যখন শহরের অশ্লীল হৈ-হুল্লা, বিরক্তিকর যানজট,
নিষ্ফল বচসা,
তারুণ্যের নষ্টামি, বয়স্কদের হ্যাংলামি আর ভণ্ডামি,
বর্বর-বাহিনীর জয়োল্লাস, ন্যায়ের নির্বাসন,
আইন-শৃংখলার মুখ-থুবড়ে-পড়া, প্রশাসনের নির্বোধ
স্বেচ্ছাচার,
মর্গে অশনাক্ত লাশের ভিড়,
সন্ত্রসীদের বেলাগাম দাপট, ফাঁপা রাজনীতির
করুণ পরিণতি আমাকে খুব ক্লান্ত করে,
তখন ইচ্ছে হয়,
তোমাকে নিয়ে চলে যাই
আমাদের পাড়াগাঁর বাড়িতে।
ইচ্ছে হয় পাড়াতলীর প্রজাপতিময় সর্ষে ক্ষেতের ধারে,
দিঘীর পারে
তোমার হাত ধরে হেঁটে বেড়াই। আমার পরহেজগার
পূর্বপুরুষগণ কি নারাজ হতেন খুব?
সেরকম ভাবনা আমাকে ডুমো মাছির মতো
উত্ত্যক্ত করে না। গৌরী,
সেখানে গেলে তুমি দেখতে পেতে
তাদের আনন্দ প্রতিফলিত আম-জামের পাতায়,
বউ কথা কত্ত পাখির ডাকে।
১২/১১/৯৫
তোমাকে দেখি প্রতিক্ষণ
তোমাকে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ দেখতে চাই দু’চোখ ভ’রে
যখন তোমাকে দেখতে পাই না,
তোমার পাশে ব’সে কিছু সময় কাটানো থেকে
বঞ্চিত হই, তখন মনে হয়-
আমি যেন সেই রোগী, যাকে শ্বাসকষ্ট ভোগায়
প্রতি মুহূর্তে। তোমার মুখ অদর্শনের
অন্ধকার তীরে থাকলে
এই মতো অনুভূত হয়,
আমি এক বিয়াবান কন্টকময় পথ
পাড়ি দিচ্ছি দিগভ্রান্ত পথিকের মতো; আমাকে
আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে বহু উদ্ধত ফণিমনসা।
সে-পথে বিষধর সাপের কুণ্ডলী,
হিংস্র জন্তুর আধ-খাওয়া নরদেহ এবং
দৃষ্টি-অন্ধ করা দীর্ঘস্থায়ী আঁধিঝড়।
ক্যালেন্ডারের তিন শো পঁয়ষট্রি দিনের তিন শো দিনই
তোমাকে দেখতে পাই না। বাকি দিনগুলি
তোমার দেখা পাই কখনো প্রকাশ্যে, কখনো-বা সঙ্গোপনে।
সতর্ক, ক্রূর দৃষ্টির পাহারা,
নিষেধের সদা উদ্যত তর্জনী,
বাধার দুর্লঙ্ঘ্য কাঁটাতার তোমাকে
দেখতে দেয় না প্রতিদিন। এই বিরূপ সংসারের
অদৃশ্য, অমানবিক নিপীড়নে কাটে আমার দিনরাত্রি।
অনেক বছর
তুমিহীনতায় কেটে গ্যাছে। আমরা কেউ কাউকে
দেখতে পাইনি, যদিও এই একই শহরে ছিলাম দু’জন;
আরো ক’বছর আগে
কেন আমরা আমাদের হইনি? কেন?
