মানসিক খরা হেতু
একজন বহুক্ষণ বসে আছে চুপচাপ বড় একা, রয়েছে সম্মুখে
খোলা পাতা, শাদা পাতা ধু ধু চর, কোনও শব্দ কিংবা কাটাকুটি
সেখানে কিছুই নেই। তার মন এ মুহূর্তে বড়ই খারাপ;
সিগারেট খায় না সে, অন্য কোনও মাদক দ্রব্যের প্রতি টান
নেই তার, কালেভদ্রে একটি কি দু’টি পেগ হুইস্কি সেবন করে
বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে। এখন সুরায় গলা ভেজাবার ইচ্ছে নেই মোটে।
কেন সে এমন অবেলায় ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে
আছে একা? এখনও জ্বালেনি বাতি, যাবে না বাইরে কোনওখানে
সরস আড্ডার লোভে, অথবা বেইলি রোডে থিয়েটার দেখে
কিছুটা সময় কাটাবার সাধ নেই। কী এক নাছোড় কষ্ট
বেশ কিছুদিন থেকে কেবলি পোড়াচ্ছে তাকে-যেন সে চিতায়
শুয়ে আছে। কারও সঙ্গে বাক্যলাপ নেই, বই নিয়ে নাড়াচাড়া
করে শুধু, আধখানা পাতাও দেখে না চোখে। আসলে সে কিছুদিন ধরে
একটানা মানসিক খরা হেতু একটি প্রকৃত শোকগাথা, হায়, লিখতে পারেনি।
যান্ত্রিক মিছিলে
মনুষ্যত্ব নিয়ত নিহত হচ্ছে মানুষের হাতে
কী দিনে কী রাতে
খোলা পথে এবং আকাশ-ছোঁয়া ফ্ল্যাটে। ঘোড়ামুখো কিছু লোক
চৌরাস্তায় অস্ত্র নিয়ে হৈ হল্লায় মেতে উঠে শোক
ছড়ায় নিরীহ কত ঘরে
খেলাচ্ছলে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সর্বত্র রক্ত ঝরে
প্রায় অবিরাম; সব পাখি, প্রজাপতি,
ভ্রমর, মৌমাছি এ শহর ছেড়ে অতি
দুঃখে, হায়, নিয়েছে বিদায় শেষে। কেবল মানুষ
মনুষ্যত্ব হত্যা করে ঘন ঘন ওড়ায় ফানুস
খামখেয়ালের আর ভালোবাসা ধুলোয় লুটিয়ে,
খিস্তি খেউড়ের পুঁতিগন্ধময় ডোবায় ডুবিয়ে
নিজেদের আপাদমস্তক
অজ্ঞানের ঘন কুয়াশায় আঁকে সর্বনাশা ছক!
অনেকেই, মনে হয়, সদ্য কবরের কীটের উৎসব থেকে
বেরিয়ে এসেছে মুখ ঢেকে
কাদা, মাটি আর ঘাসে। ভয়ঙ্কর এইসব মুখ
বিভীষিকা ডেকে আনে; ভীষণ অসুখ
নিয়ে ওরা সত্তায় এবং চেতনায়
ভিষকের ভূমিকায় নিত্য অভিনয় করে যায়।
চতুর্দিকে মনুষ্যত্বহীন মানুষের
যান্ত্রিক মিছিল যাচ্ছে কোথায় জানে না কেউ কিছু।
শওকত ওসমান যখন হাসপাতালে
এ কেমন মেহমান আপনি আছেন শুয়ে এই
সুশীতল ঘরে বড় বেঘোরে সটান? আপনার
কপালে রেখেছি হাত, ছুঁয়ে দেখেছি কয়েকবার,
কিন্তু চোখ খোলেন নি একবারও; এমন নিঃসাড়,
অচঞ্চল আপনাকে কখনও দেখিনি। প্রগতির
মিছিল চলেছে পথে, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার
সভা রমনার বটমূলে, অথচ আপনি প্রায়
মমির ধরনে চিৎ হয়ে রয়েছেন পড়ে বেডে।
যে আপনি অজস্র কথার ফুলঝুরি ছড়াতেন
ক্ষণে ক্ষণে তিনি কেন এরকম নীরব, নিশ্চুপ
বস্তুত দিনের পর দিন, আজও ভোরের প্রতীক্ষায়
থাকি টেলিফোনে আপনার অন্তরঙ্গ কণ্ঠস্বরে
কান পেতে রাখবার জন্যে। দেশ-বিদেশের রাজনীতি,
হালে পড়া কোনও বই, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ আর
বাস্তবের কুশাঙ্কুর নিয়ে কত কথার বুনন
ছিল আপনার কণ্ঠস্বরে। এবার গা ঝাড়া দিন।
এখনও তো পিঞ্জরে রয়েছে পাখি, ঈষৎ স্পন্দিত,
জেগে আছি পুনরায় তার গান শোনার আশায়।
শব্দের প্রতিমা
শেষ পঙ্ক্তি লিখে ফেলে এক পাশে কলমটা রেখে
মুক্তির নিশ্বাস নেন তিনি। একটু পরেই তার
সদ্যলেখা কবিতার দিকে দৃষ্টি যায়। মনে হলো,
শুরুটা হয়নি ঠিক, ফলে বাতিল সম্পূর্ণ পঙ্ক্তি।
আবার পছন্দসই শব্দগুচ্ছ পেতে কেটে যায় বেশ কিছু
সময় এবং আরও দু’চারটি পরিবর্তনের
দুর্বার তাগিদ তাকে মৎস্য-শিকারির মতো টানা
প্রতীক্ষায় রাখে আর ধৈর্যের করাতে লগ্ন হয়ে
কত যে রক্তক্ষরণ হয় কে তার হিসাব রাখে?
