এ শহরে কোনোদিন কোকিলের ডাক শুনে অকস্মাৎ
থমকে দাঁড়াই ফুটপাথে। শ্যামলীর এ মলিন
গলিতেও গোলাপের চাষ হয়, কোথাও কোথাও
প’ড়ে থাকে বুগেনভেলিয়া। সর্বোপরি আমাদের
দু’জনের অপরূপ মানবিক ভালোবাসা ধু ধু
শহরকে বাঁচাবে নিশ্চিত মরুভূর গ্রাস থেকে।
১৮/৩/৯৫
বৃষ্টি
একটি স্বপ্নের মাঝখানে হঠাৎ
আমার ঘুম ভেঙে যায়; দৃষ্টি মেলে দেখি
তখনও শেষ রাতের হাত
আকাশের কোমড়ে জড়ানো। বাইরে
বৃষ্টির মৃদু শব্দ, আমার মনে নামে
বিষণ্নতার নিস্তব্ধ কুয়াশা।
স্বপ্নে তোমাকেই দেখছিলাম। আমরা,
তুমি আর আমি, একটি ফুটফুটে জ্যোৎস্নাপ্রতিম
বালিকার জন্যে সাজাচ্ছিলাম ঘর,
কোত্থেকে হিংসুটে এক ঝড় বুনো ষাঁড়ের মতো
তছনছ ক’রে দিলো সব, আমরা
একপাল শূয়োরের পায়ের তলায় ভীষণ জব্দ।
একটি মালা আমাদের দু’জনের হাতে
জড়িয়ে যাচ্ছিল মমতায়; কাঁচের মতো স্বপ্ন গেল ভেঙে।
হাত মুখ ধুয়ে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় একজন
চীনা কবির কবিতা পড়ার চেষ্টা করি; বার বার
দেয়ালে, বাইরে ঝাপসা ঘরবাড়ি আর গাছপালায়
দৃষ্টি যায়। মনের বিষণ্নতা
অধিকতর ঘন হয় এবং
তখনও তোমার অশ্রু-ফোঁটার মতো
বৃষ্টি ঝরছে
টিপ টিপ
টিপ টিপ
টিপ টিপ…
২৫/১১/৯৫
ভালোবাসা কারে কয়
লোকে জানে, আমি নিজে জানি সবচে’ বেশি,
অতীতে বহুবার প্রেম-প্রেম খেলা খেলেছি
বেপরোয়া জুয়াড়ির ধরনে এবং
সেসব খেলা ভেঙে যেতে অধিক সময় লাগেনি।
তোমাকে ভালোবাসার আগে,
তোমার প্রেমের পূর্ণিমায় স্নাত হওয়ার আগে
ধনীর দুলাল কায়েস ঐশ্বর্যখচিত খিমা ছেড়ে
কেন ছিন্ন বেশে উদ্ভ্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছে
শরীর শীর্ণ এবং
পা রক্তাক্ত ক’রে লায়লা লায়লা ব’লে,
ভাস্কর ফরহাদ কেন শিঁরির জন্যে
নহর আনার উদ্দেশ্যে, নিজেকে দিনরাত
উপোসী রেখে পাহাড় কাটার কাজে বিলীন করেছে,
সওদাগর কেন মাহিওয়াল হয়ে
নিজের উরুর মাংস কেটে
পাঠিয়েছে সোহনীর উদ্দেশে,
মালকা বানুর আশেক মনু মিয়া তার মাশুকের জন্যে
কেন বারবার পেরিয়েছে মহেশখালী প্রণালী-
এসব অসম্ভবের তাৎপর্য
কখনো উপলব্ধি করিনি।
কত দুর্গম পথ পেরিয়ে বিষধর সাপের ফণা থেকে
মণি ছিনিয়ে এনে একটি মণিহার
তোমাকে পরিয়ে আর তোমার ভালোবাসার
চন্দন-তিলক ললাটে নিয়ে জেনেছি
ভালোবাসা কারে কয়।
২২/১১/৯৫
মাতাল
মদিরা করিনি স্পর্শ, অথচ মাতাল হ’য়ে আছি
দিনরাত; নিত্য কুৎসাকারীদের জিভের খোরাক
আমি, কেউ কেউ ক্রোধে আমাকে পুড়িয়ে করে খাক।
আমার করোটি জুড়ে কবিতার সোনালী মৌমাছি
প্রায়শ গুঞ্জন তোলে; অচিন পাখিরা নাচানাচি
করে হৃৎবাগানে আমার। গূঢ় রহস্যের ডাক
নিশীথে নদীর তীরে নিয়ে গিয়ে বলে, ‘ভরা থাক
তোমার প্রেমের পাত্র। যদি থাকে, তাহ’লেই বাঁচি!