তবুও যে শেষ পর্যন্ত মিলিত হলাম আমরা,
একেই পরম সৌভাগ্য জ্ঞান করি।
কঠোর বাধার বেড়া ডিঙিয়ে,
বলা যেতে পারে, তোমাকে দেখি প্রতিদিন,
প্রতিক্ষণ স্বপ্নে, আমার ভাবনার নন্দন-কাননে।
১২/১১/৯৫
প্রতীক্ষায় প্রতিক্ষণ
আমরা যখন ভেসে যাচ্ছিলাম নানা
কথার স্রোতে, তখনও তুমি বলোনি,
আজ সন্ধেবেলা তুমি আসবে। আমরা দু’জন
মুগ্ধাবেশে বলছিলাম ভাসমান মেঘের কথা, সদ্য
উড়তে-শেখা পক্ষী শাবকের কথা,
এমন একটি বাড়ির কথা বলছিলাম, যার অবস্থান
গাছপালা, লতাগুল্মময় টিলার উপর। সেই
বিনীত, বাংলো প্যাটার্নের বাড়িতে
থাকবো শুধু আমরা দু’জন। কেউ আমাদের
নির্জনতার দ্বারে
হানবে না আঘাত। তুমি বললে কণ্ঠস্বরে মাধুর্যের
ঢেউ খেলিয়ে, ‘এই শোনো,
তুমি কখনো কবিতা পড়বে,
আমি শুনব তন্ময় হ’য়ে, আর আমি পড়বো তোমার
নতুন লেখা কোন কবিতা তুমি শুনবে আনন্দিত চিত্তে,
আমি পড়তে গিয়ে হোঁচট খেলে, তুমি মৃদু হাসবে।
কখনো তোমার মাথা টেনে নেব কোলে,
আমার চুল ছড়িয়ে পড়বে তোমার সারা মুখে।
আমার আদরে তোমার চোখে নামবে ঘুম।
আমাদের স্বপ্নের বাড়িতে বয়ে যাবে
আমাদের দিনগুলো, রাতগুলো, যেন গুণীর তান।
তুমি চৈত্র-দুপুরে তোমার একাকিত্বের কথা বললে,
আমি বললাম আমার ভেতরকার হু হু হাওয়া আর
হাহাকারের কথা। কিন্তু আমরা কেউ কারো কথার
নিঃসীম শূন্যতাকে ধারণ করতে পারিনি।
এক ধরনের অভিমান তোমার মনে
ঝুলে রইল সব কালো মেঘ হয়ে।
আবার আজ তুমি আসবে আমার ঘরে। আমি সেই
সম্ভাবনার কথা ভেবে বসন্ত ঋতুকে নিবেদন করলাম,
আজ আসতে হবে আমার ঘরের ভেতর, নার্সারির গোলাপগুলোকে আমার অতিথি হওয়ার
আবেদন জানালাম; কোকিল এবং দোয়েলের কাছে
খবর পাঠালাম আমার ঘরকে সুরেলা করার জন্যে।
এভাবেই সাজাবো আমার ছোট ঘরটিকে।
তুমি আসবে তো তোমার সৌন্দর্যের তরঙ্গ তুলে,
সুরভি ছড়িয়ে হাওয়ায়?
আমি সেই কখন থেকে তোমার
প্রতীক্ষায় প্রতিক্ষণ কখনো ধনুকের ছিলা,
কখনো চাতকের তৃষিত ডাক।
২৩/৩/৯৫
বলতে যাবো না
সেদিন তোমাকে কিছু কটু কথা শুনিয়েছিলাম
ক্রোধে জ্বলে, এর আগে যা আমি করিনি কোনোদিন
কোনোক্রমে। তুমি শরাহত রাজহংসীর মতোই
বসেছিলে এক কোণে বেদনার্ত। কোনো নিষ্ঠাবান
চিত্রকর যেমন সুন্দর ছবিতে খুঁত দেখে ছিঁড়ে খুঁড়ে
ফেলে নিজ শিল্পকর্ম, আমি সেদিন সেই মতো
আচরণ করেছি হঠাৎ। তুমি মৃদু প্রতিবাদী
স্বরে কিছু বলে চুপ। সে-রাত আমার ক্রোধে, ক্ষোভে
নির্ঘুম কেটেছে আর কবিতাও আসেনি শোনাতে
প্রবোধের স্নিগ্ধ কোনো বাণী, দগ্ধ হয়েছি অন্তরে
অতিশয়। কী ছিলো তোমার ক্রটি যা আমাকে অন্ধ,
নাছোড় বৃশ্চিক হয়ে করেছে দংশন? মনে-মনে
হয়েছি নিজেরই হন্তারক। সে ক্রটির কথা আমি
নিশ্চিত কখনো হাটে লোক ডেকে বলতে যাবে না।
১৮/১১/৯৫
বাঁচাবে
এ শহরে জীবিকা সর্বত্রগামী; ছোট বড় সব
চাকুরে, টাউট, উচ্চাকাংক্ষী ধনবান, ভিখারীর
ভিড়, শীতরাতে অতি ব্যবহারে জীর্ণ, শীর্ণকায়
রঙিন গণিকা, গঞ্জনায় অভ্যস৫ত খঞ্জের জন্যে
আয়ের নানান পথ খোলা। বেশ কিছু বেকার যুবক
মাস্তানের দঙ্গলে সহজে ভিড়ে যায়। যত্রতত্র
ধর্মের ব্যবসা জমে ওঠে; নীতিবিবর্জত ফাঁপা
রাজনীতি, বাণিজ্যিক সভ্যতার মরু বেড়ে চলে।