দু’টি ছবি
একজন খ্যাতিমান চিত্রকর, ষাটোর্ধ এবং
হৃতস্বাস্থ্য, বহুদিন ধরে
ক্যানভাসে আঁকছেন একটি পোট্রেট
সযত্নে, অথচ কিছুতেই
নিজেরই পছন্দসই হচ্ছে না। সর্বদা ছবি তাকে
ভাবায়, দেয় না স্বস্তি এতটুকু।
ইচ্ছা ছিল আঁকবেন একটি সুকান্ত মুখচ্ছবি
কল্পনার জ্যোতি দিয়ে। তুলি আর রঙ ক্ষণে ক্ষণে
ক্যানভাসে সুন্দর নিপুণ অনূদিত হয়,
আবার অবাক কাণ্ড পর মুহূর্তেই সেই মুখ
নিষ্ঠুর, বীভৎস হতে থাকে। এ কেমন পুরুষের অবয়ব
রঙের আড়াল থেকে ফুটে ওঠে? চিত্রকর তার
অসমাপ্ত ছবি রেখে বাইরে বাগানে চলে যান কিছুক্ষণ
বিশ্রামের টানে, মনে তার দুশ্চিন্তার আঁকি-বুঁকি।
ক্যানভাসে ভয়ঙ্কর এক মুখচ্ছবি
যেন বা জীবন্ত খুব, ভাঁজে ভাঁজে নির্দয়তা মাখা।
কী খেয়াল হ’ল বালকের, তুলি আর রং নিয়ে
আরেক খেলায় মেতে ওঠে। চিত্রকরের ছবির
পাশেই আনাড়ি ঢঙে একজন শিশুর কোমল ছবি আঁকে
খেলাচ্ছলে এবং ছবির শিশু হয় দেবশিশু।
নিঃসঙ্গতা
সেতো আজকের নয়, বেশ ক’যুগ
আগেকার কথা; তখন আমি
কৈশোর আর যৌবনের মোহনায় দাঁড়ানো
পুরনো ঢাকার গলির এক বুড়ো সুড়ো বাড়িতে
আমরা থাকি। কোনও কোনও গোধূলিবেলায় অথবা
সন্ধ্যারাতে লম্বা বারান্দার এক কোণে একলা
বসে খানিক সময় যাপন করতাম। আমাকে
অমন দেখে বাবা অপ্রসন্ন হতেন, মনে হতো। তিনি
যখন জিগ্যেস করতেন, ‘কী করছিস তুই এখানে’, হতচকিত আমি
বোবা হয়ে থাকতাম, যেন হাতে-নাতে-নাতে ধরা-পড়া চোর।
না, আমি বাবার পকেট থেকে টাকাকড়ি
সরাইনি কখনও, মায়ের হাত বাক্সেও করিনি হামলা। নিশ্চুপ
বারান্দার নির্জন কোণে বসে আকাশ কুসুম ভাবতাম,
চুরি করতাম, গোওধূলিবেলার রঙ, সেসব
পাখির উড়াল, যাদের ডানায় নীড়ে ফেরার ব্যাকুলতা,
হাল্কা হাওয়ার রেশমি আরাম আর সন্ধ্যাতারার আলো।
বাবার নারাজ মুখ দেখে নিরুত্তর আমি
বারান্দায় নির্জনতা ছেড়ে চলে যেতাম
আরেক নির্জনতায়, যেখান থেকে অন্তহীন টানেলে
অথবা জটিল অরণ্যে প্রবেশ করে হরিণীর চোখের কোমলতা
বুনো গাছের শিহরণ আর জ্যোৎস্নার ঘ্রাণ
লুট করলে কেউ আমাকে পাকড়াও করবে না
কোন অছিলায়, যেখানে অসীম নিঃসঙ্গতা সখীকে
বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকব।
এখন এতকাল পরে, যখন সময়
তার মুঠোয় আমার চুল ধরে টেনে নিচ্ছে বার্ধক্যের
দোরগোড়ায়, আমি নির্দ্ধিধায় একলা
বসে থাকতে পারি ইচ্ছে মতো আমার বারান্দায়। আজ আমাকে
কেউ প্রশ্ন করতে আসবে না কেন আমি
এভাবে বড় একা নীরবতায় এলিয়ে রয়েছি।
আজকাল নিঃসঙ্গতা বড়ই বিপন্ন করে তুলছে;
যখন ঘরে নিঃসঙ্গ বসে থাকি,
দুর্ভাবনা সন্ত্রাসীর মতো অস্ত্র চেপে ধরে আমার
স্পন্দিত বুকে, ক’জন মুখোশধারী
আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে ভাগাড়ে,
গলায় কাটা মুণ্ডের মালা ঝুলিয়ে
এক পাষণ্ড আমার মুখে লাথি মারছে ক্রমাগত।
অথচ এই মুহূর্তে কেউ এসে আমাকে
জিগ্যেস করছে না, এই অন্ধকার ঘরে
একা-একা কী করছিস তুই? মরহুম আব্বার মুখে
ক’যুগ আগের সেই অবাক-করা প্রশ্ন শোনার জন্যে
আজ আমি বড়ই ব্যাকুল, তৃষিত আর অর্থসন্ধানী হয়ে আছি।
নিঝুম ভেতরে
কয়েক হাজার বছরের রৌদ্রজ্যোৎস্না আর গাঢ়
অন্ধকার তার
নিঝুম ভেতরে খেলা করে সাবলীল। কখনও সে
এই সত্য ভুলে থাকে, কখনও আবার
ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে ওঠে কিংবা কোনও গোধূলিবেলায়
আকাশের দিকে খুব বিমুগ্ধ তাকিয়ে
অকস্মাৎ এ সত্যের শাঁস করে অনুভব রক্তের ভিতর
এবং কেমন স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে যায় লহমায়।
এত্তেলা না দিয়ে তার ঘরের ভেতর
প্রবেশ করেন এক দীপ্তিমান, সুকান্ত পুরুষ। কণ্ঠস্বর
তার বেজে ওঠে স্তব্ধতার বুক চিরে-
‘দ্যাখো তো আমাকে তুমি চিনতে পারো কি?