মাতাল, মাতাল আমি সুনিশ্চিত। কারো অপবাদ
দেবো না উড়িয়ে হেসে, তবে বলি দৃঢ় কণ্ঠস্বরে-
বিত্তের লালসা নয়, চপল খ্যাতির মোহ নয়,
প্রতাপশালীর সীমাহীন তীব্র ক্ষমতার সাধ
কিংবা ধর্মান্ধতা নয়, সত্যি আমাকে মাতাল করে
প্রকৃত কবিতা আর সুপ্রিয়ার প্রগাঢ় প্রণয়।
১১/৩/৯৫
মেঘদূত
আমিও মেঘকে দূত ক’রে এখুনি পাঠাতে চাই
তার কাছে, যে-আছে আমার পথ চেয়ে
প্রতিক্ষণ। কালিদাস নই, তবু কত অনুনয়
করি মেঘকন্যাদের উদ্দেশে, অথচ ওরা চুপ
থাকে, সাড়া দেয় না কখনো একালের
শাদামাটা কবির অধীর মিনতিতে। নিরুপায়
আমি ধর্ণা দিই টেলিফোনের নিকট। কিন্তু তবু
স্বস্তি নেই; টেলিফোনও বিগড়ে থাকে যখন তখন।
সে জানে, আমার মেঘদূত নেই কোনো, তার
কাছে বার্তা পাঠানো সহজ নয় সকল সময়।
যখন গহন বর্ষা হৃদয়ের দু’ কূল ছাপিয়ে
স্পন্দমান, তাকে কাছে পাওয়ার বাসনা অগ্নিবাণ
হ’য়ে জ্বলে, পোড়ায় আমাকে। তার অশ্রুধারা আর
শ্রাবণের জলধারা নীল শূন্যে একাকার হয়।
২৯/৬/৯৫
যদিও লোকটা অসুস্থ
বেশ কিছুদিন হলো, বহুদিন হলো অসুস্থতা
চঞ্চুতে রেখেছে বিদ্ধ করে লোকটিকে। এখন সে
পড়ে না সংবাদপত্র, কতদিন কবিতার বই
সস্নেহে আলতো ছুঁয়ে রেখে দেয়, কখনো হয় না
পড়া, মাঝে মাঝে খুব কষ্ট ক’রে একটি কি দু’টি
কবিতা অথবা ‘ছিন্ন পত্রাবলী’ থেকে এক আধ
পাতা চেখে নেয়, রোগাক্রান্ত ক্লান্ত চোখ বুঁজে আসে;
শোণিতে শর্করা হেতু দুর্বল শরীর, মনে পড়ে-
সমানবয়সী বন্ধু কেউ কেউ গত, কেউ কেউ
ধুঁকছে অসুখে ইদানীং তারই মতো। সাড়ে তিন
বছরের পৌত্রী এসে যখন জড়িয়ে ধরে গলা,
কথা বলে শৈশবের স্নিগ্ধ স্বরে, অসুস্থ লোকটা
কেমন সজীব হয়ে ওঠে, মৃত্যুচিন্তা অস্তাচলে যায়।
উৎসুক অথচ ক্ষীণ দৃষ্টি মেলে তাকায় শিশুর
দিকে, যে সম্পদ কিংবা বিষাদ বোঝে না, ফুটে থাকে
কনকচাঁপার মতো। এই বয়সেও এ বিবর্ণ
কালেও যে তাকে ভালোবাসে, যখন সে চলে আসে
কোনো সন্ধেবেলা, তাকে দেখলেই চিত্তময়
রঙিন ফোয়ারা উচ্ছুসিত হয়, তার কণ্ঠস্বর
একবার শুনলেই আরো বহুকাল বাঁচবার
সাধ জাগে, তার গভীর মনোজ শুশ্রূষায়
জীবনের বহু ক্ষত সেরে যায়, অন্ধকার ফুঁড়ে
বৃত্ত-চাঁদ ওঠে রুগ্ন মনের দিগন্তে, লোকটার
মনে হয়, বিপন্নতা জীবনকে করে উপরূপ।
১২/৪/৯৫
যাওয়া যায়
যখন দাঁড়াও তুমি রাত্তিরে কৃপণ বারান্দায়
নিরিবিলি, খোলা আকাশের তারাগুলি বিস্ফারিত
চোখে দ্যাখে তোমাকে এবং ভাবে-কে এই মানবী
এমন স্বর্গীয় রূপ নিয়ে আছে ধূসর জমিনে?
‘অতিশয়োক্তির অবকাশ নেই’, মেঘ তারাদের
কানে-কানে বলে। আমি মেঘ থেকে তৎক্ষণাৎ চোখ
সরিয়ে নক্ষত্রদের কৃতঞ্জতা জানাই আমার প্রেমিকার
উদ্দেশে প্রশস্তি রচনার জন্যে কৃপণ সমাজে।
আমার প্রাণের কথা নক্ষত্র বলেছে অবিকল,
মনে মনে জানি আর যে যাই বলুক আমি তাকে
সবচে’ রূপসী ব’লে করি পান বিষণ্ন সৌন্দর্য
তার সঙ্গোপনে; উপরন্তু যার মনের বৈভব
সব বিবেচনাকে ছাপিয়ে ওঠে, তার কাছে রোজ
যাওয়া যায় সব বাধা, ঝড়জল হেলায় উজিয়ে।
৬/৫/৯৫