Site icon BnBoi.Com

ঝর্ণা আমার আঙুলে – শামসুর রাহমান

ঝর্ণা আমার আঙুলে - শামসুর রাহমান

অধিক একাকী

ঝর ঝর ঝর
এক নাগাড়ে একটানা বর্ষণের পর
সৌভাগ্যবশত কচি রোদ্দুর ছড়ানো ভোরবেলা
কোত্থেকে এসেছে এই পাখি,
নিজেকেই প্রশ্ন করি। ফ্ল্যাটের বারান্দাটায় তাকে
কীভাবে আটকে রাখি ভাবি।
একা-একা পাখিটা দিয়েছে জুড়ে খেলা;
কিছুই না ক’রে কিছুক্ষণ খুব চুপচাপ থাকি।

আমাতে কী যেন ছেয়ে থাকে
পাথরের চতুর্দিকে-ঘেরা গুঢ় রহস্যের মতো। পাখিটাকে কী যে দাবি
আমার নিকট, বোঝা দায়।
ছড়িয়ে নিজস্ব রঙ খেলা করে, নেই কোনো গান
আপাতত কণ্ঠে তার। খানিক খাবার পেতে চায়,
হতে পারে, কিংবা চায় ঈষৎ তৃষ্ণার অবসান।

পারবো কি ধরতে ওকে? যাবে না খাঁচায় তাকে পোরা
কোনোদিন থাক যতক্ষণ
ইচ্ছে ওর এই বারান্দায় থাক বন্ধ ক’রে ওড়া।
মন, ওরে, মন
যদি আমি গম কিংবা ছোলার সন্ধানে গিয়ে ফিরে
আসি, হয়তো দেখবো সে উড়ে
চ’লে গেছে দূরে, অন্ধকারময় দূরে।
নড়ি না চেয়ার থেকে; অকস্মাৎ সেই পাখি
স্তব্ধতার অন্তর্বাস ছিঁড়ে
শিস দিয়ে অন্তর্হিত; ঘরে ব’সে হয়ে যাই অধিক একাকী।।

আমার আয়েশা ফুফু

হঠাৎ কোনো কোনোদিন দুপুরবেলা
কিংবা সুপুরিগাছে ক্রীড়াপরায়ণ রোদের
বিকেলে আমার আয়েশা ফুফুর কথা
মনে পড়ে। কপাল ভেঙে ছিলো তাঁর
যৌবনের উষায়, তারপর আর কস্মিনকালেও
হাতে মেহেদির ছোপ লাগে নি।

থাকতেন তিনি পল্লীর প্রান্ত-সীমায়
বড় একলা ঘরে। কখনো কখনো
তাঁকে দেখা যেতে কুয়োতলায়, কখনো-বা
বাঁশঝাড়ে দাঁড়িয়ে ঘোমটার
অন্তরাল থেকে কি-যেন দেখতেন, দূর আসমানেও
খেতের আলের মতো কিছু আছে কিনা
ভাবতে চাইতেন আমার আয়েশা ফুফু।

এতকাল পরে আজও যখন দেশবাড়িতে যাই, আয়েশা ফুফুর
বাড়ির সামনে দাঁড়াই ভেতরে ডাকে,
ভাবি তিনি, আমার আয়েশা ফুফু,
এক্ষুণি বেরিয়ে আসবেন শাদা গোলাপ-শাড়িটার
আঁচল সামলাতে সামলাতে, চকিতে নাকে
এসে লাগে কবেকার সেমাইয়ের ঘ্রাণ।

এমন খাঁ খাঁ কোনো জায়গা আছে কি কোথাও? এই প্রশ্ন
আমাকে অসীম শূন্যময় সেখান থেকে
দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়,
কোথাও আমি আমার আয়েশা ফুফুকে দেখি না।
মেঘে মেঘে অনেক বেলা হলো। এখনও যখন
গোধূলিতে হঠাৎ আকাশের মুখ কালো হয়ে যায়
মেঘের জটলায়, বৃষ্টি নামে শহর ডুবিয়ে,
অথবা রাতে ঝিল্লীর স্বরে
কিছুতেই ঘুম আসে না, তাকাই শূন্য সুরাইয়ের দিকে,
যখন কান্নায়
ভেঙে পড়ে কোনো পাখি, তখন
আমার আয়েশা ফুফুর বনশিউলি আর
জলবিছুটির গন্ধকোমল মুখ মনে পড়ে।।

আমার পিতার গ্রামে

(একটি প্রাচীন উপকথা মনে রেখে)

আমার পিতার গ্রামে কোনো পাখি শিকারের লোভে
কখনো যাই নি;
যদিও পিতার ছিলো সাওতালি রমনীর গায়ের রঙের
মতো চকচকে এক দোনলা বন্ধুক, তবু আমি
ওর প্রতি কোনোদিন আকর্ষণ বোধ
করেছি, এ-কথা বলা যাবে না; অবিশ্যি মাঝে মাঝে
যখন বন্দুকটিকে পিতা করতেন পরিষ্কার,
সে-দৃশ্য দেখেছি দূর থেকে, মনে পড়ে।

