- বইয়ের নামঃ টেবিলে আপেলগুলো হেসে উঠে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অপরাহ্নে বসে ছিলে তুমি
অপরাহ্নে বসেছিলে তুমি সোফায় সাজিয়ে ঊষা,
কী সহজ। এমন মুহূর্তে বেশভূষা
অবান্তর; প্রকৃতিতে দ্বিধা নেই, আছে অন্তরাল
নানান রঙের, তুমি ঠোঁটে ফিকে লাল
করেছো অর্চনা। আকর্ষণ
দুর্নিবার, আমার ভেতরে টাইফুন আর তোমার অমন
‘ছুঁয়ো না আমাকে’ দৃঢ় আঙ্গিকে প্রবল ভাঙচুর
নৈঃশব্দ্যকে সুর
করবার ভারি সাধ হলো; যদি ছুঁই
তোমাকে এখন, তাহলে কি তুমি জুঁই
হয়ে ঝরে যাবে এই পাটের কার্পেটে? অনন্তর
তোমার এ-ঘর
বেবাক অশুদ্ধ হয়ে যাবে? নাকি
‘গ্রৃহস্থের খোকা হোক’ বলে ডেকে যাবে বেলাজ একটি পাখি।
অমল, তোমার জন্যে
ফোন বারবার বেজে উঠবে আমার
ছোট ঘরে, অথচ তোমার কণ্ঠস্বর কোনোদিন
শুনবো না আর
ভোরবেলা অথবা রাত্তিরে কিংবা যাবো না কখনো
সেই শাদা বাড়িতে প্রবাসকে
আপন নিবাস
করবার আকাঙ্ক্ষায় মজে। যদি যাই কোনোদিন বাড়িটার
পথের কিনার দিয়ে, চমকে উঠবো অকস্মাৎ।
সেই বাড়িটিকে মনে হবে
স্মৃতিসৌধ, বড় চুপচাপ পোহাচ্ছে সময় আর
মনে পড়ে যাবে
অমল তোমার ঝকঝকে মুখ, চোখের রহস্যময় দ্যুতি-
বুকের ভেতরে কিছু দুঃখ লুকিয়ে রাখার
প্রবণতা, হুইস্কির গ্লাস হাতে কৌচে
শিল্পিত কথার ঝিলিমিলি। অমল, তোমার জন্যে কোনো কোনো
প্রহরে আমার মন কেমন করবে, মনে রেখো।
তোমার কি মনে আছে? সেখানে কি থাকে
মনে কোনো কিছু? দয়িতার ভালোবাসা, সান্ধ্য আড্ডা, কবিতার
ছন্দমিল মনে থাকে? এই তো সে-রাতে
ফোন বেজে উঠলো, এল ভেসে
যেন বেদনার ছায়াচ্ছন্ন কণ্ঠস্বর, বাক্যহারা
শুনলাম অমল, তোমার
গলার আওয়াজ, মনে হলো। অথচ সে ধ্বনি, হায়,
পর মুহূর্তেই
রমণী-সত্তার ধ্বনি হয়ে যায়। ‘আমরা তো অর্ধনারীশ্বর’,
এই বলে নিজেকে প্রবোধ দিই শুধু
অমল আমাকে তুমি, মনে পড়ে, হেমন্ত সন্ধ্যায়
দিয়েছিলে উপহার
একখানি আধুনিক কবিতার বই-
বইয়ের ‘সময় বড় কম’ নাম দেখে কেন যেন
আমার নিভৃত মর্মমূলে
লেগেছিল টান। তুমি আমি সে সন্ধ্যায়
ড্রইংরুমের স্বল্পালোকে ঘুণাক্ষরে জানতে পারি নি হে বন্ধু
তোমার সময় এত কম।
আমাকে প্রতীক্ষা করে যেতে হবে
আমাকে প্রতীক্ষা করে যেতে হবে এই
একই জায়গায়
দীর্ঘকাল। এখানে কিছুই নেই, যা দেখে আমার
চক্ষুদ্বয় জুড়াবে; অথবা
কেউ নেই, যার সঙ্গে কথা বলে কাটবে সময়
ভালোয় ভালোয়।
সত্যের খাতিরে বলা যায়,-
আছে একজন; কিন্তু সে কখনো ভুলেও খোলে না
মুখ, ঠায় বসে থাকে
দৃষ্টি মেলে, সে দৃষ্টি এমন শূন্য, কখনো কখনো
মনে হয় ওর
দৃষ্টিশক্তি নেই, শুধু আছে চেয়ে থাকা।
কখনো মাটিতে বসে থাকি,
আবার কখনো উঠে দাঁড়াই সহসা, কিছুক্ষণ
পায়চারি করি, ফিরে এসে
বসি আগেকার জায়গায়, উঠে দাঁড়াই খানিক,
পুনরায় বসে পড়ি, এইমতো চলে
সারা বেলা, বলা যায়, এই খেলা আমার নিজেরই সঙ্গে।
আবার এমনও হয়, জুতোর ফিতেটা তাড়াতাড়ি
খুলে ফেলি, আস্তে সুস্থে ফের
বাঁধি, খুলি আর বাঁধি, বাঁধি আর খুলি;
তারপর জুতোটাই ছুঁড়ে
ফেলে দিই দূরে, ভাবি একটি কুকুর
থাকলে ভালোই হতো, কিছুটা জমতো এই জুতো জুতো খেলা।
যে আছে অদূরে একা
ভাবলেশহীন, তার উদ্দেশে কী যেন এলোমেলো
বলি প্রিয় সম্ভাষণ করে; কী আশ্চর্য, আমি নিজে
সে ভাষা বুঝি না, তবু বলে যাই একটানা বেশ
কিছুক্ষণ; স্তব্ধতাকে আঁচড়াই, মাঝে মাঝে নখ
খাই, দিই বাড়িয়ে নিজের গলা লোকটার দিকে।
ধূসর পথের দিকে চেয়ে থাকি মাঝে-মাধ্যে; কারো
আসার তেমন কোনো
আভাস কোথাও নেই। কোনো দূত এসে
এখানে রটাবে বার্তা, এই প্রত্যাশাকে
পাঠিয়ে দিয়েছি বলে অনেক আগেই। শুধু জানি বৃক্ষহীন
নদীহীন, রুক্ষ এ-প্রান্তরে প্রতীক্ষা করাই একমাত্র আশা।
এই এক সময়
এই এক সময়, যখন কেউ কারো সামনে সহজে
মুখ খুলতে চায় না। বন্ধুতার সাজ পরে বস্তুত
ক’জন আততায়ীর অব্যর্থ আঙ্গিক
ভেতরে লুকিয়ে রেখে চারপাশে আনাগোনা করে, তার হিসেব
মেলাতে গিয়ে বারবার
ভুল হয়ে যায়। এই এক সময়, যখন কেউ কারো, আস্থাভাজন নয়।
এই এক সময়, যখন শ্বেতচন্দনের বদলে
গন্ধকের গন্ধ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এবং গোলাপকে
হটিয়ে ঘেঁটু ফুল
সম্প্রসারণবাদীর ভূমিকায় কী দড়। এই এক সময়
যখন কোকিলের ঘাড় মটকে
কাক নিয়ে স্বৈরাচারীদের জয়োল্লাস দিক দিগন্তরে।
এই এক সময়, যখন সত্য অন্যমনস্ক ছাত্রের মতো
ব্যাক বেঞ্চে বসে থাকে আর
মিথ্যা প্রথম সারিতে বিজ্ঞ সেজে ঘাড় নাড়ে, রায় দেয়
যখন তখন। গস্টাপোর ফেউয়ের সন্ত্রাসে
ন্যায় নতজানু অন্যায়ের সম্মুখে; হাজার হাজার গজ
থান কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে নিরীহ রক্তের ছোপ।
এই এক সময়, যখন রাইফেলের ধমকে
বারংবার থেমে যাচ্ছে গুণীর তান,
মনুষ্যত্বের গলায় দিনরাত চালানো হচ্ছে
ধারালো ছুরি, অথচ অনেকে
সে-দৃশ্য না দেখার ভান করে অকাতরে তিন পাক ঘুরে
শুনিয়ে দিচ্ছে এমন কল্যাণ।
এই এক সময়, ভয়ঙ্কর সময়। যারা একনায়কের
স্তব করার বদলে নিন্দা-মুখর, তাদের পেছনে
লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে ডালকুত্তা, যারা
কণ্ঠে তুলে নিয়েছে প্রতিবাদের ঝাঁঝালো ভাষা,
হাতে কল্যাণের পতাকা
তারাই ক্রুশবিদ্ধ হচ্ছে বারংবার।
এখন ডাকছো কাকে
এখন ডাকছো কাকে? কে যাবে তোমার সঙ্গে? নেই,
সে কোথাও নেই। তাকে তুমি
ডুমুর গাছের কাছে দেখেছিলে যেদিন প্রথম,
সেদিন এখনো বুঝি তোমাকে ইঙ্গিতে
ডেকে নিয়ে যায়
তারুণ্য-খচিত ঘাটে, যেখানে কলস ভাসে স্মৃতির উদ্ভাসে।
দেখলে কি তাকে বাসস্টপে?
