- বইয়ের নামঃ টুকরা কিছু সংলাপের সাঁকো
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অখ্যাত কবরে
এই যে এখানে এসে থমকে দাঁড়াই আজ, কেন?
কী আছে এখানে
এমন নিস্তব্ধ স্থানে? আমার পায়ের নিচে কিছু
মরা পাতাদের খস খস
এবং ঝিঁঝির ডাক ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই,
কয়েকটি কংকাল প্রতিম
গাছ আর ঝোপঝাড় আছে,
অন্য কিছু নেই, মাঝে মাঝে কয়েকটি
জোনাকি ফোটায় আলো, ফের
নিভে যায়; ঘুরে ফিরে এই জ্বলা নেভা।
এখানে দাঁড়াতে হবে বেশ কিছুক্ষণ,
মনে হয়; মাথার উপর কালপুরুষ দাঁড়ানো
অসীম নীরব অহঙ্কারে। তার কাছে বর্তমান
ভূত, ভবিষ্যত-সব কিছু অর্থহীন। অনন্তের
কী-যে মানে তা’ নিয়ে ভাবনা তার নেই কোনও; আমি
এখানে নিঃসঙ্গ, অসহায়
নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছি
আমার আপনকার কবিতার অখ্যাত কবরে
অনন্তের গোধূলি রঙিন পথে
চৈত্রসংক্রান্তির রাতে ডাগর চাঁদের ছলছলে চোখে
তাকিয়ে নদের চাঁদ মহুয়ার কথা ভাবে। তাকে কি কখনও
ফিরে পাবে আর? দূরে কালো গাছ গৌতম বুদ্ধের
ধরনে গভীর ধ্যানী। সে-ও কি হারিয়ে-যাওয়া কোনও
বৃক্ষললনার ভাবনায় মগ্ন? কাল
পুরনোর জাল ছিঁড়ে নতুন তুলবে তার অনাবিল মুখ,
যেন সূর্যোদয়; লতাপাতা, ঘাস, পাখি, পুরনো হ্রদের জল,
ফুলদল, সর্বোপরি মানবেরা স্বাগত জানাবে
তাকে কাল। মৃৎশিল্পী রঙিন পুতুল,
গরু, হাতি, ঘোড়া, হাঁড়ি, গাড়ি, নৌকা বানিয়ে সাজাবে
যখন মাটির ঘরে, মেলার বাজনা বেজে উঠবে
যথারীতি; মেলায় পাবে কি দেখা নন্দিত মুহূর্তে মহুয়ার?
নীলাভ জীনস্-পরা যুবা ধোঁয়া ছাড়ে, সিগারেট
পোড়ে ঘনঘন, চোখ নাচে
বিজ্ঞাপনে, কণ্ঠে বাজে র্যাঁপ-সুর; খোঁজে
সোনিয়াকে নিদিষ্ট পথের মোড়ে, সোনিয়া ডার্লিং
তার, দেখা হচ্ছে না ক’দিন। সেই হেতু
মন কি খারাপ খুব? না, মোটেও মনে
জমে না বিষণ্ন মেঘ। সোনিয়াই একমাত্র মেয়ে নয়
জগৎসংসারে;
জোরে শিস দিলে কিংবা মদির তাকালে কিছুক্ষণ,
জুটে যাবে কেউ কেউ সালোয়ার কামিজ অথবা
সিল্কের শাড়িতে ঢেউ তুলে।
সেই যুবা দ্যাখে শানবাঁধানো সড়কে আনাড়ির
মতো হাঁটে সরল নদের চাঁদ, যেন সে হোঁচট খেতে খেতে
গড়াবে রাস্তায় মুখে বিস্তর গাঁজলা তুলে, দু’চোখে দেখবে
তারাদের ফুলঝুরি দিনদুপুরেই।
উৎসবের রঙে মেতে-ওঠা শহরের ঝকমকে
প্রোফাইল দেখে, সেই যুবা ভাবে, এই যে নদের চাঁদ
নামের লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেঁয়ো মহুয়ার
তালাশে ঠোকর খাচ্ছে ক্রমাগত, ওর দিকে টাকাকড়ি ছুঁড়ে
দেখেছি সে হেলায় কিছু না নিয়ে দূরে
সরে গ্যাছে। কেমন আশ্চর্য চোখ তার,
যেখানে হরিণ, সরোবর, কবুতর, উপবন এবং ডাগর চাঁদ
ভেসে ওঠে বারবার। ভিখারি সে নয় কোনওমতে,
বরং প্রেমের অনশ্বর যুবরাজ,-
এই সত্য নীলাভ জীনস্-পরা যুবা ঠিক বুঝতে পারেনি।
দুই,
একটি নাছোড় গিরগিটি
আমার স্মৃতিকে চেটে খাচ্ছে অবিরত
একটু একটু করে। তাই ভুলে যেতে থাকি চৈত্রসংক্রান্তির
সেই ঘুড়ি-ওড়ানো বিকেল, মেঘে মেঘে রঙবেরঙের
নানা ছবি দেখা ছাদে বসে। কীরকম ছিল সেই সব ছবি?