তারপরও অতৃপ্তি কবিকে হিংস্র ঠোকরাতে থাকে।
জানলার কাছে এসে ক্লান্ত কবি ভাবে প্রতিটি
পঙ্ক্তিকে গাইতে হবে পাখির মতোন, তাহলেই
তৃপ্ত হবো আমি আর কবিতা নিশ্চিত খুঁজে পাবে
প্রকৃত রসিক। ‘এতকাল যা লিখেছি সবই আজ
কত তুচ্ছ পরিণামহীন মনে হয়’, বলে তিনি
পুনরায় লেখার টেবিলে যান, কলম চালান
সফেদ কাগজে; কিছুক্ষণ চলে কাটাকুটি, পরে
ঝর্ণাধারা হয়ে যায়, গড়ে ওঠে শব্দের প্রতিমা।
শুভ চেতনার সূর্যালোকে যাও
ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন সন্ধ্যা প্রভাতকে গ্রাস করতে উদ্যত,
তোমরা কি দেখছ না? দাঁতাল আঁধার মেতেছে পিশাচ-নৃত্যে, রক্ত-হোলি চলে
নিত্যদিন, অশুভের জয়োল্লাসে পাড়ায় পাড়ায়
ঘুম নেই কারও আজ। শুভবুদ্ধি চতুর্দিক থেকে
ভীষণ আক্রান্ত আর প্রতিক্রিয়ার হুঙ্কারে কাঁপে জনপদ।
তোমরা কি জান না এখন
তোমাদের চারপাশে শক্ররা জমায় ভিড় আর
চোখে ধুলো দিয়ে
নিয়ে যেতে চায় চোরাবালির দিকেই?
চেয়ে দেখ, হায়েনার দাঁত আর নেকড়ের থাবা
কেমন মোহন রূপে তোমাদের পথ
সহজে ভুলিয়ে নিয়ে অন্ধকূপে ঠেলে
দিচ্ছে আর তোমরা ভাবছ পৌঁছে যাবে
সব পেয়েছির দেশে। অথচ ভস্মের অন্ধ ঝড়
বইছে সেখানে আর অন্ধরাই চক্ষুষ্মানদের
পথ দেখাবার দায়িত্বের
তক্মা গলায় এঁটে পথ হাতড়ে বেড়ায় শুধু
ধূ ধূ প্রান্তরের
ঠিকানাবিহীন সব পুরনো খোঁদলে।
যদি চাও বাঁচুক দোয়েল
পাপিয়া, কোকিল আর চঞ্চল রঙিন প্রজাপতি,
যদি চাও সুবাতাস বয়ে যাক এখানে সর্বদা
মেধা ও মননে না লাগুক গ্রহণ কখনও,
তাহ’লে নিরেট অন্ধত্বের হাতছানি
হেলায় উপেক্ষা করে মুক্তবুদ্ধি আর শুভ চেতনার সূর্যালোক যাও।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবর পড়ে
আমরা বীরের জাতি বটে,
ওহো বীরের জাতি।
হরহামেশা লুটতরাজে,
খুনের নেশায় ভীষণ মাতি।
আমরা বীরের জাতি বটে,
ওহো বীরের জাতি।
যখন তখন দিন দুপুরে, সন্ধ্যারাতে
টাকা কড়ি ছিনিয়ে নিতে
চাক্কু চালাই, গুলি ছুঁড়ি,
নিভাই হেসে খেলে কত
লোকের প্রাণের বাতি।
আমরা বীরের জাতি।
শ্বশুর আমি, আমার দু’টি
ইয়া জোয়ান ছেলে আছে।
বড় ছেলের ঘরের বউ
আনে নি ছাই কোনো যৌতুক,
বউয়ের বাপের এটা কৌতুক।
আমরা জানি মজার খেলা,
একদিন তাই বিকেল বেলা
আমি আর দুই জোয়ান ছেলে
পিটিয়ে মারি বউটাকে।
ধেই ধেই নাচ,
লাঠির ঘায়ে যায় ফেটে যায় বউয়ের ছাতি।
আমরা বীরের জাতি বটে,
ওহো বীরের জাতি!