নাকি লঞ্চ টার্মিনালে কারো সঙ্গে সুটকেস হাতে
চলে গেল হেঁটে
সুদিনের মতো? তুমি ছুটে গিয়ে দেখলে সে
চোখের পলকে
কোথায় যে মিশে গেল ভিড়ে। তারস্বরে ডেকেও এখন তাকে
পাবে না কোথাও খুঁজে। শুধু
প্রতিধ্বনি তোমার হৃদয়ে এসে বাজবে ভীষণ।
ধরা যাক, অনেক বছর পরে ফের,
দৈবে এরকমও ঘটে,
তার সঙ্গে কোনোদিন কোনো এক অচেনা স্টেশনে
দেখা হয়ে গেল
প্রতীক্ষায় ঘরে দুলে ওঠে লাইনসম্যানের আলো;
তোমাকে গোয়েন্দা ভেবে সরে গেল দূরে।
তখন নিকটে গিয়ে বললে তুমি-
‘চলো যাই, আমরা দু’জন আজ একসঙ্গে ফরেস্টের
ডাকবাংলোয় গিয়ে উঠি। সেখানে নিঃশব্দে বসে
শুনবো ঝিঁঝির ডাক, মাঝে-মধ্যে কোনো বন্য প্রাণী
শুকনো পাতায় শব্দ বাজিয়ে আড়ালে
চলে যাবে শিকারের লোভে। নিরিবিলি
আমরা দৃশ্যের ভাগ নেবো। দেখে নিও
ফিরিয়ে আনবো আমি শূন্য থেকে হারানো গোলাপ।
‘এখন ডাকছো কাকে? কে যাবে তোমার সঙ্গে? নেই,
সে কোথাও নেই আজ’ বলে সে চকিতে
শালটা জড়িয়ে তার প্রখর শরীরে
স্বপ্নের ধরনে যাবে মিলিয়ে নীলাভ কুয়াশায়।
এখন বাজার
পরাবাস্তবের হাট, হাজার হাজার
চিত্রকল্প, প্রতীকের ভিড়; গালগল্প, কেনাকাটা
চলে পুরোদমে; কার্ডরুমে বিশ্ব সুন্দরীর হাত,
চোখ, নাক, ভুরু, বুকটুক, ঊরু, পাছা এবং হাঁটার
ভঙ্গী নিয়ে বাছা বৃদ্ধিজীবীদের টাকরায় অকস্মাৎ
জ্বলে ওঠে মদির দেয়ালি, বুড়ো হাড়ে
ভেল্কি লাগে কারো কারো। ধূর্ত আততায়ী
থমকে দাঁড়ায় ক্ষণকাল, মজে বসন্ত বাহারে,
মাতাল গলির মোড়ে বমি করে, খই
ভাজি কল্পনার বন্ধ ঘরে, কবিতার অনাবাদী জমি করি
চাষ; খেটে মরি, কেউ কেউ বলে বটে
ভূতের বেগার খাটা। অবসরহীন এই অলীক চাকরি
নিয়ে দিন কাটে, রাত কাটে।
তুমিতো জানোই বাণিজ্যের গুপ্ত গুহায় অনেকে
আজ আলিবাবার সোদর;
তাল তাল সোনা নিয়ে কিস্তিমাৎ করা লোকে চোখ মুখ ঢেকে
মণিরত্নে কাটায় প্রহর।
ব্যাপক ধ্বংসের
এবং দাবার চালে দেবদূত হেরে যায় শয়তানের কাছে
বার বার, আগুন রঙের এক ডাগর ফড়িং
এর ওর মাথা ছুঁয়ে কিঞ্চিৎ প্রণামী
নিয়ে উড়ে চলে যায় দূরে; ভাবো তুমি ইদানীং
আমার পদ্যের চেয়ে পেয়াজ কি রসুন অনেক বেশি দামি?
এবং এ জন্যেই
এই যে আজ অব্দি কোথাও আমি
একটা বাড়ি তৈরি করতে পারি নি, সেজন্যে আমার
কোনো দুঃখ নেই।
ব্যাঙ্কের গুহায় আমার লক্ষ লক্ষ টাকা
গা ঢাকা দিয়ে নেই বলে
দুঃখ আমার বুক আঁচড়ায় না বেড়ালের মতো।
পাঁচতলা হোটেলের স্যুইটে
সোফায় গা এলিয়ে
ঝাঁক ঝাঁক ক্যামেরা ঝলসিত
প্রেস-কনফারেন্স করবার সৌভাগ্য আনি নি, সেজন্যেও
দুঃখের ঢেউ
আছড়ে পড়ে না অস্তিত্বের তটে।
এতদিনে মেনে নিয়েছি
বস্তুত দুঃখ হলো ইলাসটিকে, যত বেশি টানো
তত যাবে বেড়ে আর এমন কিছু বিলাসী ব্যক্তি আছেন
যাঁরা দুঃখকে ময়ূরের কলাপের সঙ্গে
তুলনা করতে ভালোবাসেন। দুঃখকে তাঁরা
আঙুলের ডগায় দাঁড় করিয়ে দেখেন ওর মার্চপাস্ট।
তার অস্তিত্ব নেই, এ বিষয়ে কেউ
বৃহদায়তন দার্শনিক বই লিখলেও, পাড়ার পাঁচজন
কানে তুলবে না সেকথা।
কথার আরপ্যাঁচ যত উঁদুরেরই হোক,
এই থিসিস কেউ মেনে নেবে না যে সে নেই।
দুঃখ আছে এই গ্রহে
কোনো কোমল প্রাণীর মতো, যার ভেতর থেকে
যখন তখন হতে থাকে হিমশীতল, ধারালো ক্ষরণ।
আজকাল যখন আমি জুতোর ফিতে বাঁধি
কিংবা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে
দৃষ্টি মেলে দিই সুপুরি গাছের নির্জনতায়,
তখন দুঃখ আমার কাঁধে হাত রেখে ভরাট গলায়
বলে, আমি এসেছি।
অবাক হই না; কেননা ইদানীং
কী যে হয়েছে, আমার নিজের ঘরের ভেতর
ইচ্ছে হলেই
ফোটাতে পারি না গোলাপ, পারি না বইয়ে দিতে
মন্দাকিনীর ধারা, অথবা ডেকে আনা
সম্ভব হয় না আমার পক্ষে
সিরাজউদ্দৌলার কালের উদাসীন ঘোড়াগুলিকে।
কিন্তু সময় তার অ্যাসিডে সবকিছুর ধার
ক্ষইয়ে দেয় ক্রমে। কোনো কিছুই
ঠিক আগের মতো
থাকে না আর। সত্যি বলতে কি, সম্প্রতি দুঃখ যখন
আমার মুখোমুখি এসে বসে মোড়টায়
ওর প্রাচীন দীঘির মতো
চোখে চোখ রেখে আগের মতো দুঃখ আমার ওপর ঝুঁকে থাকে।
কথায় কথায়
বলেছি সেদিন কথায় কথায় বন্ধুকে,
কত কথা আজ হাওয়ায় রটায় নিন্দুকে-
আমি নাকি তিনকালে-ঠেকা এক কালে
আটকা পড়েছি প্রেমকাব্যের আদি জালে!
ফলত পাঠাই কবিতাকে কিছু ধুলো নিতে।
অথচ আবার প্রেমকে সাজিয়ে বেলাবেলি
মাত্রাবৃত্তে ঘোর অন্যায় করে ফেলি!!
কবিতা-সন্ধ্যা
এরকম ঘটে না প্রত্যহ, সকলেই জানে বটে,
যেমন দেয়ালে বসে শিস
দেয় না সুকণ্ঠ পাখি প্রতিদিন। ছিলাম দু’জন সন্ধ্যেবেলা
স্বপ্নাচ্ছন্ন ঘরে, খেলা করছিল আলো চতুর্দিকে।
টেবিলে সাজানো প্লেট, সোনালি চায়ের,
কেকের সুঘ্রাণ ভাসমান, আসবাবে শব্দহীন অলৌকিক
কোলাহল, অ্যালবাম থেকে
অতীত অর্মত্য কণ্ঠে গেয়ে ওঠে গান ক্ষণে ক্ষণে
পুরুষানুক্রমে,
বিভিন্ন পর্যায়ে তুমি নানা ফুলের একটি মালা।
আমাদের স্বরচিত দ্বীপ গুঞ্জরিত দূরাগত নাবিকের
গানে, আমাদের
সংলাপে অতীতে ছিল, ছিল বর্তমান,
ছিল স্মৃতি-জাগানো তরঙ্গ, গাছগাছালির আন্দোলন আর
ফুলের পরাগ, বড়ে গোলামের তান, লয়কারি।
তোমার পরনে ছিল ঘাসরঙ শাড়ি,
কপালে মেরুন টিপ, যেন নীপবনে বসে তুমি
খাতা খুলে পড়ছিলে ঈষৎ মোহন
দুলে দুলে সদ্যলেখা কবিতা তোমার। শব্দগুলি,
রঙবেরঙের, প্রজাপতি, সত্তার গহন থেকে
কী সহজে উড়ে যায় দূরে কোথাও, হৃদয় ছুঁয়ে
গেল ওরা আমার ভেতরকার সমালোচকের
মুখ বন্ধ করে,
আশ্চর্য তোমার কণ্ঠস্বরে যেন জ্যোৎস্নাপ্লুত ঝর্ণার নিবাস।
আমি মূক রইলাম তাকিয়ে কিছুক্ষণ
তোমার চোখের দিকে, যে-চোখে বনের নীলাঞ্জন,
হ্রদের সৌন্দর্য, দিগন্তের ব্যাপকতা। মুগ্ধাবেশে
দেখলাম তোমার বাগান
কী করে যে ঘরের ভেতরে চলে এল। মনে মনে
উচ্চারণে মর্মরিত আমার হৃদয়-
আসুক তোমার কবিতায় ভোরবেলাকার রোদ,
যেমন তোমার ঘরে আসে
শারদ রোদ্দুর, স্মিত ফুটুক গোলাপ,
যেমন সুন্দর ফোটে তোমার বাগানে নিরিবিলি। সিঁড়ি দিয়ে
নামতে নামতে মনে হলো, জানানো জরুরি ছিল
কিছু কথা তোমাকে, অথচ পরমুহূর্তেই ভাবি,
কী দরকার জানাবার? থাক ওরা প্রচ্ছন্ন সেখানে
দূরত্বের স্তব্ধ গুঞ্জরনে
বাগানের পত্রগুচ্ছে, ফুলে, ঘাসে স্বপ্নময় দীর্ঘশ্বাস হয়ে।
কিংবদন্তী
প্রাচীন কালের কথা। ছিলেন পায়ক
এক ধনধান্যে পুষ্পেভরা সুবিশাল দেশে, তাঁর
সুরে সুরে দেশের আবার বৃদ্ধ বনিতার
হৃদয় উঠতো নেচে, বলা যায়। ছিলেন নায়ক
তিনি সকলের কল্পনায়। কাছে দূরে
বারো মাস তেরো পার্বণের ডাকে তাঁকে
সাড়া দিতে হতো; জীবন্ত সে কিংবদন্তী জয়ঢাকে
মেতে সুরে সুরে
ফোটাতেন গোলাপ, টগর, শ্বেতপদ্ম, রক্তজবা;
নিমেষে বাগান হয়ে যেতো জনসভা।
কিছুকাল পর তিনি মনোনীত বিপুল সংঘের প্রয়োজনে
দিলেন ভাসিয়ে দেশ প্লাবনের মতো
ক্রমাগত দুর্বার ভাষণে।
একদা যে কণ্ঠস্বরে
ফুটতো ফুলের মুদ্রা, অর্মত্য রাগিণী শত শত,
অতঃপর সেই কণ্ঠে রাশি রাশি পেতল এবং সীসে ঝরে!!
