- বইয়ের নামঃ টুকরা কিছু সংলাপের সাঁকো
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অখ্যাত কবরে
এই যে এখানে এসে থমকে দাঁড়াই আজ, কেন?
কী আছে এখানে
এমন নিস্তব্ধ স্থানে? আমার পায়ের নিচে কিছু
মরা পাতাদের খস খস
এবং ঝিঁঝির ডাক ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই,
কয়েকটি কংকাল প্রতিম
গাছ আর ঝোপঝাড় আছে,
অন্য কিছু নেই, মাঝে মাঝে কয়েকটি
জোনাকি ফোটায় আলো, ফের
নিভে যায়; ঘুরে ফিরে এই জ্বলা নেভা।
এখানে দাঁড়াতে হবে বেশ কিছুক্ষণ,
মনে হয়; মাথার উপর কালপুরুষ দাঁড়ানো
অসীম নীরব অহঙ্কারে। তার কাছে বর্তমান
ভূত, ভবিষ্যত-সব কিছু অর্থহীন। অনন্তের
কী-যে মানে তা’ নিয়ে ভাবনা তার নেই কোনও; আমি
এখানে নিঃসঙ্গ, অসহায়
নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছি
আমার আপনকার কবিতার অখ্যাত কবরে
অনন্তের গোধূলি রঙিন পথে
চৈত্রসংক্রান্তির রাতে ডাগর চাঁদের ছলছলে চোখে
তাকিয়ে নদের চাঁদ মহুয়ার কথা ভাবে। তাকে কি কখনও
ফিরে পাবে আর? দূরে কালো গাছ গৌতম বুদ্ধের
ধরনে গভীর ধ্যানী। সে-ও কি হারিয়ে-যাওয়া কোনও
বৃক্ষললনার ভাবনায় মগ্ন? কাল
পুরনোর জাল ছিঁড়ে নতুন তুলবে তার অনাবিল মুখ,
যেন সূর্যোদয়; লতাপাতা, ঘাস, পাখি, পুরনো হ্রদের জল,
ফুলদল, সর্বোপরি মানবেরা স্বাগত জানাবে
তাকে কাল। মৃৎশিল্পী রঙিন পুতুল,
গরু, হাতি, ঘোড়া, হাঁড়ি, গাড়ি, নৌকা বানিয়ে সাজাবে
যখন মাটির ঘরে, মেলার বাজনা বেজে উঠবে
যথারীতি; মেলায় পাবে কি দেখা নন্দিত মুহূর্তে মহুয়ার?
নীলাভ জীনস্-পরা যুবা ধোঁয়া ছাড়ে, সিগারেট
পোড়ে ঘনঘন, চোখ নাচে
বিজ্ঞাপনে, কণ্ঠে বাজে র্যাঁপ-সুর; খোঁজে
সোনিয়াকে নিদিষ্ট পথের মোড়ে, সোনিয়া ডার্লিং
তার, দেখা হচ্ছে না ক’দিন। সেই হেতু
মন কি খারাপ খুব? না, মোটেও মনে
জমে না বিষণ্ন মেঘ। সোনিয়াই একমাত্র মেয়ে নয়
জগৎসংসারে;
জোরে শিস দিলে কিংবা মদির তাকালে কিছুক্ষণ,
জুটে যাবে কেউ কেউ সালোয়ার কামিজ অথবা
সিল্কের শাড়িতে ঢেউ তুলে।
সেই যুবা দ্যাখে শানবাঁধানো সড়কে আনাড়ির
মতো হাঁটে সরল নদের চাঁদ, যেন সে হোঁচট খেতে খেতে
গড়াবে রাস্তায় মুখে বিস্তর গাঁজলা তুলে, দু’চোখে দেখবে
তারাদের ফুলঝুরি দিনদুপুরেই।
উৎসবের রঙে মেতে-ওঠা শহরের ঝকমকে
প্রোফাইল দেখে, সেই যুবা ভাবে, এই যে নদের চাঁদ
নামের লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেঁয়ো মহুয়ার
তালাশে ঠোকর খাচ্ছে ক্রমাগত, ওর দিকে টাকাকড়ি ছুঁড়ে
দেখেছি সে হেলায় কিছু না নিয়ে দূরে
সরে গ্যাছে। কেমন আশ্চর্য চোখ তার,
যেখানে হরিণ, সরোবর, কবুতর, উপবন এবং ডাগর চাঁদ
ভেসে ওঠে বারবার। ভিখারি সে নয় কোনওমতে,
বরং প্রেমের অনশ্বর যুবরাজ,-
এই সত্য নীলাভ জীনস্-পরা যুবা ঠিক বুঝতে পারেনি।
দুই,
একটি নাছোড় গিরগিটি
আমার স্মৃতিকে চেটে খাচ্ছে অবিরত
একটু একটু করে। তাই ভুলে যেতে থাকি চৈত্রসংক্রান্তির
সেই ঘুড়ি-ওড়ানো বিকেল, মেঘে মেঘে রঙবেরঙের
নানা ছবি দেখা ছাদে বসে। কীরকম ছিল সেই সব ছবি?
কার হাত সিঁড়ির আঁধারে জ্বলে উঠেছিল চাঁদিনীর মতো,
আজ আর মনেই পড়ে না। সেই হাত
আমার ক্ষণিক স্পর্শে কেঁপেছিল কি না, কিংবা
আদৌ তাকে ছুঁয়েছিলাম কি-এর সদত্তর জানে
স্মরণ হরণকারী গিরগিটি। মনে হয়, বহু বঙ্গাব্দের
ছায়ারা সস্নেহে তাকে আড়ালে রেখেছে, শুধু তার
কিছু উজ্জ্বলতা ঝিকমিক করে জোনাকির মতো
চোখে নববর্ষের ঝলক, আগামীর মৃগতৃষা
নিয়ে আছি আজও, দেখি মুণ্ডহীন ধড়গুলো নাচে
বৈশাখের গন্ধে বর্ণে, তাদের ফ্যাকাসে আঙুলের
ডগায় কাঁপছে ভবিষ্যের জন্যে কাতরতা আর
আমার টেবিলে রাখা পানপাত্র, কিন্তু ওরা চক্ষুহারা ব’লে
বাড়াতে পারে না হাত অনন্তর খর ধুলিঝড়ে
মিশে যায়। কারা ওরা, ভেবে সারা হাই; অকস্মাৎ দেখা পাই
নদের চাঁদের, মহুয়াকে পায়নি সে খুঁজে বলে
চৈত্রসংক্রান্তির রাতে-দেখা ডাগর চাঁদের স্মৃতি
পীড়ন করছে তাকে অতিশয়। নদের চাঁদের মুখচ্ছদে
নিজের মুখে কিছু ধূসর আদল দেখে চমকিতে হই
এবং বৈশাখী হাওয়া গীতবিতানের পাতাগুলো
সাদরে ওল্টাতে থাকে, দেবব্রত বিশ্বাসের গানে
শূন্য ঘর পূর্ণ হয়, গাছে গাছে লাগে দোলা, নীলিমাকে ছোঁয়
সুরধারা; অনন্তের গোধূলিরঙিন পথে এক
ডাক-হরকরা সুরে সুর মেলাতে মেলাতে যায়,
পায়ে পায়ে তার রেণু ওড়ে, সম্মুখে লুটিয়ে পড়ে
অগণিত প্রজাপতি, বিরল কুসুম, পক্ষিকুল। যতদূর
জানি, ডাক-হরকরা অবরে-সবরে আসে, কাধে ব্যাগ নেই,
বহন করে না ডাক কোনওদিন, হাতে তার স্পন্দমান অলীক দোতারা!
অন্তরালে
ইমরুল কায়েসের উট মরুভূমি পাড়ি দিয়ে
বেলাশেষে মরুদ্যানে পৌঁছে যায়। কবি পানপাত্র
হাতে নিয়ে মুগ্ধাবেশে ক’ছত্র কবিতা
আবৃত্তি করেন আর রমণীর নেকাব সরিয়ে
রূপের গহনে ডুবে যান। রাত্রিশেষে সদ্যলেখা
কবিতার গুঞ্জরণ জাগে তার মনে। অন্তর্জ্বালা
তার আড়ালেই থাকে, কখনও কখনও
অগ্নিকণা হয়ে জ্বলে কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে।
ভাস্কর রোদ্যাঁর হাত নিথর পাথরে নানা ছাঁদে
প্রাণের স্পন্দন আনে। অনন্য সৃজনে
পাথর ভাবুক হয়, ব্রোঞ্জ হয়ে যায়
দুঃখী মানুষের মুখ অন্তরে নাছোড় যন্ত্রণা সর্বক্ষণ
তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে; মুক্তি
খোঁজেন ভাস্কর রোদ্যাঁ প্রেমে, কাজে, নিরন্তর কাজে।
হায়, ভ্যানগগের কানের রক্তভেজা ব্যান্ডেজ করুণ ঝুলে
আছে শিকে; শিল্পী ফসলের ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছেন,
এক ঝাঁক কাক ওড়ে হলুদ শস্যকে কালো করে।
দুপুরে চড়া রোদে কী এক বেয়াড়া ঘোরে তুলি
প্রবল চলতে থাকে ক্যানভাসে। কী এক যন্ত্রণা
শিল্পীকে উন্নত্ততার সীমানায় নিয়ে যায় আর
কাটাছেঁড়া কানে তার জপায় কুহকী মন্ত্র আত্মহননের।
যন্ত্রণা শিল্পের সঙ্গে নিত্যদিন করে বাসবাস;
কখনও সে ফুঁসে ওঠে কখনও-বা অন্তরালে করে অশ্রুপাত।
আঁধার ছড়ায় ওরা
আঁধার ছড়ায় ওরা সগৌরবে গ্রামে গ্রামে আর
শহরের কলোনির ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে, বস্তিতে বস্তিতে।
আঁধার ছড়ায় ওরা মানুষের মগজের কোষে
নানা ছলে আর কত ছদ্মবেশী প্রলোভনে দেখি
নিজেদের শিবিরে জুটিয়ে নেয় শত শত কিশোর, যুবক।
ওদের রুখতে হবে, নইলে কাঁদবে গোলাপ, স্বর্ণ চাঁপা;
আর্তনাদে বুক ফেটে যাবে দোয়েলের, কোকিলের, পায়রার;
মানবতা দগ্ধ হবে মৌলবাদী আগুনের ঝড়ে। সর্বনাশা
এই ঝড় তারাই রুখতে পারে যারা প্রকৃতই মুক্তমতি,
মনুষ্যত্বকেই যারা ধ্রুব জেনে এগোয় সম্মুখে সর্বক্ষণ।
আত্মশুদ্ধি
বহু ঝড়ঝাপ্টা তাকে জখম করার
পরেই সে অকস্মাৎ পেয়ে গেল গোধূলিবেলায়
গহন সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত
শান্তি নীড়ঃ প্রত্যাশিত ছিল না বলেই
আনন্দধারায় স্নাত সে কুড়ায় নক্ষত্রের কণা
ধুলো থেকে প্রত্যহ চলার পথে আর
একটি নিজস্ব স্বর্গ গড়ে নেয় গৈরিক মাটিতে
গানে গানে। জগৎ-সংসার তার সহজে আপন হয়ে ওঠে।
কিছুকাল পর প্রতারক এক রাতে
ঘোর অমাবস্যা তাকে ঘিরে ধরে অপদেবতার
চাদরের মতো, মতিচ্ছন্নতায় হঠাৎ সে স্বেচ্ছায় পোড়ায়
নিজের প্রফুল্ল শান্তিনীড় আর ক্রূর লকলকে
আগুনে নিজেও পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
অনন্তর নিভে যাওয়া অঙ্গার এবং ভস্ম থেকে
প্রকৃত হীরক দীপ্ত চোখ মেলে চায়।
আনতেই হবে শান্তি
আনতেই হবে শান্তি
ডানে নয় জানি বামে চলাটাই শ্রেয়
অনেক হেঁটেছি, কত পথ আর বাকি?
দু’পায়ে জমেছে বিস্তর ধুলোবালি,
ভাবি যাত্রায় কতটুকু ছিল ফাঁকি?
পেছনের পথ লুপ্ত হয়েছে আজ,
সামনের পথ ঘন কুয়াশায় ঘেরা।
চলতেই হবে তবু সামনের দিকে,
জানি না মিলবে কবে শান্তির ডেরা।
কত প্রিয় সহযাত্রী হারিয়ে গেছে,
কখনও স্মৃতিতে সেই মুখগুলি ভাসে।
একদা ছিলাম সংগ্রামে এক সাথে,
মগজে অতীত জোনাকির মতো হাসে!
