সুফীরা বলেন
আমার কাটে না দিন, কাটে না যে রাত, প্রিয়তমা,
তোমার বিহনে আর। আকাশের মেঘ,
গাছের পাতায় রোদে, অন্ধকারে, পূর্ণিমায়, শ্রাবণ
ধারায়,
নির্দয় খরায়, ঝিলে, পাখির স্বপ্নিল চোখে, রুক্ষ
পাথরে, ঝর্ণায় আর হরিণের চিত্রল শরীরে
তোমাকেই খুঁজি নিশিদিন। বস্তুত তোমারই শুদ্ধ ধ্যানে
রোজ
বেলা ব’য়ে যায়
আমাকে ক্ষতার্ত ক’রে। ব’সে থাকি অসহায়, একা।
কখনো যখন কবিতার খাতা খুলে বসি অতি
সঙ্গোপনে, তুমি অক্ষরের
অনিন্দ্য প্রতিমা হ’য়ে দাঁড়াও পাতায়। তোমাকেই
সারাক্ষণ দেখার আশায় থাকি এই
বিরূপ শহরে পায়ে ফোস্কা নিয়ে, ধূসর মাথায়
কাঁটার মুকুট প’রে। তবু যদি তুমি
বোধাতীত অভিমানে, ক্ষোভে নিজে খুব
দগ্ধ হয়ে আমাকে পোড়াও, তবে আমি
অনিন্দ্রপীড়িত এই মাথা কার জানু কিংবা বুকে
রেখে স্নিগ্ধ বাগানের ঘ্রাণ পাবো, বলো?
প্রিয়তমা, হয়ো না বিমুখ, একবার
এসে দেখে যাও আজ তোমার ইস্কের আতশের
কুণ্ডলীতে আমার যা হাল,
একেই তো সুফীরা বলেন জানি ফানা হ’য়ে যাওয়া।
১০/১১/৯৫
সে-রাতে নতুন ক’রে
অকস্মাৎ সে-রাতে নতুন ক’রে পেলাম তোমাকে
হৃদয়ের খুব কাছে। প্রত্যাশা ছিল না,
তবু আমার ঘাটে ভিড়ল আশ্চর্য তরী এক
অপরূপ সম্ভার সমেত। শুধু বিস্ময়ে তাকাই নিষ্পলক
সারাক্ষণ, ফেরাতে পারি না দৃষ্টি কিছুতেই। তুমি,
তরণীর পরম ঐশ্বর্য, নেমে এলে ধীর,
গৌর পদক্ষেপে।
কখন যে আমার পায়ের কাছে এসে বসলে সবার
অগোচরে, স্বপ্নবিষ্ট আমি
খেয়ালই করিনি; দেখি আমার উরুতে
স্থাপিত তোমার মুখ। তোমার অতল চোখ দু’টি
কখনো আংশিক খোলা, কখনো নিবিড় নিমীলিত।
মাঝে মাঝে
চোখ মেলে দেখছ আমাকে, যেন খোদ ভালোবাসা
তাকাচ্ছে আমার দিকে সম্পূর্ণ নতুন ক’রে গাঢ়
অনুরাগে, আমার দু’ হাতে
তোমার অতুলনীয় মুখ, বুঝি কোনো শায়েরের
অঞ্জলিতে অনুপম প্রস্ফুটিত রূঁপসী গজল।
আকাশে ছিল কি চাঁদ? সপ্তর্ষিমগুল?
বলতো কী ক’রে বলি? আমি তো তোমাকে ছাড়া আর
কিছুই দেখি নি স্পষ্ট ভেতরে বাহিরে।
সৌন্দর্যের কসম, তোমাকে
এর আগে এমন সুন্দর আমি কখনো দেখি নি,
যদিও সৌন্দর্যে লগ্ন আমার সমুখে দাঁড়িয়েছ,
বসেছ ঘনিষ্ট হয়ে বহুদিন, বহু
মুহূর্ত কেটেছে আমাদের আলিঙ্গনে, ওষ্ঠের নিলনে।
১৪/১১/৯৫
স্বল্পভাষী
সেদিন দুপুরে বিদেশে যাবার আগে
প্রায় নিজে যেচে গেলাম তোমার বাড়ি।
বারান্দা থেকে আমাকে দেখেই তুমি
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলে তাড়াতাড়ি।
‘কেমন আছেন? এখানে বসুন এই
সোফাটায়, কী-যে ভালো দুপুরটা আজ।
কী দেবো এখন? দেবো কি ঠাণ্ডা কিছু?
‘কিছুই খাবো না। বাড়বে তোমার কাজ।‘
আমার তুচ্ছ কথায় কান দিয়ে
নিয়ে এলে কিছু খাদ্য এবং দামি
বীয়ারের ক্যান। জীবনের মতো ক্যান
নিমেষে ফুরোলো, ঈষৎ হেসেই থামি।
‘কেন যে আপনি বলেন না কিছু?
