কষ্ট আছে, কাঁটা আছে
কষ্ট আছে, কাঁটা আছে, পায়ের রক্ত ঝরা আছে,
তবু অনেক দীর্ঘ পথে বিরামবিহীন চলা আছে।
ক্লান্তি এসে চোখের পাতায় ঘুমের কুঁড়ি ফুটিয়ে দেবে,
কিন্তু আমার ঘুমের গন্ধ থেকে দূরে, অনেক দূরে থাকতে হবে।
এই তো দেখি নৃত্যপরা রূপসীরা মায়ার খেলা
দেখায় কত, বসাতে চায় তারাভরা আঁচল পেতে।
ভুলিয়ে রাখে পথের দিশা হাত বুলিয়ে ক্লান্ত মাথায়।
প্রতারক এ আলো নিয়ে আমায় ভ্রষ্ট যাত্রী করে।
বেঠিক পথে যতই ঘুরি, যতই ভুলি প্রতাণায়,
শেষ অবধি ধ্রুবতারা পথ চেনাবে, আশা রাখি।
আমার পাশে আজকে যারা সময় কাটায়, করছে তারা
ডানে বামে কেবল তুমুল চ্যাঁচামেচি, তারা সবাই
আমায় কালো বদ্ধ ডোবায় আটকে সদা রাখার পক্ষে।
কিন্তু ওরা বোঝে না যে আমার বুকে গান জেগেছে
সুমুদ্দুরের; কেটে ছেঁটে পিগ্মি করে রাখতে আমায়
চাইলে ওরা ব্যর্থ হবে, আমার মাথা নিরিবিলি আকাশ ছোঁবে।
কষ্ট আছে, কাঁটা আছে, পায়ের রক্ত ঝরা আছে;
কত যে হায় খানাখন্দ চলার পথে বেলাবেলি দিচ্ছে বাধা,
নানা মুখোশ যখন তখন ভয় দেখাতে নাচতে থাকে।
মনোলোকে চলছে কত ভাঙাগড়া, বিষের ধোঁয়ায় পায়রা ওড়াই।
শরীর থেকে অন্ধ ডোবার শ্যাওলা ঝেড়ে এগোই এখন খোলা পথে,
রক্তে আমার সৃষ্টি-শিহর সারাবেলা, নইতো আর একা একা,
সবার হাতে হাত মিলিয়ে যাব অনেক দূরের পথে,
সমুদ্দুরের নিগুঢ় গানের প্রেরণাতে মহত্ত্বকে সত্যি ছোঁব।
কী যেন ভয় দেখায়
এতকাল পরেও কেমন বুক ঢিপ ঢিপ, মুখমণ্ডল জুড়ে
আচমকা রক্তোচ্ছ্বাস। কী যেন আমাকে ভয় দেখায় সারাক্ষণ।
এই যে সকালবেলা কয়েকটি পঙ্ক্তি লিখলাম, সেগুলোর
ওপর এ কিসের ছায়া? শব্দসমুদয় ভয়ার্ত শিশুর মতো মুখ
লুকায় আর দশ আঙুলের ঈষৎ ফাঁক দিয়ে তাকায় দোদুল্যমান
ছায়ার দিকে। খরার দাবদাহ, ঝড়ের ঝাপ্টা বহুরূপী শাসানি
থেকে কোনওমতে বাঁচিয়ে শব্দগুলোকে সস্নেহে জড়ো করেছি
এক জায়গায়। ওরা এখন ভোরবেলার টাটকা রোদ্দুর পান করে।
সুশৃঙ্খল খেলায় মেতেছে। আমার নির্ঘুম রাতের ছটফটানি ওদের
তালাশে দিগ্ধিদিক ছোটার যন্ত্রণা, নাছোড় ব্যাকুলতা দিব্যি ভুলে
গিয়ে নিজেদের মিলিত রূপটানের আনন্দের ঢেউ। সেই অজানা এক
ছায়ার ভাবনা ওদের কাছ থেকে সরে থাকে প্রায়শ;
আমি ছায়াটিকে মুছে ফেলার চেষ্টায় ক্লান্ত। শব্দগুলোর মুখ
থেকে ঘাম মুছিয়ে চুল আঁচড়িয়ে, সাজিয়ে গুজিয়ে ওদের যখন
হাজির করি আমার একান্ত আপনজনের কাছে, তখন প্রিয়তমার
চোখের মুখে মুগ্ধতার কলাপ। নিমেষে আমার অন্তর্লোকে
প্রস্ফুটিত অপরূপ শোভা। সেই মুহূর্তে রক্ত হিম-করে-দেওয়া
ছায়াটির কথা একটুও মনে পড়ে না।