কার হাত সিঁড়ির আঁধারে জ্বলে উঠেছিল চাঁদিনীর মতো,
আজ আর মনেই পড়ে না। সেই হাত
আমার ক্ষণিক স্পর্শে কেঁপেছিল কি না, কিংবা
আদৌ তাকে ছুঁয়েছিলাম কি-এর সদত্তর জানে
স্মরণ হরণকারী গিরগিটি। মনে হয়, বহু বঙ্গাব্দের
ছায়ারা সস্নেহে তাকে আড়ালে রেখেছে, শুধু তার
কিছু উজ্জ্বলতা ঝিকমিক করে জোনাকির মতো
চোখে নববর্ষের ঝলক, আগামীর মৃগতৃষা
নিয়ে আছি আজও, দেখি মুণ্ডহীন ধড়গুলো নাচে
বৈশাখের গন্ধে বর্ণে, তাদের ফ্যাকাসে আঙুলের
ডগায় কাঁপছে ভবিষ্যের জন্যে কাতরতা আর
আমার টেবিলে রাখা পানপাত্র, কিন্তু ওরা চক্ষুহারা ব’লে
বাড়াতে পারে না হাত অনন্তর খর ধুলিঝড়ে
মিশে যায়। কারা ওরা, ভেবে সারা হাই; অকস্মাৎ দেখা পাই
নদের চাঁদের, মহুয়াকে পায়নি সে খুঁজে বলে
চৈত্রসংক্রান্তির রাতে-দেখা ডাগর চাঁদের স্মৃতি
পীড়ন করছে তাকে অতিশয়। নদের চাঁদের মুখচ্ছদে
নিজের মুখে কিছু ধূসর আদল দেখে চমকিতে হই
এবং বৈশাখী হাওয়া গীতবিতানের পাতাগুলো
সাদরে ওল্টাতে থাকে, দেবব্রত বিশ্বাসের গানে
শূন্য ঘর পূর্ণ হয়, গাছে গাছে লাগে দোলা, নীলিমাকে ছোঁয়
সুরধারা; অনন্তের গোধূলিরঙিন পথে এক
ডাক-হরকরা সুরে সুর মেলাতে মেলাতে যায়,
পায়ে পায়ে তার রেণু ওড়ে, সম্মুখে লুটিয়ে পড়ে
অগণিত প্রজাপতি, বিরল কুসুম, পক্ষিকুল। যতদূর
জানি, ডাক-হরকরা অবরে-সবরে আসে, কাধে ব্যাগ নেই,
বহন করে না ডাক কোনওদিন, হাতে তার স্পন্দমান অলীক দোতারা!
অন্তরালে
ইমরুল কায়েসের উট মরুভূমি পাড়ি দিয়ে
বেলাশেষে মরুদ্যানে পৌঁছে যায়। কবি পানপাত্র
হাতে নিয়ে মুগ্ধাবেশে ক’ছত্র কবিতা
আবৃত্তি করেন আর রমণীর নেকাব সরিয়ে
রূপের গহনে ডুবে যান। রাত্রিশেষে সদ্যলেখা
কবিতার গুঞ্জরণ জাগে তার মনে। অন্তর্জ্বালা
তার আড়ালেই থাকে, কখনও কখনও
অগ্নিকণা হয়ে জ্বলে কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে।
ভাস্কর রোদ্যাঁর হাত নিথর পাথরে নানা ছাঁদে
প্রাণের স্পন্দন আনে। অনন্য সৃজনে
পাথর ভাবুক হয়, ব্রোঞ্জ হয়ে যায়
দুঃখী মানুষের মুখ অন্তরে নাছোড় যন্ত্রণা সর্বক্ষণ
তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে; মুক্তি
খোঁজেন ভাস্কর রোদ্যাঁ প্রেমে, কাজে, নিরন্তর কাজে।
হায়, ভ্যানগগের কানের রক্তভেজা ব্যান্ডেজ করুণ ঝুলে
আছে শিকে; শিল্পী ফসলের ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছেন,
এক ঝাঁক কাক ওড়ে হলুদ শস্যকে কালো করে।
দুপুরে চড়া রোদে কী এক বেয়াড়া ঘোরে তুলি
প্রবল চলতে থাকে ক্যানভাসে। কী এক যন্ত্রণা
শিল্পীকে উন্নত্ততার সীমানায় নিয়ে যায় আর
কাটাছেঁড়া কানে তার জপায় কুহকী মন্ত্র আত্মহননের।
যন্ত্রণা শিল্পের সঙ্গে নিত্যদিন করে বাসবাস;
কখনও সে ফুঁসে ওঠে কখনও-বা অন্তরালে করে অশ্রুপাত।