বহুদিন পর পাড়াতলীতে আবার
দাঁড়-বাওয়া নাও নয়, যন্ত্রচালিত নৌকায় চড়ে
মাঝে মাঝে ঝুঁকে হাত দিয়ে মেঘনার পানি ছুঁয়ে
যেতে-যেতে দূর থেকে গন্তব্যের যমজ গাছের
কেবল একটি দেখে প্রশ্নাকুল হই। আলুঘাটে পৌঁছে শুনি
ক্রমাগত ঢেউয়ের প্রহারে দু’টি যমজ গাছের একজন
আহত যোদ্ধার মতো লুটিয়ে পড়েছে মৃত্তিকায়।
ফসলের ক্ষেতের আইলে হেঁটে যাওয়ার সময়
আমাকে জড়িয়ে ধরে ধান ও গমের ঘ্রাণ, মিঠা আলুবীজ
হয়ে ক’দিন আগে বোনা, শিশু চারাগুলো খুব
উৎফুল্ল তাকায় এই পথচারী আমার দিকেই। দৃষ্টি মেলে
কুড়াই নানান দৃশ্য, আমার নিজের
গ্রাম পাড়াতলী অদূরেই আছে স্মৃতির ছায়ায়।
হেঁটে যেতে-যেতে বাঁশবন, ঘাসবন চোখে পড়ে,
একদা এখানে যারা ছিল এ পাড়ায়
তারা কি এখনও আছে? এখনও কি তাদের উঠোনে
মাছ ধরবার জাল শুকোয় রোদ্দুরে? ডুবে শাড়ি-পরা নারী
সরিয়ে গাছের ডাল আলগোছে দেবে কি ঈষৎ উঁকি এই
ধূসর শহুরে লোকটিকে এক নজর দেখার জন্যে? তাকে
চেনা মনে হবে তার? সংস্কৃতির বেড়া
মাঝখান থেকে, হায়, এক চুলও সরে দাঁড়াবে না।
পিতৃপুরুষের হু হু ভিটার কাছেই
একটি পুকুর, তার কিনারায় গাছের ছায়ায়
ক্লান্তি মুছে নিতে বসি টিনের চেয়ারে, মনে পড়ে
একাত্তরের এপ্রিল দুপুরে
কবিতা লিখেছিলাম নাক্ষত্রিক আলোড়নে আর
এই পুকুরের পিপাসার্ত জল আমার অসুস্থ
আত্মজকে অনুরূপ দ্বিপ্রহরে করেছিল গ্রাস। তবু এই জলাশয়
রোদালো দুপুরে আর জ্যোৎস্নাময়ী রাতে মন কাড়ে,
মন কাড়ে হাঁসের সাঁতার। এ পুকুর
আমার পিতামহের সমান বয়সী কিংবা আরও
অধিক প্রবীণ যার জলজ স্মৃতিতে জমা আছে
বুঝি বলবার মতো ঢের গল্পাগাথা, এখনও যা খুঁজি।
বিকেলের মৃত রোদে সেকালের মসজিদটির
পাশে পারিবারিক নিভৃত গোরস্তানে নিরিবিলি
দাঁড়াই, যেখানে পিতা, পিতামহ, আমার আত্মজ
মতিন, মোমেনা খালা মিশে আছেন মাটিতে।
কাঁপেনি আমার ওষ্ঠ প্রজাপতির পাখার মতো,
স্তব্ধতার মূর্তি আমি, কেমন সুদূর, যোগযোগহীন।
সন্ধ্যা না হতেই পুকুরের স্নিগ্ধ ঘাট, হাঁস, বালিকার
স্নান আর আম-জাম, জামরুল কুমড়োলতার কাছ থেকে,
কবরস্তানের মৃত রোদ, বুনো ঘাস, বাঁশবন
থেকে খুব নীরবে বিদায় নিয়ে আলুঘাটে পৌঁছে যাই আর
অস্তগামী সূর্যটিকে কোনও পিতৃপুরুষের রাঙা
মুখ মনে হ’ল ভেজা ঘাটে পা রেখে। নৌকোয় ওঠে পড়ি;
ইঞ্জিনের থর থর শব্দ, সরে-যাওয়া ঘাট, ক’জন স্বজন
