চারটি স্তবক
কুয়োর শীতল জল আঁজলায় নিয়ে সন্ধেবেলা
চেয়ে থাকি কিছুক্ষণ; জলে কার মুখ ভেসে ওঠে।
পাখির চিৎকার শুনি, ভাঙে শীতল জলের খেলা
অকস্মাৎ, অদূরে কোথাও শরমিলা ফুল ফোটে।
২
তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কোনো কুয়োতলায়
কিংবা কোনো বাঁশের ঝাড়ে।
তোমাকে আমি দেখেছিলাম এই শহরে কিছু দূরে
স্বল্প ভিড়ে হ্রদের ধারে।
বসেছিলাম পাশাপাশি, হাওয়ায় ছিলো মাদকতা,
ছিলো কিছু জলজ ঘ্রাণ;
চোখের চাওয়ায়, কথা বলার ঈষৎ মায়ায়
দুলেছিলো দু’টি প্রাণ।
৩
তোমার দাঁড়ানো বারান্দায়,
পশামি চপ্পল পায়ে হেঁটে বেড়ানো চাঁদের নিচে, একা
ব’সে থাকা ঘাসে,
অথবা তাকানো সন্ধেবেলা আকাশের
উড়ে-যাওয়া পাখিদের দিকে,
জঙ্গলে সফল পিকনিক, কানায় কানায় ভরা
অবকাশে খাটে শুয়ে নিভৃতে তোমার
নিমগ্ন কবিতা পাঠ, দূরন্ত হাওয়ায়
ফিরোজা শাড়ির আঁচলের নৌকার উদ্দাম পাল
হয়ে যাওয়া-এইসব দেখে যদি
কেটে যেত সারাটি জীবন।
৪
কী ক’রে এখন শান্ত থাকবো বলো
যখন তোমার চোখ দু’টি ছলো ছলো?
আমার হৃদয় ঝড়ের রাতের পথ,
নিঃশ্বাস নেয় রুগ্ন পক্ষীবৎ।
বিষাদ তোমার রূপের পড়শি ব’লে
মনে হয় যেন পড়েছি অগাধ জলে।
৯/৪/৯৫
তবু তোমাকেই
পথিক, পক্ষী ফিরে যায় আশ্রয়ে,
দিগন্ত জুড়ে নেমেছে অন্ধ রাত।
সময় এখন কী ভীষণ অসময়,
আলোর দিকেই বাড়ানো আমার হাত।
ধূলিঝড়ে চোখে কিছুই যায় না দেখা,
কোথায় হারালো কনকাঁপার কাল?
তবু তোমাকেই ব্যাকুল বেড়াই খুঁজে,
যদিও আমাকে জড়ায় ঊর্ণাজাল।
যখন নিবিড় তাকাও আমার দিকে,
হৃদয়ে আমার ফোটে অজস্র তারা;
যখন তোমার কথা শুনি কান পেতে,
করি অনুভব মন্দাকিনীর ধারা।
আজ দুপুরের কাঁপছে চোখের পাতা;
হঠাৎ বললে আমাকে কথাচ্ছলে,
‘তোমার মধ্য বয়সে হয়নি দেখা,
নিশ্চয় তুমি ছিলে খুব জ্বলজ্বলে।‘
এখন আমার শেষ বয়সের রেখা
গোধূলিতে আঁকে বেদনার হু হু ছায়া।
আমিও তোমার পাইনি তখন দেখা,
যখন তোমার নব-যৌবন মায়া।
তা’ ব’লে আমার মনে নেই কোন খেদ,
হয় না পূর্ণ জীবনের বহু সাধ।
তোমার শরীরে যৌবন জ্বলে আজো,
আছে রাঙা ঠোঁটে মধুর, মদির স্বাদ।
তা’ছাড়া আমাকে তোমার মনের দ্যুতি
সবচেয়ে বেশি তোমার দিকেই টানে।
এই শহরের অবিরাম কোলাহলে
বাঁচি আনন্দে তোমার প্রাণের গানে।
১৬/৩/৯৫
তুমি আমাকে দিয়ে বলিয়ে নাও
না, কোনো লুকোছাপা নেই, কখনো কখনো
আমার কোনো কোনো অব্যক্ত ভাবনা
দূর শতাব্দীর আফ্রিকার অন্ধকারের মতো
গুমরে ওঠে, যেন বোবার গোঙানি।
বহু নিশুত রাতের মদিরা আমার শিরায় শিরায়
জমতে থাকে; রোমকূপ ফুঁড়ে প্রবাহিত হ’তে চায়
দিন-দুপুরে,
অথচ কোনো বিস্ফোরণ ঘটে না। কে যেন
শরবিদ্ধ প্রাণীর মতো সারাক্ষণ ভাষাহীন
আর্ত স্বর হ’য়ে আহত উন্মত্ততায় ঘুরতে থাকে
আমার আস্তিত্বের পরতে পরতে।
প্রায়শ নিশ্চুপ থাকি, মুখে কথা সরে না সহজে;
নিজের এই অক্ষমতাকে সুফীদের আত্মগত নিস্তব্ধতায়
নিমজ্জন
এবং উপনিষদের দ্বিতীয় পাখির অবিরাম,
অকস্পিত দৃষ্টিপাতের
দৃষ্টান্তের আড়ালে ঢাকতে চেষ্টাশীল আমি।
মাঝে-মধ্যে ভাষার প্রয়োজনীয়তা
