এর পরেও
আড়ালে থাকার বাসনায় এই বিরূপ ঋতুতে
আমার নিজের ঘরে বসে আছি অত্যন্ত একাকী।
কোনো কিছু করার উৎসাহ নেই; বাইরে তাকানো
আছে শুধু মাঝে-মধ্যে আর আছে গোপন দহন।
আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে সে, যাকে দ্বিধাহীন
হৃদয়ের নীল পদ্ম করেছি অর্পণ। আমার সে
জখমি হৃদয় থেকে ফোঁটা শোণিত ঝরছে।
চাই না করুণা কারো, আমাকে থাকতে দাও আজ
আমার নিজের মতো। কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো
অভিযোগ নেই আর; আমাকে নিজেই সবচেয়ে
বেশি দগ্ধ করি, ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলি নিজের হৃদয়,
আমার অপনকার পোড়া দেহ দেখি নির্বিকার।
তারপরও সতেজ বুক ভ’রে নিতে পারি,
কাব্যপাঠে মগ্ন হই, কখনো-সখনো লিখতেও
পারা যায় কিছু পদাবলী আর, কী আশ্চর্য, এর
পরেও গৌরীর কথা ভেবে রঙধনু হয়ে যাই!
১৮/১১/৯৫
কতিপয় উচ্চারণ
হর পরহেজগার মুসলমানের কণ্ঠে প্রায় প্রতিক্ষণ
উচ্চারিত হয় আল্লা-রসুলের নাম,
ভক্তিরসে নিমজ্জিত হিন্দু হরে কৃষ্ণ হরে রাম,
দুর্গা দুর্গা
জপেন সর্বদা, নিবেদিত ভক্তপ্রাণ
খৃস্টান গির্জায় কিংবা ঘরে
যীশু আর মাতা মেরী উচ্চারণে, স্তবে অনলস।
কৃচ্ছ্রনিষ্ঠ বৌদ্ধ ভিক্ষু বুদ্ধের উদ্দেশে
‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ মন্ত্র আওড়ান
পবিত্রতা ধ্যানে এনে।
অথচ এই যে আমি রুগ্ন, অসহায়, ধিক্কার অথবা
চরম দণ্ডের প্রতি উদাসীন সকল সময়
সুফী ঘরানার নৃত্যপর বৃত্ত ছুঁয়ে
অন্তর্গত স্তব্ধতায় লীন
কিবা স্বপ্নে কিবা জাগরণে আমার স্পন্দিত ওষ্ঠে
ফোটাই তারার মতো অবিরত দয়িতা
তোমার প্রিয় নাম।
নিউইয়র্ক, ১৬/৯/৯৫
কী রকম সাজ
কী রকম সাজ আজ শোভা পাবে তোমার শরীরে?
আনবে কি ফিরিয়ে সহজে তুমি রাঙা থরথর
প্রথম যৌবন পুনরায়? শরীর যে বসন্তের
অনুরূপ হ’য়ে ওঠে, তোমাকে দেখেই বোঝা যায়
লহমায়। তোমার ভেতরে গান, গহন সুরভি
জেগে ওঠে অগোচরে; গীতবিতানের শব্দাবলী
তোমাকে আতিথ্য দেয় মহিমার স্বতন্ত্র ভুবনে
ক্ষণে ক্ষণে। তোমার বিভায় আমি সর্বদা মোহিত।
তোমাকে আজকে সন্ধেবেলা দেখব না, এই সাজ
হবে না আমার চোখে উদ্ভাসিত; আমাকে এ খেদ
করবে অস্থির সারাক্ষণ, গোপন ঈর্ষার হুল
ফুটবে হৃদয়ে, তুমি জানবে না। তোমার শরীর
আজকের মতো জ্বলে উঠবে কি ফের আমাদের
দু’জনের প্রেমাঙ্কুর জাগৃতির জন্মবার্ষিকীতে?
