এক শুয়ে আছে
লোকটা সকালবেলা একা শুয়ে আছে বিছানায়
চিৎ হয়ে; তার ভেতরে প্রবেশ করে ফের
সন্ধ্যারূপে নিশ্চুপ বেরিয়ে
ছড়িয়ে পড়বে চারাচরে। লোকটা লোকটা ধোয়নি মুখ আর
সারাবেলা খায়নি কিছুই। আলিফের
মতো পড়ে আছে মলিন শয্যায়, দৃষ্টি তার
নিবদ্ধ আকাশে আর সেখানে অনেকগুলো জেব্রা মনোরম
মেঘের প্রগাঢ় ঘাস খাচ্ছে নিরিবিলি। ওরা ছুটে
আসবে এখানে ঘরে লোকটাকে আনন্দ জোগাতে। ওর হাত
পৌঁছে যায় মেঘদলে এবং জেব্রার পাল বিমুগ্ধ তাকায়।
একজন বৃদ্ধের কথা
একজন বুড়ো সুড়ো লোক বারান্দায়
বসে দেখছেন বিকেলের স্তব্ধ রোদ ঈষৎ কাঁপিয়ে এক
বেগুনি রঙের পাখি নিয়েছে বিনম্র ঠাঁই গাছের শাখায়।
লোকটার মাথায় বিরল শাদা চুলে
হাওয়া মৃদু খেলে যায়। ক’জন বালক
বালিকা আনন্দ হয়ে খেলছে গলিতে। শৈশবের
খেলা দেখে ভাবলেন ভদ্রলোক তার ছেলেবেলা
ভুলেও কখনও আর ফিরে আসবে না।
কিছুক্ষণ পরে সেই বৃদ্ধের উৎসুক চোখে পড়ে-
তরুণ তরুণী হেঁটে যাচ্ছে হাত ধরাধরি করে
যুগ্মতায় গাঢ় অনুরাগ নিয়ে। বুড়ো লোকটার
কানে দীর্ঘশ্বাস বলে হতাশার স্বরে-
তোমার যৌবন আর আসবে না ফিরে
বাজিয়ে মদির রাঁশি কোনওকালে। তোমার এ জরাগ্রস্ত হাতে
রাখবে না হাত কোনও প্রেমময়ী তরুণী কখনও। ফাঁকা দৃষ্টি
নিয়ে তিনি নিশ্চুপ থাকেন বসে একা বারান্দায়।
এখনই নামবে সন্ধ্যা; ভাবেন সে বৃদ্ধ, যা যা ছেড়ে
গেছে তাকে সময়ের নানা বাঁকে, তার
কিছুই কখনও ফিরে আসবে না। এখন তো তার জন্যে কবরের
হাতছানি ছাড়া কিছু নেই। মৃত্যু ফিরে
আসবে কেবল নানা ছদ্মবেশে, যতদিন প্রাণ
আছে এই এই ক্ষয়িষ্ণু শরীরে। তবু তিনি,
সেই বৃদ্ধ, রৌদ্র-ছায়া, গাছের সবুজ পাতা, ক্যামেলিয়া আর
গোলাপের হাসি আর তারার রূপালি মহফিল
এবং বালক-বালিকার খেলা দেখে, পুরনো দিনের সুর
শুনে অবশিষ্ট আয়ু সুস্মিত কাটিয়ে দিতে চান। অকস্মাৎ
তার চোখ কেন যেন অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে যায়
আর বুকে জেগে ওঠে বোবা হাহাকার।
একজন শিল্পীর প্রোফাইল
এখন বয়স তাঁর পুরোপুরি পঁচাশি বছর;
ধবধবে শাদা চুল আর দাড়ি, প্রায় টলস্টয়
মনে হয় কখনও কখনও। একা ঘরে বসে মৃতা
পত্নীর রঙিন প্রতিকৃতি, তাঁরই আঁকা, দেখেছেন
সানুরাগ দৃষ্টিতে; পড়ছে মনে অতীতের কিছু
খুচরো ঘটনাবলী স্কেচের ধরনে। দিনান্তের
অস্তরাগ, সর্ষেক্ষেত, বৃষ্টিধারা, তারার কারাভাঁ
গন্তব্যের কুয়াশাজড়ানো পথ কী-যে বলে তাঁকে,
কিছু তার স্পষ্টত বোঝেন আর কিছুটা বোধের
বাইরেই থেকে যায়। এখন আঁকেন মাঝে মাঝে
কোনও ছবি অন্তর্গত সৃজনের হাতছানি তাঁকে
বড়ই ব্যাকুল করে বলে। কানে আসে কারও ডাক,
কে ডাকল এমন গহন রাতে? অচেনা ধূসর
কণ্ঠস্বর; কাউকে না জাগিয়ে দরজা খুলে একা
দাঁড়ান নিঝুম অন্ধকার বারান্দায়। আসমানে
সুবিপুল রহস্যের দীর্ঘশ্বাস, সপ্তর্ষিমণ্ডল
নীরবে পাহারা দেয়। অতীতের ঊর্ণাজাল তাঁকে
চকিতে জড়িয়ে ধরে পুনরায়। তাঁর চোখ মুখ
কেমন আচ্ছন্ন হয় সম্মোহনী সুরে, ক্ষণিকের
জন্যে; চোখে শিশিরের ফোঁটা নিয়ে আগামীর দিকে
সতৃষ্ণ তাকান তিনি, শিল্পী কাজী আবুল কাসেম।
একটি গাছ
গোধূলিতে গাড়ি বারান্দায় নির্জনতা
পোহাতে পোহাতে তুমি টেলিফোনে কথা
বলছিলে আর বাইরে একটি
বুড়ো সুড়ো গাছ
দমকা হাওয়ার খুব ভয়ে কাঁপছিল, পাছে
সে মুখ থুবড়ে পড়ে পথের ধুলোয়। তুমি ওকে
দূর থেকে দেখে
ভাবো আজ না হয় আগামী
কোনওদিন কেউ ওর গুঁড়িসুদ্ধ উপড়ে ফেলবে
বারবার কুঠারের ঘায়ে।
রোদ-পোড়া, উন্মাতাল ঝড়ের প্রহার-সওয়া এই
বুড়ো সুড়ো গাছ
কতকাল বাজখাঁই দুপুরে মেলেছে
ছায়ার নরম ছাতা পথচারিদের
মাথার ওপর আর গাছটির পাতার কাঁপন
আর স্তব্ধ অন্ধকারে পূর্ণিমায় অথবা বর্ষায়
ওর স্নান দেখে তুমি স্পন্দিত হয়েছ
বহুবার এই কথা ভেবে
দূরের গাছের জন্যে তোমার হৃদয়
মমতায় কানায় কানায় ভরে ওঠে
আজও, জানি। অথচ আমি যে এতো কাছের মানুষ
তাকে কেন মাঝে মাঝে আজকাল দুর্বাসা-চৈত্রের ঝাঁঝ দাও?