খুব দ্রুত যাচ্ছি চলে
অনেক বছর আগে কোনও এক জাফরানী প্রান্তরে নিঃসঙ্গ
একটি গাছের নিচে তার সঙ্গে দেখা
হয়েছিল আমার কৈশোরে। লোকটার
গায়ে ছোঁড়া আলখাল্লা, এক মাথা দীর্ঘ কালো চুল,
গালভরা ঘন দাড়ি, চোখ দু’টো প্রদীপ্ত, উদাস,
যেন তিনি দেখছেন সব কিছু, কিন্তু কিছুতেই নেই মন।
‘যখন আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, হে কিশোর,
এরপর থেকে অস্থিরতা আর উদ্বেগ তোমার
নিত্যসঙ্গী হবে, তবে মাঝে মাঝে তোমার অন্তরে
বলা নেই কওয়া নেই কাঁটা ফুঁড়ে ফুটবে কুসুম, চর্চা যার
মাতিয়ে তুলবে দশ দিগন্তকে। যেদিন আমার
সঙ্গে ফের দেখা হবে, সেদিন তোমার
সব অস্থিরতা, ব্যাকুলতা আর উদ্বেগের হবে অবসান’,
বলে তিনি সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে যান।
তারপর অনেক অনেক সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের
আলো-ঢেউ আমাকে নিবিড় ছুঁয়ে গেছে, ঝরে গেছে
ঢের পাতা আমার রক্তাক্ত পদতলে,
অথচ অচিন সেই পুরুষের সাক্ষাৎ মেলেনি
আজ অব্দি সন্ধানের পরেও এবং আমি
ক্রমাগত খুব দ্রুত যাচ্ছি চলে কবরের দিকে।
ঘোড়সওয়ারের স্বপ্ন
কয়েকটি কর্দমাক্ত প্রাচীন কঙ্কাল ছিল নির্জন প্রান্তরে
কুমারী নিশীথে; মাঝে মাঝে রুগ্ন এক কুকুরের
আর্তস্বর শোনা যায়। অদূরে একটি বধ্যভূমি,
যার মাথা ছুঁয়ে জপ করে একা ভাঙাচোরা চাঁদ
গাঢ় রাত, ক’জন জুয়াড়ি এসে জোটে জনহীন
প্রান্তরের এক প্রান্তে, দিশি মদ খায়, কেউ হো হো হেসে ওঠে,
কেউবা ফুঁপিয়ে কাঁদে ইয়ারের কোলে মাথা রেখে,
কখনও আবার কেউ গ্লাশ ভরে নেয়, কেউ কেউ
ভেসে যায় খিস্তিখেউড়ের স্রোতে। একজন অকস্মাৎ
বুভুক্ষু চাঁদের দিকে মাটির সেয়ানা
ঢেলা ছুঁড়ে মারে জোরে; সাতজন জিপ্সি রমণী
ঘাগরা দুলিয়ে জুড়ে দেয় নাচ। নক্ষত্রেরা নৃত্যপর
পায়ের ছন্দিত ঠামে ঝরে পড়ে। কোত্থেকে ক’জন
বিশীর্ণ ভিখিরি এসে তারাগুলো চকচকে টাকা ভেবে নিয়ে
সাগ্রহে কুড়ায় আর একটি আহত ঘোড়া খোঁড়াতে খোঁড়াতে
কানায় কানায় ভরা টলটলে জলাশয়ে মুখ রাখে ধূসর তৃষ্ণায়।
বৃত্তাকারে বসেছে ক’জন শুক্নো ঘাসে। কারও কারও
জিভের ডগায় গল্প নড়ে চড়ে, কেউ বা নিশ্চুপ
অতিশয়; আগুনে ঝলসে যাচ্ছে যুবা
হরিণের গুলিবিদ্ধ শরীর; তিনটি
চমকিত ঘোড়া চোখে অশ্রুকণাসহ অদূরে দাঁড়িয়ে থাকে,
হয়তো খুঁজছে ওরা মেঘলোকে নিরাপদ ডেরা।
তিনটি ব্যথিত ঘোড়া ঘোড়সওয়ারকে বৃত্ত থেকে
তুলে নিয়ে কখনও গহীন গাঙে আর
কখনও-বা ফুলবনে রাখে। ঘুমের ভেতরে ঘুম,
ঘুমে কিছু পরাগ এবং মেঘ, আসমানি নীল লেগে থাকে।