আঁধার ছড়ায় ওরা
আঁধার ছড়ায় ওরা সগৌরবে গ্রামে গ্রামে আর
শহরের কলোনির ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে, বস্তিতে বস্তিতে।
আঁধার ছড়ায় ওরা মানুষের মগজের কোষে
নানা ছলে আর কত ছদ্মবেশী প্রলোভনে দেখি
নিজেদের শিবিরে জুটিয়ে নেয় শত শত কিশোর, যুবক।
ওদের রুখতে হবে, নইলে কাঁদবে গোলাপ, স্বর্ণ চাঁপা;
আর্তনাদে বুক ফেটে যাবে দোয়েলের, কোকিলের, পায়রার;
মানবতা দগ্ধ হবে মৌলবাদী আগুনের ঝড়ে। সর্বনাশা
এই ঝড় তারাই রুখতে পারে যারা প্রকৃতই মুক্তমতি,
মনুষ্যত্বকেই যারা ধ্রুব জেনে এগোয় সম্মুখে সর্বক্ষণ।
আত্মশুদ্ধি
বহু ঝড়ঝাপ্টা তাকে জখম করার
পরেই সে অকস্মাৎ পেয়ে গেল গোধূলিবেলায়
গহন সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত
শান্তি নীড়ঃ প্রত্যাশিত ছিল না বলেই
আনন্দধারায় স্নাত সে কুড়ায় নক্ষত্রের কণা
ধুলো থেকে প্রত্যহ চলার পথে আর
একটি নিজস্ব স্বর্গ গড়ে নেয় গৈরিক মাটিতে
গানে গানে। জগৎ-সংসার তার সহজে আপন হয়ে ওঠে।
কিছুকাল পর প্রতারক এক রাতে
ঘোর অমাবস্যা তাকে ঘিরে ধরে অপদেবতার
চাদরের মতো, মতিচ্ছন্নতায় হঠাৎ সে স্বেচ্ছায় পোড়ায়
নিজের প্রফুল্ল শান্তিনীড় আর ক্রূর লকলকে
আগুনে নিজেও পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
অনন্তর নিভে যাওয়া অঙ্গার এবং ভস্ম থেকে
প্রকৃত হীরক দীপ্ত চোখ মেলে চায়।
আনতেই হবে শান্তি
আনতেই হবে শান্তি
ডানে নয় জানি বামে চলাটাই শ্রেয়
অনেক হেঁটেছি, কত পথ আর বাকি?
দু’পায়ে জমেছে বিস্তর ধুলোবালি,
ভাবি যাত্রায় কতটুকু ছিল ফাঁকি?
পেছনের পথ লুপ্ত হয়েছে আজ,
সামনের পথ ঘন কুয়াশায় ঘেরা।
চলতেই হবে তবু সামনের দিকে,
জানি না মিলবে কবে শান্তির ডেরা।
কত প্রিয় সহযাত্রী হারিয়ে গেছে,
কখনও স্মৃতিতে সেই মুখগুলি ভাসে।
একদা ছিলাম সংগ্রামে এক সাথে,
মগজে অতীত জোনাকির মতো হাসে!
বন্ধু এখন শহরে ও গ্রামে দেখি
নেকড়ের পাল মেতে ওঠে সংহারে;
ওদের দাপট এখনই প্রবল রুখে
আনতেই হবে শান্তি এ সংসারে।
আমরা ক’জন
আমরা ক’জন নানা বয়েসী পুরুষ প্রায় প্রত্যহ এখানে
এই ঘরে বসি, কিছু সময় কাটাই। কেউ কেউ সহজেই
জমিয়ে ফেলেন গল্প, কারও ঠাট্রা মশ্করায় খোলে
মাথা, কেউ সমাজতত্ত্বের ভাষ্যকার, কেউ কেউ দার্শনিক
তর্কে মেতে ওঠেন হামেশা। একজন প্রৌঢ় কবি মাঝে মাঝে
আবৃত্তি করেন নানা বিদেশী কবিতা, বিশেষত নেরুদার।
আমি নিজে স্বল্পবাক, অন্যদের রকমারি কথা কানে নিয়ে
বিস্তর আনন্দ পাই। কোনও কোনও দিন কারও স্থুল রসিকতা
আমাকে পীড়িত করে এবং নীরবে সহ্য করি অরুচির
নিপীড়ন কালেভদ্রে। কোনও দিন ঘরে ঢুকেই কেমন হু হু ফাঁকা
লাগে, আমাদের একজন আর কখনও এখানে আসবে না
আসরের আকর্ষণে। চোরা ব্যাধি তাকে চুরি করে নিয়ে গেছে।
কিছুদিন মন খারাপের মেঘ থাকে, আড্ডায় ভাটার ছাপ
পড়ে, তারপর অচিরেই আবার জোয়ার আসে যথারীতি,
আবার প্রচুর গালগল্প, ঠাট্রা তামাশা, তর্কের ঝড়ঝাপ্টা
সেই ঘরে। কখনও ডায়েবেটিস, রক্তচাপ, হার্টের অসুখ
