পূর্বসূরীদের উদ্দেশে
এ কেমন পৃথিবী যাচ্ছেন রেখে আজ আমাদের
জন্যে অবশেষে? অপরাধ
নেবেন না কৃপা করে, যদি কণ্ঠস্বরে
অভিযোগ ফণা তোলে। আমরা বালক
কেউ কেউ, কেউ বা কিশোর,
বুঝি না কিছুই; হে আমার
প্রবীণ দানেশমন্দ পূর্বসূরীগণ, আপনারা
দোষী, এরকম অপবাদ
দেয়া কিছুতেই
সাজে না আমাকে। মাঝে-মাঝে কিছু কথা কানে আসে,
তা-ই শুধু শোনাবো আপনাদের আজ।
একটু সময় হবে সেসব শোনার?
কানে আসে, দেশ-দেশান্তরে
সুসজ্জিত দর্পিত সেনারা
দুনিয়া-কাঁপানো এক ভীষণ আওয়াজে
করে কুচকাওয়াজ এবং
শোষণ চলছে দ্বিগ্ধিদিক পুরোদমে,
হাবিলের চেয়ে কাবিলের সংখ্যা অতি দ্রুত আজ
হাজার হাজার গুণ যাচ্ছে বেড়ে; শুনি
একটি বোতম টিপলেই
আমাদের প্রিয় পৃথিবীর গায়ে পারমাণবিক
ছাই জমা হবে রাশি রাশি।
তারপর একটি পাখিও আর কিছুতেই
গাইবে না গান,
সমুদ্রে নদীতে মৎস্যকুল
হবে না কখনো আর কেলিপরায়ণ; দলে দলে
পুষ্পপ্রায় রাজহাঁস কাটবে না সাঁতার কখনো
কোনো সরোবরে, লুপ্ত হবে সবকিছু। পৃথিবীতে
বিখ্যাত মানব জাতি বলে ছিল কিছু,
এ-কথা জানার মতো থাকবে না কেউ।
দিনরাত্রি ভয়ে ভয়ে থাকি। আপাতত
দেশে দেশে একনায়কের
তর্জন-গর্জনে আর তারকা যুদ্ধের বিভীষিকা
নিয়ে সত্তাময়
কী করে বাঁচবো, বলে দিন হে আমার
অভিজ্ঞ প্রবীণ, প্রাজ্ঞ পূর্বসূরীগণ?
আপনারা কেন পৃথিবীর
গলিজ জঞ্জাল
সরাতে এমন উদাসীন? এ কেমন
উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছেন পেছনে অসহায়
বংশধরদের জন্যে? কেন নিজেদের
রক্তক্ষয়ী সংগ্রামকে ব্যর্থ হতে দিচ্ছেন এভাবে?
পেঁয়াজ রসুন
কোথাও কখনো কেউ সবুর না করলেও প্রচুর রসুন
বোনা হয়, হবে চিরদিন। এমনিতে
দিব্যি থাকি, তবে মাঝে-মাঝে
প্রসিদ্ধ শিবের গীতে,
জীবন মাইক্রোফোনে বাঁধা
যাদের তাদের খাল কেটে কুমির আনার কাজে
দু’চোখে আঁধার
দেখি কিংবা হঠাৎ মাথায় চাপে খুন।
প্রকৃত কে আমি
প্রকৃত কে আমি এই মানুষের ব্যাপক মেলায়?
বেলা গেল মেঘে মেঘে, নানা খেলা খেলেছি এখানে
আবেগের ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে নিজের বিষয়ে
স্থির জেনে কত কিছু, তবু বিছানায় আড়মোড়া ভেঙে
মনে হয়, যে আমি রাত্তিরে ছিল দুঃস্বপ্নে অস্থির
আর ভোরে যে আমি শিশির ভেজা ঘাস, কিয়দ্দূরে
সুপুরি গাছের সারি, ফিরোজা আকাশ, ফুলদানি,
খয়েরি শাড়ির, পায়রার ঝলসানি দেখে খুশি,
চা খেয়ে সংবাদপত্র পড়ে আনে ডেকে ছায়াছন্ন
ঘরে অবলীলাক্রমে হিস্পানী জগতে-এ দু’য়ের
মধ্যে কাকে আমি বলে করবো শনাক্ত বাস্তবিক?