চরম সমন
আমার কী অপরাধ বোঝার আগেই
হে আমার মনোনীতা তুমি
আমাকে দেখিয়ে দিলে খোলা দরজাটা।
যেন পথে কাঁটা
বিছানো, এমন ভঙ্গিমায় আমি সেই
অপরাহ্নে নিঃশব্দে গেলাম হেঁটে। ভূমি
বারবার উঠেছিল টলে
আমার পায়ের নিচে। বুঝি পড়েছি অগাধ জলে।
একবার ঠিক আমন্ত্রিত অতিথি হয়েও সভাগৃহ থেকে
উঠে যেতে হলো গায়ে কাদা মেখে
কারণ আমার আমন্ত্রণলিপি নাকি কলঙ্কিত
বিস্তর প্রমাদে, আমি ভীত
সস্ত্রস্ত গেলাম ফিরে প্রতিবাদহীণ মাথা হেঁট
করে ঝলমলে ভিড় ছেড়ে, কারা স্টুপিড, গবেট
বলে দিলো প্রচুর ধিক্কার, না দেখেই কোনোমতে
নেমে পড়ি পথে।
দেখেছি দুপুরুবেলা পথচারী জমকালো গাড়িচাপা পড়ে
আমাকে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরে বিকারের ঘোরে
কৃতজ্ঞতা অস্পষ্ট জানায়
আমাকে এবং আমি তাকে হোলি ক্রস
হাসপাতালের বেডে নিয়ে যাবো ভাবি,
অকস্মাৎ চতুর্দিক থেকে দশজন লোক আমার পাঞ্জাবি
ক্রুদ্ধ টানে ছিঁড়ে টেনে নিয়ে যায় কাছের থানায়,
তাদের মুঠোয় আমি ভীরু খরগোশ।
সপ্তাহান্তের মধ্যরাতে রজস্বলা মেয়ে
বৌদ্ধ ভিক্ষুণীর মতো শরীরে আগুন
দিয়ে চারতলা ফ্ল্যাটে হলো খুন।
জানি না কী নাম তার, শুধু সিঁড়ি বেয়ে
ওঠা কিংবা নামার সময় চোখে পড়েছে যৌবন
তার কালেভদ্রে। তিন দিন তিন রাত্রি পরে
ক্লান্ত হয়ে ঘরে
ফিরে দেখি প্রহরী আমার নামে নিয়ে আসে চরম সমন।
জুডাস কি ছিল কোনো নারী?
স্তব্ধ মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে দেখি কেমন অদ্ভুত
ভঙ্গিতে একাকী দেবদূত
চেয়ারে আছেন বসে আলমারি ঘেষে। মুখে হাসি ঝুলে আছে,
অস্তিতে বিভার ঢেউ, চোখে তার নাচে
সুদূরতা। বিছানায় উঠে বসে ভাবি,-
এই যে রূপালি চাবি
ঘন ঘন ঘোরাচ্ছেন বিপুণ আঙুলে, কোথাকার,
কবেকার এই চাবি? দেবদূতী চিত্রিত পাখার
অন্তরালে আছে কি জগত
কোনো রহস্যের খাপে ঢাকা? আছে কোনো দীর্ঘ পথ?
তার চোখে চোখ রেখে মনে হলো, হয়তো মৃত্যু হবে
আমার এখন এই স্তব্ধ রাতে। অত্যন্ত নীরবে
শুধু চেয়ে থাকি,
বুক চিরে বৈদ্যুতিক ট্রেন যায়, হঠাৎ কোথাও দূরে পাখি
ডেকে ওঠে অতীতের মতো
কণ্ঠসুরে, আর মনে পড়ে অবিরত
তোমার মুখশ্রী, মনে পড়ে গোধূলিতে ঝর্ণাধারা,
বয়ে গেছে মায়া কাননের ফুল, আনন্দাশ্রু-তারা
ফুটেছে নিভৃত ঘরে আমাদের। মাতিসের ছবি,
ওডেলিস্ক, সত্তায় ছড়িয়ে দিয়েছিল এক গহন পূরবী।
রাত্রি-মাখা জানালার ফ্রেমে
সাঁটা রমণীয় মুখ, দু’টি চোখ প্রেমে না অপ্রেমে
অমন কাতর আমি বুঝতে পারি না। মনে ফণা
তোলে প্রশ্ন, জুডাস কি ছিল কোনো নারী? জানবো না
কোনোদিন। দেবদূত এগোলেন, পাখার দোলায় কামরায়
জ্যোতিকণা ঝরে, বললেন তিনি, এই চামড়ায়
লেখো তুমি যা খুশি তোমার, অমরতা, স্বর্গসিঁড়ি, অপরূপ
কবিতা; খানিক চুপ
থেকে আমি দ্বিধাহীন তোমার নিরালা ডাকনাম
সেই হিরন্ময় চর্মপত্রে লিখলাম।
টেবিলের আপেলগুলো হেসে ওঠে
যখন সে তরুণ শিক্ষার্থী ফিরে আসে
তার ঘরে টেবিলে আপেলগুলো হেসে ওঠে, ক্ষুধিত পাষাণে
যেরকম হাসির বর্ণনা আছে, ঠিক
সেরকম। রাত্রির আকাশে
চোখ রেখে নক্ষত্রের টানে
আকাশ পাতাল ভাবে, স্বপ্নাংশের মতো চিকচিক
করে কিছু দূরে, মনে হয়। যখন সে বই খুলে
বসে, ভুলে যায় মর্মমূলে
কাঁটার পীড়ন, প্লেটো কিংবা হাইডেগারের বাণী
নিয়ে মাতে, তখন ‘বোরিং’
বলে আপেলেরা পরস্পর করে হাত টানাটানি
কিছুক্ষণ, তারপর ঘুমে ঢুলে পড়ে,
শিক্ষার্থীর আঙুলের রিং
ফড়িং-এর মতো উড়ে গিয়ে অকাতরে
খয়েরি পর্দায় বসে, টেবিলে আপেলগুলো হঠাৎ আবার
জেগে হেসে ওঠে, চমকিত সে তাকায়,
একটি আপেল তুলে নিয়ে হাতে করে লোফালুফি।
কেউ কি দাঁড়িয়ে আছে খোলা দরজায়?
আস্তে হেঁটে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে চুপি চুপি
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে, চোখে ঘুম
নেই এক ফাঁটা, হু হু বুক কেন এমন নিঝুম?
লালচে আপেলগুলে তাকে প্রান্তরের উপকথা,
সম্রদেতীরের কিছু কাহিনী শোনাতে চায়। তার নামহীন
মন নেই আপেল ও প্রতিশ্রুত বাগিচার প্রতি, নামহীন ব্যাকুলতা
দখল করেছে তাকে এবং ক্ষুধিত পাষাণে অন্ধকার,
মনে হয়, ঘিরে থাকে
সারাক্ষণ তাকে।
দিন তার কেটেছিল বন্ধুদের চায়ের আসরে।
কারা রাজনীতির বাসরে
প্রধান ভূমিকা নিয়ে জটলা পাকায়, কারা কবিতায়
হেজে-যাওয়া মান্দাস ভাসায়,
এ নিয়ে তুমুল
তর্কের তুফান উঠেছিল। কার পাকা ধানে কারা
দিচ্ছে মই যখন তখন; অবক্ষয়, অধঃপাত, যৌথ ভুল
ইত্যাদিতে ইদানীং অধ্যাপক-পাড়া
কী রকম মশগুল, বৃদ্ধিজীবীদের মগজে কতটা ঘুণ
করেছে প্রবেশ, তার কড়চায় হয়েছে হেসে খুন।
টেবিলে আপেলগুলো হেসে ওঠে জ্যোৎস্না-ঝলসিত
ঝর্ণার ধরনে বারবার।
এখন ঘুমোতে যাবে,
ভাবে
তরুণ শিক্ষার্থী; অথচ সে কেন ভীত
শুতে যেতে বিছানায়? শবাধার
বলে মনে হলো কি শয্যাকে তার? নাকি
আপেলের হাসি শুনে কবেকার পাখি,
ভীতির দোসর, এসে ঠোকরাচ্ছে তাকে?
অকস্মাৎ দু’হাতে সে তীব্র মুখ ঢাকে।
বাইরে বেরিয়ে যেতে চায় সে কোথাও দূরে দিকচিহ্নহীন;
কে এক প্রহরী প্রস্থানের পথ আগলে দাঁড়ায়।
বাদ-প্রতিবাদ ধ্বস্তাধ্বস্তি চলে; হাওয়ায় বিলীন
হয়ে যায় পরাভূত সে প্রহরী, তরুণ শিক্ষার্থী পা বাড়ায়,
আস্তে সুস্থে অজানার দিকে আর গভীর আত্মিক
যন্ত্রণায় কায়ক্লেশ ভুলে
আশ্চর্য সাহসে ফ্যানে ঝুলে
পড়ে আর টেবিলে আপেলগুলো কেঁদে ওঠে ঠিক
সেরকম, যেরকম ক্ষুধিত পাষাণে
ঝরে পড়েছিল পাথরের বুক থেকে রূপসীর, পাঠকেরা জানে,
কান্নার শিশির।
তবু আসতেই হলো
নিমগ্ন তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে, নক্ষত্রের
ওপারে কী আছে ভাবি। এই যে এলাম
সব ছেড়ে ছুড়ে
সাত তাড়াতাড়ি,
এতকাল পরে, কী পেলাম? শুধু ফাঁকা
ধু ধু লাগে, যেদিকে তাকাই।
অথচ অভাব নেই কিছুরই এখানে। স্বর্ণাভার
কারুকাজ, দরদালানের ভিড়,
চমৎকার সাজানো দোকানপাট, গাড়ির আওয়াজ,
সেলুন, চা-খানা, লন্ড্রি, লোকজন, রঙিন তামাশা-
সবই আছে।
জানালার বাইরে দাঁড়ানো
সাতটি সুপুরি গাছ, শাদা বাড়ি, বেগনি ফুলের
টব বারান্দায়, কারো স্মিত
অস্তিত্বের ঝিলিক মিলিয়ে যায়, পর্দা, নীল সিল্ক,
দোলে; বায়ুস্তরে
ঢেউ তোলে পাখি
এবং একের পর এক এলেবেলে স্মৃতির জোনাকি। এই
ভোরবেলা, কোন, সোনারুর
সূক্ষ্মবোধে শিল্পিত, হঠাৎ
রাত্রি হয়ে গেল;
আমার আপন অতীতের মুহূর্তগুলিকে আর
ফেলে-আসা পায়রাগুলিকে
যদি কেউ আশীর্বাদ করে,
আমি তাকে দিয়ে যাবো কৃতজ্ঞতাময়
ঘাটে; হায়, এখানে শূন্যতা
ছাড়া কিছু নেই, তবু আসতেই হলো।
দরজায় দাঁড়ানো কেউ
দরজায় কে দাঁড়ালো একরম ঘোষণাবিহীন,
এমন নিঃশব্দ? দেখেছি কি তাকে আগে
কখনো গলির মোড়ে একা
দাঁড়ানো? অথবা ফুটপাতে? দেখেছি কি
চকিতে উঠতে বাসে ভিড়
ঠেলে কোনো গ্রীষ্মের দুপুরে কিংবা শীতার্ত সন্ধ্যায়
কুয়াশায় নিমেষে মিলিয়ে
যেতে নিকটকে দূরত্বের শীতবর্ণে গূঢ় লেপে?