বন্ধু এখন শহরে ও গ্রামে দেখি
নেকড়ের পাল মেতে ওঠে সংহারে;
ওদের দাপট এখনই প্রবল রুখে
আনতেই হবে শান্তি এ সংসারে।
আমরা ক’জন
আমরা ক’জন নানা বয়েসী পুরুষ প্রায় প্রত্যহ এখানে
এই ঘরে বসি, কিছু সময় কাটাই। কেউ কেউ সহজেই
জমিয়ে ফেলেন গল্প, কারও ঠাট্রা মশ্করায় খোলে
মাথা, কেউ সমাজতত্ত্বের ভাষ্যকার, কেউ কেউ দার্শনিক
তর্কে মেতে ওঠেন হামেশা। একজন প্রৌঢ় কবি মাঝে মাঝে
আবৃত্তি করেন নানা বিদেশী কবিতা, বিশেষত নেরুদার।
আমি নিজে স্বল্পবাক, অন্যদের রকমারি কথা কানে নিয়ে
বিস্তর আনন্দ পাই। কোনও কোনও দিন কারও স্থুল রসিকতা
আমাকে পীড়িত করে এবং নীরবে সহ্য করি অরুচির
নিপীড়ন কালেভদ্রে। কোনও দিন ঘরে ঢুকেই কেমন হু হু ফাঁকা
লাগে, আমাদের একজন আর কখনও এখানে আসবে না
আসরের আকর্ষণে। চোরা ব্যাধি তাকে চুরি করে নিয়ে গেছে।
কিছুদিন মন খারাপের মেঘ থাকে, আড্ডায় ভাটার ছাপ
পড়ে, তারপর অচিরেই আবার জোয়ার আসে যথারীতি,
আবার প্রচুর গালগল্প, ঠাট্রা তামাশা, তর্কের ঝড়ঝাপ্টা
সেই ঘরে। কখনও ডায়েবেটিস, রক্তচাপ, হার্টের অসুখ
নিয়ে কিছু কথা হয়। একদিন উপস্থিত আমাদের কেউ
একজন আসবে না আর এই ঘরে, এ সরল সত্য ভুলে থাকি।
আমার বাবার ঘর
কালেভদ্রে ভাবতে ভালোই লাগে, আজও কোনওখানে
বাবার একটি ঘর আছে; কিন্তু জানি না কোথায়
কোন্ সীমা-সরহদে। সেই ঘরে তাঁর আচকান,
রুমি কিংবা মখমলী গোল টুপি, কোরান শরিফ
অথবা জায়নামাজ, তসবিহ্, হলুদ পঞ্জিকা-
বস্তুত কিছুই নেই, আছে শুধু শূন্যতার ধু ধু মৃগতৃষা।
সে ঘরের আশপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও
পাড়াতলী গাঁয়ের সবুজ, বাঁশঝাড়, মসজিদ,
প্রসন্ন পুকুর, কিছুই তো পাবেন না সবচে’ ধীমান
পর্যটক। ঢাকা শহরের হাই-রাইজ দালান,
সুপার মার্কেট কিংবা বুড়িগঙ্গা নদীও নজরে
তার পড়বে না আর প্রিন্টিং প্রেসের অনস্তিত্ব
অকূল শূন্যতাকেই অধিক প্রখর
করে তুলে পরাবাস্তবের ঘোরময় বিভ্রমের দিকে নেবে।
বাবার সে ঘরে নেই জননী আমার,
জনক নিজেও নেই কোনও রূপে; অনুরূপ ঘর
একদিন নিশ্চিত আমারও হবে, কিন্তু কেউ কারও
পড়শি হবো না কোনওকালে হবে না কখনও দেখা।
স্বপ্ন কি দুঃস্বপ্ন নেই, নাস্তির ভুবনে
ধূলিকণা, শুধু ধুলিকণা।
আমার শরীর থেকে মন
একদিন অকস্মাৎ কী খেয়ালে আমার শরীর থেকে মন
আলাদা বেগানা হয়ে যায়। তারপর
কখনও দোয়েলরূপে শিস দেয় বিনষ্ট বাগানে,
কখনও-বা প্রজাপতিরূপে
দিব্যি ওড়াউড়ি করে এখানে সেখানে, বসে গিয়ে
বিনম্র আমার দয়িতার কাঁধে, অসিত খোঁপায়।
আমার শরীর আর থাকে না আমার
বাস্তবিক, পড়ে থাকে বিছানায় ফাঁপা,
ভাবলেশহীন; চোখ শুধু একই দিকে স্থির এবং শ্রুতিতে
পশে না গানের সুর; বই, ফুলদানিময় গোলাপগুচ্ছের
পেলব পাপড়ি থাকে স্পর্শাতীত আর
অস্তমিত স্নিগ্ধ শিশু, তরুণীকে চুম্বনের সাধ।
দূর থেকে মন অনুভূতিহীন শরীরকে দেখে ভাবে, ঐ যে
লোকটা শয্যায় পড়ে আছে, সে-তো বস্তু শুধু,
নিঃসাড়, সে আর এ মুহূর্তে বসবে না
নিবিড় টেবিলে তার, নেবে না কলম তুলে হাতে, কবিতার
পঙ্ক্তিমালা হবে না রচিত কোনওমতে। মনে বলে,
‘মগজ নিষ্ক্রিয় তার, কেননা আমি তো চেতনাকে
সঙ্গী করে বেরিয়ে এসেছি
লোকটার অভ্যন্তর থেকে। এখন সে প্রকৃত সে নয় আর।
আমি কি তাহ’লে
আমি কি তাহ’লে উন্মাদ হয়ে যাব?
হিংস্র বাতাস মাংসে বসায় দাঁত,
সহযাত্রীরা অনেকে বিগত আজ,
অথচ করি না কখনও অশ্রুপাত।
হৃদয়ে একদা ছিল সবুজের মায়া,
এখন সেখানে ধূসর পাথর শুধু।
তৃষ্ণা-মেটানো পানি নেই এক ফোঁটা,
চৌদিকে দেখি বালুকণা করে ধূ ধূ।
দয়িতাও হায় বিরূপ আমার প্রতি,
শক্ররা হাসে আমাকে বেহাল দেখে।
কাদাজলে পড়ে খাচ্ছি কেবল খাবি,
দু’চোখ ক্রমশ আঁধারে যাচ্ছে ঢেকে।
প্রগতির কথা যত বেশি বলি আজ
ততই স্বদেশ পশ্চাতে যায় দেখি।
হুল্লোড়ে খাঁটি পড়ছে ধুলোয় ঢাকা,
যত্রতত্র ঝকঝক করে মেকি!
ষড়যন্ত্রের হোতারা রয়েছে মেতে
ধ্বংসে এবং ছড়ায় মোহের জাল।
ভাগীদার সব জোটে খোলা রাজপথে,
কাটে দিনরাত শান্তির শুভ ডাল।
বন্ধু এখনও থাকবে কি নিষ্ক্রিয়?
দেখবে কি বসে ধ্বংসের আয়োজন?
চাও কি অসুর রক্ত চাটুক সুখে,
সাধের বাগান হোক কণ্ঠকবন?
এক শুয়ে আছে
লোকটা সকালবেলা একা শুয়ে আছে বিছানায়
চিৎ হয়ে; তার ভেতরে প্রবেশ করে ফের
সন্ধ্যারূপে নিশ্চুপ বেরিয়ে
ছড়িয়ে পড়বে চারাচরে। লোকটা লোকটা ধোয়নি মুখ আর
সারাবেলা খায়নি কিছুই। আলিফের
মতো পড়ে আছে মলিন শয্যায়, দৃষ্টি তার
নিবদ্ধ আকাশে আর সেখানে অনেকগুলো জেব্রা মনোরম
মেঘের প্রগাঢ় ঘাস খাচ্ছে নিরিবিলি। ওরা ছুটে
আসবে এখানে ঘরে লোকটাকে আনন্দ জোগাতে। ওর হাত
পৌঁছে যায় মেঘদলে এবং জেব্রার পাল বিমুগ্ধ তাকায়।
একজন বৃদ্ধের কথা
একজন বুড়ো সুড়ো লোক বারান্দায়
বসে দেখছেন বিকেলের স্তব্ধ রোদ ঈষৎ কাঁপিয়ে এক
বেগুনি রঙের পাখি নিয়েছে বিনম্র ঠাঁই গাছের শাখায়।
লোকটার মাথায় বিরল শাদা চুলে
হাওয়া মৃদু খেলে যায়। ক’জন বালক
বালিকা আনন্দ হয়ে খেলছে গলিতে। শৈশবের
খেলা দেখে ভাবলেন ভদ্রলোক তার ছেলেবেলা
ভুলেও কখনও আর ফিরে আসবে না।
কিছুক্ষণ পরে সেই বৃদ্ধের উৎসুক চোখে পড়ে-
তরুণ তরুণী হেঁটে যাচ্ছে হাত ধরাধরি করে
যুগ্মতায় গাঢ় অনুরাগ নিয়ে। বুড়ো লোকটার
কানে দীর্ঘশ্বাস বলে হতাশার স্বরে-
তোমার যৌবন আর আসবে না ফিরে
বাজিয়ে মদির রাঁশি কোনওকালে। তোমার এ জরাগ্রস্ত হাতে
রাখবে না হাত কোনও প্রেমময়ী তরুণী কখনও। ফাঁকা দৃষ্টি
নিয়ে তিনি নিশ্চুপ থাকেন বসে একা বারান্দায়।
এখনই নামবে সন্ধ্যা; ভাবেন সে বৃদ্ধ, যা যা ছেড়ে
গেছে তাকে সময়ের নানা বাঁকে, তার
কিছুই কখনও ফিরে আসবে না। এখন তো তার জন্যে কবরের
হাতছানি ছাড়া কিছু নেই। মৃত্যু ফিরে
আসবে কেবল নানা ছদ্মবেশে, যতদিন প্রাণ
আছে এই এই ক্ষয়িষ্ণু শরীরে। তবু তিনি,
সেই বৃদ্ধ, রৌদ্র-ছায়া, গাছের সবুজ পাতা, ক্যামেলিয়া আর
গোলাপের হাসি আর তারার রূপালি মহফিল
এবং বালক-বালিকার খেলা দেখে, পুরনো দিনের সুর
শুনে অবশিষ্ট আয়ু সুস্মিত কাটিয়ে দিতে চান। অকস্মাৎ
তার চোখ কেন যেন অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে যায়
আর বুকে জেগে ওঠে বোবা হাহাকার।
একজন শিল্পীর প্রোফাইল
এখন বয়স তাঁর পুরোপুরি পঁচাশি বছর;
ধবধবে শাদা চুল আর দাড়ি, প্রায় টলস্টয়
মনে হয় কখনও কখনও। একা ঘরে বসে মৃতা
পত্নীর রঙিন প্রতিকৃতি, তাঁরই আঁকা, দেখেছেন
সানুরাগ দৃষ্টিতে; পড়ছে মনে অতীতের কিছু
খুচরো ঘটনাবলী স্কেচের ধরনে। দিনান্তের
অস্তরাগ, সর্ষেক্ষেত, বৃষ্টিধারা, তারার কারাভাঁ
গন্তব্যের কুয়াশাজড়ানো পথ কী-যে বলে তাঁকে,
কিছু তার স্পষ্টত বোঝেন আর কিছুটা বোধের
বাইরেই থেকে যায়। এখন আঁকেন মাঝে মাঝে
কোনও ছবি অন্তর্গত সৃজনের হাতছানি তাঁকে
বড়ই ব্যাকুল করে বলে। কানে আসে কারও ডাক,
কে ডাকল এমন গহন রাতে? অচেনা ধূসর
কণ্ঠস্বর; কাউকে না জাগিয়ে দরজা খুলে একা
দাঁড়ান নিঝুম অন্ধকার বারান্দায়। আসমানে
সুবিপুল রহস্যের দীর্ঘশ্বাস, সপ্তর্ষিমণ্ডল
নীরবে পাহারা দেয়। অতীতের ঊর্ণাজাল তাঁকে
চকিতে জড়িয়ে ধরে পুনরায়। তাঁর চোখ মুখ
কেমন আচ্ছন্ন হয় সম্মোহনী সুরে, ক্ষণিকের
জন্যে; চোখে শিশিরের ফোঁটা নিয়ে আগামীর দিকে
সতৃষ্ণ তাকান তিনি, শিল্পী কাজী আবুল কাসেম।
একটি গাছ
গোধূলিতে গাড়ি বারান্দায় নির্জনতা
পোহাতে পোহাতে তুমি টেলিফোনে কথা
বলছিলে আর বাইরে একটি
বুড়ো সুড়ো গাছ
দমকা হাওয়ার খুব ভয়ে কাঁপছিল, পাছে
সে মুখ থুবড়ে পড়ে পথের ধুলোয়। তুমি ওকে
দূর থেকে দেখে
ভাবো আজ না হয় আগামী
কোনওদিন কেউ ওর গুঁড়িসুদ্ধ উপড়ে ফেলবে
বারবার কুঠারের ঘায়ে।
রোদ-পোড়া, উন্মাতাল ঝড়ের প্রহার-সওয়া এই
বুড়ো সুড়ো গাছ
কতকাল বাজখাঁই দুপুরে মেলেছে
ছায়ার নরম ছাতা পথচারিদের
মাথার ওপর আর গাছটির পাতার কাঁপন
আর স্তব্ধ অন্ধকারে পূর্ণিমায় অথবা বর্ষায়
ওর স্নান দেখে তুমি স্পন্দিত হয়েছ
বহুবার এই কথা ভেবে
দূরের গাছের জন্যে তোমার হৃদয়
মমতায় কানায় কানায় ভরে ওঠে
আজও, জানি। অথচ আমি যে এতো কাছের মানুষ
তাকে কেন মাঝে মাঝে আজকাল দুর্বাসা-চৈত্রের ঝাঁঝ দাও?
কতকাল এভাবে থাকব
কতকাল এভাবে থাকব এই ব্যাপক আঁধারে
চুপচাপ? আঁধারের প্রাণীগুলি তেড়ে
আসে চারদিক থেকে, ওদের জান্তব পদশব্দে
কাঁপে পথ, তুমুল গর্জনে
নড়ে ওঠে শান্তির নিবাস। ওরা খুব ঘটা করে
চেটে পুটে খেতে থাকে মানুষের মেধা।
কতকাল এভাবে কাটাব দিনগুলি, রাতগুলি
শঙ্কার থাবার নিচে? কোন্ ঝড় এসে
হঠাৎ উড়িয়ে নিয়ে যাবে ঘরদোর? সর্বক্ষণ
ভয়ে-ভয়ে থাকা,
দুঃস্বপ্নতাড়িত হয়ে থাকা, দরজায়
নেকড়ের ক্ষুধার্ত দঙ্গল নিয়ে বসবাস সকল সময়
কী করে সম্ভব? দেখি চোখ মেলে বাইরে জ্যোৎস্নার
জোয়ার ভাসিয়ে নিয়ে যাবে যেন
সোমত্ত রাত্রিকে কোনও নিরাপদ বাসরে কোথায়
আর কয়েকটি তারা বন পরীদের মুখ হয়।
কপটতা, কূপমণ্ডুকতা আজ জেঁকে বসে গেছে
সবখানে, গুপ্ত হত্যা ঝোপ বুঝে কোপ দেয়
আর কত বিভ্রম সহজে চেতনাকে
বিপথে চালিত করে। বিভ্রান্তি ভস্ম ঝেড়ে ফেলে
আবার নতুন করে স্বপ্নবীজ বুনে
আমরা তাকাই আদিগন্ত অর্থে সূর্যমুখী-ফসলের দিকে।
কবি বলেন
এখানে এই ধুলোবালি, রক্তমাখা মাটির ঢেলা,
ছেঁড়া ন্যাকড়া, হু হু শাদা ক’খানা হাড় কান্নাকাতর।
রুক্ষ ফাটা মাটি ফুঁড়ে ছিন্ন হাতের জেগে-ওঠা,
ছিন্ন হাতে মরা পদ্ম নুয়ে থাকে সকল সময়।
পাথুরে এই রক্ষ পথে ঝর্ণাধারা পাবে না কেউ
কোনও মতে; ধু ধু তৃষ্ণায় বুকে ধুলো জমছে শুধু।
গলায় বালি, কাঁকর ভরা, কেবল ভীষণ ক্লান্ত লাগে,
প্রেতের মতো মানুষগুলো অন্ধকারে পাশা খেলে।
ভায়ের গলায় ভায়ের ছুরি যায় বসে যায় অবলীলায়,
দিন-দুপুরে রাহাজানি, সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া অষ্টপ্রহর;
পশুপ্রতিম যৌনমত্ত পুরুষেরা নারী-শিশুর খুঁড়ছে শরীর,
চোর পুলিশে তফাৎ কত, হারে কপাল, বোঝাই দায়!
