ডাঃ জেকিল অ্যান্ড মিঃ হাইড
ছিলাম তো শাদামাঠা, আলাভোলা শহুরে বাসিন্দা
একজন; কারও সাথে পাঁচে
ছিল না আমার মন কোনওদিন, গৃহকোণে জ্ঞানান্বেষী সাধকের মতো
সুন্দর ও কল্যাণের ধ্যানে মগ্ন ছিলাম সর্বদা। শক্র মিত্র
যাচাইয়ের ক্ষমতায় দিইনি অধিক ধার আর
করেছি বিশ্বাস সবাইকে খোলা মনে। ভেবেছি রোদ্দুরে আর
জ্যোৎস্নায় সাঁতার কেটে যাবে বেলা,
ফুটবে না কাঁটা পায়ে রুক্ষ পথ যখন তখন।
একদিন কী-যে হ’ল দেহমনে, চেয়ে দেখি এ কি
আমার ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে ভেজা
লকলকে জিভ আর মুহূর্তেই আমি কান্তিমান,
সুঠাম দেহের অধিকারী, গভীর নিশীথে বসি
জুয়োর টেবিলে নিত্য দেবদূতদের
সঙ্গে, খরদৃষ্টিতে পোড়াই
প্রতিযোগীদের আর রমণীলোলুপ আমি প্রকৃত প্রেমের
সন্ধান পেয়েও নষ্ট মেয়েমানুষের
সঙ্গে মাতি ক্ষণিকের কপট প্রণয়ে! একজন
বামন আমার দিকে ছুঁড়ে দে কুটিল তামাশা।
আয়নায় নিজেকে দেখে চম্কে উঠি-এ কোন সুকান্ত
পশু, যাকে বস্তুত চিনি না, যে আমার সত্তা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেই করে
হাতাহাতি কঠিন আঘাতে আর্ত কেউ,
কারও কষ বেয়ে রক্ত ঝরে
এবং নিজেও আমি শরীরে প্রচুর ক্ষত নিয়ে
উদ্ভ্রান্ত ডেরায় ফিরি। রাত্রিশেষে আমার প্রকৃত
আমি হয়ে যেতে থাকি, যখন সূর্যের
প্রথম কিরণ চুমো খায় আমাকে নতুন ভেবে।
সন্ধ্যা নেমে এলেই চকিতে অন্য কেউ, যার বুকের ভেতর
নিমেষে গজায় লোমরাশি, আমাকে দখল করে,
দস্তানায় লুকিয়ে সুতীক্ষ্ম নোখ কাফে
কিংবা বারে যাই, গোল বাধে যথারীতি, ঘরে ফিরি
ঝড়োবেগে, বুকজোড়া হা-হুতাশ, আমার তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠে ঝরে
দু’ফোটা শিশির, কী ব্যাকুল চেটে নিই।
প্রত্যুষ ফিরিয়ে দেয় পুরনো চেহারা শাদামাঠা, আলাভোলা,
সারল্যে কোমল, টলটলে; কৃতকর্মে অনুতাপে
দুগ্ধ হই বারবার। স্থাপিত আমার নত কাঁধে
সুন্দর ও কল্যাণের হাত। ‘বিনাশে তোমার ত্রাণ’,
দশদিকে থেকে ডেকে বলে ঘন ঘন
রোদের ঝিলিক-লাগা নগ্ন কবরের ঘাসমাটি।
ডাকি ভগ্নস্বরে
শাতার্ত প্রান্তরে হু হু কাঁপছি নিয়ত। ঝরা পাতা,
মরা পাতাগুলো প্রেতস্বরে
বলে কিছু গূঢ় কথা; কিয়দ্দূরে পাখির কঙ্কাল
সদ্য বিধবার
নিভৃত শোকের মতো পড়ে আছে। শীতল হাওয়ার
স্পর্শে আজ সুখহ নেই, মনে হয় কয়েকটি তীক্ষ্ণ দাঁত
আমার ঈষৎ
বিবর্ণ শিথিল ত্বক ভেদ করে মাংসে
নিষ্করুণ বসে যাচ্ছে ক্রমাগত, মাথার কেশর
উধাও এখন, স্বাস্থ্য লুট হ’য়ে একাকী হেঁটে বেড়াতে পারি না
কিংবা নিশীথের
তৃতীয় প্রহরে সঙ্গলিপ্সু বান্ধবের সঙ্গে ঘুরে
ঘুরে পথে সকালের চোখে চোখ রাখতে অক্ষম
অথবা নৌকায় চড়ে ভাসি না পূণিমা-রাতে ধীর বুড়িগঙ্গার সলিলে।
হায়, মনমাতানো আড্ডার লোভে কতকাল আমি
যাইনি বিউটি বোর্ডিং এর শান্ত আশ্রয়ে এবং
কতদিন শুইনি মাঠের ঘাসে। এখন প্রায়শ