না দেখে নি। দেখছি এখন তার এই চলে-আসা
চৌকাঠে দিয়েছে মেলে অচিন আঙ্গিক
খুব নিরিবিলি। আমি কোনো
সরলীকরণে
কখনো উদ্যমশীল নই
ফলে লহমার দৃশ্যটিকে তুড়ি মেরে নির্বাসনে
পাঠাতে পারি নি,
বরং অত্যন্ত ঝাঁঝাঁ দুপুরে রাখাল
যেমন তাকিয়ে থাকে রৌদ্রের ওপারে কিছু দেখে,
তেম্নি তাকে দৃষ্টির সীমায় রাখি গহন মুদ্রায়।
যখন ভেবেছি আগন্তক বলবে না
কোনো কথা, তখনই সে কণ্ঠে দিলো খুলে
মোহন ফোয়ারা এক-‘তোমার এ-ঘরে
নামবে অরণ্যছায়া, বাজবে মৃদঙ্গ অদৃশ্যের, এতকাল
যা দ্যাখো নি দেখবে, শুনবে যা শোনো নি
তোমার দেয়ালগুলি দেবো আমি সরিয়ে এবং স্বপ্নের ভেতরে স্বপ্ন,
স্মৃতির ভেতরে স্মৃতি ভরে দেবো’ বলে
সে মিলিয়ে গেল বায়ুস্তরে। শুনি কার পক্ষধ্বনি?
একটি অনুপস্থিতি এমম শূন্যতা রেখে যায়,
ভাবি নি কখনো আগে।
ক্ষণিকের জন্যে হলেও সে দরজায় এসে ঋজু
রহস্যে দাঁড়িয়ে ছিল। আপাতত প্রতিফলনের
আভা শ্বেত গোলাপের মতো
ফুটে থাকে কিছুক্ষণ, যা ফোটাতে পারে তারই মতো আগন্তুক।
দিই না দুয়ো
অনেক দেখে অনেক ঠেকে এখন আমার
শেখা হয়ে গেছে
অনেক কিছুই। আমার চারদিকে উল্টোপাল্টা
যা কিছুই ঘটুক,
আমি আর চমকে উঠি না; বেমক্কা কোনো
পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
ঘাবড়ে যাবো, এমন হয় না কখনো,
আর ধরি না অদ্ভুত এই কলিকালের খুঁত।
কিছু কিছু লোক আছে বাগানে টগর কি জুঁই
গোলাপ অথবা রক্তজবা দেখলেই
ফুলগুলোর গায়ের থুথু ছিটোতে থাকে।
কিছু কিছু লোক আছে আকাশে তারা ফুটতে
কিংবা চাঁদ উঠতে দেখলেই ঠিক
ট্রাউজারের বোতাম খুলে
ল্যাম্পপোষ্টের মূলে বারবার ভারমুক্ত হবার
দুর্নিবার তাগিদ অনুভব করে
কিছু কিছু লোক আছে ছাদের কার্নিশে,
রেলিঙে কোনো
কবুতর দেখামাত্র তার ঘাড় মটকে দমবন্ধ করবার জন্যে
আঙুল মটকাতে থাকে।
কস্মিনকালেও ওদের আমি দিই না দুয়ো,
বলি না ওদের সাত পুরুষের ভিটায়
চরুক ঘুঘু;
বরং ওরা যাতে বেঁচেবর্তে থাকে,
থুথু ছিটানোর মতো যথেষ্ট থুথু যাতে থাকে ওদের মুখে,
সঙ সেজে আরো বেশি রঙ তামাশা
করতে পারে এই দুনিয়ায়,
সেই কামনাই করি অষ্টপ্রহর।
দিতে পারে নয়া সাজ
অফিস উগরে দিলো দুপুরে। এখন, ওরে মন,
কী করি? বিবর্ণ স্ফীতোদের বাসে চেপে প্রথামতো
অবসন্ন মনে ফিরে যাবো কি বাসায়? ক্ষিপ্র ডান
হাতের ব্যাপার সেরে বিছানায় গোয়েন্দা কাহিনী
নিয়ে কিছু সময় গড়িয়ে দেবো? না, থাক; বরং
ট্যাঁক হালকা করে রেস্তোরাঁয়, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত
সিনেমায় কিছুকাল কাটিয়ে আয়েশে ফেরা যাবে
ভাড়াটে বাসায় কায়ক্লেশে আরশোলার আস্তানায়।
কে কার জীবন আজ করছে যাপন? এই আমি
নগণ্য চাকুরে, মাস কাবারে, দেনায় হাবুডুবু,
গিন্নীর গঞ্জনা সয়ে খোদার তিরিশও দিন, এই
আমি কি আমার মধ্যে ন্যালাক্ষ্যাপা ভিন্ন মানুষের
জীবন ধারণ করি? হাজিরা খাতায় প্রত্যহ যে
করে সেই, সে কি আমি? মই বেয়ে উঠি নীলিমায়?
আগুনের রেশম কবিতা, মাঝে সাঝে এমনকি
আমারও বুকের মধ্যে মঞ্জরিত; ফেটে-পড়া বীজ
সাজাই খাতায়; বাজে কাগজের ঝুড়ির খোরাক
সুনিশ্চয় আমার পদ্যের শৈশবের হুটোপুটি।
প্রগাঢ় যযাতি রাত্রি মাথায় লাগায় চুপিসারে
স্বপ্নের কলপ আর দুর্ভিক্ষে রাস্তায় মৃতা কোনো
মায়ের বিশুষ্ক স্তনে মুখ-গোঁজা শিশুর মতোই
পড়ে থাকে বে-লেবাস আমার স্বপ্নেরা ইতস্তত।
সংসদ ভবন নির্বাসিত সম্রাটের মতো বড়
চিন্তাকুল, স্থাণু আর অন্ধকারে সূর্য সাজাবার
আ মরি তাগিদে হৈ-হুল্লোড়ে পাড়া তোলপাড় করে
বখাটে কর্মীরা বিদ্যুচ্চমকের মতো ওরা ভোল
পাল্টায় এবং মূঢ়তার ঘেরাটোপে জীবনকে
সঁপে দিয়ে জীবন হননে মাতে ঋতুতে ঋতুতে।
সতর্ক সেপাই ঘেরা বনেদী জলসা ঘরে ওহো
প্রাক্তন বিপ্লবীদের ওষ্ঠে চাকভাঙা মধু ঝরে,
মধু ঝরে; মুখে জনগণ নাম হামেশা, সাধের
প্রগতি চুলোয় যাক বীতশান সূর্যাস্তের পথে!
দেশ হালবিহীন নৌকোর মতো ঘুরপাক খায়
ঘূর্ণিজলে অবিরত। কবন্ধের দল চতুর্দিকে;
গরুর গাড়ির চাকা ডোবে পিচ্ছিল কাদায়, আর
ভাবি আজ বিপ্লবই দেশকে দিতে পারে নয়া সাজ।
দ্বিচারী
সারাদিনমান দিগ্ধিদিক
পর্যটন সেরে চৌরাস্তার গহন চোখের কালো
মেয়েটির কাছ থেকে বকুল ফুলের মালা কিনে
ধুলোমাখা পায়ে ফিরে আসতেই বললো কিছু আলো
ছড়িয়ে উঠোনে হাস্নাহেনা
‘কিছুক্ষণ দাঁড়াবে না
হে আমার উদাস প্রেমিক?’
কী করে যে নিলো চিনে
এরকম গাঢ় অন্ধকারে। দৃষ্টি দিয়ে
ঈষৎ আদর করে তাকে ফের নিজেকে ছিনিয়ে
নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে
উঠে যাই ছায়াচ্ছন্ন ঘরের ভেতরে।
চোখে ক্লান্তি আসে ছেয়ে,
তারপর গৃহিণীর কোমর জড়িয়ে বাম পাশ
বেছে শুই, কোমর প্রবেশ করি ঘুমের গহ্বরে;
বকুল ফুলের মালা টেবিলে শীতল দীর্ঘশ্বাস।
নির্ধারিত কোনো তারিখ নেই
কখনো সখনো যে চা-খানায় চা খেতে যাই কিংবা কিছু সময় কাটাতে,
সেখানেই তার সঙ্গে দেখা।
বলা কওয়া নেই,
লোকটা গ্যাট হয়ে বসে আমার মুখোমুখি।
কোনো কোনো মানুষ আছে
যাদের দেখলেই মনে পড়ে পাখির কথা।
লোকটা সে ধরনের একজন মানুষ।
কেন জানি না,
তাকে মনে হলো একটা দাঁড়কাকের মতো,
যদিও এই বিশেষ প্রাণীটির সঙ্গে তার কোনো মিল আমি খুঁজে
বের করতে পারি নি।
লক্ষ করলাম, ওর ভুরুতে বনস্থলির শ্যামলিমা,
হাতের নোংরা নখ থেকে বেরিয়ে এসেছে
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর লালিমা,
ঠোঁটে সমুরদ্রতটের নুন, চোখে
কবরের ভেতরকার রহস্য।
সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল,
সে এসেছে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত থেকে।
আমার চায়ের আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করে
লোকটা তাকালো রাস্তার দিকে,
তারপর বলতে শুরু করলো একটি কাহিনী;
আমি শুনতে চাই কিনা সে-কথা জানতেও চাইলো না।
কথার বড়শি দিয়ে সে গেঁথে ফেললো আমাকে।
কার সাধ্য সেই বড়শি থেকে ছাড়া পায়?