কারা কখন কার পেছনে গুপ্ত ঘাতক লেলিয়ে দেয়,
সহজে কেউ বোঝে না আজ। মিথ্যার তোড়ে
সত্য ভাসে অন্ধ ডোবায়; মানবতার পা পড়েছে
পিছল গর্তে, প্রগতিভুক্ত ছায়াগুলো দেখাচ্ছে ভয়।
প্রেতের নাচন, ভাগাড় আছে, কবি বলেন, নিলাম মেনে;
কিন্তু দ্যাখো ফুল ফুটেছে পথের ধারে, মাঝে মাঝে
পাখি ছড়ায় গানের আভা। এখনও তো প্রেমের গানে
হৃদয় জাগে, শিশুর এবং চাঁদের হাসি হৃদয় জুড়ায়।
কষ্ট আছে, কাঁটা আছে
কষ্ট আছে, কাঁটা আছে, পায়ের রক্ত ঝরা আছে,
তবু অনেক দীর্ঘ পথে বিরামবিহীন চলা আছে।
ক্লান্তি এসে চোখের পাতায় ঘুমের কুঁড়ি ফুটিয়ে দেবে,
কিন্তু আমার ঘুমের গন্ধ থেকে দূরে, অনেক দূরে থাকতে হবে।
এই তো দেখি নৃত্যপরা রূপসীরা মায়ার খেলা
দেখায় কত, বসাতে চায় তারাভরা আঁচল পেতে।
ভুলিয়ে রাখে পথের দিশা হাত বুলিয়ে ক্লান্ত মাথায়।
প্রতারক এ আলো নিয়ে আমায় ভ্রষ্ট যাত্রী করে।
বেঠিক পথে যতই ঘুরি, যতই ভুলি প্রতাণায়,
শেষ অবধি ধ্রুবতারা পথ চেনাবে, আশা রাখি।
আমার পাশে আজকে যারা সময় কাটায়, করছে তারা
ডানে বামে কেবল তুমুল চ্যাঁচামেচি, তারা সবাই
আমায় কালো বদ্ধ ডোবায় আটকে সদা রাখার পক্ষে।
কিন্তু ওরা বোঝে না যে আমার বুকে গান জেগেছে
সুমুদ্দুরের; কেটে ছেঁটে পিগ্মি করে রাখতে আমায়
চাইলে ওরা ব্যর্থ হবে, আমার মাথা নিরিবিলি আকাশ ছোঁবে।
কষ্ট আছে, কাঁটা আছে, পায়ের রক্ত ঝরা আছে;
কত যে হায় খানাখন্দ চলার পথে বেলাবেলি দিচ্ছে বাধা,
নানা মুখোশ যখন তখন ভয় দেখাতে নাচতে থাকে।
মনোলোকে চলছে কত ভাঙাগড়া, বিষের ধোঁয়ায় পায়রা ওড়াই।
শরীর থেকে অন্ধ ডোবার শ্যাওলা ঝেড়ে এগোই এখন খোলা পথে,
রক্তে আমার সৃষ্টি-শিহর সারাবেলা, নইতো আর একা একা,
সবার হাতে হাত মিলিয়ে যাব অনেক দূরের পথে,
সমুদ্দুরের নিগুঢ় গানের প্রেরণাতে মহত্ত্বকে সত্যি ছোঁব।
কী যেন ভয় দেখায়
এতকাল পরেও কেমন বুক ঢিপ ঢিপ, মুখমণ্ডল জুড়ে
আচমকা রক্তোচ্ছ্বাস। কী যেন আমাকে ভয় দেখায় সারাক্ষণ।
এই যে সকালবেলা কয়েকটি পঙ্ক্তি লিখলাম, সেগুলোর
ওপর এ কিসের ছায়া? শব্দসমুদয় ভয়ার্ত শিশুর মতো মুখ
লুকায় আর দশ আঙুলের ঈষৎ ফাঁক দিয়ে তাকায় দোদুল্যমান
ছায়ার দিকে। খরার দাবদাহ, ঝড়ের ঝাপ্টা বহুরূপী শাসানি
থেকে কোনওমতে বাঁচিয়ে শব্দগুলোকে সস্নেহে জড়ো করেছি
এক জায়গায়। ওরা এখন ভোরবেলার টাটকা রোদ্দুর পান করে।
সুশৃঙ্খল খেলায় মেতেছে। আমার নির্ঘুম রাতের ছটফটানি ওদের
তালাশে দিগ্ধিদিক ছোটার যন্ত্রণা, নাছোড় ব্যাকুলতা দিব্যি ভুলে
গিয়ে নিজেদের মিলিত রূপটানের আনন্দের ঢেউ। সেই অজানা এক
ছায়ার ভাবনা ওদের কাছ থেকে সরে থাকে প্রায়শ;
আমি ছায়াটিকে মুছে ফেলার চেষ্টায় ক্লান্ত। শব্দগুলোর মুখ
থেকে ঘাম মুছিয়ে চুল আঁচড়িয়ে, সাজিয়ে গুজিয়ে ওদের যখন
হাজির করি আমার একান্ত আপনজনের কাছে, তখন প্রিয়তমার
চোখের মুখে মুগ্ধতার কলাপ। নিমেষে আমার অন্তর্লোকে
প্রস্ফুটিত অপরূপ শোভা। সেই মুহূর্তে রক্ত হিম-করে-দেওয়া
ছায়াটির কথা একটুও মনে পড়ে না।
খুব দ্রুত যাচ্ছি চলে
অনেক বছর আগে কোনও এক জাফরানী প্রান্তরে নিঃসঙ্গ
একটি গাছের নিচে তার সঙ্গে দেখা
হয়েছিল আমার কৈশোরে। লোকটার
গায়ে ছোঁড়া আলখাল্লা, এক মাথা দীর্ঘ কালো চুল,
গালভরা ঘন দাড়ি, চোখ দু’টো প্রদীপ্ত, উদাস,
যেন তিনি দেখছেন সব কিছু, কিন্তু কিছুতেই নেই মন।
‘যখন আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, হে কিশোর,
এরপর থেকে অস্থিরতা আর উদ্বেগ তোমার
নিত্যসঙ্গী হবে, তবে মাঝে মাঝে তোমার অন্তরে
বলা নেই কওয়া নেই কাঁটা ফুঁড়ে ফুটবে কুসুম, চর্চা যার
মাতিয়ে তুলবে দশ দিগন্তকে। যেদিন আমার
সঙ্গে ফের দেখা হবে, সেদিন তোমার
সব অস্থিরতা, ব্যাকুলতা আর উদ্বেগের হবে অবসান’,
বলে তিনি সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে যান।
তারপর অনেক অনেক সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের
আলো-ঢেউ আমাকে নিবিড় ছুঁয়ে গেছে, ঝরে গেছে
ঢের পাতা আমার রক্তাক্ত পদতলে,
অথচ অচিন সেই পুরুষের সাক্ষাৎ মেলেনি
আজ অব্দি সন্ধানের পরেও এবং আমি
ক্রমাগত খুব দ্রুত যাচ্ছি চলে কবরের দিকে।
ঘোড়সওয়ারের স্বপ্ন
কয়েকটি কর্দমাক্ত প্রাচীন কঙ্কাল ছিল নির্জন প্রান্তরে
কুমারী নিশীথে; মাঝে মাঝে রুগ্ন এক কুকুরের
আর্তস্বর শোনা যায়। অদূরে একটি বধ্যভূমি,
যার মাথা ছুঁয়ে জপ করে একা ভাঙাচোরা চাঁদ
গাঢ় রাত, ক’জন জুয়াড়ি এসে জোটে জনহীন
প্রান্তরের এক প্রান্তে, দিশি মদ খায়, কেউ হো হো হেসে ওঠে,
কেউবা ফুঁপিয়ে কাঁদে ইয়ারের কোলে মাথা রেখে,
কখনও আবার কেউ গ্লাশ ভরে নেয়, কেউ কেউ
ভেসে যায় খিস্তিখেউড়ের স্রোতে। একজন অকস্মাৎ
বুভুক্ষু চাঁদের দিকে মাটির সেয়ানা
ঢেলা ছুঁড়ে মারে জোরে; সাতজন জিপ্সি রমণী
ঘাগরা দুলিয়ে জুড়ে দেয় নাচ। নক্ষত্রেরা নৃত্যপর
পায়ের ছন্দিত ঠামে ঝরে পড়ে। কোত্থেকে ক’জন
বিশীর্ণ ভিখিরি এসে তারাগুলো চকচকে টাকা ভেবে নিয়ে
সাগ্রহে কুড়ায় আর একটি আহত ঘোড়া খোঁড়াতে খোঁড়াতে
কানায় কানায় ভরা টলটলে জলাশয়ে মুখ রাখে ধূসর তৃষ্ণায়।
বৃত্তাকারে বসেছে ক’জন শুক্নো ঘাসে। কারও কারও
জিভের ডগায় গল্প নড়ে চড়ে, কেউ বা নিশ্চুপ
অতিশয়; আগুনে ঝলসে যাচ্ছে যুবা
হরিণের গুলিবিদ্ধ শরীর; তিনটি
চমকিত ঘোড়া চোখে অশ্রুকণাসহ অদূরে দাঁড়িয়ে থাকে,
হয়তো খুঁজছে ওরা মেঘলোকে নিরাপদ ডেরা।
তিনটি ব্যথিত ঘোড়া ঘোড়সওয়ারকে বৃত্ত থেকে
তুলে নিয়ে কখনও গহীন গাঙে আর
কখনও-বা ফুলবনে রাখে। ঘুমের ভেতরে ঘুম,
ঘুমে কিছু পরাগ এবং মেঘ, আসমানি নীল লেগে থাকে।
ছিন্নভিন্ন হতে থাকি কাস্তের আঘাতে
আকাশের গায়ে গোধূলির জাফরানি ওড়না সেঁটে রয়েছে। চওড়া
গলি আর আধ-পুরনো বাড়িগুলো ওপারে ট্রাফিকের ঝিমিয়ে
পড়া গর্জন। অগোছালো কিছু বই আর কাগজপত্রের মধ্যে প্রায়
গা ঢাকা-দেওয়া টেলিফোন সেটা পরিচিত সুরে বেজে ওঠে টেবিলের
ওপর। চেয়ারে বসে আকাশ পাতাল ভাবছিল সে, উড়ে যাচ্ছিল গোধূলি
মেঘের ভেতর, কখনও পৌঁছে যাচ্ছিল মানস সরোবরে অথবা
এলদেরাদোয়। টেলিফোনের আওয়াজ তাকে ফিরিয়ে আনে নিজের
ঘরের টেবিলের ধারে। হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে নিয়ে নিজস্ব কণ্ঠের
জানান দেয়। ওপার থেকে মধুর কিন্তু চমকিত কণ্ঠস্বরের প্রশ্ন, ‘কে
আপনি? আপনাকে তো চিনতে পারছি না। অনেকগুলো অগোছালো বই
আর কাগজপত্রের মধ্যে বসবাসকারী লোকটি নিজের স্বরভঙ্গের কথা বলে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তার কথায় ভাসমান মেঘমালা আর সব পেয়েছির
দেশের স্পর্শ এবং ঘ্রাণ পেয়ে চিনতে আর বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না
লোকটি কে। সেই তো তার চিরচেনা মনের মানুষ। অন্যান্য দিন
লোকটি বেশিরভাগ সময় নীরবতার স্তব্ধ দিঘিতে ডুবসাঁতার দেয়। অথচ
আজ সে কেমন বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। মধূরভাষিণীর আকুল মিনতি
যাতে সে বেশি কথা না বলে, কারণ তার কণ্ঠস্বরের ক্ষতি হবে। অথচ
লোকটা স্বল্পবাক বলে এতদিন কত অনুযোগই না করা হয়েছে। মৌন
দিয়ে সে অনুযোগগুলোকে আদর করে।
কয়েকটি ঘোড়া, শাদা, বাদামি, কালো, ওর চারদিকে চক্রাকারে
ঘোরে। কখনও কখনও এত কাছে এসে ওরা, ওদের নিঃশ্বাসের
তাপ এবং গন্ধ সে টের পায়। ঘোড়াগুলোর চোখে ভাঙা প্রাসাদ, উজাড়
বাগানে এবং দালানের গায়ে দাপটে গড়িয়ে ওঠা আগাছার নাচ, জলসা
ঘরে প্রায় অস্তমিত আভিজাত্যের মাতলামি, ওস্তাদের ঠুমরি, সারেঙ্গিত
সুর, নর্তকীর নূপুর ধ্বনি। একটি বাদামি ঘোড়ার কেশরে হাত বুলোতে
ভারি ইচ্ছে হলো তার। ঘোড়ার তরঙ্গিত কেশরের দিকে হাত বাড়াতেই
সেই সুন্দর প্রাণী হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তবে কি সে স্বপ্ন দেখছিল? এই
মুহূর্তে সেই খোওয়াব মুছে গ্যাছে একেবারে? কিন্তু ঘোড়াদের সতেজ
নিঃশ্বাস এখনও তার মুখে লেগে আছে যেন। স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে
কতটুকু ফারাক, নিজেকে প্রশ্ন করে সে। এই যে আমি ঘোড়াগুলোর
চোখের ভেররে ছবিগুলো দেখলাম একটু আগে, সেগুলো কি
আগাগোড়াই অলীক, এই জিজ্ঞাসা তার কাছে হাজির হয় কাঠঠোকরা
রূপে। মাঝে মাঝে স্বপ্ন আর বাস্তবের অপরূপ রাসায়নিক মিশ্রণ মন্দ
কী?
