সকালে ঘুম ভাঙার পর
বেশ কিছুদিন পর আজ খুব সকালে ঘুম ভাঙল;
রোদ্দুর তখনও ঘরে কলাপ মেলেনি, রেশমি
আরাম আমার শরীর জুড়ে। একটু পরেই রোদের ঝলক
চুমো খায় বারান্দা, ঘরের মেঝে, দেয়াল, লেখার
টেবিল, বিছানা আর বুক শেলফগুলোকে। কেন যেন
মনে হলো আমার বুকের ভেতর বিলের চকচকে জল,
একটা, নুয়ে পড়া বাঁশের কঞ্চিতে বসে-থাকা মাছরাঙা
উড়বে কি উড়বে না, ভাবছে। ঘুরে ঢুকে পড়ে একটি ভ্রমর
গুনগুনিয়ে খুশি বিতরণ করে; কী যে ভালো লাগল
আমার। গৌতম বুদ্ধের মতো সংসারত্যাগী হওয়ার
ভাবনা মনে উঁকিও দিল না কখনও, যদিও প্রায়শ নিজস্ব
ধরনে বসে যাই শব্দ ও ছন্দের ধ্যানে।
পর্যটক মেঘের দিকে তাকাই, গত রাতের অসমাপ্ত
কবিতার একটি কি দু’টি পঙক্তি ঝিকিয়ে ওঠে স্মৃতিতে,
এবং টুকরো কবিতাই সেই সন্ধ্যারাতের দৃশ্যটিতে টেনে আনে
যার মুখ্য চরিত্র ছিলাম গৌরী আর আমি। আনন্দের তরঙ্গ
থেকে তরঙ্গে আমার দোল-খাওয়া। আজ সকালে
টেবিলে-রাখা শুকিয়ে-যাওয়া ছোট্র গাঁদা ফুল, দেয়ালে
মিহি জালে বসে-থাকা সন্তানসম্ভবা মাকড়সা, মেঝের হাল্কা
ধুলো-সব কিছুই খুব ভালো লাগছে। এমন কি কি সবুজ ঘাসে নীরব,
বিচরণকারী গুবরে পোকা আর নর্দমায় লাফিয়ে ওঠা
কোলাব্যাঙটিকেও পরম সুন্দর আত্মীয় মনে হলো আমার।
সায়াহ্নে মুখোমুখি
সেই যে কখন থেক লোকটা আমার মুখোমুখি
বসে আছে, তার চোখ দু’টি
নিষ্পলক চেয়ে আছে আমার দিকেই
মৎস্য শিকারির মতো। আমি কি পড়ব ধরা তার
বেঁকে-যাওয়া ছিপীই স্তব্ধ সন্ধ্যেবেলা? এখন সে
টেবিলে একটি রাঙা পোকাকে আঙুলে চটকাচ্ছে নিরিবিলি।
আমি এ টেবিল ছেড়ে খুব দ্রুত চলে যেতে চাই
অন্য কোনওখানে, কিন্তু যেন
যুদ্ধবন্দি আমি বাস্তবিক, এতটুকু সরবার
জো নেই কোথাও। অস্বস্তির কাঁটাগুলো মাংসে গেঁথে
যাচ্ছে ক্রমাগত আর লোকটার
হাতের আঙুলগুলো লোহার শিকের রূপ ধরে
আচানক; বমি পায়, যেন বড় তাড়াহুড়ো করে
কয়েকটি মেঘলা মদের পাত্র পর পর করেছি উজাড়।
স্বর্ণচাঁপা ওয়েস্ট্রেস মেন্যু হাতে আমাদের টেবিলের কাছে
এসে হেসে দাঁড়িয়ে,বাড়ায় আলগোছে স্নিগ্ধ মেন্যু-
কফি আর কেকের অর্ডার নিয়ে শাড়ির আঁচল
পেবল উড়িয়ে মিশে যায় কুয়াশায়। মৃদু হেসে
লোকটা টেবিলে মাত্রাবৃত্ত বাজায় এবং চোখে
আনে যুগপৎ
মিলন ও বিচ্ছেদের রঙ, ওর চোখে
চন্দ্র সূর্য অস্ত যায় এবং অজস্র নক্ষত্রের জন্ম হয়।
কে এই বেগানা লোক? এই প্রশ্ন আমাকে ব্যাকুল করে আর
আমার কম্পিত ঠোঁট শব্দময় হওয়ার আগেই
সে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায় ত্বরিৎ, হেঁটে হেঁটে
আমার নিকট থেকে বহু দূরে চলে যায়। অকস্মাৎ বিদ্যুচ্চকের
মতো মনে হয়, আমি তার অস্তিত্বের
অস্থিচর্ম, মেদমজ্জা, চেতনায় মিশে দ্রুত করছি প্রস্থান।
হাতের দোতারায় নানান গৎ
রেখেছি বুক পেতে মাটির সোঁদা বুকে,
খুঁড়েছি নিজেকেই নিত্যদিন
আমার হাত দু’টি বিদ্ধ কণ্টকে,
রক্ত দিয়ে শেষে শুধব ঋণ?