আর আস্তে আমার ভিতর জন্ম নিতে থাকে ক’বিঘা সবুজ।
বাজান গো
বাজান গো, তুমি ক্যান আনলা আমারে
পাথরের শহরে, এহানে
আমাগো গাঁয়ের
উদাম সবুজ মাঠ নাই, ক্ষেতের আইল নাই, দীঘি
নাই, নাই ইঁদারা, ঘুঘুর ডাক। সরিষার ক্ষেতে
প্রজাপতি নাচে না এহানে।
আমি হর অক্ত এক কালা ছায়া দেহি
আমার উপর বেরহম
হামেশা নাইমা আসে দেওয়ের লাহান।
বাজান গো, আমিতো আইতে চাই নাই
এই ইট পাথরের শহরে, এহানে
আমার লাহান বাচ্চা মাইয়ারে ছিঁড়া
খাইবার চায় মানু, শরীলে বসায় দাঁত, খুন
ঝরে, শুধু ঝরে,
বড়ই জুলুম করে। আমি
হগল সময় দেহি এক কালা ব্যাটা
আমারে চাইপা ধরে, আমার নিশাস্
বন্ধ হইবার চায়। একখানা কালা ছায়া হগল সময়
আমারে জুলুম করে। হায় খোদা, কালা
খুন ঝরে শরীল থাইকা ঝরে হগল সময়।
বাজান গো, তুমি ক্যান আনলা আমারে
পাথরের শহরে, এহানে
আমি আর থাকবার পারুম না। আমারে দেহায়
ডর এক কালা ছায়া হারা দিন হারা রাইত, বাজান।
বিজ্ঞান সম্মেলনের পরে
বিজ্ঞান সম্মেলনটি শেষ হ’লে
একজন সংবাদ-শিকারি
সম্মেলনের সবচেয়ে ধীমান, প্রবীণ
বৈজ্ঞানিকের মুখের সামনে ক্ষুদে মাইক্রোফোন
রেখে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার কাছে
সবচেয়ে ভালো লাগে কী?’
বৈজ্ঞানিক, যার মাথায় কাশফুলের মতো
চুল, চোখ প্রজ্ঞায় সুদূর, গভীর,
সংবাদ-শিকারির দিকে না তাকিয়ে,
করিডোরের ওপারে খোলা আকাশের নীলিমায়
নিমগ্ন হ’য়ে নম্র কণ্ঠে বলেন,-
‘শিশুর হাসি আর ভোরবেলার রোদে নিশির-ফোঁটা।
বিস্মিত দেবদূত
ঘুম আর ঝিমুনি কুয়াশার মতো ঢেকে ফেলেছে
শহরটাকে; দিন-দুপুরেও অনেকে
ঘুমোয়; ঝিমোয় প্রায় সবাই। একজন এই প্রবণতা থেকে
নিজেকে মুক্ত রেখেছে। লোকটা
নিজের আস্তানা ছেড়ে বেরোয়া কম, ঘরে
বসে বই পড়ে, পায়চারি করে সময়
কাটায়, একাই থাকে সব ঋতুতে। মাঝে-মাঝে
কেউ এলে কিছু কথাবার্তা, চা সিগারেটের ধোয়া।
ঝিমধরা লোকজনদের অনেকে
খানিক জেগে তাচ্ছিল্যের থুতু ছিটিয়ে ভাবে-
লোকটার চালচলন
বিধিসম্মত নয়। শোনা যায়,
ঘরে বসে নাকি সে গোধূলিতে, সন্ধ্যারাতে
এবং মধ্যরাতে কী সব রঙিন ফানুস ওড়ায়।
সাত আসমানের নানা রঙের
মেঘের স্তর পেরিয়ে এই শহরে নেমে এসে
একজন দেবদূত গভীর রাতে লোকটার ঘরে
আলো জ্বলতে দেখে
স্বগতোক্তি করলেন, ঝিমুনি-ধরা, ঘুমে কাদা
মানুষের ভিড়ে সে এখনও জেগে থাকে রোজ, লোকটা স্টুপিড নাকি
উন্মাদ!