নিয়ে কিছু কথা হয়। একদিন উপস্থিত আমাদের কেউ
একজন আসবে না আর এই ঘরে, এ সরল সত্য ভুলে থাকি।
আমার বাবার ঘর
কালেভদ্রে ভাবতে ভালোই লাগে, আজও কোনওখানে
বাবার একটি ঘর আছে; কিন্তু জানি না কোথায়
কোন্ সীমা-সরহদে। সেই ঘরে তাঁর আচকান,
রুমি কিংবা মখমলী গোল টুপি, কোরান শরিফ
অথবা জায়নামাজ, তসবিহ্, হলুদ পঞ্জিকা-
বস্তুত কিছুই নেই, আছে শুধু শূন্যতার ধু ধু মৃগতৃষা।
সে ঘরের আশপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও
পাড়াতলী গাঁয়ের সবুজ, বাঁশঝাড়, মসজিদ,
প্রসন্ন পুকুর, কিছুই তো পাবেন না সবচে’ ধীমান
পর্যটক। ঢাকা শহরের হাই-রাইজ দালান,
সুপার মার্কেট কিংবা বুড়িগঙ্গা নদীও নজরে
তার পড়বে না আর প্রিন্টিং প্রেসের অনস্তিত্ব
অকূল শূন্যতাকেই অধিক প্রখর
করে তুলে পরাবাস্তবের ঘোরময় বিভ্রমের দিকে নেবে।
বাবার সে ঘরে নেই জননী আমার,
জনক নিজেও নেই কোনও রূপে; অনুরূপ ঘর
একদিন নিশ্চিত আমারও হবে, কিন্তু কেউ কারও
পড়শি হবো না কোনওকালে হবে না কখনও দেখা।
স্বপ্ন কি দুঃস্বপ্ন নেই, নাস্তির ভুবনে
ধূলিকণা, শুধু ধুলিকণা।
আমার শরীর থেকে মন
একদিন অকস্মাৎ কী খেয়ালে আমার শরীর থেকে মন
আলাদা বেগানা হয়ে যায়। তারপর
কখনও দোয়েলরূপে শিস দেয় বিনষ্ট বাগানে,
কখনও-বা প্রজাপতিরূপে
দিব্যি ওড়াউড়ি করে এখানে সেখানে, বসে গিয়ে
বিনম্র আমার দয়িতার কাঁধে, অসিত খোঁপায়।
আমার শরীর আর থাকে না আমার
বাস্তবিক, পড়ে থাকে বিছানায় ফাঁপা,
ভাবলেশহীন; চোখ শুধু একই দিকে স্থির এবং শ্রুতিতে
পশে না গানের সুর; বই, ফুলদানিময় গোলাপগুচ্ছের
পেলব পাপড়ি থাকে স্পর্শাতীত আর
অস্তমিত স্নিগ্ধ শিশু, তরুণীকে চুম্বনের সাধ।
দূর থেকে মন অনুভূতিহীন শরীরকে দেখে ভাবে, ঐ যে
লোকটা শয্যায় পড়ে আছে, সে-তো বস্তু শুধু,
নিঃসাড়, সে আর এ মুহূর্তে বসবে না
নিবিড় টেবিলে তার, নেবে না কলম তুলে হাতে, কবিতার
পঙ্ক্তিমালা হবে না রচিত কোনওমতে। মনে বলে,
‘মগজ নিষ্ক্রিয় তার, কেননা আমি তো চেতনাকে
সঙ্গী করে বেরিয়ে এসেছি
লোকটার অভ্যন্তর থেকে। এখন সে প্রকৃত সে নয় আর।
আমি কি তাহ’লে
আমি কি তাহ’লে উন্মাদ হয়ে যাব?
হিংস্র বাতাস মাংসে বসায় দাঁত,
সহযাত্রীরা অনেকে বিগত আজ,
অথচ করি না কখনও অশ্রুপাত।
হৃদয়ে একদা ছিল সবুজের মায়া,
এখন সেখানে ধূসর পাথর শুধু।
তৃষ্ণা-মেটানো পানি নেই এক ফোঁটা,
চৌদিকে দেখি বালুকণা করে ধূ ধূ।
দয়িতাও হায় বিরূপ আমার প্রতি,
শক্ররা হাসে আমাকে বেহাল দেখে।
কাদাজলে পড়ে খাচ্ছি কেবল খাবি,
দু’চোখ ক্রমশ আঁধারে যাচ্ছে ঢেকে।
প্রগতির কথা যত বেশি বলি আজ
ততই স্বদেশ পশ্চাতে যায় দেখি।
হুল্লোড়ে খাঁটি পড়ছে ধুলোয় ঢাকা,
যত্রতত্র ঝকঝক করে মেকি!
ষড়যন্ত্রের হোতারা রয়েছে মেতে
ধ্বংসে এবং ছড়ায় মোহের জাল।
ভাগীদার সব জোটে খোলা রাজপথে,
কাটে দিনরাত শান্তির শুভ ডাল।
বন্ধু এখনও থাকবে কি নিষ্ক্রিয়?
দেখবে কি বসে ধ্বংসের আয়োজন?
চাও কি অসুর রক্ত চাটুক সুখে,
সাধের বাগান হোক কণ্ঠকবন?