অনেকক্ষণ হাঁটছে সে। পথের দু’ধারে সারি সারি দীর্ঘ গাছ।
ছায়ায় ছায়ায় পথ চলতে ভালো লাগে। কোথাও কোনও জনমনিষের দেখা নেই।
কখনও কখনও একটি কি দু’টি পাখি ডেকে ওঠে, পাখির ডাক
চারদিকের নীরবতাকে অধিক গাঢ় করে তোলে। এইমাত্র একটা
শিঙঅলা হরিণ ছুটে গেল তার পাশ ঘেঁষে। ঈষৎ ভড়কে গিয়ে নিজেকে
সামলে নেয় সে। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে, অথচ কোথাও কোনও
ঘরবাড়ি নেই। অনেকক্ষণ ধরে একটা পোস্ট অফিস খুঁজছে সে, চোখে পড়ে
নি। একটা জরুরি চিঠি পাঠাবার প্রয়োজন তাকে তাগিদ দিয়ে চলেছে
ক্রমাগত। নিরুপায় লোকটা এদিক ওদিক তাকায় গোয়েন্দায় মতো।
কিন্তু কোথাও একটা ডাকঘর নেই। ডাকঘরের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে সে
জরুরি চিঠিটা লিখবে। কী লিখবে তা সে জানে না। তবে এটুকু জানে
চিঠিটা একান্ত জরুরি এবং ত্বরিত প্রেরিতব্য। আরও কিছুদূর হাঁটার পর
একটা গোল দিঘি দেখতে পায় পথচারী। ক্লান্তি হরণের জন্যে দিঘির
পাড়ে বসে সে, তাকায় দূরের পাটল আসমানের দিকে। দিঘিতে
সাবলীল ফুটে আছে কয়েকটি নীল পদ্ম। পথচারী নীল পদ্ম এর আগে
কখনও দ্যাখোনি। আমাদের চারপাশে সুন্দর প্রকাশিত হয়ে আছে কত
রূপে, আমরা অন্যমনস্কতা আর হেলায় লক্ষ্যই করি না, ভাবে সেই
একলা পথচারী। জরুরি চিঠির কথা আবার তার মনে পড়ে মেঘের বুকে
নিদ্যুল্লতার মতো। অথচ চিঠিতে কী লিখবে আর কাকেই বা পাঠাবে,
সবার তার অজানা। আর এখানে কোথাও কোনো ডাকঘর নেই।
আমার ঘাড়ে তো থাবা প্রচণ্ড বসিয়ে দিয়েছিল, সে ভাবে, ক’জন
দুর্জন। শরীর থেকে মাংসখণ্ডগুলো খসে ঠাঁই নিত ওদের নখাগ্রে আর
সবাই দশদিকের লোকজন ধিক্কারে আর ঘেন্নায় আমার বিকৃত রূপে থুতু
ছিটিয়ে যে যার ঘরে পৌঁছে রটাত কত কেচ্ছা, ভেবে সে কুঁকড়ে যায়
ভেতরে ভেতরে। সেই মুধুরভাষিণী ভালোবাসার ঐশ্বর্যে শ্বাপদের
হিংস্রতাকে স্তব্ধতায় পরিণত করেছে এবং আমি আমার ভেতরে
অন্ধকারের পরিবর্তে অঢেল জ্যোৎস্না দেখতে পেলাম, সে নিজেকে
আশ্বস্ত করে দূর দিগন্তের দিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে। তার দু’চোখে কৃতজ্ঞতার
শিশির। ভালোবাসা এমন মহিমাময়, ওর জানা ছিল না। এ খবর কাউকে
পৌঁছে দেওয়ার মতো কোনও ডাকঘর কোথাও নেই। এখনও মাঝে
মাঝে তার বুকের বোবা চিৎকার।
ইথারে ভেসে আসে শুনি, আমার হৃদয়ে না কি গ্রহণ লেগেছে, জং
ধরেছে অনুভূতিমালায়। ইথারে বাহিত ধ্বনি কেন যে আমাকে টেনে
নিয়ে যায় অনুশোচনার গুহায় আর আমি বিলাপ করি অনবরত,
কিছুতেই বুঝতে পারি না। আমি তো স্যাটার্নের মতো স্বর্গের অধিকার
নিয়ে লড়িনি অলিম্পিয়ানদের বিরুদ্ধে কিংবা প্যারিসের মতো হরণ
করিনি কোনও সুন্দরীতমা হেলেনকে, তবে কেন আমাকে বিলাপ করতে
হবে অন্ধ গুহায়, কেন আমার এই অরণ্যে রোদন? কেন বিপুল ধ্বংসে
এই অতন? দূরের আকাশে ঐ যে নিভৃত গোধূলি রঙ, সে কি আমার
ব্যর্থতার স্মৃতি? কখনও কখনও মনে হয়, আমার মাথার ভেতর অজস্র
মোমাছির পীড়ন, কতগুলো ছেঁড়া কাগজের কাদাজলে হুটোপুটি, কাটা
ঘুড়ির ঝাপ্টা, বুনো শূয়োরের দাপাদাপি, একজন পঙ্গুর ক্রাচের খটখট
শব্দ, হারিয়ে যাওয়া পথের বিভ্রম, চকচকে মরীচিকা। বয়সের কোপে
ছিন্নভিন্ন হতে থাকি যেমন কাস্তের আঘাতে লতাপাতা। তবু ভালোবাসার
জমি বেদখল হতে দিইনি; ঘোর অমাবস্যায় মাঝে মাঝে হারিয়ে
ফেলার ভাবনা আমার অস্তিত্বের আনন্দ ও বেদনায় সূর্যাস্ত টেনে আনে।
মৃত্যু তার সারা শরীর আর মুখ খরখরে কালো চাদরে মুড়ে খুব কাছে
থেকে আমাকে শাসায়। চুলোয় যাক মৃত্যুর চাদর। এখন এই মুহূর্তে
সামনে এসে দাঁড়াক আমার প্রিয়তমা, আমি তার বুকে চন্দ্রোদয় আর
দু’চোখে বসন্তোৎসব দেখব। এই পর্যন্ত লিখে সে ঘুমিয়ে পড়ে বিছানায়।
ভোরবেলা ঘুমভাঙা চোখে দ্যাখে কাগজ থেকে বাক্যগুলো কে যেন
মুছে ফেলেছে। শাদা কাগজে শুধু ভোরের আলোর কৌতুকময় হাসি।
ডাঃ জেকিল অ্যান্ড মিঃ হাইড
ছিলাম তো শাদামাঠা, আলাভোলা শহুরে বাসিন্দা
একজন; কারও সাথে পাঁচে
ছিল না আমার মন কোনওদিন, গৃহকোণে জ্ঞানান্বেষী সাধকের মতো
সুন্দর ও কল্যাণের ধ্যানে মগ্ন ছিলাম সর্বদা। শক্র মিত্র
যাচাইয়ের ক্ষমতায় দিইনি অধিক ধার আর
করেছি বিশ্বাস সবাইকে খোলা মনে। ভেবেছি রোদ্দুরে আর
জ্যোৎস্নায় সাঁতার কেটে যাবে বেলা,
ফুটবে না কাঁটা পায়ে রুক্ষ পথ যখন তখন।
একদিন কী-যে হ’ল দেহমনে, চেয়ে দেখি এ কি
আমার ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে ভেজা
লকলকে জিভ আর মুহূর্তেই আমি কান্তিমান,
সুঠাম দেহের অধিকারী, গভীর নিশীথে বসি
জুয়োর টেবিলে নিত্য দেবদূতদের
সঙ্গে, খরদৃষ্টিতে পোড়াই
প্রতিযোগীদের আর রমণীলোলুপ আমি প্রকৃত প্রেমের
সন্ধান পেয়েও নষ্ট মেয়েমানুষের
সঙ্গে মাতি ক্ষণিকের কপট প্রণয়ে! একজন
বামন আমার দিকে ছুঁড়ে দে কুটিল তামাশা।
আয়নায় নিজেকে দেখে চম্কে উঠি-এ কোন সুকান্ত
পশু, যাকে বস্তুত চিনি না, যে আমার সত্তা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেই করে
হাতাহাতি কঠিন আঘাতে আর্ত কেউ,
কারও কষ বেয়ে রক্ত ঝরে
এবং নিজেও আমি শরীরে প্রচুর ক্ষত নিয়ে
উদ্ভ্রান্ত ডেরায় ফিরি। রাত্রিশেষে আমার প্রকৃত
আমি হয়ে যেতে থাকি, যখন সূর্যের
প্রথম কিরণ চুমো খায় আমাকে নতুন ভেবে।
সন্ধ্যা নেমে এলেই চকিতে অন্য কেউ, যার বুকের ভেতর
নিমেষে গজায় লোমরাশি, আমাকে দখল করে,
দস্তানায় লুকিয়ে সুতীক্ষ্ম নোখ কাফে
কিংবা বারে যাই, গোল বাধে যথারীতি, ঘরে ফিরি
ঝড়োবেগে, বুকজোড়া হা-হুতাশ, আমার তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠে ঝরে
দু’ফোটা শিশির, কী ব্যাকুল চেটে নিই।
প্রত্যুষ ফিরিয়ে দেয় পুরনো চেহারা শাদামাঠা, আলাভোলা,
সারল্যে কোমল, টলটলে; কৃতকর্মে অনুতাপে
দুগ্ধ হই বারবার। স্থাপিত আমার নত কাঁধে
সুন্দর ও কল্যাণের হাত। ‘বিনাশে তোমার ত্রাণ’,
দশদিকে থেকে ডেকে বলে ঘন ঘন
রোদের ঝিলিক-লাগা নগ্ন কবরের ঘাসমাটি।
ডাকি ভগ্নস্বরে
শাতার্ত প্রান্তরে হু হু কাঁপছি নিয়ত। ঝরা পাতা,
মরা পাতাগুলো প্রেতস্বরে
বলে কিছু গূঢ় কথা; কিয়দ্দূরে পাখির কঙ্কাল
সদ্য বিধবার
নিভৃত শোকের মতো পড়ে আছে। শীতল হাওয়ার
স্পর্শে আজ সুখহ নেই, মনে হয় কয়েকটি তীক্ষ্ণ দাঁত
আমার ঈষৎ
বিবর্ণ শিথিল ত্বক ভেদ করে মাংসে
নিষ্করুণ বসে যাচ্ছে ক্রমাগত, মাথার কেশর
উধাও এখন, স্বাস্থ্য লুট হ’য়ে একাকী হেঁটে বেড়াতে পারি না
কিংবা নিশীথের
তৃতীয় প্রহরে সঙ্গলিপ্সু বান্ধবের সঙ্গে ঘুরে
ঘুরে পথে সকালের চোখে চোখ রাখতে অক্ষম
অথবা নৌকায় চড়ে ভাসি না পূণিমা-রাতে ধীর বুড়িগঙ্গার সলিলে।
হায়, মনমাতানো আড্ডার লোভে কতকাল আমি
যাইনি বিউটি বোর্ডিং এর শান্ত আশ্রয়ে এবং
কতদিন শুইনি মাঠের ঘাসে। এখন প্রায়শ
ঘরে থাকি, লেখাপড়া আছে যথারীতি,
রুগ্ন ফুস্ফুস্ নিয়ে কাশি হরদম,
দেখি দূর প্রবালদ্বীপের পাশে মৎস্যকন্যাদের জলকেলি
ভাবি তার কথা যে আমার নিভৃতির
উদাস প্রাঙ্গণে করে আসা-যাওয়া অলক্ষে সবার।
কে ক্রুদ্ধ ঈগল ক্রমান্বয়ে আমার শরীরটিকে ছিঁড়েখুঁড়ে
করেছে ভীষণ জব্দ, অথচ মনের
ঝুঁটি আজও অনমিত। নতুন শতাব্দী কড়া নাড়ে,
দাঁড়িয়ে ক্ষয়ের বৃত্তে ক্ষণে ক্ষণে যৌবনকে ডাকি ভগ্নস্বরে।
তার কথা
‘ঘুমিয়েছিলাম ঘরে গোধূলিবেলায়, ঘুম ভেঙে গেলে দেখি
তিনটি দোয়েল আর তিনটি পাপিয়া
নেচে নেচে ঢুকে পড়ে আমার নিঝুম করোটিতে,
আমার পায়ের তলা ফুঁড়ে বনতুলসীর ঝাড়
নিমেষে গজায়, চণ্ডীদাস রাজহাঁস বুকে চেপে
টেবিলের ওপরে বসেন। ওষ্ঠে তার
কী এক দ্যুতির আসা-যাওয়া; পুরনো দেয়াল থেকে
বেরিয়ে আসেন ভবভূতি
পাণ্ডুলিপি হাতে, চোখে থেকে
ঘুমের কুয়াশা ঝেড়ে অসামান্য অতিথিদ্বয়ের জন্যে দ্রুত
চা করে আনার কথা ভেবে ছুটে যাই
এবং আমার ঘর অকস্মাৎ ঐরাবত হয়ে মেঘলোকে
উড়ে যায়’-এইটুকু লিখে তার নিজের খাতায়
দেয়ালের দিকে চোখ রেখে ক্লান্ত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
০২
মলিন ধূসর কবি হেঁটে যেতে যেতে দেখে, ভাবে কী সহজে
অসঙ্কোচে গোল চাঁদ ছায়া ফেলে অসুস্থ ডোবায়
চিরকাল। আহার করেনি কবি দ্বিপ্রহরে, কেবল বিকেল
চা খানায় গলা ভিজিয়েছি। পকেটে পয়সা নয়, কতিপয়
উপমা, মিলের ঝলকানি, চিত্রকল্প নড়ে চড়ে। নিঃসঙ্গ সে
বসে পড়ে ডোবার কিনারে, দেখে জ্যোৎস্নার জোয়ারে
ডোবায় অখ্যাত শোক হয়ে আট্কে আছে
যুবতীর লাশ; এই ছবি
সে হয়তো প্রগাঢ় তুলে নেবে ভিন্ন রূপে তার কবিতায়। তদন্তের
শরীরে দিনের পর দিন শ্যাওলা জমবে যথারীতি।
০৩
কখনও-সখনও লোকটার মনে পড়ে তার মা’র
কবরের কথা, মনে পড়ে যায় কোনও এক বিকেলবেলায়
মা’র কবরের পাশে বসেছিল একা;
দেখেছিল কয়েকটি প্রজাপতি কবরকে হাল্কা চুমো খেয়ে
উড়ে যায় কোন্ অজানায়।