বৈশাখ সুস্পষ্ট লেখে
আকাশের তুলট কাগজে কী সহজে
বৈশাখ স্পষ্ট লেখে প্রথম অক্ষর,
যেন আদি কবির খাগের কলমের
ডগা থেকে ঝরে আদি শ্লোক নতুনের
খবর রটিয়ে চরাচরে। মুহূর্তেই
দিগন্তের রেখা রূপময় হয়ে ওঠে
তুলির টানের মতো; চেতনার নানা
স্তরে দোলে বৃক্ষছায়া নুড়ির নূপুর
বাজায় পাহাড়ি ঝর্ণা, চিত্রল হরিণ
ছোটাছুটি করে, পাতা চিবোয় এবং
পিপাসা মেটায় ঝিলে মুখ রেখে ধূ-ধূ
প্রান্তর, ফসল-তরঙ্গিত ক্ষেত জুড়ে
সুতীব্র দহন, পুড়ে যেতে চায় কচি
ঘাস, লতাপাতা আর পাখির পালক।
গেরুয়া চাদরে মোড়া উদাস বৈশাখ চেয়ে থাকে অপলক
রোদের প্রখর স্তব্ধতায়, শুক্নো ঠোঁটের কাঁপে
ঘন ঘন রুক্ষ চুল ওড়ে
হাওয়ায়, একটি পাখি ঝিমায় গাছের ডালে পাতার আড়ালে,
কিশোর গায়ের জ্বালা জুড়োতে দিঘির
জলে নামে, দেয় ডুব বারবার, যেন সে পাতাল
ছুঁতে চায়। একজন তরুণী কলসি কাঁখে গা থেকে পানির
ফোঁটা সমুদয়
ঝরাতে ঝরাতে যায় একাকিনী, মাটি
শুষে নেয় জল, ছায়াচ্ছন্ন ঝাড়ে ঘুঘুদের হু হু
ডাক দুপুরকে বড় ব্যাকুল, উদান করে তোলে,
যেন কেউ মাটির গভীরে খুব ডুকরে ওঠে।
ভোরবেলা বৈশাখকে ডাকছেন কবি অন্তরঙ্গ
কণ্ঠস্বরে সে আহ্বান শঙ্খধ্বনি হয়ে
ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে কলাবিদ ধনীর ড্রইংরুমের আর
দরিদ্রের হতশ্রী কুটিরে। ফিরে আসে প্রতিবার
রবীন্দ্রনাথের চিরনতুন বৈশাখ রমনার বটমূলে, জোড়াসাঁকো,
আর শান্তিনিকেতনে, সাঁওতালী গ্রামে।
নতুন আসে যেন গাছের কচি পাতা
কিংবা সকালের প্রথম তাজা আলো।
পক্ষীশাবকের প্রখর ওড়াউড়ি
শূন্যে গুঁজে দেওয়া ঝাপ্টা নতুনের।
নতুন এলে বুঝি পুরনো হয় লীন
নিমেষে নাস্তির কৃষ্ণ হাহাকারে।
তাহ’লে কেন মনে স্মৃতির ছায়া কাঁপে?
স্মৃতি কি পুরনো প্রতিচ্ছবি নয়?
বিগত দিনগুলি এবং রাতগুলি
কত যে কথা বলে প্রতীকে উপমায়-
কখনও চোখে ভাসে দূরের ধু-ধু পথ,
কখনও বুকে নদী চকিতে বয়ে যায়।
ছিলাম কোনওদিন আমিও জ্বলজ্বলে
সুশ্রী যুবা এক, সহসা মনে পড়ে।
আমার পদাঘাতে যুগের নুড়ি ওড়ে,
মুঠোয় সময়ের প্রবল ঝুঁটি কাঁপে।
এখন আমি খুব বয়সে ভারানত,
রয়েছি ছোট ঘরে রোগের কব্জায়।
আমার সারা মুখে ধুলোর আবরণ,
আমার হাতে আজ তিনটি মৃত পাখি
যতই স্মৃতিকণা খুঁটি না কেন, তবু
দখিন হাওয়া এসে জাগিয়ে তোলে প্রাণ।
আবার হালখাতা সামনে, নেচে ওঠে,
নতুন দিন আঁকে সোনালি স্বাক্ষর।
স্বপ্ন জোনাকির মতোই জ্বলে নেভে,
প্রবল পূণিমা জোয়ারে টেনে আনে
একটি প্রতিমাকে মনের উপকূলে।
তার সে হেঁটে-আসা ঝরায় তারাফুল।
জ্যোৎস্না খেকো ধেড়ে ইঁদুরগুলো মাঠে
ছুটছে অবিরত। ধানের শীষ গায়ে
লাগছে বলে ওরা কখনও হেসে ওঠে
কখনও বিপদের আভাসে শঙ্কিত।
আমার ছোট ঘরে এমন রাত্তিরে
ভাবতে পারি না তো ফ্রস্ট আসবেন;
দরজা খুলে দেখি জীবনানন্দের
দু’চোখ ভাসমান, আয়ত, সুগভীর।
রূপসী বাংলার আত্মভোলা কবি
রাখেন হাত এই রুগ্ন লোকটার
কাঁধের শিহরণে নববর্ষে তিনি।
প্রবোধ দেন খুব বিফল আমাকেই।
কখনও নিরাশায় অমাবস্যা আমি,
আশায় কখনওবা সূর্যোদয় হই।
পঙ্গু অসহায় দাঁড়িয়ে নয়া মোড়ে
সামনে এগোবার শপথ নিই ফের।
চকচকে ব্লেডের মতো এই বৈশাখী দিন, কবির
মনে হ’ল, ওর ক্লান্তিকে মুছে ফেলেছে একেবারে। এখন
ওর চোখে চারপাশের সব কিছু সূচনা করেছে
এই উৎসব, মনে ফুটেছে অজস্র কুসুম। বিছানা ছেড়ে উঠে
সে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়,
আহ্, এই চেনা গলিটা আজ কেমন
নতুন সাজে নর্তকীর নাচের মুদ্রায় সুস্থির। এই যে
দু’ একজন পথিক হেঁটে যাচ্ছে
ধীর গতিতে, তাদের প্রত্যেককে, হোক তিনি
ধনবান কিংবা কোনও দুস্থ ভিখিরি,
আলিঙ্গনে বাঁধতে ইচ্ছে করছে
কবির, আর কাছের গাছের ডালে বসে-থাকা ঝুঁটি-অলা
পাখিটাকে ডেকে এনে ছোলা কিংবা পাউরুটির টুকরো
খেতে দিলে কী ভালোই না লাগত!
