তবু আসতেই হলো
নিমগ্ন তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে, নক্ষত্রের
ওপারে কী আছে ভাবি। এই যে এলাম
সব ছেড়ে ছুড়ে
সাত তাড়াতাড়ি,
এতকাল পরে, কী পেলাম? শুধু ফাঁকা
ধু ধু লাগে, যেদিকে তাকাই।
অথচ অভাব নেই কিছুরই এখানে। স্বর্ণাভার
কারুকাজ, দরদালানের ভিড়,
চমৎকার সাজানো দোকানপাট, গাড়ির আওয়াজ,
সেলুন, চা-খানা, লন্ড্রি, লোকজন, রঙিন তামাশা-
সবই আছে।
জানালার বাইরে দাঁড়ানো
সাতটি সুপুরি গাছ, শাদা বাড়ি, বেগনি ফুলের
টব বারান্দায়, কারো স্মিত
অস্তিত্বের ঝিলিক মিলিয়ে যায়, পর্দা, নীল সিল্ক,
দোলে; বায়ুস্তরে
ঢেউ তোলে পাখি
এবং একের পর এক এলেবেলে স্মৃতির জোনাকি। এই
ভোরবেলা, কোন, সোনারুর
সূক্ষ্মবোধে শিল্পিত, হঠাৎ
রাত্রি হয়ে গেল;
আমার আপন অতীতের মুহূর্তগুলিকে আর
ফেলে-আসা পায়রাগুলিকে
যদি কেউ আশীর্বাদ করে,
আমি তাকে দিয়ে যাবো কৃতজ্ঞতাময়
ঘাটে; হায়, এখানে শূন্যতা
ছাড়া কিছু নেই, তবু আসতেই হলো।
দরজায় দাঁড়ানো কেউ
দরজায় কে দাঁড়ালো একরম ঘোষণাবিহীন,
এমন নিঃশব্দ? দেখেছি কি তাকে আগে
কখনো গলির মোড়ে একা
দাঁড়ানো? অথবা ফুটপাতে? দেখেছি কি
চকিতে উঠতে বাসে ভিড়
ঠেলে কোনো গ্রীষ্মের দুপুরে কিংবা শীতার্ত সন্ধ্যায়
কুয়াশায় নিমেষে মিলিয়ে
যেতে নিকটকে দূরত্বের শীতবর্ণে গূঢ় লেপে?
না দেখে নি। দেখছি এখন তার এই চলে-আসা
চৌকাঠে দিয়েছে মেলে অচিন আঙ্গিক
খুব নিরিবিলি। আমি কোনো
সরলীকরণে
কখনো উদ্যমশীল নই
ফলে লহমার দৃশ্যটিকে তুড়ি মেরে নির্বাসনে
পাঠাতে পারি নি,
বরং অত্যন্ত ঝাঁঝাঁ দুপুরে রাখাল
যেমন তাকিয়ে থাকে রৌদ্রের ওপারে কিছু দেখে,
তেম্নি তাকে দৃষ্টির সীমায় রাখি গহন মুদ্রায়।
যখন ভেবেছি আগন্তক বলবে না
কোনো কথা, তখনই সে কণ্ঠে দিলো খুলে
মোহন ফোয়ারা এক-‘তোমার এ-ঘরে
নামবে অরণ্যছায়া, বাজবে মৃদঙ্গ অদৃশ্যের, এতকাল
যা দ্যাখো নি দেখবে, শুনবে যা শোনো নি
তোমার দেয়ালগুলি দেবো আমি সরিয়ে এবং স্বপ্নের ভেতরে স্বপ্ন,
স্মৃতির ভেতরে স্মৃতি ভরে দেবো’ বলে
সে মিলিয়ে গেল বায়ুস্তরে। শুনি কার পক্ষধ্বনি?