মানুষের শরীরের রূপান্তর তার ভাবনাকে
কেমন ঘোলাটে করে। শরীর একদা সুশ্রী ছিল
মার আর এখন তা বিশীর্ণ কঙ্কাল
এবং মাটির নিচে প্রজাপতি অথবা গোলাপ কিছু নেই,
যা আছে সে-কথা ভাবলেও, হায়, আপন কঙ্কাল কেঁপে ওঠে।
০৪
তার কিছু কিছু কথা লোকে জানে, জানে না সকল
কথা কেউ। লোকটা সহজ, স্বাভাবিক, তবু কিছু
অন্তর্গত ক্ষ্যাপামি রয়েছে। তাকে পথে একা হেঁটে
যেতে দেখা যায়, মাঝেমাঝে পার্কের বেঞ্চিতে বসে চুপচাপ
কী-যে ভাবে, হয়তো কিছু শব্দ তাকে ঠোকরাতে থাকে
চঞ্চল মাছের মতো। তার সঙ্গে প্রায়শ টেবিলে
মুখোমুখি বসে স্তব্ধ গোধূলিতে চা খায় বিষাদ।
বুকে তার একটি অচিন ফুল ফুটে আছে, অনেকের চোখে
পড়ে; আসলে তা ফুল নয়, ক্ষত। শোণিত-বুদ্বুদে
কেমন উথলে ওঠে শব্দরাজি, নবীন প্রতীক। মাঝে মাঝে
ধুলোবালি ঢেকে রাখে তাকে,
কখনও-কখনও আসমানে সে আসীন এক উড়ন্ত ময়ূর-সিংহাসনে।
দু’টি ছবি
একজন খ্যাতিমান চিত্রকর, ষাটোর্ধ এবং
হৃতস্বাস্থ্য, বহুদিন ধরে
ক্যানভাসে আঁকছেন একটি পোট্রেট
সযত্নে, অথচ কিছুতেই
নিজেরই পছন্দসই হচ্ছে না। সর্বদা ছবি তাকে
ভাবায়, দেয় না স্বস্তি এতটুকু।
ইচ্ছা ছিল আঁকবেন একটি সুকান্ত মুখচ্ছবি
কল্পনার জ্যোতি দিয়ে। তুলি আর রঙ ক্ষণে ক্ষণে
ক্যানভাসে সুন্দর নিপুণ অনূদিত হয়,
আবার অবাক কাণ্ড পর মুহূর্তেই সেই মুখ
নিষ্ঠুর, বীভৎস হতে থাকে। এ কেমন পুরুষের অবয়ব
রঙের আড়াল থেকে ফুটে ওঠে? চিত্রকর তার
অসমাপ্ত ছবি রেখে বাইরে বাগানে চলে যান কিছুক্ষণ
বিশ্রামের টানে, মনে তার দুশ্চিন্তার আঁকি-বুঁকি।
ক্যানভাসে ভয়ঙ্কর এক মুখচ্ছবি
যেন বা জীবন্ত খুব, ভাঁজে ভাঁজে নির্দয়তা মাখা।
কী খেয়াল হ’ল বালকের, তুলি আর রং নিয়ে
আরেক খেলায় মেতে ওঠে। চিত্রকরের ছবির
পাশেই আনাড়ি ঢঙে একজন শিশুর কোমল ছবি আঁকে
খেলাচ্ছলে এবং ছবির শিশু হয় দেবশিশু।
নিঃসঙ্গতা
সেতো আজকের নয়, বেশ ক’যুগ
আগেকার কথা; তখন আমি
কৈশোর আর যৌবনের মোহনায় দাঁড়ানো
পুরনো ঢাকার গলির এক বুড়ো সুড়ো বাড়িতে
আমরা থাকি। কোনও কোনও গোধূলিবেলায় অথবা
সন্ধ্যারাতে লম্বা বারান্দার এক কোণে একলা
বসে খানিক সময় যাপন করতাম। আমাকে
অমন দেখে বাবা অপ্রসন্ন হতেন, মনে হতো। তিনি
যখন জিগ্যেস করতেন, ‘কী করছিস তুই এখানে’, হতচকিত আমি
বোবা হয়ে থাকতাম, যেন হাতে-নাতে-নাতে ধরা-পড়া চোর।
না, আমি বাবার পকেট থেকে টাকাকড়ি
সরাইনি কখনও, মায়ের হাত বাক্সেও করিনি হামলা। নিশ্চুপ
বারান্দার নির্জন কোণে বসে আকাশ কুসুম ভাবতাম,
চুরি করতাম, গোওধূলিবেলার রঙ, সেসব
পাখির উড়াল, যাদের ডানায় নীড়ে ফেরার ব্যাকুলতা,
হাল্কা হাওয়ার রেশমি আরাম আর সন্ধ্যাতারার আলো।
বাবার নারাজ মুখ দেখে নিরুত্তর আমি
বারান্দায় নির্জনতা ছেড়ে চলে যেতাম
আরেক নির্জনতায়, যেখান থেকে অন্তহীন টানেলে
অথবা জটিল অরণ্যে প্রবেশ করে হরিণীর চোখের কোমলতা
বুনো গাছের শিহরণ আর জ্যোৎস্নার ঘ্রাণ
লুট করলে কেউ আমাকে পাকড়াও করবে না
কোন অছিলায়, যেখানে অসীম নিঃসঙ্গতা সখীকে
বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকব।
এখন এতকাল পরে, যখন সময়
তার মুঠোয় আমার চুল ধরে টেনে নিচ্ছে বার্ধক্যের
দোরগোড়ায়, আমি নির্দ্ধিধায় একলা
বসে থাকতে পারি ইচ্ছে মতো আমার বারান্দায়। আজ আমাকে
কেউ প্রশ্ন করতে আসবে না কেন আমি
এভাবে বড় একা নীরবতায় এলিয়ে রয়েছি।
আজকাল নিঃসঙ্গতা বড়ই বিপন্ন করে তুলছে;
যখন ঘরে নিঃসঙ্গ বসে থাকি,
দুর্ভাবনা সন্ত্রাসীর মতো অস্ত্র চেপে ধরে আমার
স্পন্দিত বুকে, ক’জন মুখোশধারী
আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে ভাগাড়ে,
গলায় কাটা মুণ্ডের মালা ঝুলিয়ে
এক পাষণ্ড আমার মুখে লাথি মারছে ক্রমাগত।
অথচ এই মুহূর্তে কেউ এসে আমাকে
জিগ্যেস করছে না, এই অন্ধকার ঘরে
একা-একা কী করছিস তুই? মরহুম আব্বার মুখে
ক’যুগ আগের সেই অবাক-করা প্রশ্ন শোনার জন্যে
আজ আমি বড়ই ব্যাকুল, তৃষিত আর অর্থসন্ধানী হয়ে আছি।
নিঝুম ভেতরে
কয়েক হাজার বছরের রৌদ্রজ্যোৎস্না আর গাঢ়
অন্ধকার তার
নিঝুম ভেতরে খেলা করে সাবলীল। কখনও সে
এই সত্য ভুলে থাকে, কখনও আবার
ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে ওঠে কিংবা কোনও গোধূলিবেলায়
আকাশের দিকে খুব বিমুগ্ধ তাকিয়ে
অকস্মাৎ এ সত্যের শাঁস করে অনুভব রক্তের ভিতর
এবং কেমন স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে যায় লহমায়।
এত্তেলা না দিয়ে তার ঘরের ভেতর
প্রবেশ করেন এক দীপ্তিমান, সুকান্ত পুরুষ। কণ্ঠস্বর
তার বেজে ওঠে স্তব্ধতার বুক চিরে-
‘দ্যাখো তো আমাকে তুমি চিনতে পারো কি?
হাজার বছর আগে কাব্য রচনার প্রতিযোগিতায় আমি
তোমাকেই বারবার পরাস্ত করেছি,
যদিও নিশ্চিত জানতাম, প্রকৃত তোমারই প্রাপ্য সকল শিরোপা।
তার প্রস্থানের পর ঘরময় চন্দনের ঘ্রাণ ঝুলে থাকে।
মধরাতে বয়েসী লোকটা বিছানায় এপাশ করে
কিছুক্ষণ, অকস্মাৎ অন্ধকার ঘর আলো করে একজন
সুন্দরী দাঁড়ায় শয্যা ঘেঁষে, কণ্ঠে বীণাবাদনের
সুর এনে বলে,
‘দ্যাখো তো আমাকে তুমি চিনতে পারো কি?
হাজার বছর আগে তুমি আর আমি
ভাসিয়ে ছিলাম তরী প্রণয়ের উত্তাল সাগরে,
আমাদের দু’জনকে ঢেকে ফেলেছিল
হিংসুটে করাল মেঘ। ভালোবাসার অপরাধে
হয়েছিল শিরশ্ছেদ তোমার,’ বলেই
অপরূপ সেই নারী হাওয়ায় ছড়িয়ে
লোধ্ররেণু কুরুবক-ঘ্রাণ হাজার বছরে নম্র মিশে যায়।
কয়েক হাজার বছরের রৌদ্রজ্যোৎস্না আর গাঢ়
অন্ধকার তার
নিঝুম ভেতরে খেলা করে। অতীতের ছায়াতরী
ভেড়ে ঘাটে বারবার অবচেতনের স্তরে স্তরে। কোন্ নীল
স্বপ্নময়তায় তার বর্তমান অতীতের অন্তর্গত এবং অতীত
বর্তমানে রাজহাঁসরূপে গ্রীবা তোলে-
তার কিছু বোঝে আর কিছু বোধতীত থেকে যায়।
নিরন্তর ব্রতী
কী সুখেরই না ছিল সেসব দিন পক্ষিরাজের
ডানা-অলা দিনগুলি আমাকে নিয়ে
উড়ে বেড়িয়েছে আকাশে আকাশে। আনন্দ-আবিরে
রঞ্জিত দিনগুলি
প্রজাপতির রেশমি পাখনা হয়ে খেলা করত বাগানে,
তখন আমার আনন্দের জন্যে কোনও বড় রকমের
আয়োজনের প্রয়োজন ছিল না। ঘরের কোণে
বেড়ালের বসে-থাকা, হাওয়ায় স্পন্দিত ঘাস অথবা
একটি পাখিকে উড়ে যেতে দেখলে
কিংবা সন্ধ্যারাতে বাড়ির কাছে মোটরকার এলে
আমি আনন্দ-সরোবরে নেয়ে উঠতাম এবং
সবার অলক্ষ্যে প্রবেশ করতাম ঝলমলে এক জগতে।
অথচ আমার আনন্দধারা হারিয়ে গেছে
রুক্ষ, ধূ-ধূ মরুভূমিতে। নিজেই আমি
অপমান করে দূরে সরিয়ে দিয়েছি বসন্ত বাহারে ঝস্কৃত
সেই দিনগুলিকে; বেদনার্ত হৃদয়ে ওরা
নির্বাসনে গিয়ে অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে
রেখেছে। অভিমানে। সেই দিনগুলোর দিকে
তাল তাল কাদা আর পাথর ছুঁড়ে ওদের বুক
ঝাঁঝরা করে দিয়েছি।
পরম সুখের সেই দিনগুলিকে ফিরিয়ে আনতে
পারব কি আবার? সেইসব দিনরাত্রি উন্মোচিত হতো
উৎফুল্ল লাল নীল পদ্মের মতো। পদ্মের সুঘ্রাণ আমার
ঘুমের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ত। ওদের ক্রূশে
চড়িয়ে পেরেক ঠুকে ঠুকে ভীষণ ফ্যাকাশে, নিষ্প্রাণ
করে ফেলেছি। এখন ক্রুশ থেকে নামিয়ে
শুশ্রূষা করলে কি ওরা সজীব হাসির ঝর্ণা হ’য়ে উঠবে?
জানি না পুনরুত্থান সম্ভব কিনা আর। তবে আমাকে
আকাশ-ছোঁয়া স্পর্ধায় অসাধ্য সাধনে
নিরন্তর ব্রতী হতে হবে সকল বিরূপতা উজিয়ে।
নিশ্চিত বলা যাবে না কিছু
ঘরে বসে আছি একা। অকস্মাৎ এক ঝাঁক হল্দে প্রজাপতি
ঢুকে পড়ে পাখনা দুলিয়ে, প্রজাপতিদের চোখ
এই নম্র হলুদ বিকেলে
চকিতে আমাকে দেখে কী ভাবে? কে আমি
ওদের নিকট? দেয়ালের টিকটিক, কাচপোকা
এবং নিজের তৈরি নক্শি-জালে ধ্যানমগ্ন মাকড়সা-ওরা
আমার বিষয়ে কিছু জানে কি বস্তুত?
ওদের বাস্তবতায় আমার কি আছে বাস্তুভিটা এক কোণে?
০২
কী এক রহস্যময়তায় শহরলীর ছায়াচ্ছন্ন ছাদে
ভাষা থেকে সরে
জীবনানন্দের কিছু স্বপ্ন মেঘমালা হয়ে ভাসে।
সেসব মেঘের রোঁয়া অভিমানে কোন্ সে সুদূর
বঙ্গাব্দে নীরবে পৌঁছে যাবে,
গড়বে উৎসব এক তারাময় সমারোহে আকাশে আকাশে।
জীবনানন্দের ভাষা ঘাস আর শিশিরের সংসর্গে এবং
হ্যাইড্রান্ট আর নুলো ভিখিরির ছেঁড়া ন্যাকড়ার কটু গন্ধে
ভরপুর অপরূপ ওড়াবে নিশান সৌরলোকে। অরুণিকা
সান্যালের মুখে জেগে থাকবে কুয়াশায় কিংবা জ্যোৎস্নাময়তায়।
০৩
নিশ্চিত বলা যাবে না পঙ্ক্তিটি কোথায়
গায়েব হলো। কিছুক্ষণ পর অনূঢ়ার হাসির মতো রোদ
ছড়িয়ে পড়ে। পাশের বাড়ির তরুণী বারান্দায় এসে দাঁড়ায়;
একটা কাক বাতিল হাঁড়িতে জমে-থাকা পানি
শুষে নিয়ে তৃষ্ণা মেটায়। কিয়দ্দূরে মলিন খুপরিতে বসে
একজন তরুণ কবি খাঁ খাঁ শূন্যতার ভেতর থেকে
টেনে তোলে জালে ধরা-পড়া চকচকে মাছের মতো
কয়েকটি চিত্রকল্প আর গাছের পাতাগুলো
করতালি বাজিয়ে সবুজ পরীর হাতে রূপান্তরিত। পঞ্চাশ
বছরের মালতীকে ওরা কি খুন করেছিল এমন ঝকঝকে
ভেজা দুপুরে?