কত লোক শুনি কথা বলে রাশি রাশি
অথচ আপনি নিজের মধ্যে ডুবে
থাকেন শুধুই, আপনি স্বল্পভাষী।‘
আমিও নীরবে মেনে নিই অপবাদ।
‘অমন আপনি আপনি কর যে তুমি
তা হ’লে কী ক’রে ফুটবে কথার ফুল?
কীভাবে ভরবে সুরভিতে মনোভূমি?
হাতে হাত রেখে বললে মধুর স্বরে,
‘সহজে আসে না ছোট্র এ তুমি, মাফ
ক’রে দাও, আর কখনো হবে না ভুল।
পেয়ে যাই তার হৃদয়ের উত্তাপ।
বলি তার কানে ‘রোজ এই অভাজন
ব্যাকুল বাজায় তোমার নামের বাঁশি
মাটিতে আকাশে সকল সময়, তবু
আমাকেই তুমি বলবে স্বল্পভাষী?’
১/৩/৯৫
হ্যাঁ গৌরী, তোমাকেই
হ্যাঁ গৌরী, তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
তোমাকে ভালো না বেসে পারা যায় না,
তোমাকে ভালো না বেসে বাঁচা অসম্ভব।
আমার প্রতি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে
তোমার বসতি।
কী ক’রে আমি পথ হাঁটবো, আকাশের দিকে
দৃষ্টি মেলে দেবো সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্ত দেখার জন্যে,
কী ক’রে আমি আঁজলায় ভরে নেবো শান্তির জলধারা,
কী ক’রে আমি কবিতা লিখবো
তোমাকে ভালো না বেসে?
হ্যাঁ, গৌরী, তোমাকে ছাড়া আমার জীবন
অচল মুদ্রা বৈ তো নয়।
হ্যাঁ, গৌরী, তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
সুন্দরবনের আরণ্যক শোভার শপথ,
গারো পাহাড়ের আর্ত নিস্তব্ধতার শপথ,
উত্তরবঙ্গের রাঙামাটির পথের শপথ,
পার্বত্য চট্রগ্রামের পাকদন্ডি, ঝর্ণা আর
পাহাড়ি যুবার অপার বেদনার শপথ,
মেঘনার অজস্র ঢেউয়ের শপথ,
পদ্মার ঝলসে ওঠা চকচকে ইলিশের শপথ,
পরিযায়ী পাখিদের অনলস রঙিন ডানার শপথ,
তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
হ্যাঁ গৌরী, তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
মসজিদের কবুতরময় গম্বুজ আর উঁচু মিনারের শপথ,
মন্দিরের সন্ধ্যাপ্রদীপ আর ঘন্টাধ্বনির শপথ,
নির্জার আইকনের, অর্গানের প্রার্থনা-মন্দ্রিত সঙ্গীতের শপথ,
বৌদ্ধ বিহারের নিরলঙ্কার সৌম্য কান্তির শপথ,
তোমাকে, হ্যাঁ শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
নীল পদ্মের উন্মীলন, সরোবরের জ্যোৎস্নাঝলসিত আহ্বান,
হরিণের চোখের মায়া, উদাস দুপুরে ঘুঘুর ডাক,
সন্ধ্যামগ্ন ঝোপঝাড়ে জোনাকির জ্বলে-ওঠা আর নিভে যাওয়া,
সাঁঝ-লাগা গাঁয়ের পথে রাখালের ঘরে ফেরা,
ঘাটে-ভেড়া নৌকার মৃদু আলো আর
নূর হোসেন স্কোয়ারের জাগরণের শপথ,
অপশাসন-বিরোধী প্রতিবাদী মিছিলের শপথ,
তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
পেত্রার্কার সনেট, কাতাল্লুসের প্রেমের কবিতা,
রবীন্দ্রনাথের
গীতবিতান, রুমির মাসনভি, গালিবের পাথরের বুকে
ফুল-ফোটানো গজল, ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁর
‘যমুনা কে তীর’
চাইকোভস্কির রাজহংসী শোভিত হ্রদের অলৌকিক
বিচ্ছুরণ,
বাংলার অজানা মাঝির মেদুর গলার ভাটিয়ালী,
উত্তরবঙ্গের এবড়ো-থেবড়ো পথে গাড়িয়াল ভাইয়ের ভাওয়াইয়া
এবং আমার সকল লেখা এবং না-লেখা কবিতার শপথ,
তোমাকে, আজ শুধু তোমাকেই ভালোবাসি, গৌরী,
১৪/১১/৯৫