তার কথা বলার ধরণ থেকে
ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো আমার কাছে যে,
সে এক প্রাচীন ভ্রমণকারী,
নানা ঘাটের পানি-খাওয়া।
ওর গলায় বহু অভিজ্ঞতার মিশ্র স্বর,
এক চিত্ত-আলোড়নকারী ঐক্যতান। আমার
ওপর দিয়ে বয়ে গেল ঢেউয়ের পর ঢেউ।
বিচিত্র মসলার ঘ্রাণে ভরে উঠলো সেই চা-খানা, অনুভব
করলাম পাখির বুকের উত্তাপ, সুদূরতম দ্বীপের ওপর বয়ে-যাওয়া
হাওয়ার ঝলক, ঝরণার স্বচ্ছ জলের শীতলতা।
সে তার কাহিনী শুরু করলো এভাবে এভাবে-
এক ঝাঁক দাঁড়কাক এসে বসলো উঁচু দেয়ালে,
যেন পুঞ্জ পুঞ্জ হিংসা। ওদের পাখায়
লেখা আছে, একটা শব্দ, প্রতিশোধ।
দাঁড়াকাকগুলো দশদিক চমকে দিয়ে চিৎকার করতে শুরু করলো,
আশে পাশে ছড়িয়ে পড়লো কুচকুচে কালো রঙ।
দাঁড়কাকদের গলা সেই রঙের উৎস।
একে একে ওরা উড়ে গেল প্রাসাদটির প্রতি, ফিরে এল
একটু পরে; ফের হানা দিলো সবাই এক সঙ্গে।
চঞ্চুর আঘাতে আঘাতে ওরা ছিঁড়ে খুঁড়ে
ফেলতে চাইলো ফটকটিকে।
প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে ওরা ভেতরকার রহস্য জেনে নিতে চায়,
জেনে নিতে চায় এমন কী আছে প্রাসাদের ভেতরে
যা রাখতে হবে সবার চোখের আড়ালে?
মোদ্দা কথা, ওরা প্রাসাদটিকে দখল করতে চায়।
কিন্তু আপাদমস্তক দামি ধাতুতে মোড়া প্রহরীদের বন্দুকের ধমকে ওরা
ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো, কালো কালো ছেঁড়া পালকে
ছেয়ে গেল চারদিক, দাঁড়কাকগুলো রাশি রাশি মন্ডের
মতো পড়ে রইলো।
ফটক ছিদ্র করবার মতো শক্তিমান ছিল না ওদের চঞ্চু।
আর ওরা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রহরীদের বর্মের ঝলসানিতে।
প্রহরীরা বীরদর্পে দাঁড়কাকের শবের ওপর
কুচকাওয়াজ করলো কিছুক্ষণ;
কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ।
দাঁড়কাকদের পরাজয়ের পর দিন যায়, দিন যায়।
সময়ের ঠোকরে চিড় ধরে না প্রাসাদের প্রাচীরে,
খোলে না ফটক। খুললেও কারো
প্রবেশাধিকার নেই সেখানে,
শুধুমাত্র নির্বাচিতরাই যেতে পারে ভেতরে। যারা যায়
তারা আর ফিরে আসে না। প্রাসাদের প্রাচীরে কিংবা গম্বুজে
কাকপক্ষীও বসতে পারে না। দামি ধাতুতে মোড়া প্রহরীরা
অষ্ট প্রহর প্রস্তুত। একটা পিঁপড়ে ওদের চোখ এড়িয়ে যাবে,
এমন ফাঁকফোকর ওরা রাখেনি কোথাও। প্রাসাদ আছে
প্রাসাদের হালে, কখনো কখনো
ভেতর থেকে ভেসে আসে নানা বাদ্যরব,
নর্তকীদের মঞ্জীর ধ্বনি,
ফটকের বাইরে সকাল সন্ধ্যা বর্মাবৃত প্রহরীরা
করে কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ।
হঠাৎ একদল শিম্পাঞ্জী সেই প্রাসাদের ওপর
চড়াও হলো একদিন। কিন্তু ওদের উৎপাত
স্তব্ধ হয়ে গেল এক পশলা বুলেটে। একটা আঁচড়ও
লাগলো না প্রাসাদের গায়ে।
পরাভূত শিম্পাঞ্জীদের অনেকেই
বেঘোরে প্রাণ হারালো, যারা বেঁচে
রইলো তাদের বেঁচে না থাকাই ছিল ভালো।
কেউ হারালো হাত, কেউ পা, কেউ কেউ
হাত-পা দু’টোই। প্রহরীদের বর্মে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে,
ঝলসিত হয় চতুর্দিক। শিম্পাঞ্জীদের
শক্রর ওপর প্রহরীরা বীরদর্পে কুচকাওয়াজ
করলো কিছুক্ষণ;
কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ।
শিম্পাঞ্জীদের পরাজয়ের পর দিন যায়, দিন যায়।
পূর্ব দিকে সূর্য ওঠে, পশ্চিমে অস্ত যায়।
গাছে পাতা গজায়, পাতা ঝরে যায়।
প্রাসাদ থাকে প্রাসাদের হালে; ঝকঝক করে
সূর্যের আলোয়, অন্ধকারকে শাসন করে নিজস্ব আলোর ছটায়।
শোনা যায়, প্রাসাদের ভেতরে বারো মাস তেরো পার্বণ
কাটে প্রায় একই ভাবে, একই তালে লয়ে। মাঝে-মাঝে
গুঞ্জন রটে বাইরে।
গুজব, গুজবই। তাই ওসব নিয়ে
মাথা ঘামানোর লোকের সংখ্যা কম। প্রহরীরা
টহল দিয়ে বেড়ায় প্রাসাদের চারদিক। দিনভর, রাতভর।
কোনো কিছু নড়তে চড়তে দেখলেই বলে, ‘হল্ট’
সহজে কেউ ঘেঁষে না ফটকের কাছে, দূর থেকে
তাকায় আড় চোখে। লোকে বলে,
কোনো কোনো মধ্যরাতে প্রাসাদের প্রাচীরগুলি
ডুকরে ওঠে ট্রয় নগরীর রমণীদের বিলাপের মতো।
শিম্পাঞ্জীদের পরাজয়ের বহু বছর পরে
শত শত লোক ছুটে এল প্রাসাদের দিকে
লাঠিসোঁটা আর দা-কুড়াল নিয়ে।
মনে হলো জন বন্যায় দেশলাইয়ের বাক্সের মতো
ভেসে যাবে প্রাসাদ। কিন্তু ঝাঁক ঝাঁক
বুলেট আর কামানের গোলায় বন্যার
গতি হলো রুদ্ধ, মৃত্যু এলোপাতাড়ি
উপড়ে নিলো বহু প্রাণশস্য।
যারা এসেছিল প্রাসাদের প্রাচীর চুরমার করার জন্যে,
ব্যর্থ হলো তারা।
ওরা এসেছিল একটা সূর্যোদয়ের জন্যে ফিরে গেল
অস্তিত্বময় অমাবস্যা নিয়ে। তখন আমি
জ্বল জ্বলে যুবক, সবেমাত্র কুড়ি পেরিয়েছি।
আমার হাতের মুঠোয় স্বপ্নের চারাগাছ, চোখে
সামুদ্রিক ঢেউয়ের ঝাপটা, আমার সত্তায় ভবিষ্যতের লাবণ্য।
যাকগে, মানুষের সেই পরাজয় আমি প্রত্যক্ষ করেছি।
এত লাশ আমি এর আগে দেখি নি।
চোখে জ্বালা ধরে যায়।
মৃতদেহে এত আগুন, কে জানতো? চোখ পড়ে যায়।
কেউ কেউ বাঁচলো পালিয়ে, কিন্তু সেই
বাঁচার চেয়ে মরাই ছিল ভালো।
আসল পা ছেড়ে কাঠের পা নিয়ে কে বাঁচতে চায়?
কে চায় হুইল চেয়ারে বসে ঝিমোতে? চোখের জ্যোতি হারিয়ে
দিন যাপনের গ্লানি সইতে কে চায়? প্রিয় সঙ্গীর
মুণ্ডুহীন ধড় দেখার পর কেউ সুস্থ, স্বাভাবিক
জীবনের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে কি? আপাদমস্তক
দামি ধাতুতে মোড়া প্রহরীরা
মানুষের লাশের ওপর কুচকাওয়াজ করলো কিছুক্ষণ;
কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ।
সেই পরাস্ত লোকগুলোর মধ্যে ছিল একজন জিপসি।
বেখাপ্পা তার জীবনযাত্রা, অদ্ভুত তার আচরণ।
ওরা পালিয়ে এসে ডেরা বাঁধলো বহুদূরে, নদীতীরে। লোকগুলো
বসেছিল গোল হয়ে ফ্রেস্কোর মণ্ডলের মতো
কারো মাথায় ব্যান্ডেজ,
কারো উড়ে-যাওয়া পায়ে ব্যান্ডেজ,
কারো চোখে ব্যান্ডেজ।
জিপসিটা বললো, মনমরা হয়ে থেকো না তোমরা,
যারা একদিন বীরের মতো প্রবেশ করবে সেই প্রাসাদে
আপাদমস্তক দামি ধাতুতে মোড়া প্রহরীদের
পরাস্ত করে তারা বাড়ছে গোকুলে।
ওরা কারা? জানতে চাইলো সবাই। জানি না,
তবে ওরা আসবে,
দূর দিগন্তের দিকে দৃষ্টি মেলে উত্তর দিলো সেই জিপসি।
কবে আসবে সেদিন?
একটা গুঞ্জন উঠলো আহত লোকগুলোর মধ্যে।
সেই বিজয়ের দিন কবে আসবে? এই প্রশ্ন তীরের মতো
ছুটে গেল জিপসির দিকে। জিপসির চোখে কী একটা
ছায়া দুলে ওঠে যেন,
আকাশে ঝুলে আছে
যুদ্ধে হারিয়ে-যাওয়া চোখের মতো চাঁদ।
জিপসি স্বপ্নঝলসিত কণ্ঠে বলে, বিজয়ের নির্ধারিত কোনো
তারিখ নেই।
এটুকু বলে থামলো আমার
মুখোমুখি বসে থাকা লোকটা।
জিপসির সেই বাণী,
বিজয়ের নির্ধারিত কোনো তারিখ নেই
গুঞ্জরিত হতে থাকলো চা-খানায়,
যেন শুনতে পেলাম আমি।
হঠাৎ দাঁড়কাকের মতো লোকটা চেয়ার ছেড়ে
উঠে দাঁড়ালো, রওনা হলো রাস্তার দিকে। আমি তাকে
ডাকলাম, কিন্তু সে ফিরে তাকালো না পর্যন্ত। যেন আমি
কোনো ধর্তব্যের মধ্যেই নেই। লোকটার,
হাঁটার ভঙ্গিতে কোনো স্বাভাবিকতা ছিল না। খট খট করে
একটা শব্দ হচ্ছিলো। তখুনি
প্রথম বারের মতো লক্ষ করলাম, লোকটার
একটা পা কাঠের। আর
সেই কাঠের পা থেকেই
বিজয়ের কোন নির্ধারিত তারিখ নেই শব্দগুচ্ছ
মঞ্জরিত হয়ে চা-খানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়লো চরাচরে।
পূর্বসূরীদের উদ্দেশে
এ কেমন পৃথিবী যাচ্ছেন রেখে আজ আমাদের
জন্যে অবশেষে? অপরাধ
নেবেন না কৃপা করে, যদি কণ্ঠস্বরে
অভিযোগ ফণা তোলে। আমরা বালক
কেউ কেউ, কেউ বা কিশোর,
বুঝি না কিছুই; হে আমার
প্রবীণ দানেশমন্দ পূর্বসূরীগণ, আপনারা
দোষী, এরকম অপবাদ
দেয়া কিছুতেই
সাজে না আমাকে। মাঝে-মাঝে কিছু কথা কানে আসে,
তা-ই শুধু শোনাবো আপনাদের আজ।
একটু সময় হবে সেসব শোনার?