০৪
বলব কি রাত্রির টহলদার পুলিশের বুটের আঘাতে
কাতরাচ্ছে লাজুক আঁধার?
বলব কি ‘সাতটি তারার তিমির’কে
সাতটি অমল হাঁস বয়ে নিয়ে যাচ্ছে
কর্মিষ্ঠ ডানায়? বলব কি
মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে বড় একা শুয়ে আছি নক্ষত্রের খাটে;
হাতে কির্কেগার্ডের কেতাব? বলব কি অ্যাম্বলেন্সে অচেতন
যাচ্ছেন মুমূর্ষ ছুটে যিনি, সুজন সে-নাগরিক
আমারই সুহৃদ? বলব কি দিচ্ছেন আমার দিকে
এগিয়ে সুরার পাত্র মাইকেল মধুসূদন অমিত্রাক্ষর ছন্দে মেতে?
বলব কি আমার পায়ের জুতোজোড়া খুব ছোট হয়ে গেছে বলে
আঙুল ভীষণ ফেটে রক্ত
ঝরছে কেবল? বলব কি আমার পায়ের নিচে
সুশীতল ঝর্ণাধারা বয়?
বলব কি আমার কলম
মেরুপ্রদেশের তুষারের ঝড়ে সমাহিত হবে একদিন?
০৫
এই তো খুড়িয়ে-হাঁটা হরিণের আহত পায়ের
ক্ষতে পট্রি বেঁধে পোস্টমর্ডাণ কবির
চোখে মুখে লান্তি নামে; তিনি ঝিলের কিনারে ঝরা
পাতার বালিশে মাথা রেখে
ঘুমিয়ে পড়েন, স্বপ্নে মঙ্গলকাব্যের পাঁচালির খুঁটিনাটি জড়ো হয়।
দেহাতি চাঁদের দিকে তাকাতে তাকাতে
গাজনে মজেন কবি আর বঙ্গাব্দের পর বঙ্গাব্দ পেরিয়ে
যান বসে ময়ূরপঙ্ক্ষীর পাটাতনে।
নয়না এবং আমি
নয়না, আমার পাঁচ বছরের পৌত্রী, বিকেলের
খেলা ছেড়ে এসে বলে, ‘আচ্ছা, দাদাভাই,
ঐ যে মেঘগুলো চলে যাচ্ছে বেশ দূরে,
বলো তো কোথায় যাচ্ছে? ওদের কি খেলাঘর আছে?
তোমার মতোই কোনও দাদাভাই আছে?
ওরাও কি ক্লাশে যায়, যেমন আমাকে যেতে হয়?’
নয়নাকে বলি,-
‘আকাশই ওদের খেলাঘর, সেখানে কোথাও দূরে
আমার চেয়েও ঢের ভালো এক দাদাভাই আছে
মেঘমণিদের, তার চুল শাদা নয়,
চোখে কালো চশ্মা নেই। তিনি পঙ্ক্ষিরাজ
ঘোড়া চড়ে রোজনা ছোটেন নানা দেশে। ‘তা হ’তেই
পারে না, তোমার চেয়ে ভালো জবাব শোনায়।
একদিন ভর সন্ধেবেলা মাগরের নামাজের কিছু আগে
পাড়ার ক’জন মানুষকে খাটে লাশ বয়ে নিয়ে
যেতে দেখে নয়না আমাকে
বিস্মিত জিগ্যেস করে, ‘আচ্ছা দাদাভাই
ওরা টগরের
বাপীকে এভাবে শাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে
এখন কোথায় নিয়ে যাবে?’ নিরুত্তর
বিষণ্ন আমার দিকে নয়না তাকায়।
‘একদিন আমাকেও এভাবেই নিয়ে যাবে তোমার নিকট
থেকে বহুদূরে,
যেখানে শুইয়ে দেবে সেখানে জ্বলে না আলো অথবা বয় না
বাতাস কখনও, শুধু নিশ্চিহ্ন হওয়ার ধুলোপথে
আমাকে রাখবে ফেলে সবাই’, এ-কথা
নয়নাকে সেই ভর সন্ধ্যেবেলা বলতে গিয়েও বলা হয়নি
তখন।
প্রকাশিত হয় নানা স্তরে
এই যে আমার চতুর্দিকে সারি সারি গ্রন্থ, রাও
বৌদ্ধ শ্রমণের মতো ধ্যানমগ্ন এখন, প্রায়শ
এরকমই থাকে, মাঝে মাঝে
আমার হাতের স্পর্শে কারও ধ্যান ভাঙে। এসব গ্রন্থের
বই আছে, যেন বিত্তবানের ভবনে
দরিদ্র আত্মীয়, বড় প্রচ্ছন্ন, নীরব,
সঙ্কুচিত সর্বক্ষণ। সময় ওদের কালো করে বয়ে যায়।
কিয়দ্দূরে ডালিম গাছের পাতা হাওয়ার
হাতের স্পর্শে পুলকিত হয়, একটি সুনীল পোকা ঘাসের চাদরে
হাঁটে প্রাতঃভ্রমণকারীর মতো আর
টিঙটিঙে ঘাস ফড়িং-এর নাচানাচি
দেখে নিয়ে ঈষৎ কৌতুক বোধ করে কাকাতুয়া। এই গলি
অকস্মাৎ গভীর রাত্তিরের হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের গান,
গালিবের গজল কখনও। ঘুম থেকে জেগে ওঠে দেখি
আমার চাদ্দিকে সারি সারি বই নিস্তব্ধ কবর।
কখনও-কখনও এই সব কবরের সঙ্গ ছেড়ে
ডালিম গাছের পাতা, কাজল দিঘির পদ্ম, বাঁশবন আর
গোধূলি রঙিন সর্ষে ক্ষেত, ঘন মেঘে ঢাকা-পড়া
শালবন আর মাছরাঙাদের কাছে
চলে যেতে বড় সাধ হয়। তাহলে কি
পুস্তক-বিরোধী আমি? রাশি রাশি হরফের সন্ত্রাসে কাতর?
এখনও তো দেশ-বিদেশের নানান কালের কবিতার
অন্তঃপুর থেকে কত ফুলের সৌরভ, সরোবরের ঝলক,
প্রজাপতিদের শোভা, কামিনীর চোখের সুদূর
উপকথা প্রকাশিত হয় নানা স্তরে।
বহুদিন পর পাড়াতলীতে আবার
দাঁড়-বাওয়া নাও নয়, যন্ত্রচালিত নৌকায় চড়ে
মাঝে মাঝে ঝুঁকে হাত দিয়ে মেঘনার পানি ছুঁয়ে
যেতে-যেতে দূর থেকে গন্তব্যের যমজ গাছের
কেবল একটি দেখে প্রশ্নাকুল হই। আলুঘাটে পৌঁছে শুনি
ক্রমাগত ঢেউয়ের প্রহারে দু’টি যমজ গাছের একজন
আহত যোদ্ধার মতো লুটিয়ে পড়েছে মৃত্তিকায়।
ফসলের ক্ষেতের আইলে হেঁটে যাওয়ার সময়
আমাকে জড়িয়ে ধরে ধান ও গমের ঘ্রাণ, মিঠা আলুবীজ
হয়ে ক’দিন আগে বোনা, শিশু চারাগুলো খুব
উৎফুল্ল তাকায় এই পথচারী আমার দিকেই। দৃষ্টি মেলে
কুড়াই নানান দৃশ্য, আমার নিজের
গ্রাম পাড়াতলী অদূরেই আছে স্মৃতির ছায়ায়।
হেঁটে যেতে-যেতে বাঁশবন, ঘাসবন চোখে পড়ে,
একদা এখানে যারা ছিল এ পাড়ায়
তারা কি এখনও আছে? এখনও কি তাদের উঠোনে
মাছ ধরবার জাল শুকোয় রোদ্দুরে? ডুবে শাড়ি-পরা নারী
সরিয়ে গাছের ডাল আলগোছে দেবে কি ঈষৎ উঁকি এই
ধূসর শহুরে লোকটিকে এক নজর দেখার জন্যে? তাকে
চেনা মনে হবে তার? সংস্কৃতির বেড়া
মাঝখান থেকে, হায়, এক চুলও সরে দাঁড়াবে না।
পিতৃপুরুষের হু হু ভিটার কাছেই
একটি পুকুর, তার কিনারায় গাছের ছায়ায়
ক্লান্তি মুছে নিতে বসি টিনের চেয়ারে, মনে পড়ে
একাত্তরের এপ্রিল দুপুরে
কবিতা লিখেছিলাম নাক্ষত্রিক আলোড়নে আর
এই পুকুরের পিপাসার্ত জল আমার অসুস্থ
আত্মজকে অনুরূপ দ্বিপ্রহরে করেছিল গ্রাস। তবু এই জলাশয়
রোদালো দুপুরে আর জ্যোৎস্নাময়ী রাতে মন কাড়ে,
মন কাড়ে হাঁসের সাঁতার। এ পুকুর
আমার পিতামহের সমান বয়সী কিংবা আরও
অধিক প্রবীণ যার জলজ স্মৃতিতে জমা আছে
বুঝি বলবার মতো ঢের গল্পাগাথা, এখনও যা খুঁজি।
বিকেলের মৃত রোদে সেকালের মসজিদটির
পাশে পারিবারিক নিভৃত গোরস্তানে নিরিবিলি
দাঁড়াই, যেখানে পিতা, পিতামহ, আমার আত্মজ
মতিন, মোমেনা খালা মিশে আছেন মাটিতে।
কাঁপেনি আমার ওষ্ঠ প্রজাপতির পাখার মতো,
স্তব্ধতার মূর্তি আমি, কেমন সুদূর, যোগযোগহীন।
সন্ধ্যা না হতেই পুকুরের স্নিগ্ধ ঘাট, হাঁস, বালিকার
স্নান আর আম-জাম, জামরুল কুমড়োলতার কাছ থেকে,
কবরস্তানের মৃত রোদ, বুনো ঘাস, বাঁশবন
থেকে খুব নীরবে বিদায় নিয়ে আলুঘাটে পৌঁছে যাই আর
অস্তগামী সূর্যটিকে কোনও পিতৃপুরুষের রাঙা
মুখ মনে হ’ল ভেজা ঘাটে পা রেখে। নৌকোয় ওঠে পড়ি;
ইঞ্জিনের থর থর শব্দ, সরে-যাওয়া ঘাট, ক’জন স্বজন
আর আস্তে আমার ভিতর জন্ম নিতে থাকে ক’বিঘা সবুজ।
বাজান গো
বাজান গো, তুমি ক্যান আনলা আমারে
পাথরের শহরে, এহানে
আমাগো গাঁয়ের
উদাম সবুজ মাঠ নাই, ক্ষেতের আইল নাই, দীঘি
নাই, নাই ইঁদারা, ঘুঘুর ডাক। সরিষার ক্ষেতে
প্রজাপতি নাচে না এহানে।
আমি হর অক্ত এক কালা ছায়া দেহি
আমার উপর বেরহম
হামেশা নাইমা আসে দেওয়ের লাহান।
বাজান গো, আমিতো আইতে চাই নাই
এই ইট পাথরের শহরে, এহানে
আমার লাহান বাচ্চা মাইয়ারে ছিঁড়া
খাইবার চায় মানু, শরীলে বসায় দাঁত, খুন
ঝরে, শুধু ঝরে,
বড়ই জুলুম করে। আমি
হগল সময় দেহি এক কালা ব্যাটা
আমারে চাইপা ধরে, আমার নিশাস্
বন্ধ হইবার চায়। একখানা কালা ছায়া হগল সময়
আমারে জুলুম করে। হায় খোদা, কালা
খুন ঝরে শরীল থাইকা ঝরে হগল সময়।
বাজান গো, তুমি ক্যান আনলা আমারে
পাথরের শহরে, এহানে
আমি আর থাকবার পারুম না। আমারে দেহায়
ডর এক কালা ছায়া হারা দিন হারা রাইত, বাজান।
বিজ্ঞান সম্মেলনের পরে
বিজ্ঞান সম্মেলনটি শেষ হ’লে
একজন সংবাদ-শিকারি
সম্মেলনের সবচেয়ে ধীমান, প্রবীণ
বৈজ্ঞানিকের মুখের সামনে ক্ষুদে মাইক্রোফোন
রেখে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার কাছে
সবচেয়ে ভালো লাগে কী?’
বৈজ্ঞানিক, যার মাথায় কাশফুলের মতো
চুল, চোখ প্রজ্ঞায় সুদূর, গভীর,
সংবাদ-শিকারির দিকে না তাকিয়ে,
করিডোরের ওপারে খোলা আকাশের নীলিমায়
নিমগ্ন হ’য়ে নম্র কণ্ঠে বলেন,-
‘শিশুর হাসি আর ভোরবেলার রোদে নিশির-ফোঁটা।
বিস্মিত দেবদূত
ঘুম আর ঝিমুনি কুয়াশার মতো ঢেকে ফেলেছে
শহরটাকে; দিন-দুপুরেও অনেকে
ঘুমোয়; ঝিমোয় প্রায় সবাই। একজন এই প্রবণতা থেকে
নিজেকে মুক্ত রেখেছে। লোকটা
নিজের আস্তানা ছেড়ে বেরোয়া কম, ঘরে
বসে বই পড়ে, পায়চারি করে সময়
কাটায়, একাই থাকে সব ঋতুতে। মাঝে-মাঝে
কেউ এলে কিছু কথাবার্তা, চা সিগারেটের ধোয়া।
ঝিমধরা লোকজনদের অনেকে
খানিক জেগে তাচ্ছিল্যের থুতু ছিটিয়ে ভাবে-
লোকটার চালচলন
বিধিসম্মত নয়। শোনা যায়,
ঘরে বসে নাকি সে গোধূলিতে, সন্ধ্যারাতে
এবং মধ্যরাতে কী সব রঙিন ফানুস ওড়ায়।
সাত আসমানের নানা রঙের
মেঘের স্তর পেরিয়ে এই শহরে নেমে এসে
একজন দেবদূত গভীর রাতে লোকটার ঘরে
আলো জ্বলতে দেখে
স্বগতোক্তি করলেন, ঝিমুনি-ধরা, ঘুমে কাদা
মানুষের ভিড়ে সে এখনও জেগে থাকে রোজ, লোকটা স্টুপিড নাকি
উন্মাদ!