৫/৫/৯৫
ক’দিন তোমার আসা-যাওয়া
ক’দিন তোমার আসা-যাওয়া দেখব না। হাওয়া এসে
আদর বুলিয়ে দেয় আমার সত্তায়,
রোদ এসে আবীর ছড়ায় সারা ঘরে, পাখি আসে
ভোরবেলা, গান গায় আনন্দের সুরে,
অথচ আসো না তুমি ক্ষণিকের জন্যেও এখানে;
আমিও পারি না যেতে তোমার নিবাসে।
নিয়মের বেড়া লণ্ডভণ্ড করা সহজ তো নয়।
হে বন্দিনী,
ইচ্ছে হয়, সারা পথ হেঁটে গিয়ে খসিয়ে শেকল
তোমাকে বাইরে টেনে আনি, পরমুহূর্তেই দেখি
তোমার সম্ভ্রম ময়ূরের দৃষ্টি নিয়ে
তাকায় আমার দিকে, আমার ভেতরকার তেজী
পুরুষের আদিমতা মাথা নত করে।
ধুলো চেটে পড়ে থাকি।
ক’টি দিন কেটে যাবে শেষতক। আমার বেলা যে
যায় কঠিনের সঙ্গে সংঘর্ষে, করুণ
সাঁঝে তুমি জ্বালো দীপ হৃদয়ে আমার। দীপশিখা
আমাকে দেখায় পথ বিভ্রমের গোলক ধাঁধায়,
পৌঁছে দেখি তোমার স্বর্ণাভ বাহু বরাভয় হয়ে
স্থাপিত সন্ধ্যায়। দৃশ্যাবলি ফুটে উঠে ঝরে যায়।
দুঃসময় অন্ধ পাখি অতিকায়, কালো
ছায়া ফেলে আমাদের প্রেমের উপর, আমরাতো
ভিন্নতর ছায়া চাই, পুষ্পবৃষ্টি চাই
সুতীক্ষ্ণ কাঁটার আগ্রাসনে, চাই স্বাদু পায়েসান্ন
করাল কাহাতে। শুধু আমরা দু’জন নয়,
সবাইকে নিয়ে
খরায় অভীষ্ট ঝর্ণা তলায় আঁজলা ভরে
জলপায়ী হবো।
৯/৪/৯৫
খুব প্রয়োজন ছিল
এই ভরদুপুরে যখন আমার বুক
বিরান পথের মতো খাঁ খাঁ, যখন আমার ধূসর
দৃষ্টিময় চোখ ফেটে জল ঝরতে চাইছে, যখন
তোমার বিচ্ছেদে আমি কাতর, নতুন করে মনে হলো
তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন ছিল
অনেক অনেক বছর আগেই,
যেমন কৃষকের প্রয়োজন ফসলের ঢেউ খেলানো
ক্ষেতের, যেমন কবির প্রয়োজন দ্যুতিপ্রতিম
প্রেরণার, যেমন বিপ্লবীর প্রয়োজন
আলো বিকিরণকারী আদর্শের, যেমন পিপাসার্ত
পথিকের শীতল জল, যেমন অন্ধের
জ্যোতির ঝলক, যেমন মিছিলের
অগ্রযাত্রার জন্যে প্রয়োজন হিল্লোলিত নিশানের।
তুমি আমার হৃদয়ের কদমতলায়
পা রাখার অনেক আগে
ঘুরেছি এখানে সেখানে, হেসেছি খেলেছি
অনেক রঙিন পুতুলের সঙ্গে, অথচ আমার অজান্তে
আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম অবচেতনের
কানন –পথে। সেই সব পতুলের
কারো কারো রঙ চটে গ্যাছে
সহজেই, কেউ কেউ ভেঙে লুটিয়ে পড়েছে ধুলোয়,
কারো কারো মন বসেনি খেলায়,
ফলত হয়েছে উধাও আমার চোখে ধুলো ছড়িয়ে।
বুঝতেই পারছ,
তোমাকে আমার প্রয়োজন ছিল অনেক অনেক বছর
আগেই; যা হবার নয় তা নিয়ে
অরণ্যে রোদন অবান্তর জানি, তবুও
আক্ষেপের তীর বিদ্ধ হয় মর্মমূলে।
অসীম আকাশের দিকে
তাকিয়ে ভেবে ভেবে সারা হই-
যদি তুমি কয়েক বছর আগে কিংবা
আমি কয়েক বছর পরে
জন্ম নিতাম, তাহলে কী এমন ক্ষতি হতো কার?
তুমি এসেই কেমন বদলে দিয়েছ আমার জীবন;
এখন আমি বয়সের ধুলি ঝেড়ে ফেলে
তারুণ্যের তরঙ্গিত নদীতে নেমেছি,
এখন আমি গোরস্তানের কথা ভুলে গোলাপ বাগানের
কথা ভাবি। আমাদের দু’জনের ভালোবাসা
নীল পদ্মের মতো প্রস্ফুটিত হওয়ার আগে
নিমজ্জিত ছিলাম হতাশার ঘোর অমাবস্যায়,
এখন আশাবাদ
আমার চৈতন্য-প্রবাহে ঝলসাচ্ছে, যেমন
ফসলের মরশুমে চাষীর কাস্তে থেকে
ঠিকরে-পড়া রোদ।
২১/১১/৯৫