ঘরে থাকি, লেখাপড়া আছে যথারীতি,
রুগ্ন ফুস্ফুস্ নিয়ে কাশি হরদম,
দেখি দূর প্রবালদ্বীপের পাশে মৎস্যকন্যাদের জলকেলি
ভাবি তার কথা যে আমার নিভৃতির
উদাস প্রাঙ্গণে করে আসা-যাওয়া অলক্ষে সবার।
কে ক্রুদ্ধ ঈগল ক্রমান্বয়ে আমার শরীরটিকে ছিঁড়েখুঁড়ে
করেছে ভীষণ জব্দ, অথচ মনের
ঝুঁটি আজও অনমিত। নতুন শতাব্দী কড়া নাড়ে,
দাঁড়িয়ে ক্ষয়ের বৃত্তে ক্ষণে ক্ষণে যৌবনকে ডাকি ভগ্নস্বরে।
তার কথা
‘ঘুমিয়েছিলাম ঘরে গোধূলিবেলায়, ঘুম ভেঙে গেলে দেখি
তিনটি দোয়েল আর তিনটি পাপিয়া
নেচে নেচে ঢুকে পড়ে আমার নিঝুম করোটিতে,
আমার পায়ের তলা ফুঁড়ে বনতুলসীর ঝাড়
নিমেষে গজায়, চণ্ডীদাস রাজহাঁস বুকে চেপে
টেবিলের ওপরে বসেন। ওষ্ঠে তার
কী এক দ্যুতির আসা-যাওয়া; পুরনো দেয়াল থেকে
বেরিয়ে আসেন ভবভূতি
পাণ্ডুলিপি হাতে, চোখে থেকে
ঘুমের কুয়াশা ঝেড়ে অসামান্য অতিথিদ্বয়ের জন্যে দ্রুত
চা করে আনার কথা ভেবে ছুটে যাই
এবং আমার ঘর অকস্মাৎ ঐরাবত হয়ে মেঘলোকে
উড়ে যায়’-এইটুকু লিখে তার নিজের খাতায়
দেয়ালের দিকে চোখ রেখে ক্লান্ত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
০২
মলিন ধূসর কবি হেঁটে যেতে যেতে দেখে, ভাবে কী সহজে
অসঙ্কোচে গোল চাঁদ ছায়া ফেলে অসুস্থ ডোবায়
চিরকাল। আহার করেনি কবি দ্বিপ্রহরে, কেবল বিকেল
চা খানায় গলা ভিজিয়েছি। পকেটে পয়সা নয়, কতিপয়
উপমা, মিলের ঝলকানি, চিত্রকল্প নড়ে চড়ে। নিঃসঙ্গ সে
বসে পড়ে ডোবার কিনারে, দেখে জ্যোৎস্নার জোয়ারে
ডোবায় অখ্যাত শোক হয়ে আট্কে আছে
যুবতীর লাশ; এই ছবি
সে হয়তো প্রগাঢ় তুলে নেবে ভিন্ন রূপে তার কবিতায়। তদন্তের
শরীরে দিনের পর দিন শ্যাওলা জমবে যথারীতি।
০৩
কখনও-সখনও লোকটার মনে পড়ে তার মা’র
কবরের কথা, মনে পড়ে যায় কোনও এক বিকেলবেলায়
মা’র কবরের পাশে বসেছিল একা;
দেখেছিল কয়েকটি প্রজাপতি কবরকে হাল্কা চুমো খেয়ে
উড়ে যায় কোন্ অজানায়।
মানুষের শরীরের রূপান্তর তার ভাবনাকে
কেমন ঘোলাটে করে। শরীর একদা সুশ্রী ছিল
মার আর এখন তা বিশীর্ণ কঙ্কাল
এবং মাটির নিচে প্রজাপতি অথবা গোলাপ কিছু নেই,
যা আছে সে-কথা ভাবলেও, হায়, আপন কঙ্কাল কেঁপে ওঠে।
০৪
তার কিছু কিছু কথা লোকে জানে, জানে না সকল
কথা কেউ। লোকটা সহজ, স্বাভাবিক, তবু কিছু
অন্তর্গত ক্ষ্যাপামি রয়েছে। তাকে পথে একা হেঁটে
যেতে দেখা যায়, মাঝেমাঝে পার্কের বেঞ্চিতে বসে চুপচাপ
কী-যে ভাবে, হয়তো কিছু শব্দ তাকে ঠোকরাতে থাকে
চঞ্চল মাছের মতো। তার সঙ্গে প্রায়শ টেবিলে
মুখোমুখি বসে স্তব্ধ গোধূলিতে চা খায় বিষাদ।
বুকে তার একটি অচিন ফুল ফুটে আছে, অনেকের চোখে
পড়ে; আসলে তা ফুল নয়, ক্ষত। শোণিত-বুদ্বুদে
কেমন উথলে ওঠে শব্দরাজি, নবীন প্রতীক। মাঝে মাঝে
ধুলোবালি ঢেকে রাখে তাকে,
কখনও-কখনও আসমানে সে আসীন এক উড়ন্ত ময়ূর-সিংহাসনে।