বৈশাখ সুস্পষ্ট লেখে
আকাশের তুলট কাগজে কী সহজে
বৈশাখ স্পষ্ট লেখে প্রথম অক্ষর,
যেন আদি কবির খাগের কলমের
ডগা থেকে ঝরে আদি শ্লোক নতুনের
খবর রটিয়ে চরাচরে। মুহূর্তেই
দিগন্তের রেখা রূপময় হয়ে ওঠে
তুলির টানের মতো; চেতনার নানা
স্তরে দোলে বৃক্ষছায়া নুড়ির নূপুর
বাজায় পাহাড়ি ঝর্ণা, চিত্রল হরিণ
ছোটাছুটি করে, পাতা চিবোয় এবং
পিপাসা মেটায় ঝিলে মুখ রেখে ধূ-ধূ
প্রান্তর, ফসল-তরঙ্গিত ক্ষেত জুড়ে
সুতীব্র দহন, পুড়ে যেতে চায় কচি
ঘাস, লতাপাতা আর পাখির পালক।
গেরুয়া চাদরে মোড়া উদাস বৈশাখ চেয়ে থাকে অপলক
রোদের প্রখর স্তব্ধতায়, শুক্নো ঠোঁটের কাঁপে
ঘন ঘন রুক্ষ চুল ওড়ে
হাওয়ায়, একটি পাখি ঝিমায় গাছের ডালে পাতার আড়ালে,
কিশোর গায়ের জ্বালা জুড়োতে দিঘির
জলে নামে, দেয় ডুব বারবার, যেন সে পাতাল
ছুঁতে চায়। একজন তরুণী কলসি কাঁখে গা থেকে পানির
ফোঁটা সমুদয়
ঝরাতে ঝরাতে যায় একাকিনী, মাটি
শুষে নেয় জল, ছায়াচ্ছন্ন ঝাড়ে ঘুঘুদের হু হু
ডাক দুপুরকে বড় ব্যাকুল, উদান করে তোলে,
যেন কেউ মাটির গভীরে খুব ডুকরে ওঠে।
ভোরবেলা বৈশাখকে ডাকছেন কবি অন্তরঙ্গ
কণ্ঠস্বরে সে আহ্বান শঙ্খধ্বনি হয়ে
ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে কলাবিদ ধনীর ড্রইংরুমের আর
দরিদ্রের হতশ্রী কুটিরে। ফিরে আসে প্রতিবার
রবীন্দ্রনাথের চিরনতুন বৈশাখ রমনার বটমূলে, জোড়াসাঁকো,
আর শান্তিনিকেতনে, সাঁওতালী গ্রামে।
নতুন আসে যেন গাছের কচি পাতা
কিংবা সকালের প্রথম তাজা আলো।
পক্ষীশাবকের প্রখর ওড়াউড়ি
শূন্যে গুঁজে দেওয়া ঝাপ্টা নতুনের।
নতুন এলে বুঝি পুরনো হয় লীন
নিমেষে নাস্তির কৃষ্ণ হাহাকারে।
তাহ’লে কেন মনে স্মৃতির ছায়া কাঁপে?
স্মৃতি কি পুরনো প্রতিচ্ছবি নয়?
বিগত দিনগুলি এবং রাতগুলি
কত যে কথা বলে প্রতীকে উপমায়-
কখনও চোখে ভাসে দূরের ধু-ধু পথ,
কখনও বুকে নদী চকিতে বয়ে যায়।
ছিলাম কোনওদিন আমিও জ্বলজ্বলে
সুশ্রী যুবা এক, সহসা মনে পড়ে।
আমার পদাঘাতে যুগের নুড়ি ওড়ে,
মুঠোয় সময়ের প্রবল ঝুঁটি কাঁপে।
এখন আমি খুব বয়সে ভারানত,
রয়েছি ছোট ঘরে রোগের কব্জায়।
আমার সারা মুখে ধুলোর আবরণ,
আমার হাতে আজ তিনটি মৃত পাখি
যতই স্মৃতিকণা খুঁটি না কেন, তবু
দখিন হাওয়া এসে জাগিয়ে তোলে প্রাণ।
আবার হালখাতা সামনে, নেচে ওঠে,
নতুন দিন আঁকে সোনালি স্বাক্ষর।
স্বপ্ন জোনাকির মতোই জ্বলে নেভে,
প্রবল পূণিমা জোয়ারে টেনে আনে
একটি প্রতিমাকে মনের উপকূলে।
তার সে হেঁটে-আসা ঝরায় তারাফুল।
জ্যোৎস্না খেকো ধেড়ে ইঁদুরগুলো মাঠে
ছুটছে অবিরত। ধানের শীষ গায়ে
লাগছে বলে ওরা কখনও হেসে ওঠে
কখনও বিপদের আভাসে শঙ্কিত।
আমার ছোট ঘরে এমন রাত্তিরে
ভাবতে পারি না তো ফ্রস্ট আসবেন;
দরজা খুলে দেখি জীবনানন্দের
দু’চোখ ভাসমান, আয়ত, সুগভীর।
রূপসী বাংলার আত্মভোলা কবি
রাখেন হাত এই রুগ্ন লোকটার
কাঁধের শিহরণে নববর্ষে তিনি।
প্রবোধ দেন খুব বিফল আমাকেই।
কখনও নিরাশায় অমাবস্যা আমি,
আশায় কখনওবা সূর্যোদয় হই।
পঙ্গু অসহায় দাঁড়িয়ে নয়া মোড়ে
সামনে এগোবার শপথ নিই ফের।
চকচকে ব্লেডের মতো এই বৈশাখী দিন, কবির
মনে হ’ল, ওর ক্লান্তিকে মুছে ফেলেছে একেবারে। এখন
ওর চোখে চারপাশের সব কিছু সূচনা করেছে
এই উৎসব, মনে ফুটেছে অজস্র কুসুম। বিছানা ছেড়ে উঠে
সে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়,
আহ্, এই চেনা গলিটা আজ কেমন
নতুন সাজে নর্তকীর নাচের মুদ্রায় সুস্থির। এই যে
দু’ একজন পথিক হেঁটে যাচ্ছে
ধীর গতিতে, তাদের প্রত্যেককে, হোক তিনি
ধনবান কিংবা কোনও দুস্থ ভিখিরি,
আলিঙ্গনে বাঁধতে ইচ্ছে করছে
কবির, আর কাছের গাছের ডালে বসে-থাকা ঝুঁটি-অলা
পাখিটাকে ডেকে এনে ছোলা কিংবা পাউরুটির টুকরো
খেতে দিলে কী ভালোই না লাগত!
গত রাতের শেষ করতে না-পারা কবিতাটির কথা মনে পড়ে যায়
তার, যখন সে তাকায় শালিকগুলোর রোদ্দুর
আর ধুলো নিয়ে চানাচানির দিকে। নিজের
সৃজনকালের অন্তর্গত রুদ্র জ্যোৎস্না স্মরণে আসে কবির।
বৈশাখী দিনের মতো ঝকঝকে কবিতা
লেখার কথা কতই না ভেবেছে, সত্যিকারের নতুন
তার পঙ্ক্তিমালাকে চুম্বন করুক, এই কামনা
ওর অনেক প্রহরের ঘুম চুরি করেছে।
টেবিল থেকে লেখার খাতা কুড়িয়ে নিয়ে
অসমাপ্ত কবিতার শরীরে দৃষ্টি বুলোয় কিছুক্ষণ।
না, একে পরিণতির ঘাটে ভেড়ানো নিষ্ফল, বরং
বাজে কাগজের ঝুড়িতে হোক এর ঠাঁই। চেয়ারে বসে
মৈমনসিংহ গীতিকার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে সে
পথ খোঁজে ফসলের ঘ্রাণময় পথের মোড়ে। খাপ থেকে
বেরিয়ে-আসা তরবারির মতো বৈশাখী দিন
শাণিত আলোর ঝলকানিতে
মহুয়াকে জ্যোতির্ময়ী করে নিমেষে। কবি মহুয়ার আদলে
তার আধুনিকা দয়িতাকে নিবেদন করে সনেট আর ভিলানেল।
এই বোশেখে পাব তোমার প্রসন্নতা, আশা রাখি
বহু দিনের রুক্ষ কিছু কথার কাঁটা ছিঁড়েছে বুক,
চোখ হয়েছে রক্তজবা। হাতছানি কার
তোমাকে এই চোরাবালির কাদায় ডোবায়?
কে দিয়েছে তোমার হাতে বিষের পাত্র ছদ্মবেশে?
চৈত্র জুড়ে ভীষণ পুড়ে আমায় কেন দিলে ছুঁড়ে
অগ্নি ঝড়ে? এই বোশেখে নিভবে আগুন, বলল এসে
শান্তিপুরের অচিনা পাখি। সোজাসুজি পাখির দিকে
গেলাম ছুটে। কাঁটা ফেলে, গরল ধুলোয় গড়িয়ে এসে
আমায় তুমি তোমার শ্যামল ছায়ায় নাও।
শুধু ঝকঝকে হাসি থাকে না বৈশাখী দিনে কখনও কখনও
বৈশাখের দীপ্ত দিন কালো
কেশর দুলিয়ে
গর্জনে কাঁপিয়ে দেশদিক প্রবল ঝাঁপিয়ে পড়ে
শহরে ও গ্রামে। হিংস্র দাঁতে আর সুতীক্ষ্ম নখরে
ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলে গাছপালা,
অসহায় মানুষের প্রশান্ত বসতি;
কখনও কখনও লোকক্ষয় হয়, হাহাকার ওঠে।
যদি কালবৈশাখী চকিতে
দুরন্ত ঝাপ্টায়, কবি ভাবে, লোকালয়ে
হাহাকার না ছড়িয়ে স্বার্থান্ধ, কপট
সমাজের উৎপীড়ন, বৈষম্য, দুর্গতি
সমূলে উড়িয়ে নিয়ে যেত,
তবে তার রণমূর্তি শতবার কাঙ্ক্ষণীয় হতো।
মানসিক খরা হেতু
একজন বহুক্ষণ বসে আছে চুপচাপ বড় একা, রয়েছে সম্মুখে
খোলা পাতা, শাদা পাতা ধু ধু চর, কোনও শব্দ কিংবা কাটাকুটি
সেখানে কিছুই নেই। তার মন এ মুহূর্তে বড়ই খারাপ;
সিগারেট খায় না সে, অন্য কোনও মাদক দ্রব্যের প্রতি টান
নেই তার, কালেভদ্রে একটি কি দু’টি পেগ হুইস্কি সেবন করে
বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে। এখন সুরায় গলা ভেজাবার ইচ্ছে নেই মোটে।
কেন সে এমন অবেলায় ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে
আছে একা? এখনও জ্বালেনি বাতি, যাবে না বাইরে কোনওখানে
সরস আড্ডার লোভে, অথবা বেইলি রোডে থিয়েটার দেখে
কিছুটা সময় কাটাবার সাধ নেই। কী এক নাছোড় কষ্ট
বেশ কিছুদিন থেকে কেবলি পোড়াচ্ছে তাকে-যেন সে চিতায়
শুয়ে আছে। কারও সঙ্গে বাক্যলাপ নেই, বই নিয়ে নাড়াচাড়া
করে শুধু, আধখানা পাতাও দেখে না চোখে। আসলে সে কিছুদিন ধরে
একটানা মানসিক খরা হেতু একটি প্রকৃত শোকগাথা, হায়, লিখতে পারেনি।
যান্ত্রিক মিছিলে
মনুষ্যত্ব নিয়ত নিহত হচ্ছে মানুষের হাতে
কী দিনে কী রাতে
খোলা পথে এবং আকাশ-ছোঁয়া ফ্ল্যাটে। ঘোড়ামুখো কিছু লোক
চৌরাস্তায় অস্ত্র নিয়ে হৈ হল্লায় মেতে উঠে শোক
ছড়ায় নিরীহ কত ঘরে
খেলাচ্ছলে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সর্বত্র রক্ত ঝরে
প্রায় অবিরাম; সব পাখি, প্রজাপতি,
ভ্রমর, মৌমাছি এ শহর ছেড়ে অতি
দুঃখে, হায়, নিয়েছে বিদায় শেষে। কেবল মানুষ
মনুষ্যত্ব হত্যা করে ঘন ঘন ওড়ায় ফানুস
খামখেয়ালের আর ভালোবাসা ধুলোয় লুটিয়ে,
খিস্তি খেউড়ের পুঁতিগন্ধময় ডোবায় ডুবিয়ে
নিজেদের আপাদমস্তক
অজ্ঞানের ঘন কুয়াশায় আঁকে সর্বনাশা ছক!