অবান্তর মনে হয়। মনের ভেতর ডুবসাঁতার কেটে
মনোমীনের সন্ধানহ শেয়।
অথচ তুমি কখনো তোমার চোখের চাউনি,
হাতের নড়া,
শরীরের কোনো বিশেষ ভঙ্গি দিয়ে
এই আমাকে কেমন বাঙ্ময় ক’রে তোলো।
আমার এই চোখ, কান, নাক, হাত,
রোমরাজিময় বুক,
প্রায়-মূক মুখ কথা বলতে থাকে
অবিরল কখনো কখনো।
এই তো সেদিন দুপুরবেলা কী-যে বললে তুমি আর
আমার
কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হলো কথায় ঝর্ণাধারা, ‘এই
ভূমণ্ডল, এই সৌরলোক, বিশ্বমানব-
সবকিছুই আমার।‘ তোমাকে প্রথমবার ‘তুমি আমার’
কথাটি বলতে গিয়ে দ্বিধাদ্বন্দের কুশাঙ্কুরে
ভীষণ বিদ্ধ হয়েছিলাম
আড়ষ্ট হ’য়ে এসেছিল আমার জিহ্বা;
কিন্তু সেদিন আমি বার বার উচ্চারণ করলাম
‘তুমি আমার,।
তখন আমাকে প্রগল্ভ মনে হ’তে পারতো।
তুমি আমাকে দিয়ে বলিয়ে নাও এমন সব কথা,
যা বলবার আগেও আমার মধ্যে ছিল না।
হ্যাঁ, তুমি আমার ভেতর থেকে বের ক’রে আনো
অভাবিত অনেক কিছু। এবং কতবার তুমি
একটি ইঙ্গিতে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছ অনেক
কবিতা।
তুমি কি আমার কাছে ছিঁচকাঁদুনে প্রেমের পদ্য
প্রত্যাশা করো?
এই ধরো, ন্যাকা ন্যাকা যত সব বুলি যা মুহূর্তেই
অপরিণত উঠতি তরুণ তরুণীদের মন ভেজায়,
স্যাঁত স্যাঁত ক’রে তোলে। না, প্রিয়তমা,
আমাকে দিয়ে ওসব কিছু হবার নয়।
অব্যশই আমাকে তুমি কথাদের মাঝে নিয়ে যাবে,
তুমি দেখবে আমাকে খুব কাছ থেকে,
আমার হাত নিয়ে খেলা করবে আর
আমার মগজের কোষ থেকে, হৃদয়ের তন্ত্রী থেকে
টপ্ টপ ক’রে ঝরবে শব্দাবলি
কবিতার খাতার সফেদ পাতায়, সেগুলো
আমার নিজের মতো ক’রেই সাজিয়ে নেব
রাতের শেষ প্রহরে কিংবা আকাশের উষ্ঠে যখন
প্রত্যুষের চুম্বন অঙ্কিত হয়।
১২/১১/৯৫
তোমাকে ঘিরে আমার কোনো কোনো সাধ
গৌরী, তোমাকে ঘিরে কত সাধ মঞ্জরিত হয়
আমার মনে দিনরাত, তুমি জানো না।
হয়তো বিনিদ্র রাতে শয্যায়
অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ ক’রে
জানলার বাইরে তাকিয়ে তারা গোনার
চেষ্টা করছি, তখন মনে হয়,
তোমাকে নিয়ে যদি কুষ্টিয়ার সেউড়িয়ায় লালনের
মাজারের পাশের কোনো গাছের ছায়ায় দাঁড়াতে
পারতাম
সাঁঝবেলায়, যদি সেই মুহূর্তে তোমাকে
গাঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে তোমার মুখ চুম্বন করতে পারতাম,
তাহলে আমার হৃদয় হতো বাউলের সুর।
লালন সাঁই কি রুষ্ট হতেন?
আমার মনে হয় না, বরং এতদিনে একজন কবির
মনের মানুষের সনে মিলন হয়েছে জেনে
আনন্দ ঝঙ্কারে বেজে উঠতো তার বহুদিনের নিস্তব্ধ
দোরাতা।
যখন কোনো কোনোদিন কবিতা লেখার সময়
কাঙ্ক্ষিত পংক্তিমালা পথ হারিয়ে ফেলে নীলাভ কুয়াশায়,
তখন তোমাকে নিয়ে কবিগুরুর শিলাইদহের বোটে
চ’ড়ে পদ্মায়
ভেসে বেড়াতে বড় সাধ হয়। যদি আমরা কোনো
অনুমতি ছাড়াই
সেই বোটে গিয়ে উঠতাম, তবে কি রবীন্দ্রনাথ
শিল্পসম্মত ভঙ্গিতে
উষ্মা প্রকাশ করতেন? আমার বিশ্বাস,
তিনি খুশিই হতেন
আর তাঁর গীতবিতানের পাতাগুলো
রৌদ্র-জ্যোৎস্না হয়ে
আদর করতো আমাদের দু’জনকে,
জোগাতো ভ্রমণের উৎসাহ।