কতকাল এভাবে থাকব
কতকাল এভাবে থাকব এই ব্যাপক আঁধারে
চুপচাপ? আঁধারের প্রাণীগুলি তেড়ে
আসে চারদিক থেকে, ওদের জান্তব পদশব্দে
কাঁপে পথ, তুমুল গর্জনে
নড়ে ওঠে শান্তির নিবাস। ওরা খুব ঘটা করে
চেটে পুটে খেতে থাকে মানুষের মেধা।
কতকাল এভাবে কাটাব দিনগুলি, রাতগুলি
শঙ্কার থাবার নিচে? কোন্ ঝড় এসে
হঠাৎ উড়িয়ে নিয়ে যাবে ঘরদোর? সর্বক্ষণ
ভয়ে-ভয়ে থাকা,
দুঃস্বপ্নতাড়িত হয়ে থাকা, দরজায়
নেকড়ের ক্ষুধার্ত দঙ্গল নিয়ে বসবাস সকল সময়
কী করে সম্ভব? দেখি চোখ মেলে বাইরে জ্যোৎস্নার
জোয়ার ভাসিয়ে নিয়ে যাবে যেন
সোমত্ত রাত্রিকে কোনও নিরাপদ বাসরে কোথায়
আর কয়েকটি তারা বন পরীদের মুখ হয়।
কপটতা, কূপমণ্ডুকতা আজ জেঁকে বসে গেছে
সবখানে, গুপ্ত হত্যা ঝোপ বুঝে কোপ দেয়
আর কত বিভ্রম সহজে চেতনাকে
বিপথে চালিত করে। বিভ্রান্তি ভস্ম ঝেড়ে ফেলে
আবার নতুন করে স্বপ্নবীজ বুনে
আমরা তাকাই আদিগন্ত অর্থে সূর্যমুখী-ফসলের দিকে।
কবি বলেন
এখানে এই ধুলোবালি, রক্তমাখা মাটির ঢেলা,
ছেঁড়া ন্যাকড়া, হু হু শাদা ক’খানা হাড় কান্নাকাতর।
রুক্ষ ফাটা মাটি ফুঁড়ে ছিন্ন হাতের জেগে-ওঠা,
ছিন্ন হাতে মরা পদ্ম নুয়ে থাকে সকল সময়।
পাথুরে এই রক্ষ পথে ঝর্ণাধারা পাবে না কেউ
কোনও মতে; ধু ধু তৃষ্ণায় বুকে ধুলো জমছে শুধু।
গলায় বালি, কাঁকর ভরা, কেবল ভীষণ ক্লান্ত লাগে,
প্রেতের মতো মানুষগুলো অন্ধকারে পাশা খেলে।
ভায়ের গলায় ভায়ের ছুরি যায় বসে যায় অবলীলায়,
দিন-দুপুরে রাহাজানি, সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া অষ্টপ্রহর;
পশুপ্রতিম যৌনমত্ত পুরুষেরা নারী-শিশুর খুঁড়ছে শরীর,
চোর পুলিশে তফাৎ কত, হারে কপাল, বোঝাই দায়!
কারা কখন কার পেছনে গুপ্ত ঘাতক লেলিয়ে দেয়,
সহজে কেউ বোঝে না আজ। মিথ্যার তোড়ে
সত্য ভাসে অন্ধ ডোবায়; মানবতার পা পড়েছে
পিছল গর্তে, প্রগতিভুক্ত ছায়াগুলো দেখাচ্ছে ভয়।
প্রেতের নাচন, ভাগাড় আছে, কবি বলেন, নিলাম মেনে;
কিন্তু দ্যাখো ফুল ফুটেছে পথের ধারে, মাঝে মাঝে
পাখি ছড়ায় গানের আভা। এখনও তো প্রেমের গানে
হৃদয় জাগে, শিশুর এবং চাঁদের হাসি হৃদয় জুড়ায়।