কানে আসে, দেশ-দেশান্তরে
সুসজ্জিত দর্পিত সেনারা
দুনিয়া-কাঁপানো এক ভীষণ আওয়াজে
করে কুচকাওয়াজ এবং
শোষণ চলছে দ্বিগ্ধিদিক পুরোদমে,
হাবিলের চেয়ে কাবিলের সংখ্যা অতি দ্রুত আজ
হাজার হাজার গুণ যাচ্ছে বেড়ে; শুনি
একটি বোতম টিপলেই
আমাদের প্রিয় পৃথিবীর গায়ে পারমাণবিক
ছাই জমা হবে রাশি রাশি।
তারপর একটি পাখিও আর কিছুতেই
গাইবে না গান,
সমুদ্রে নদীতে মৎস্যকুল
হবে না কখনো আর কেলিপরায়ণ; দলে দলে
পুষ্পপ্রায় রাজহাঁস কাটবে না সাঁতার কখনো
কোনো সরোবরে, লুপ্ত হবে সবকিছু। পৃথিবীতে
বিখ্যাত মানব জাতি বলে ছিল কিছু,
এ-কথা জানার মতো থাকবে না কেউ।
দিনরাত্রি ভয়ে ভয়ে থাকি। আপাতত
দেশে দেশে একনায়কের
তর্জন-গর্জনে আর তারকা যুদ্ধের বিভীষিকা
নিয়ে সত্তাময়
কী করে বাঁচবো, বলে দিন হে আমার
অভিজ্ঞ প্রবীণ, প্রাজ্ঞ পূর্বসূরীগণ?
আপনারা কেন পৃথিবীর
গলিজ জঞ্জাল
সরাতে এমন উদাসীন? এ কেমন
উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছেন পেছনে অসহায়
বংশধরদের জন্যে? কেন নিজেদের
রক্তক্ষয়ী সংগ্রামকে ব্যর্থ হতে দিচ্ছেন এভাবে?
পেঁয়াজ রসুন
কোথাও কখনো কেউ সবুর না করলেও প্রচুর রসুন
বোনা হয়, হবে চিরদিন। এমনিতে
দিব্যি থাকি, তবে মাঝে-মাঝে
প্রসিদ্ধ শিবের গীতে,
জীবন মাইক্রোফোনে বাঁধা
যাদের তাদের খাল কেটে কুমির আনার কাজে
দু’চোখে আঁধার
দেখি কিংবা হঠাৎ মাথায় চাপে খুন।
প্রকৃত কে আমি
প্রকৃত কে আমি এই মানুষের ব্যাপক মেলায়?
বেলা গেল মেঘে মেঘে, নানা খেলা খেলেছি এখানে
আবেগের ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে নিজের বিষয়ে
স্থির জেনে কত কিছু, তবু বিছানায় আড়মোড়া ভেঙে
মনে হয়, যে আমি রাত্তিরে ছিল দুঃস্বপ্নে অস্থির
আর ভোরে যে আমি শিশির ভেজা ঘাস, কিয়দ্দূরে
সুপুরি গাছের সারি, ফিরোজা আকাশ, ফুলদানি,
খয়েরি শাড়ির, পায়রার ঝলসানি দেখে খুশি,
চা খেয়ে সংবাদপত্র পড়ে আনে ডেকে ছায়াছন্ন
ঘরে অবলীলাক্রমে হিস্পানী জগতে-এ দু’য়ের
মধ্যে কাকে আমি বলে করবো শনাক্ত বাস্তবিক?
যে ছিল অঞ্জলি পেতে সপ্তম শতকে অষ্টাদশী
গৌরীর সমুখে একা তৃষ্ণার দুপুরে, বৌদ্ধ মঠে
যার বাস, অনেক শতাব্দী আগে পটে ছবি এঁকে যিনি
হাটে করেছেন বিকিকিনি, কিংবা খাব-ঝলসিত
ইমরুল কায়েস, উটের পিঠে কাব্যের নেকাব
উন্মোচন করেছেন যিনি, সেই তো প্রকৃত আমি।
আবার কখনো মনে হয়, ধীমান হেরোডোটাস
আমি, ইতিহাস যার নর্মসখী, অথবা সুদূর
এথেন্সের আঁধার প্রকোষ্ঠে ওরা আমারই অধরে
দিয়েছিল ঢেলে কালকূট। কিংবা বলা যায়, যুগে
যুগে হেঁটে যায়-নির্দেশনাহীন কণ্টকিত পথে,
দুর্গম পর্বতে যে মানুষ স্বর্গ নরক এবং বিস্মৃতির প্রতি উদাসীন, আমি সেই দুঃখ-চাওয়া
নিঃসঙ্গ পথিক, রিক্ত, ক্লিষ্ট অগ্নিবলয়ের তাপে।
ফেরা না-ফেরা
একদা এখানে দাঁড়িয়ে সে দু’ঘণ্টা লাগিয়ে দাড়ি
কামাতো এবং স্নান সেরে তাড়াতাড়ি
আঁচড়াতো চুল। তাকে দেখতে ভালোই ছিল, তার
চুল ছিল কালো আর ঘন,
প্লাস্টিকের চিরুনিটা কখনো কখনো
ভাঙবার
উপক্রম হতো, এই টেবিলে দু’বেলা তৃপ্তি নিয়ে
করতো আহার মাছ, মুড়িঘন্ট দিয়ে
সকলের সঙ্গে, গল্প-গুজবেও উঠতো মেতে
ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে।
দেখতো তাকিয়ে দূরে মাঝে-মধ্যে বাগানের ফুলের বাহার,
কখনো শুনতো মগ্ন বেলায়েত খানের সেতার।
গাছের পাতায়
পড়লে বৃষ্টির ফোঁটা সন্ধ্যেবেলা, রাত্তিরে, মাথায়
স্তূপ স্তূপ মেঘ ঢুকে যেতো তার, মনে
পড়তো সুদূর গুহা, বাকল-সজ্জিতা তীক্ষ্ণ কনে
কবেকার। হরিণের পেছনে ছোটার
উদ্দামতা আবার শিরায় শত নক্ষত্র ফোটার
প্রাক্তন শিহর দিতো জ্বেলে;
ফের দৃষ্টি মেলে
গৃহকোণে হো হো করে উঠতো নিভাঁজ হেসে, যেন অর্থহীন
সব কিছু, এমন ভঙ্গিতে পাশ ফিরে
শোয় বিছানায়; ভোরে পুনরায় অমলিন
মুখে নামে পৌরপথে, যায় অফিসে এবং মিশে যায় ভিড়ে।
অকস্মাৎ বলা-কওয়া নেই একদিন
ঠিকানা না রেখে হলো সে উধাও, যেন হাওয়ায় বিলীন
হয়ে গেল জাদু বলে। তারপর গিয়েছে গড়িয়ে
পুরোপুরি পনেরো বছর। মাতৃক্রোড়ে বসে আয় আয় টিয়ে
বলতো যে-শিশু সে এখন
কার্ল মার্কস পড়ে সুদিনকে ডাকে আর দেয় মন
নিসর্গ নারীতে আর রাজনীতিতে আকণ্ঠ মজ্জমান,
কখনো কখনো গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের গান।
পনেরো বছর পরে এল ফিরে বসতবাটিতে
কী খেয়ালে; চোখে মুখে ছিটে
লাগে অতীতের, বসে পুরানো চেয়ারে পুনরায়,
দাঁড়ায় আয়নার পাশে, দাড়ি কাটে, চুল আঁচড়ায়,
অথচ আঁচড়াবার মতো
বেশি চুল নেই আর। নজরের আলো ক্ষীণ, ক্রমাগত
কী এক খটকা এসে বেবাক ভণ্ডুল
করে দেয়। যেন অন্য কারো অতিশয় ভুল
মুখ নিয়ে করে চলাফেরা, কেউ তাকে
পারে না সহজে নিতে। সব কিছুতেই গূঢ় অন্তরাল থাকে
কখন যে কাকে ডাকে থাকে না খেয়াল!
