ক্রীড়াপ্রিয় ভাষা অন্য পথ ধরে।
স্বপ্নাশ্রিত কাঠের ঘোড়াটি ভাঙচুর সমর্থন
করে আর দৃষ্টি তার নিবদ্ধ উত্তর-আধুনিক
শিল্পের দিকেই আর রূপকল্পে আনে আলোড়ন।
অভিনব এবং খরার পরে সবুজের বানে
ভেসে যাই; অতঃপর হেলেনের চেয়েও অধিক
মহুয়ার রূপের কদর হয় গাথা আর গানে।
২৮.৭.৯৬