হাজার বছর আগে কাব্য রচনার প্রতিযোগিতায় আমি
তোমাকেই বারবার পরাস্ত করেছি,
যদিও নিশ্চিত জানতাম, প্রকৃত তোমারই প্রাপ্য সকল শিরোপা।
তার প্রস্থানের পর ঘরময় চন্দনের ঘ্রাণ ঝুলে থাকে।
মধরাতে বয়েসী লোকটা বিছানায় এপাশ করে
কিছুক্ষণ, অকস্মাৎ অন্ধকার ঘর আলো করে একজন
সুন্দরী দাঁড়ায় শয্যা ঘেঁষে, কণ্ঠে বীণাবাদনের
সুর এনে বলে,
‘দ্যাখো তো আমাকে তুমি চিনতে পারো কি?
হাজার বছর আগে তুমি আর আমি
ভাসিয়ে ছিলাম তরী প্রণয়ের উত্তাল সাগরে,
আমাদের দু’জনকে ঢেকে ফেলেছিল
হিংসুটে করাল মেঘ। ভালোবাসার অপরাধে
হয়েছিল শিরশ্ছেদ তোমার,’ বলেই
অপরূপ সেই নারী হাওয়ায় ছড়িয়ে
লোধ্ররেণু কুরুবক-ঘ্রাণ হাজার বছরে নম্র মিশে যায়।
কয়েক হাজার বছরের রৌদ্রজ্যোৎস্না আর গাঢ়
অন্ধকার তার
নিঝুম ভেতরে খেলা করে। অতীতের ছায়াতরী
ভেড়ে ঘাটে বারবার অবচেতনের স্তরে স্তরে। কোন্ নীল
স্বপ্নময়তায় তার বর্তমান অতীতের অন্তর্গত এবং অতীত
বর্তমানে রাজহাঁসরূপে গ্রীবা তোলে-
তার কিছু বোঝে আর কিছু বোধতীত থেকে যায়।
নিরন্তর ব্রতী
কী সুখেরই না ছিল সেসব দিন পক্ষিরাজের
ডানা-অলা দিনগুলি আমাকে নিয়ে
উড়ে বেড়িয়েছে আকাশে আকাশে। আনন্দ-আবিরে
রঞ্জিত দিনগুলি
প্রজাপতির রেশমি পাখনা হয়ে খেলা করত বাগানে,
তখন আমার আনন্দের জন্যে কোনও বড় রকমের
আয়োজনের প্রয়োজন ছিল না। ঘরের কোণে
বেড়ালের বসে-থাকা, হাওয়ায় স্পন্দিত ঘাস অথবা
একটি পাখিকে উড়ে যেতে দেখলে
কিংবা সন্ধ্যারাতে বাড়ির কাছে মোটরকার এলে
আমি আনন্দ-সরোবরে নেয়ে উঠতাম এবং
সবার অলক্ষ্যে প্রবেশ করতাম ঝলমলে এক জগতে।
অথচ আমার আনন্দধারা হারিয়ে গেছে
রুক্ষ, ধূ-ধূ মরুভূমিতে। নিজেই আমি
অপমান করে দূরে সরিয়ে দিয়েছি বসন্ত বাহারে ঝস্কৃত
সেই দিনগুলিকে; বেদনার্ত হৃদয়ে ওরা
নির্বাসনে গিয়ে অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে
রেখেছে। অভিমানে। সেই দিনগুলোর দিকে
তাল তাল কাদা আর পাথর ছুঁড়ে ওদের বুক
ঝাঁঝরা করে দিয়েছি।
পরম সুখের সেই দিনগুলিকে ফিরিয়ে আনতে
পারব কি আবার? সেইসব দিনরাত্রি উন্মোচিত হতো
উৎফুল্ল লাল নীল পদ্মের মতো। পদ্মের সুঘ্রাণ আমার
ঘুমের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ত। ওদের ক্রূশে
চড়িয়ে পেরেক ঠুকে ঠুকে ভীষণ ফ্যাকাশে, নিষ্প্রাণ
করে ফেলেছি। এখন ক্রুশ থেকে নামিয়ে
শুশ্রূষা করলে কি ওরা সজীব হাসির ঝর্ণা হ’য়ে উঠবে?
জানি না পুনরুত্থান সম্ভব কিনা আর। তবে আমাকে
আকাশ-ছোঁয়া স্পর্ধায় অসাধ্য সাধনে
নিরন্তর ব্রতী হতে হবে সকল বিরূপতা উজিয়ে।