বস্তুত দেয়াল
এক তার আর অন্যদের মাঝে গড়ে
ওঠে, অর্থহীন বৃত্তে ঘোরে
সারাক্ষণ ভুল পদক্ষেপে, মুখ কালো
করে ভাবে এতকাল পরে না ফেরাই ছিল ভালো।
বন্ধু তোমাকে
( ফয়েজ আহমদ কারারুদ্ধ হবার পর)
বন্ধু, তোমাকে ওরা বিচ্ছিন্ন করছে
তোমার লেখার টেবিল থেকে, সজীব বাতাসের
স্পর্শ, ফুলের ঘ্রাণ, রবীন্দ্রনাথের গান আর
প্রশস্ত রাজপথে, গমগমে মিছিল থেকে,
তোমাকে ওরা কেড়ে নিয়ে গ্যাছে আপনজন, নিষ্ঠাবান
সহযাত্রীদের কাছ থেকে।
বস্তুত ওরা তোমাকে নিক্ষেপ করেছে কারাগারে,
কেননা তোমার কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়েছিল সর্বহারাদের
সপক্ষে, গণতন্ত্রের পথ সুগম করার মন্ত্রে;
তুমি আওয়াজ তুলেছিলে
মানবতার জয় হবে বলে।
বন্ধু, এ এক চরম বিপর্যস্ত, হন্তারক সময়ে
আমরা বসবাস করছি,
আমাদের দিনরাত্রি কাটে সন্ত্রাসের ছায়ায়।
কখন কে হারায় প্রাণ ঘাতকের হাতে, কোন্
পাড়ায় জ্বলে ওঠে আগুন, এই দুর্ভাবনা
নিত্যদিন আমাদের তাড়া করে। ভাড়াটে গুণ্ডাদের থাবা
অষ্টগ্রহর উদ্যত সজ্জনদের প্রতি।
তুমি কারাগারে বন্দি হবার পরেও
চাঁদ ওঠে আকাশে, যে-চাঁদ শহীদের
রক্ত মাখা মাথা। গাছের সবুজ পাতা চিরে ডেকে ওঠে
কোকিল, কিন্তু রক্তচক্ষু কোকিলের
গলা থেকে আজ গান নয়, বিচ্ছুরিত হচ্ছে শহীদের তাজা খুন।
বিশ্বাস করো বন্ধু, এ দেশের প্রতিটি
প্রগতিশীল কবির হাত
প্রসারিত জেলখানার গরাদের দিকে, যার আড়ালে
ওরা রেখেছে তোমাকে, যাতে তোমার গলার আওয়াজ
পৌঁছুতে না পারে বাইরের জগতে। অথচ জানে না ওরা,
আমাদের প্রত্যেকের কণ্ঠস্বর আজ তোমারই কণ্ঠস্বর।
বিবাহিত
বারবার কেন একটাই
ছবি ফুটে ওঠে? গাছাগাছালির ভিড়ে
কে যেন দাঁড়িয়ে থাকে সকল সময়। তার ঠাঁই
মনের ভেতরে সেই কৈশোরের দিন থেকে। মিড়ে মিড়ে
একটি প্রচ্ছন্ন সুর বানায় গোলাপি
রঙ, কখনো বা পীত, আকন্দগাছের পাতাগুলি
হৃদয়কে ছোঁয়, মন ময়ূরের বিস্তীর্ণ কলাপ
হয়, সে দাঁড়িয়ে-থাকা গান গায়,যেন বুলবুলি।
তাকে আমি চিনি না, কখনো স্পষ্ট তার
মুখশ্রী দেখিনি; দূরবর্তী গ্রামের রেখার মতো
মনে হয় মাঝে মাঝে। মনে রাখবার
ইচ্ছে না হলেও মনে থেকে যায় আর ক্রমাগত
স্মৃতির ভেতরে স্মৃতি হতে থাকে নানা
দৃশ্য তারই চিত্রকল্পে, যাই
কত জায়গায়, দূরে দূরান্তরে, জানা কি অজানা
লোকালয়ে, শুধু সে দাঁড়িয়ে থাকা স্থির রয়ে যায়।
তার কাছে চাওয়ার কিছুই নেই, আমিও পারি না
তাকে দিতে কোনো কিছু, তবু বিনিময়
হয়ে যায় পরস্পর কেমন অজ্ঞাতসারে বিনা
শানাইয়ে, মঙ্গলঘটে, দুর্বায়, প্রশান্ত সূর্যোদয়
আর অস্তরাগ-প্রভাবিত
আমার অক্ষরবৃত্তে, তার দাঁড়াবার ভঙ্গিমায়।
পঞ্চাশ বছর গেছে অস্তাচলে, আমি বিবাহিত
হয়ে আছি অপরূপ কৌমার্যের অববাহিকায়।
মাছি
গোধূলিতে ঘাড় গুঁজে পড়ে আছে ঘাসের সবুজে
একটি বাদামি পাখি পথে যেতে দেখি আমি। সেই
পাখি কখন যে মরে ছিল সেখানে একাকী, জানা
নেই; ডানা তার জব্দ বড়, আর তাকে ঘিরে জড়ো
হয় প্ররিশ্রমী পিঁপড়ে, কতিপয় মাছি এসে বসে
যেন মেদমজ্জা নেবে শুষে, গোধূলি কী নগ্ন সজ্জা
হয়ে ঢেকে আছে তার সমস্ত শরীর, অস্ত যায়
বেলা, ফিরে আসি ঘরে। রাত্তিরে টিভির ফিল্ম দেখে,
কথা বলে গ্রিনের নভেল পড়ে ভুলে থাকি মৃত
পাখিটাকে। তৃতীয় প্রহরে ঘুম ভাঙে অকস্মাৎ,
দেখি ঘরময় কিছু নীল ডুমো মাছি নিচু হয়ে
ঝুঁকে থাকে আমার উপর সারাক্ষণ, ঢুকে যেতে
চায় কানে, নাকের খোড়লে। চেয়ে থাকি নিরুপায়,
পারি না উড়িয়ে দিতে, কী কষ্ট নিশ্বাস নিতে আজ।
যদি কোনোদিন
যদি কোনোদিন আসো দেখবে এখানে লেখা আছে স্পষ্টাক্ষরে
বাড়ির নম্বর। আমি এসেছি এখানে ডিসেম্বরে,
বলা যায়, অকস্মাৎ। পাড়ার ছেলেরা
মাঝে-মাঝে উদ্দীপনা-ঘেরা
মঞ্চে নিয়ে আমাকে বসায়, মাল্যদান
করে আর আনাড়ি কণ্ঠের রাশি রাশি কবিতা ও গান
শুনে ফ্ল্যাটে ফিরে আসি রাতে,
কখনো ছিঁচকে চোর শুনি ধরা পড়ে হাতেনাতে।
কুয়াশার শাল মুড়ি দিয়ে বসে থাকে যে সকাল,
তাকে সুরে সুরে চুমো খায় পাখি; লোক যায়, আসে,
পাতাবাহারের ডাল
ঝুঁকে থাকে জানালায়। পৌর ট্রাক দেয় হানা, দখিনা বাতাসে
ফুল আর ড্রেনের মিশ্রিত গন্ধ। কিশোরেরা শখের ক্রিকেট
খেলে ফাঁকা জায়গাটায়। কখনো বা নেট
টাঙিয়ে দু’দল লোটে ব্যাডমিন্টনের
আনন্দ এবং হল্দে তেতলা ফ্ল্যাটের
বন্ধঘরে কে তরুণ রাত তিনটেয় করে নান্দীপাঠ
আত্মহননের, ভয়ে কাঠ
কেউ কেউ গভীর রাত্তিরে, জাগে মিলিত বিলাপ।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ, রাধে রাধে
বলে চলে যায় দূরে বিবাগী বৈষ্ণব
গান গেয়ে। ভোরে দেখি অদূরে প্রশান্ত খোলা ছাদে
অষ্টাদশ শতকের রাজার শিরের মতো টব,
রোদের আবীরে স্নিগ্ধ ফুটে আছে আর্কিড, গোলাপ।
যোদ্ধা বিষয়ে
অকস্মাৎ আমার দুর্বল কাঁধে কে রাখলো হাত?
বিদ্যুল্লতা খেলে যায়,
চোখ হয় তারা আর দ্যুলোক ভ্যূলোক
কে জানে কিসের টানে অন্য মানে পায়। লোকে বলে
পথ দেখাবার ছলে কখনো কখনো
অপদূত ছদ্মবেশে নেমে আসে পথে,
তখন সংগীত থেমে যায় লহমায় গাছে গাছে
পাখি যেন বেবাক মাটির ঢেলা। যাচাই করার
কিছু আছে ভেবে বারবেলা
ঘন ঘন পেছনে তাকাই-
কেউ নেই, শুধু তর্জনীর স্পর্শ টের পাই কাঁধে।
ফিরে তাকাতেই নির্জনতা-কামড়ানো পথরেখা
কণ্টকিত আর
আমার শিরায় বেজে ওঠে উত্তরাধিকার, দেখি
অনেক পুরানো এক দীঘি থেকে দু’টি শাদা হাতে
আমার উদ্দেশে পানি কেটে
উঠে আসে। এক হাতে চকচকে শাণিত কুঠার,
অন্য হাতে নক্ষত্র-খচিত তলোয়ার। মন্ত্রমুগ্ধ তুলে নিই
সম্ভ্রমে মাটিতে নুয়ে তারা-ঝলসিত
অসি, দশমিক হয় গভীর সংগীতময়, গাছে
পাতাগুলি আরো বেশি সতেজ, সবুজ।
আকন্দফুলের গন্ধ পথময়, মাথায় শিশির।
তবে কি দীক্ষিত আমি? এই যে এখন
ব্যাপক কুয়াশা চিরে
আলপথ বেয়ে শুরু হলো চলা, শুধু
চলা, এর শেষ
কোথায় জানি না, দায়ভাগ
মাথার ভেতরে ফুটে আছে শ্বেতপদ্ম, রমণীর
প্রেম থেকে দূরে এই একলা ভ্রমণ।
চতুর্দিকে শক্রদের ঢ্যাঙা ছায়া, ওদের নিখুঁত
যুদ্ধসাজ সন্ধ্যা আনে চোখে,
তারার ছন্দিত তলোয়ারে হবে ওরা খান খান
সুনিশ্চিত, এবং জোনাকি-অভ্যর্থিত
পথে কামিনীর ঘ্রাণ নিয়ে
বাড়ি ফেরা হবে না কখনো।
রাত দেরটায়
জামগাছের ডালটা তথাস্তু বলবার ভঙ্গিতে
ঝুঁকে থাকে বাড়ির ছাদে
আর জন্ম-জন্মান্তর পাড়ি দেয়া বাতাস দিব্যি হুটোপুটি
লাগিয়ে দেয় কার্নিশে। গলিতে
একটা মাতাল কার উদ্দেশে গালাগালের নর্দমা
বইয়ে দিলো, ঠিক বোঝা গেল না। দূরে
একটা কুকুর রাস্তাকে কেমন রহস্যময়
করে কাঁদতে থাকে একটানা করুন কাহিনীর মতো।
‘ওগো, তুমি আর ওসব ঝুটঝামেলায় যেও না,
আমার বড় ভয় করে। কী দরকার
একহাঁটু ধুলো ভেঙে
অজ পাড়াগাঁয়ে ঘুরে বেড়াবার না খেয়ে, আধপেটা
খেয়ে? খামোকা গলির মোড়ে মোড়ে
লোকদের সমাজ পাল্টাবার মন্ত্র জপিয়ে অথবা
সরকার বদলের ডাক দিয়ে
নিজেরই বিপদ ডেকে আনবার কী দরকার?
তোমার একটা কিছু হলে
আমরা বসবো পথে, এই সভেংচি ভাবনাকে
তুমি মোটেও আনো না আমলে। ওলো, তোমার পায়ে পড়ি,
আর তুমি যেও না মিটিং-এ মিছিলে’,-এই বলে
রোমানা শয্যায় স্বামীকে মেয়েলি মুদ্রায়
আলিঙ্গনে বাঁধে গার্হস্থ্য প্রেমে বুঁদ হয়ে।
তার, জাভেদের, মুখে এক ফালি হাসি ঝিকিয়ে ওঠে
কিন্তু সে মুখ খোলে না। রোমানার
চোখে ঢোখ রেখে ওর ঠোঁটে আলতো ছুঁইয়ে দেয়
তর্জনী। নারীর চোখ বুঁজে আসে, পুরুষের দৃষ্টি
পর্যটক নক্ষত্র-ভরা আকাশে। একদা যেখানে ছিল
ডুমুর গাছটা, এখন নেই, সেখানে
দৃষ্টি মেলে দিয়ে কী যেন ভাবছিল তার
নিঃসঙ্গতার মণ্ডলে ঘুরপাক খেতে খেতে।
হঠাৎ এই মধ্যরাতে এত জোরে দরজায় কড়া নাড়ে কে?