একটি অনুপস্থিতি এমম শূন্যতা রেখে যায়,
ভাবি নি কখনো আগে।
ক্ষণিকের জন্যে হলেও সে দরজায় এসে ঋজু
রহস্যে দাঁড়িয়ে ছিল। আপাতত প্রতিফলনের
আভা শ্বেত গোলাপের মতো
ফুটে থাকে কিছুক্ষণ, যা ফোটাতে পারে তারই মতো আগন্তুক।
দিই না দুয়ো
অনেক দেখে অনেক ঠেকে এখন আমার
শেখা হয়ে গেছে
অনেক কিছুই। আমার চারদিকে উল্টোপাল্টা
যা কিছুই ঘটুক,
আমি আর চমকে উঠি না; বেমক্কা কোনো
পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
ঘাবড়ে যাবো, এমন হয় না কখনো,
আর ধরি না অদ্ভুত এই কলিকালের খুঁত।
কিছু কিছু লোক আছে বাগানে টগর কি জুঁই
গোলাপ অথবা রক্তজবা দেখলেই
ফুলগুলোর গায়ের থুথু ছিটোতে থাকে।
কিছু কিছু লোক আছে আকাশে তারা ফুটতে
কিংবা চাঁদ উঠতে দেখলেই ঠিক
ট্রাউজারের বোতাম খুলে
ল্যাম্পপোষ্টের মূলে বারবার ভারমুক্ত হবার
দুর্নিবার তাগিদ অনুভব করে
কিছু কিছু লোক আছে ছাদের কার্নিশে,
রেলিঙে কোনো
কবুতর দেখামাত্র তার ঘাড় মটকে দমবন্ধ করবার জন্যে
আঙুল মটকাতে থাকে।
কস্মিনকালেও ওদের আমি দিই না দুয়ো,
বলি না ওদের সাত পুরুষের ভিটায়
চরুক ঘুঘু;
বরং ওরা যাতে বেঁচেবর্তে থাকে,
থুথু ছিটানোর মতো যথেষ্ট থুথু যাতে থাকে ওদের মুখে,
সঙ সেজে আরো বেশি রঙ তামাশা
করতে পারে এই দুনিয়ায়,
সেই কামনাই করি অষ্টপ্রহর।
দিতে পারে নয়া সাজ
অফিস উগরে দিলো দুপুরে। এখন, ওরে মন,
কী করি? বিবর্ণ স্ফীতোদের বাসে চেপে প্রথামতো
অবসন্ন মনে ফিরে যাবো কি বাসায়? ক্ষিপ্র ডান
হাতের ব্যাপার সেরে বিছানায় গোয়েন্দা কাহিনী
নিয়ে কিছু সময় গড়িয়ে দেবো? না, থাক; বরং
ট্যাঁক হালকা করে রেস্তোরাঁয়, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত
সিনেমায় কিছুকাল কাটিয়ে আয়েশে ফেরা যাবে
ভাড়াটে বাসায় কায়ক্লেশে আরশোলার আস্তানায়।
কে কার জীবন আজ করছে যাপন? এই আমি
নগণ্য চাকুরে, মাস কাবারে, দেনায় হাবুডুবু,
গিন্নীর গঞ্জনা সয়ে খোদার তিরিশও দিন, এই
আমি কি আমার মধ্যে ন্যালাক্ষ্যাপা ভিন্ন মানুষের
জীবন ধারণ করি? হাজিরা খাতায় প্রত্যহ যে
করে সেই, সে কি আমি? মই বেয়ে উঠি নীলিমায়?
আগুনের রেশম কবিতা, মাঝে সাঝে এমনকি
আমারও বুকের মধ্যে মঞ্জরিত; ফেটে-পড়া বীজ
সাজাই খাতায়; বাজে কাগজের ঝুড়ির খোরাক
সুনিশ্চয় আমার পদ্যের শৈশবের হুটোপুটি।
প্রগাঢ় যযাতি রাত্রি মাথায় লাগায় চুপিসারে
স্বপ্নের কলপ আর দুর্ভিক্ষে রাস্তায় মৃতা কোনো
মায়ের বিশুষ্ক স্তনে মুখ-গোঁজা শিশুর মতোই
পড়ে থাকে বে-লেবাস আমার স্বপ্নেরা ইতস্তত।
সংসদ ভবন নির্বাসিত সম্রাটের মতো বড়
চিন্তাকুল, স্থাণু আর অন্ধকারে সূর্য সাজাবার
আ মরি তাগিদে হৈ-হুল্লোড়ে পাড়া তোলপাড় করে
বখাটে কর্মীরা বিদ্যুচ্চমকের মতো ওরা ভোল
পাল্টায় এবং মূঢ়তার ঘেরাটোপে জীবনকে
সঁপে দিয়ে জীবন হননে মাতে ঋতুতে ঋতুতে।
সতর্ক সেপাই ঘেরা বনেদী জলসা ঘরে ওহো
প্রাক্তন বিপ্লবীদের ওষ্ঠে চাকভাঙা মধু ঝরে,
মধু ঝরে; মুখে জনগণ নাম হামেশা, সাধের
প্রগতি চুলোয় যাক বীতশান সূর্যাস্তের পথে!
দেশ হালবিহীন নৌকোর মতো ঘুরপাক খায়
ঘূর্ণিজলে অবিরত। কবন্ধের দল চতুর্দিকে;
গরুর গাড়ির চাকা ডোবে পিচ্ছিল কাদায়, আর
ভাবি আজ বিপ্লবই দেশকে দিতে পারে নয়া সাজ।