নিশ্চিত বলা যাবে না কিছু
ঘরে বসে আছি একা। অকস্মাৎ এক ঝাঁক হল্দে প্রজাপতি
ঢুকে পড়ে পাখনা দুলিয়ে, প্রজাপতিদের চোখ
এই নম্র হলুদ বিকেলে
চকিতে আমাকে দেখে কী ভাবে? কে আমি
ওদের নিকট? দেয়ালের টিকটিক, কাচপোকা
এবং নিজের তৈরি নক্শি-জালে ধ্যানমগ্ন মাকড়সা-ওরা
আমার বিষয়ে কিছু জানে কি বস্তুত?
ওদের বাস্তবতায় আমার কি আছে বাস্তুভিটা এক কোণে?
০২
কী এক রহস্যময়তায় শহরলীর ছায়াচ্ছন্ন ছাদে
ভাষা থেকে সরে
জীবনানন্দের কিছু স্বপ্ন মেঘমালা হয়ে ভাসে।
সেসব মেঘের রোঁয়া অভিমানে কোন্ সে সুদূর
বঙ্গাব্দে নীরবে পৌঁছে যাবে,
গড়বে উৎসব এক তারাময় সমারোহে আকাশে আকাশে।
জীবনানন্দের ভাষা ঘাস আর শিশিরের সংসর্গে এবং
হ্যাইড্রান্ট আর নুলো ভিখিরির ছেঁড়া ন্যাকড়ার কটু গন্ধে
ভরপুর অপরূপ ওড়াবে নিশান সৌরলোকে। অরুণিকা
সান্যালের মুখে জেগে থাকবে কুয়াশায় কিংবা জ্যোৎস্নাময়তায়।
০৩
নিশ্চিত বলা যাবে না পঙ্ক্তিটি কোথায়
গায়েব হলো। কিছুক্ষণ পর অনূঢ়ার হাসির মতো রোদ
ছড়িয়ে পড়ে। পাশের বাড়ির তরুণী বারান্দায় এসে দাঁড়ায়;
একটা কাক বাতিল হাঁড়িতে জমে-থাকা পানি
শুষে নিয়ে তৃষ্ণা মেটায়। কিয়দ্দূরে মলিন খুপরিতে বসে
একজন তরুণ কবি খাঁ খাঁ শূন্যতার ভেতর থেকে
টেনে তোলে জালে ধরা-পড়া চকচকে মাছের মতো
কয়েকটি চিত্রকল্প আর গাছের পাতাগুলো
করতালি বাজিয়ে সবুজ পরীর হাতে রূপান্তরিত। পঞ্চাশ
বছরের মালতীকে ওরা কি খুন করেছিল এমন ঝকঝকে
ভেজা দুপুরে?
০৪
বলব কি রাত্রির টহলদার পুলিশের বুটের আঘাতে
কাতরাচ্ছে লাজুক আঁধার?
বলব কি ‘সাতটি তারার তিমির’কে
সাতটি অমল হাঁস বয়ে নিয়ে যাচ্ছে
কর্মিষ্ঠ ডানায়? বলব কি
মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে বড় একা শুয়ে আছি নক্ষত্রের খাটে;
হাতে কির্কেগার্ডের কেতাব? বলব কি অ্যাম্বলেন্সে অচেতন
যাচ্ছেন মুমূর্ষ ছুটে যিনি, সুজন সে-নাগরিক
আমারই সুহৃদ? বলব কি দিচ্ছেন আমার দিকে
এগিয়ে সুরার পাত্র মাইকেল মধুসূদন অমিত্রাক্ষর ছন্দে মেতে?
বলব কি আমার পায়ের জুতোজোড়া খুব ছোট হয়ে গেছে বলে
আঙুল ভীষণ ফেটে রক্ত
ঝরছে কেবল? বলব কি আমার পায়ের নিচে
সুশীতল ঝর্ণাধারা বয়?
বলব কি আমার কলম
মেরুপ্রদেশের তুষারের ঝড়ে সমাহিত হবে একদিন?