এ কোন্ ক্রূর পথে হাঁটছি ক্রমাগত?
এখানে তৃষ্ণার নেই তো জল;
ক্ষুধার করাতের দাঁতের আছে ধারা,
বাগানই নেই কোনও, উধাও ফল।
দীর্ঘ এই পথে বৃষ্টিধারা নেই,
রয়েছে পদে পদে রক্তপাত।
ধূসরতায় চোখ অন্ধ হ’ল প্রায়,
চিত্তে বিভীষিকা বসায় দাঁত।
ঝর্ণাধারা ভেবে গিয়েছি ছুটে কাছে,
অথচ ছিল সে তো চোখের ভ্রম।
ব্যাকুলতায় খুঁড়ে রুক্ষ মৃত্তিকা।
দেখছি বেলাশেষে বৃথাই শ্রম।
মধুর সঙ্গিনী ছিল যে উদার,
আমার প্রতি সে-ও বিরূপ আজ।
যে-মুখে সর্বদা সূর্যোদয় ছিল,
এখন সেখানেই নিত্য সাঁঝ!
অমৃতধারা ঠোঁটে ঝরেছে গতকাল,
কিন্তু আজ শুধু গরল বয়।
হাতির মত্ততা ছিঁড়ুক প্রীতিলতা,
সকল বিরূপতা করব জয়।
দুঃখ আমাকেই পর্যটক করে;
‘যতই তোকে ওরা ভয় দেখাক,
বন্য পশু আর নরপিশাচ দল’,
কে যেন বলে, ‘তুই চলতে থাক।
মাথায় এরকম তারার ঝলকানি,
হাতের দোতারায় নানান গৎ
কত যে দৃশ্যের শোভায় প্রীত হই,
পুষ্পে সেজে ওঠে ধুলোর পথ।
হৃদয়ে হাহাকার
আচ্ছা যদি আজ এখানে বসে পড়ি,
ঝিমোই কিছুকাল, তবে কি ক্ষতি হবে?
একটু বিশ্রাম এখানে বটমূলে,
কেই বা আপত্তি করবে এই ভেবে?
রুক্ষ পথে ঘাটে ঘুরেছি বিস্তর
জুটেছে কাদাবালি এবং কিছু ছাই।
এখন অন্তত মুক্তো হাওয়া আর
মাঠের মনোরম সবুজ ঢেউ চাই।
আমার কোথাও কি হবেই পৌঁছুতে?
কোথায়্য সে ঠিকানা, অজানা আজও রয়।
তাহলে মাথা পেতে ছায়ায় শুনি বাঁশি
অজানা সেই পথে, যেতই যদি হয়।
দেখছি ঝোপেঝাপে ফুটেছে বনফুল,
উড়ছে প্রজাপতি, গাইছে পাখি গান।
হোক হা এখানেই রাত্রিবাস, দেখি
তারার ঝিকিমিকি, জ্যোছনা করে পান।
কিন্তু কিছুতেই থামলে চলবে না,
সূর্য জাগলেই যাত্রা হবে শুরু।
করিনি সই কারও মরমী চুক্তিতে,
দীক্ষা দেননিকো আমাকে সদগুরু।
আমার পায়ে ক্ষত, আঁধার নামে চোখে;
হৃদয়ে হাহাকার, সমুখে, মৃগতৃষা।
কাঁদায় প্রতিপদে গোলকধাঁধা শুধু
এবং দুপুরেই কী ঘোর অমানিশা!
যাত্রাশেষে যদি না পাই মণিহার,
হবে না কোনও খেদ; আমি তো উৎসুক
বৃষ্টি, রামধনু, শিশির, নুড়িতেই;
অজানা পথে হেঁটে চলাতে পাই সুখ।
যখন মেঘ চিরে চাঁদের নাও ভাসে,
আমার দেহবীণা নতুন সুরে বাজে।
জাগলে মনে কারও প্রণয়-কথা কিছু,
সাজাই সত্তাকে অরূপ কত সাজে।