জাভেদ তড়াক করে চিতাবাঘের ধরনে লাফিয়ে ওঠে
বিছানা ছেড়ে, জানলা দিয়ে দ্যাখে বাইরে
ঘাপটি মেরে থাকা কালো ষাঁড়ের মতো
একটা পুলিশ ভ্যান। দূরের আকাশে তারামণ্ডলী
বর-ঠকানো আসর জমিয়ে
মিটিমিটি হাসছে আর জানলার ধারে
দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা ভাবছে
কী করে লকলকে-জিভ ডালকুত্তাদের চোখে
ধুলো দিয়ে নড়বড়ে পুরানো দেয়ালটা
টপকিয়ে আগামী বাংলাদেশের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে
মাথা উঁচিয়ে হেঁটে গিয়ে
শপথ নেবে শহীর মিনারে আবার নতুন করে।
রাস্তার ধারে
হরিণের গায়ের রঙের মতো বিকেলবেলা
রাস্তার ধারে এক রেস্তোরাঁয়
হাল আমলের তিনটি যুবক দিচ্ছে
প্রাত্যহিক আড্ডা। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে
কেউ বলে, তিন মাস ধরে দিনরাত
বিস্তর কাগজ নষ্ট করেও সে লিখতে পারে নি কিছুতেই
তিন ছত্র পদ্য। কেউ
সুন্দরবনের গল্প শোনায় জিম করবেটের ধরনে।
অ্যাসট্রেতে সিগারেটের
ছাই ঝেড়ে ঝেড়ে,
কেউ-বা দাঁড়িতে বুলিয়ে হাত সমাজ বদলে দ্বান্দ্বিক
কথা বলে সুদূর গুহাযুগের সূত্র ধরে।
মাঝে-মধ্যে ওদের ভঙ্গিতে
সেই বিকেল বেলা ফুটে ওঠে প্রতীক্ষার মুদ্রা।
সে কি তবে আসবে না আজ?
এই প্রশ্ন ওদের ওপর
চাঞ্চল্যের ঝর্ণা বইয়ে দেয় কখনো কখনো।
কারো মনে পড়ে যায়-
একদা সারা দুপুর
সে কাটিয়েছিল একঝাঁক
প্রজাপতির পেছনে ছুটতে ছুটতে।
একজন ভাবে, অধুনা রোমিও যদি নিশ্বাস নিতো
এই গ্রহে, তবে কি শুভ নাস্তিক্যের টানে তার হাত থেকে
স্খলিত হতো না বিষপাত্র? অন্যজন
মনে করতে উদ্যোগী হয় কাফ্কার স্বপ্নের মতো
কোনো স্বপ্ন, যা সে দ্যাখে বার বার।
ট্রাফিকের গর্জন, এ ওর দিকে তাকায়, মাঝে মাঝে
দৃষ্টি চালিয়ে দেয় বাইরে,
আর অপেক্ষা করে, তার জন্যে, যার আসার কথা
এখানে যে-কোনো মুহূর্তে যার জুতোয়
থাকবে ধুলো, যার চুল উস্কো খুস্কো, চোখ
স্বপ্নপরায়ণ, যে বলতে পারতো
নানা ঘাটের নানা কথা, করতল মেলে
দেখাতে পারতো নিজস্ব জগতের প্রতিভাস।
রাত্রি বাড়ে, রেস্তোরাঁ ক্রমে ফাঁকা হয়ে আসে,
সে আসে নি।
শ্রুতলিপি
সারারাত জেগে আমি ফুটিয়েছি শ্বেতপদ্ম এক
অমল অক্ষরবৃত্তে। প্রথমে খানিক দ্বিধা ছিল,
পরে মনে ঈষৎ গোলাপি আভা কলাপ হতেই
জন্মদিন শুভ হোক বলে গেলাম তোমার কাছে
সন্ধ্যেবেলা অঞ্জলিতে তুলে দিতে নিবিড় আড়ালে
স্বরচিত শ্বেতপদ্ম। ‘ধন্যবাদ’ বলে তুমি স্মিত
মুখে সোফাটির দিকে আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেলে।
সোফাটায় গা এলিয়ে বললাম, বস্তুত তোমাকেই
কৃতজ্ঞতা জানানো দরকার। কেননা এ শ্বেতপদ্ম,
যার প্রতি পরাগে উদ্ধত ‘আয়ুষ্মতী হও’ শ্লোক,
তোমার দু’চোখ, ঠোঁট, নাভিমূল, গ্রীবা আর বুক
করেছে রচনা, আমি শ্রুতলিপি করেছি ধারণ।
সেই অঘ্রানের রাতে
সেই অঘ্রানের রাতে
কী যেন থাকবে, তুমি পারবে না কিছতে ঘুমাতে;
এমনকি ব্যর্থ সেডাক্শিন; বারান্দায়
বড় একা বসবে জ্যোৎস্নায়
চোখ মেলে, ক্যাসেট প্লেয়ারে দেবব্রত
নিমগ্ন ইমন, তুমি বনপোড়া হরিণীর মতো
ছুটবে ঘরের দিকে, হয়তো আমি তখন কবরে
নিরস্তিত্ব আর অস্তিত্বের ভিন্ন স্তরে!
তুমি মনে রেখেছো কি রাখো নি আমাকে,-অর্থহীন
এই প্রশ্ন বস্তুত সেদিন।
তবু জেনে নিতে সাধ হয়, আগামীর রৌদ্রজলে
তোমার হৃদয় কাকে কোন্ কথা বলে?
পুরো স্পিড়ে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে
বইয়ের র্যােকের কাছে নিঃশব্দে এগিয়ে
যাবে, এলেবেলে খুঁজে একটি রোগাটে বই তুলে
ধুলো ঝেড়ে পাতা খুলে
জ্বালিয়ে টেবিল ল্যাম্প চোখ
বুলোবে আমার কবেকার পদ্যে, অতীতের নখ
তোমার নরম বুকে কাটবে আঁচড়,
মনে হয়, নাকি মেনহুইনের বেহালার ছড়
তোমাকে ভুলিয়ে নিয়ে যাবে
অন্য পথে জ্যোৎস্নাপ্লুত সুরের প্রভাবে?
তোমার পায়ের কাছে পড়বে লুটিয়ে দূর নীল
জল-ছোঁয় অতীত-কাতর গাংচিল।
পুরোনো রোগাটে বইটিতে হাত রেখে,
অস্পষ্ট স্বপ্নের মত নক্ষত্রের ভিড়ে মুখ ঢেকে
বলবে রাত্রির কানে তুমি, ‘এই কবি,
ছন্নছাড়া, একদা আমাকে নিয়ে ভৈরবী, পূরবী
আর দরবারী কানাড়ার রূপময়
ছবি এঁকেছিল কী তন্ময়,
মেতেছিল অধরাকে ছোঁয়ার খেলায়
রোদপোড়া জীবনের অস্থির বেলায়।
হয়তো ভেবে তুমি নিশ্চুপ, কী বোকা।
তখন আমার নেই অতীত অথবা বর্তমান
ভবিষ্যৎ, তবু আসবো গাইবো স্বরহীন গান।
সেই অঘ্রানের রাতে
ক্লান্ত হয়ে অবশেষে যাবে বিছানাতে,
পাশে নিদ্রা আর পুরুষালী ঘ্রাণ, টিপে
দিয়ে বেড-সুইচে বালিশে মাথা রাখবে, সুদূর কোনো দ্বীপ
চকিতে উঠবে জেগে। ঝর্ণা, টিলা,
অন্তরাগময়, আদিবাসী নাচ, ধনুকের ছিলা
পাকদণ্ডী, মহিষের মুণ্ডু, পদচ্ছাপ,-
প্রতীক্ষাকাতর কেউ গোলাপ বাগানে, ফটোগ্রাফ
ঝরে অ্যালবাম থেকে ক্রমাগত-
টেবিলে রোগাটে হল্দে বইটির পাতা উড়বে স্মৃতি মতো।
হাসির কবিতা
সভাকক্ষ থইথই শ্রোতাদের ঝলমলে ভিড়ে
যখন এলেন তিনি, কবি,
সুকান্ত রাজার মতো মাথা উঁচু করে,
ক্ষণিকের জন্যে গুঞ্জরণ উঠে ফের
নেমে আসে স্তব্ধতা। ঘোষক তার ঘোষণার
পর্ব শেষ করে
অন্তরালে চলে গেলে, কবি,
খ্যাতির আলোয় দীপ্যমান, এলেন চেয়ার ছেড়ে
মাইক্রোফোনের কাছে এবং তুমুল
করতালি তাঁকে নিয়ে যায় কী মোহন তরঙ্গের
ফেনিল চূড়ায় আর কবির দৃষ্টিতে
সভাকক্ষ একটি বিশাল রক্তজবা হয়ে ফোটে।
করতালি স্তব্ধ হলে কিন্নর কণ্ঠের অধিকারী
কবি তাঁর সংক্তিমালা করলেন পাঠ
অনিন্দ্য ভঙ্গিতে। কিন্তু কী আশ্চর্য, পাঠান্তে শ্রোতার
করতালি পান নি শুনতে তিনি, শুধু
মরীচিকাতুল্য নীরবতা, ভীষণ অস্বস্তিকর, ভেংচি কাটে
তাঁকে সারাক্ষণ, তিনি নাকি
এমন কবিতা আগে লেখেন নি কস্মিনকালেও।
এ যেন বাসের ভিড়ে যাত্রীকে ভীষণ
ঝাঁকুনি দেয়ার নামান্তর। ছন্দ নেই, সুর নেই, নেই মধুর কথার
গুঞ্জরন পর্বে পর্বে, উপরন্তু কবি
অর্থকে পাঠিয়েছেন বানপ্রস্থে, যেন
বিশ্বাসঘাতক তিনি, অনুরক্ত ভক্ত শ্রোতাদের
খুব ঠাণ্ডা মাথায় প্রকাশ্যে
করেছেন খুন, কেউ তাঁকে পুষ্পস্তবক অথবা
এউ-ঢেউ মালা, মৃদু সাধুবাদ দিলো না কিছুই। অকম্পিত
হোমশিখা, রাজার মতোই তিনি মঞ্চ থেকে নেমে
যেন গৃহবলিভূকদের মধ্য দিয়ে
গেলেন একাকী হেঁটে অভ্যর্থনাহীন।
অকস্মাৎ রাত তিনটেয় কবি ঘুম থেকে জেগে উঠে তাঁর
কবিতার খাতা
খুলে বসলেন আর শাদা পাতাটায়
ভোরবেলাকার
আবীরের মতো কিছু অক্ষর সাজিয়ে ছন্দে-মিলে
লিখলেন নিদারুণ হাসির কবিতা।