০৫
এই তো খুড়িয়ে-হাঁটা হরিণের আহত পায়ের
ক্ষতে পট্রি বেঁধে পোস্টমর্ডাণ কবির
চোখে মুখে লান্তি নামে; তিনি ঝিলের কিনারে ঝরা
পাতার বালিশে মাথা রেখে
ঘুমিয়ে পড়েন, স্বপ্নে মঙ্গলকাব্যের পাঁচালির খুঁটিনাটি জড়ো হয়।
দেহাতি চাঁদের দিকে তাকাতে তাকাতে
গাজনে মজেন কবি আর বঙ্গাব্দের পর বঙ্গাব্দ পেরিয়ে
যান বসে ময়ূরপঙ্ক্ষীর পাটাতনে।
নয়না এবং আমি
নয়না, আমার পাঁচ বছরের পৌত্রী, বিকেলের
খেলা ছেড়ে এসে বলে, ‘আচ্ছা, দাদাভাই,
ঐ যে মেঘগুলো চলে যাচ্ছে বেশ দূরে,
বলো তো কোথায় যাচ্ছে? ওদের কি খেলাঘর আছে?
তোমার মতোই কোনও দাদাভাই আছে?
ওরাও কি ক্লাশে যায়, যেমন আমাকে যেতে হয়?’
নয়নাকে বলি,-
‘আকাশই ওদের খেলাঘর, সেখানে কোথাও দূরে
আমার চেয়েও ঢের ভালো এক দাদাভাই আছে
মেঘমণিদের, তার চুল শাদা নয়,
চোখে কালো চশ্মা নেই। তিনি পঙ্ক্ষিরাজ
ঘোড়া চড়ে রোজনা ছোটেন নানা দেশে। ‘তা হ’তেই
পারে না, তোমার চেয়ে ভালো জবাব শোনায়।
একদিন ভর সন্ধেবেলা মাগরের নামাজের কিছু আগে
পাড়ার ক’জন মানুষকে খাটে লাশ বয়ে নিয়ে
যেতে দেখে নয়না আমাকে
বিস্মিত জিগ্যেস করে, ‘আচ্ছা দাদাভাই
ওরা টগরের
বাপীকে এভাবে শাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে
এখন কোথায় নিয়ে যাবে?’ নিরুত্তর
বিষণ্ন আমার দিকে নয়না তাকায়।
‘একদিন আমাকেও এভাবেই নিয়ে যাবে তোমার নিকট
থেকে বহুদূরে,
যেখানে শুইয়ে দেবে সেখানে জ্বলে না আলো অথবা বয় না
বাতাস কখনও, শুধু নিশ্চিহ্ন হওয়ার ধুলোপথে
আমাকে রাখবে ফেলে সবাই’, এ-কথা
নয়নাকে সেই ভর সন্ধ্যেবেলা বলতে গিয়েও বলা হয়নি
তখন।
প্রকাশিত হয় নানা স্তরে
এই যে আমার চতুর্দিকে সারি সারি গ্রন্থ, রাও
বৌদ্ধ শ্রমণের মতো ধ্যানমগ্ন এখন, প্রায়শ
এরকমই থাকে, মাঝে মাঝে
আমার হাতের স্পর্শে কারও ধ্যান ভাঙে। এসব গ্রন্থের
বই আছে, যেন বিত্তবানের ভবনে
দরিদ্র আত্মীয়, বড় প্রচ্ছন্ন, নীরব,
সঙ্কুচিত সর্বক্ষণ। সময় ওদের কালো করে বয়ে যায়।
কিয়দ্দূরে ডালিম গাছের পাতা হাওয়ার
হাতের স্পর্শে পুলকিত হয়, একটি সুনীল পোকা ঘাসের চাদরে
হাঁটে প্রাতঃভ্রমণকারীর মতো আর
টিঙটিঙে ঘাস ফড়িং-এর নাচানাচি
দেখে নিয়ে ঈষৎ কৌতুক বোধ করে কাকাতুয়া। এই গলি
অকস্মাৎ গভীর রাত্তিরের হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের গান,
গালিবের গজল কখনও। ঘুম থেকে জেগে ওঠে দেখি
আমার চাদ্দিকে সারি সারি বই নিস্তব্ধ কবর।
কখনও-কখনও এই সব কবরের সঙ্গ ছেড়ে
ডালিম গাছের পাতা, কাজল দিঘির পদ্ম, বাঁশবন আর
গোধূলি রঙিন সর্ষে ক্ষেত, ঘন মেঘে ঢাকা-পড়া
শালবন আর মাছরাঙাদের কাছে
চলে যেতে বড় সাধ হয়। তাহলে কি
পুস্তক-বিরোধী আমি? রাশি রাশি হরফের সন্ত্রাসে কাতর?
এখনও তো দেশ-বিদেশের নানান কালের কবিতার
অন্তঃপুর থেকে কত ফুলের সৌরভ, সরোবরের ঝলক,
প্রজাপতিদের শোভা, কামিনীর চোখের সুদূর
উপকথা প্রকাশিত হয় নানা স্তরে।