যে ছিল অঞ্জলি পেতে সপ্তম শতকে অষ্টাদশী
গৌরীর সমুখে একা তৃষ্ণার দুপুরে, বৌদ্ধ মঠে
যার বাস, অনেক শতাব্দী আগে পটে ছবি এঁকে যিনি
হাটে করেছেন বিকিকিনি, কিংবা খাব-ঝলসিত
ইমরুল কায়েস, উটের পিঠে কাব্যের নেকাব
উন্মোচন করেছেন যিনি, সেই তো প্রকৃত আমি।
আবার কখনো মনে হয়, ধীমান হেরোডোটাস
আমি, ইতিহাস যার নর্মসখী, অথবা সুদূর
এথেন্সের আঁধার প্রকোষ্ঠে ওরা আমারই অধরে
দিয়েছিল ঢেলে কালকূট। কিংবা বলা যায়, যুগে
যুগে হেঁটে যায়-নির্দেশনাহীন কণ্টকিত পথে,
দুর্গম পর্বতে যে মানুষ স্বর্গ নরক এবং বিস্মৃতির প্রতি উদাসীন, আমি সেই দুঃখ-চাওয়া
নিঃসঙ্গ পথিক, রিক্ত, ক্লিষ্ট অগ্নিবলয়ের তাপে।
ফেরা না-ফেরা
একদা এখানে দাঁড়িয়ে সে দু’ঘণ্টা লাগিয়ে দাড়ি
কামাতো এবং স্নান সেরে তাড়াতাড়ি
আঁচড়াতো চুল। তাকে দেখতে ভালোই ছিল, তার
চুল ছিল কালো আর ঘন,
প্লাস্টিকের চিরুনিটা কখনো কখনো
ভাঙবার
উপক্রম হতো, এই টেবিলে দু’বেলা তৃপ্তি নিয়ে
করতো আহার মাছ, মুড়িঘন্ট দিয়ে
সকলের সঙ্গে, গল্প-গুজবেও উঠতো মেতে
ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে।
দেখতো তাকিয়ে দূরে মাঝে-মধ্যে বাগানের ফুলের বাহার,
কখনো শুনতো মগ্ন বেলায়েত খানের সেতার।
গাছের পাতায়
পড়লে বৃষ্টির ফোঁটা সন্ধ্যেবেলা, রাত্তিরে, মাথায়
স্তূপ স্তূপ মেঘ ঢুকে যেতো তার, মনে
পড়তো সুদূর গুহা, বাকল-সজ্জিতা তীক্ষ্ণ কনে
কবেকার। হরিণের পেছনে ছোটার
উদ্দামতা আবার শিরায় শত নক্ষত্র ফোটার
প্রাক্তন শিহর দিতো জ্বেলে;
ফের দৃষ্টি মেলে
গৃহকোণে হো হো করে উঠতো নিভাঁজ হেসে, যেন অর্থহীন
সব কিছু, এমন ভঙ্গিতে পাশ ফিরে
শোয় বিছানায়; ভোরে পুনরায় অমলিন
মুখে নামে পৌরপথে, যায় অফিসে এবং মিশে যায় ভিড়ে।
অকস্মাৎ বলা-কওয়া নেই একদিন
ঠিকানা না রেখে হলো সে উধাও, যেন হাওয়ায় বিলীন
হয়ে গেল জাদু বলে। তারপর গিয়েছে গড়িয়ে
পুরোপুরি পনেরো বছর। মাতৃক্রোড়ে বসে আয় আয় টিয়ে
বলতো যে-শিশু সে এখন
কার্ল মার্কস পড়ে সুদিনকে ডাকে আর দেয় মন
নিসর্গ নারীতে আর রাজনীতিতে আকণ্ঠ মজ্জমান,
কখনো কখনো গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের গান।
পনেরো বছর পরে এল ফিরে বসতবাটিতে
কী খেয়ালে; চোখে মুখে ছিটে
লাগে অতীতের, বসে পুরানো চেয়ারে পুনরায়,
দাঁড়ায় আয়নার পাশে, দাড়ি কাটে, চুল আঁচড়ায়,
অথচ আঁচড়াবার মতো
বেশি চুল নেই আর। নজরের আলো ক্ষীণ, ক্রমাগত
কী এক খটকা এসে বেবাক ভণ্ডুল
করে দেয়। যেন অন্য কারো অতিশয় ভুল
মুখ নিয়ে করে চলাফেরা, কেউ তাকে
পারে না সহজে নিতে। সব কিছুতেই গূঢ় অন্তরাল থাকে
কখন যে কাকে ডাকে থাকে না খেয়াল!
বস্তুত দেয়াল
এক তার আর অন্যদের মাঝে গড়ে
ওঠে, অর্থহীন বৃত্তে ঘোরে
সারাক্ষণ ভুল পদক্ষেপে, মুখ কালো
করে ভাবে এতকাল পরে না ফেরাই ছিল ভালো।