অনেকেই, মনে হয়, সদ্য কবরের কীটের উৎসব থেকে
বেরিয়ে এসেছে মুখ ঢেকে
কাদা, মাটি আর ঘাসে। ভয়ঙ্কর এইসব মুখ
বিভীষিকা ডেকে আনে; ভীষণ অসুখ
নিয়ে ওরা সত্তায় এবং চেতনায়
ভিষকের ভূমিকায় নিত্য অভিনয় করে যায়।
চতুর্দিকে মনুষ্যত্বহীন মানুষের
যান্ত্রিক মিছিল যাচ্ছে কোথায় জানে না কেউ কিছু।
শওকত ওসমান যখন হাসপাতালে
এ কেমন মেহমান আপনি আছেন শুয়ে এই
সুশীতল ঘরে বড় বেঘোরে সটান? আপনার
কপালে রেখেছি হাত, ছুঁয়ে দেখেছি কয়েকবার,
কিন্তু চোখ খোলেন নি একবারও; এমন নিঃসাড়,
অচঞ্চল আপনাকে কখনও দেখিনি। প্রগতির
মিছিল চলেছে পথে, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার
সভা রমনার বটমূলে, অথচ আপনি প্রায়
মমির ধরনে চিৎ হয়ে রয়েছেন পড়ে বেডে।
যে আপনি অজস্র কথার ফুলঝুরি ছড়াতেন
ক্ষণে ক্ষণে তিনি কেন এরকম নীরব, নিশ্চুপ
বস্তুত দিনের পর দিন, আজও ভোরের প্রতীক্ষায়
থাকি টেলিফোনে আপনার অন্তরঙ্গ কণ্ঠস্বরে
কান পেতে রাখবার জন্যে। দেশ-বিদেশের রাজনীতি,
হালে পড়া কোনও বই, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ আর
বাস্তবের কুশাঙ্কুর নিয়ে কত কথার বুনন
ছিল আপনার কণ্ঠস্বরে। এবার গা ঝাড়া দিন।
এখনও তো পিঞ্জরে রয়েছে পাখি, ঈষৎ স্পন্দিত,
জেগে আছি পুনরায় তার গান শোনার আশায়।
শব্দের প্রতিমা
শেষ পঙ্ক্তি লিখে ফেলে এক পাশে কলমটা রেখে
মুক্তির নিশ্বাস নেন তিনি। একটু পরেই তার
সদ্যলেখা কবিতার দিকে দৃষ্টি যায়। মনে হলো,
শুরুটা হয়নি ঠিক, ফলে বাতিল সম্পূর্ণ পঙ্ক্তি।
আবার পছন্দসই শব্দগুচ্ছ পেতে কেটে যায় বেশ কিছু
সময় এবং আরও দু’চারটি পরিবর্তনের
দুর্বার তাগিদ তাকে মৎস্য-শিকারির মতো টানা
প্রতীক্ষায় রাখে আর ধৈর্যের করাতে লগ্ন হয়ে
কত যে রক্তক্ষরণ হয় কে তার হিসাব রাখে?
তারপরও অতৃপ্তি কবিকে হিংস্র ঠোকরাতে থাকে।
জানলার কাছে এসে ক্লান্ত কবি ভাবে প্রতিটি
পঙ্ক্তিকে গাইতে হবে পাখির মতোন, তাহলেই
তৃপ্ত হবো আমি আর কবিতা নিশ্চিত খুঁজে পাবে
প্রকৃত রসিক। ‘এতকাল যা লিখেছি সবই আজ
কত তুচ্ছ পরিণামহীন মনে হয়’, বলে তিনি
পুনরায় লেখার টেবিলে যান, কলম চালান
সফেদ কাগজে; কিছুক্ষণ চলে কাটাকুটি, পরে
ঝর্ণাধারা হয়ে যায়, গড়ে ওঠে শব্দের প্রতিমা।
শুভ চেতনার সূর্যালোকে যাও
ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন সন্ধ্যা প্রভাতকে গ্রাস করতে উদ্যত,
তোমরা কি দেখছ না? দাঁতাল আঁধার মেতেছে পিশাচ-নৃত্যে, রক্ত-হোলি চলে
নিত্যদিন, অশুভের জয়োল্লাসে পাড়ায় পাড়ায়
ঘুম নেই কারও আজ। শুভবুদ্ধি চতুর্দিক থেকে
ভীষণ আক্রান্ত আর প্রতিক্রিয়ার হুঙ্কারে কাঁপে জনপদ।
তোমরা কি জান না এখন
তোমাদের চারপাশে শক্ররা জমায় ভিড় আর
চোখে ধুলো দিয়ে
নিয়ে যেতে চায় চোরাবালির দিকেই?
চেয়ে দেখ, হায়েনার দাঁত আর নেকড়ের থাবা
কেমন মোহন রূপে তোমাদের পথ
সহজে ভুলিয়ে নিয়ে অন্ধকূপে ঠেলে
দিচ্ছে আর তোমরা ভাবছ পৌঁছে যাবে
সব পেয়েছির দেশে। অথচ ভস্মের অন্ধ ঝড়
বইছে সেখানে আর অন্ধরাই চক্ষুষ্মানদের
পথ দেখাবার দায়িত্বের
তক্মা গলায় এঁটে পথ হাতড়ে বেড়ায় শুধু
ধূ ধূ প্রান্তরের
ঠিকানাবিহীন সব পুরনো খোঁদলে।
যদি চাও বাঁচুক দোয়েল
পাপিয়া, কোকিল আর চঞ্চল রঙিন প্রজাপতি,
যদি চাও সুবাতাস বয়ে যাক এখানে সর্বদা
মেধা ও মননে না লাগুক গ্রহণ কখনও,
তাহ’লে নিরেট অন্ধত্বের হাতছানি
হেলায় উপেক্ষা করে মুক্তবুদ্ধি আর শুভ চেতনার সূর্যালোক যাও।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবর পড়ে
আমরা বীরের জাতি বটে,
ওহো বীরের জাতি।
হরহামেশা লুটতরাজে,
খুনের নেশায় ভীষণ মাতি।
আমরা বীরের জাতি বটে,
ওহো বীরের জাতি।
যখন তখন দিন দুপুরে, সন্ধ্যারাতে
টাকা কড়ি ছিনিয়ে নিতে
চাক্কু চালাই, গুলি ছুঁড়ি,
নিভাই হেসে খেলে কত
লোকের প্রাণের বাতি।
আমরা বীরের জাতি।
শ্বশুর আমি, আমার দু’টি
ইয়া জোয়ান ছেলে আছে।
বড় ছেলের ঘরের বউ
আনে নি ছাই কোনো যৌতুক,
বউয়ের বাপের এটা কৌতুক।
আমরা জানি মজার খেলা,
একদিন তাই বিকেল বেলা
আমি আর দুই জোয়ান ছেলে
পিটিয়ে মারি বউটাকে।
ধেই ধেই নাচ,
লাঠির ঘায়ে যায় ফেটে যায় বউয়ের ছাতি।
আমরা বীরের জাতি বটে,
ওহো বীরের জাতি!
সকালে ঘুম ভাঙার পর
বেশ কিছুদিন পর আজ খুব সকালে ঘুম ভাঙল;
রোদ্দুর তখনও ঘরে কলাপ মেলেনি, রেশমি
আরাম আমার শরীর জুড়ে। একটু পরেই রোদের ঝলক
চুমো খায় বারান্দা, ঘরের মেঝে, দেয়াল, লেখার
টেবিল, বিছানা আর বুক শেলফগুলোকে। কেন যেন
মনে হলো আমার বুকের ভেতর বিলের চকচকে জল,
একটা, নুয়ে পড়া বাঁশের কঞ্চিতে বসে-থাকা মাছরাঙা
উড়বে কি উড়বে না, ভাবছে। ঘুরে ঢুকে পড়ে একটি ভ্রমর
গুনগুনিয়ে খুশি বিতরণ করে; কী যে ভালো লাগল
আমার। গৌতম বুদ্ধের মতো সংসারত্যাগী হওয়ার
ভাবনা মনে উঁকিও দিল না কখনও, যদিও প্রায়শ নিজস্ব
ধরনে বসে যাই শব্দ ও ছন্দের ধ্যানে।
পর্যটক মেঘের দিকে তাকাই, গত রাতের অসমাপ্ত
কবিতার একটি কি দু’টি পঙক্তি ঝিকিয়ে ওঠে স্মৃতিতে,
এবং টুকরো কবিতাই সেই সন্ধ্যারাতের দৃশ্যটিতে টেনে আনে
যার মুখ্য চরিত্র ছিলাম গৌরী আর আমি। আনন্দের তরঙ্গ
থেকে তরঙ্গে আমার দোল-খাওয়া। আজ সকালে
টেবিলে-রাখা শুকিয়ে-যাওয়া ছোট্র গাঁদা ফুল, দেয়ালে
মিহি জালে বসে-থাকা সন্তানসম্ভবা মাকড়সা, মেঝের হাল্কা
ধুলো-সব কিছুই খুব ভালো লাগছে। এমন কি কি সবুজ ঘাসে নীরব,
বিচরণকারী গুবরে পোকা আর নর্দমায় লাফিয়ে ওঠা
কোলাব্যাঙটিকেও পরম সুন্দর আত্মীয় মনে হলো আমার।
সায়াহ্নে মুখোমুখি
সেই যে কখন থেক লোকটা আমার মুখোমুখি
বসে আছে, তার চোখ দু’টি
নিষ্পলক চেয়ে আছে আমার দিকেই
মৎস্য শিকারির মতো। আমি কি পড়ব ধরা তার
বেঁকে-যাওয়া ছিপীই স্তব্ধ সন্ধ্যেবেলা? এখন সে
টেবিলে একটি রাঙা পোকাকে আঙুলে চটকাচ্ছে নিরিবিলি।
আমি এ টেবিল ছেড়ে খুব দ্রুত চলে যেতে চাই
অন্য কোনওখানে, কিন্তু যেন
যুদ্ধবন্দি আমি বাস্তবিক, এতটুকু সরবার
জো নেই কোথাও। অস্বস্তির কাঁটাগুলো মাংসে গেঁথে
যাচ্ছে ক্রমাগত আর লোকটার
হাতের আঙুলগুলো লোহার শিকের রূপ ধরে
আচানক; বমি পায়, যেন বড় তাড়াহুড়ো করে
কয়েকটি মেঘলা মদের পাত্র পর পর করেছি উজাড়।
স্বর্ণচাঁপা ওয়েস্ট্রেস মেন্যু হাতে আমাদের টেবিলের কাছে
এসে হেসে দাঁড়িয়ে,বাড়ায় আলগোছে স্নিগ্ধ মেন্যু-
কফি আর কেকের অর্ডার নিয়ে শাড়ির আঁচল
পেবল উড়িয়ে মিশে যায় কুয়াশায়। মৃদু হেসে
লোকটা টেবিলে মাত্রাবৃত্ত বাজায় এবং চোখে
আনে যুগপৎ
মিলন ও বিচ্ছেদের রঙ, ওর চোখে
চন্দ্র সূর্য অস্ত যায় এবং অজস্র নক্ষত্রের জন্ম হয়।
কে এই বেগানা লোক? এই প্রশ্ন আমাকে ব্যাকুল করে আর
আমার কম্পিত ঠোঁট শব্দময় হওয়ার আগেই
সে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায় ত্বরিৎ, হেঁটে হেঁটে
আমার নিকট থেকে বহু দূরে চলে যায়। অকস্মাৎ বিদ্যুচ্চকের
মতো মনে হয়, আমি তার অস্তিত্বের
অস্থিচর্ম, মেদমজ্জা, চেতনায় মিশে দ্রুত করছি প্রস্থান।
হাতের দোতারায় নানান গৎ
রেখেছি বুক পেতে মাটির সোঁদা বুকে,
খুঁড়েছি নিজেকেই নিত্যদিন
আমার হাত দু’টি বিদ্ধ কণ্টকে,
রক্ত দিয়ে শেষে শুধব ঋণ?
এ কোন্ ক্রূর পথে হাঁটছি ক্রমাগত?
এখানে তৃষ্ণার নেই তো জল;
ক্ষুধার করাতের দাঁতের আছে ধারা,
বাগানই নেই কোনও, উধাও ফল।
দীর্ঘ এই পথে বৃষ্টিধারা নেই,
রয়েছে পদে পদে রক্তপাত।
ধূসরতায় চোখ অন্ধ হ’ল প্রায়,
চিত্তে বিভীষিকা বসায় দাঁত।
ঝর্ণাধারা ভেবে গিয়েছি ছুটে কাছে,
অথচ ছিল সে তো চোখের ভ্রম।
ব্যাকুলতায় খুঁড়ে রুক্ষ মৃত্তিকা।
দেখছি বেলাশেষে বৃথাই শ্রম।
মধুর সঙ্গিনী ছিল যে উদার,
আমার প্রতি সে-ও বিরূপ আজ।
যে-মুখে সর্বদা সূর্যোদয় ছিল,
এখন সেখানেই নিত্য সাঁঝ!
অমৃতধারা ঠোঁটে ঝরেছে গতকাল,
কিন্তু আজ শুধু গরল বয়।
হাতির মত্ততা ছিঁড়ুক প্রীতিলতা,
সকল বিরূপতা করব জয়।
দুঃখ আমাকেই পর্যটক করে;
‘যতই তোকে ওরা ভয় দেখাক,
বন্য পশু আর নরপিশাচ দল’,
কে যেন বলে, ‘তুই চলতে থাক।
মাথায় এরকম তারার ঝলকানি,
হাতের দোতারায় নানান গৎ
কত যে দৃশ্যের শোভায় প্রীত হই,
পুষ্পে সেজে ওঠে ধুলোর পথ।
হৃদয়ে হাহাকার
আচ্ছা যদি আজ এখানে বসে পড়ি,
ঝিমোই কিছুকাল, তবে কি ক্ষতি হবে?
একটু বিশ্রাম এখানে বটমূলে,
কেই বা আপত্তি করবে এই ভেবে?
রুক্ষ পথে ঘাটে ঘুরেছি বিস্তর
জুটেছে কাদাবালি এবং কিছু ছাই।
এখন অন্তত মুক্তো হাওয়া আর
মাঠের মনোরম সবুজ ঢেউ চাই।
আমার কোথাও কি হবেই পৌঁছুতে?
কোথায়্য সে ঠিকানা, অজানা আজও রয়।
তাহলে মাথা পেতে ছায়ায় শুনি বাঁশি
অজানা সেই পথে, যেতই যদি হয়।
দেখছি ঝোপেঝাপে ফুটেছে বনফুল,
উড়ছে প্রজাপতি, গাইছে পাখি গান।
হোক হা এখানেই রাত্রিবাস, দেখি
তারার ঝিকিমিকি, জ্যোছনা করে পান।
কিন্তু কিছুতেই থামলে চলবে না,
সূর্য জাগলেই যাত্রা হবে শুরু।
করিনি সই কারও মরমী চুক্তিতে,
দীক্ষা দেননিকো আমাকে সদগুরু।
আমার পায়ে ক্ষত, আঁধার নামে চোখে;
হৃদয়ে হাহাকার, সমুখে, মৃগতৃষা।
কাঁদায় প্রতিপদে গোলকধাঁধা শুধু
এবং দুপুরেই কী ঘোর অমানিশা!
যাত্রাশেষে যদি না পাই মণিহার,
হবে না কোনও খেদ; আমি তো উৎসুক
বৃষ্টি, রামধনু, শিশির, নুড়িতেই;
অজানা পথে হেঁটে চলাতে পাই সুখ।
যখন মেঘ চিরে চাঁদের নাও ভাসে,
আমার দেহবীণা নতুন সুরে বাজে।
জাগলে মনে কারও প্রণয়-কথা কিছু,
সাজাই সত্তাকে অরূপ কত সাজে।