গত রাতের শেষ করতে না-পারা কবিতাটির কথা মনে পড়ে যায়
তার, যখন সে তাকায় শালিকগুলোর রোদ্দুর
আর ধুলো নিয়ে চানাচানির দিকে। নিজের
সৃজনকালের অন্তর্গত রুদ্র জ্যোৎস্না স্মরণে আসে কবির।
বৈশাখী দিনের মতো ঝকঝকে কবিতা
লেখার কথা কতই না ভেবেছে, সত্যিকারের নতুন
তার পঙ্ক্তিমালাকে চুম্বন করুক, এই কামনা
ওর অনেক প্রহরের ঘুম চুরি করেছে।
টেবিল থেকে লেখার খাতা কুড়িয়ে নিয়ে
অসমাপ্ত কবিতার শরীরে দৃষ্টি বুলোয় কিছুক্ষণ।
না, একে পরিণতির ঘাটে ভেড়ানো নিষ্ফল, বরং
বাজে কাগজের ঝুড়িতে হোক এর ঠাঁই। চেয়ারে বসে
মৈমনসিংহ গীতিকার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে সে
পথ খোঁজে ফসলের ঘ্রাণময় পথের মোড়ে। খাপ থেকে
বেরিয়ে-আসা তরবারির মতো বৈশাখী দিন
শাণিত আলোর ঝলকানিতে
মহুয়াকে জ্যোতির্ময়ী করে নিমেষে। কবি মহুয়ার আদলে
তার আধুনিকা দয়িতাকে নিবেদন করে সনেট আর ভিলানেল।
এই বোশেখে পাব তোমার প্রসন্নতা, আশা রাখি
বহু দিনের রুক্ষ কিছু কথার কাঁটা ছিঁড়েছে বুক,
চোখ হয়েছে রক্তজবা। হাতছানি কার
তোমাকে এই চোরাবালির কাদায় ডোবায়?
কে দিয়েছে তোমার হাতে বিষের পাত্র ছদ্মবেশে?
চৈত্র জুড়ে ভীষণ পুড়ে আমায় কেন দিলে ছুঁড়ে
অগ্নি ঝড়ে? এই বোশেখে নিভবে আগুন, বলল এসে
শান্তিপুরের অচিনা পাখি। সোজাসুজি পাখির দিকে
গেলাম ছুটে। কাঁটা ফেলে, গরল ধুলোয় গড়িয়ে এসে
আমায় তুমি তোমার শ্যামল ছায়ায় নাও।
শুধু ঝকঝকে হাসি থাকে না বৈশাখী দিনে কখনও কখনও
বৈশাখের দীপ্ত দিন কালো
কেশর দুলিয়ে
গর্জনে কাঁপিয়ে দেশদিক প্রবল ঝাঁপিয়ে পড়ে
শহরে ও গ্রামে। হিংস্র দাঁতে আর সুতীক্ষ্ম নখরে
ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলে গাছপালা,
অসহায় মানুষের প্রশান্ত বসতি;
কখনও কখনও লোকক্ষয় হয়, হাহাকার ওঠে।
যদি কালবৈশাখী চকিতে
দুরন্ত ঝাপ্টায়, কবি ভাবে, লোকালয়ে
হাহাকার না ছড়িয়ে স্বার্থান্ধ, কপট
সমাজের উৎপীড়ন, বৈষম্য, দুর্গতি
সমূলে উড়িয়ে নিয়ে যেত,
তবে তার রণমূর্তি শতবার কাঙ্ক্ষণীয় হতো।