তবু কেন কখনো-সখনো মনে হয় হাতে নিয়ে
পুরানো বন্দুক ঘুরে বেড়াই একাকী
আমার পিতার গ্রামে বিলের কিনারে
বেলা অবেলায়, কেন? পানকৌড়ি, জলপিপি আর
মাছরাঙা চোখে পড়ে, বেলেহাঁস নেমে
আসে পাকা ধানের সুগন্ধে। কিন্তু আমি ভারি না কার্তুজ
বন্দুকে কস্মিনকালে, শুধু পাখিদের দেখে দেখে
কাটে বেলা, সূর্যের উনুন
ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে এলে শুই ঘাসে আর পাশে
ঘুমায় বন্দুক নিরিবিলি।

আমাকে দখল করে আচ্ছন্নতা, অকস্মাৎ চোখ
মেলে দেখি বন্দুক ধনুক হয়ে শুয়ে আছে, আমার শরীরে
যুগল কম্বল;

একজন রাজহংসী তার পালকসমেত
গায়ের চামড়াটাকে তারে গোপনে গচ্ছিত রেখে
রমনীর রূপে কাটে সাঁতার বিলের কালো জলে,
তার শরীরের আলোড়নে পানি আনন্দকণার মতো ঝরে
সন্ধেবেলা। আমি তার গায়ের চামড়াটাকে অতি সন্তর্পণে
কোথাও লুকিয়ে রাখি। রূপসী সে নারী
তীরে এসে পালকসমেত ওর গায়ের চামড়া খোঁজে এদিক ওদিক।

বিবাহ বাসরে যাবে এই প্রতিশ্রুতি সঠিক আদায় ক’রে
ফিরিয়ে দিলাম তার পালক-সম্পদ। চুপিসাড়ে
সে আমার পেছনে পেছনে আসে, আমি
তাকে নিয়ে যাই
মাথায় পালক-গোঁজা আমার পিতার সামনে, তাঁর চোখে
অনু মোদনের তারা নেচে ওঠে। আমাদের বিয়ে উপলক্ষে
পিতা দেন জেয়াফত, লোক আসে দলে দলে। ঘর
করি বহুদূর-থেকে-আসা
অলৌকিক রূপসীর সঙ্গে। একদিন
হঠাৎ দুর্ভিক্ষ নামে শত ডাকিনীর খটখটে হাসি আর
ঝাঁক-ঝাঁক শকুনের ছায়ার ধরনে
আমার পিতার গ্রামে। আমার সুন্দরী অপয়ার অপবাদ
নিয়ে অপমানে, ক্ষোভে প্রতিবাদহীন
একদিন গোধূলিবেলায়
পুনরায় রাজহংসী হয়ে উড়ে যায় লাল মেঘে।

তার অন্তর্ধানে
আমার হৃদয় হয় বিধুর বিলাপ;
আমি সেই রাজহংসীটির খোঁজে ঘুরি সারাক্ষণ
বিলের কিনারে বন বাদাড়ে, পাহাড়ে;
লোকালয় ছেড়ে দূরে বহুদূরে চ’লে যাই। কেমন অদ্ভুত
প্রাণীদের সাহায্য করার বিনিময়ে
কেবলি প্রার্থনা করি আমার হারিয়ে-যাওয়া সেই
রাজহংসীটির ঠিকানার খোঁজ। একে একে ওরা
সবাই আমাকে বলে দেয় কোন্‌ পথে গেলে
পাবো তাকে ফের। ইঁদুরের চামড়ার ভেতরে ঢুকে
খুঁজি তাকে অবিরাম প্রান্তরে, পাহাড়ে;
বুড়ো ঈগলের পরামর্শ ছাড়া খোঁজ পাওয়া ছিলো না সম্ভব।

আখেরে পেলাম তাকে সুদূর আশ্চর্য দেশে ওর
গোত্রের ভেতরে
এবং আমাকে দেখে সমগ্র সত্তায় তার স্মৃতি
স্ফুরিত পালক হয়ে দ্রুত জেগে ওঠে;
আমার পিতার গ্রাম, জলাশয়, লতাগুল্ম, গুগলি শালুক
এবং আমার প্রেম উদ্ভাসিত তার চিদাকাশে।

গোত্রপতি হংসরাজ, ওর পিতা, আমাকে নিলেন
সাদরে বরণ ক’রে, নির্ধারিত হলো ঘর
আমাদের দু’জনার। দিন যায়, রাত কাটে, এবং ক্রমশ
বছর গড়িয়ে যায় ঝর্নার নুড়ির
মতো; অলৌকিক এলাকায় ক্লান্ত হয়ে অবশেষে বিদায়ের
প্রার্থনা জানাই। গোত্রপতি
আমাকে ডানার অন্তরালে বয়ে নিয়ে
যাবার উদ্দেশ্যে হল্‌দে অপরাহ্নে এক বায়সকে
দিলেন নির্দেশ।
দাঁড়কাক আমাকে নির্বিঘে। বয়ে নিয়ে দিলো ছুঁড়ে
শূন্য চরে আর আমি বেলাশেষে চখা হয়ে উড়ি,
ঘুরি চক্রাকারে আর আমার চিৎকার ক্রমাগত
ছিঁড়ে যায় স্তব্ধতার বেবাক বাকল।
উড়ে উড়ে চখা ঢোকে আমার ভেতরে সাবলীল;
স্মৃতির দেয়ালি জ্বলে এবং আমাকে
ঘিরে থাকে কবেকার হাহাকার। দূর থেকে দেখি
আমার পিতার গ্রাম অতিশয় প্রবীণ আঁধারে,
অনন্তের উৎস থেকে উঠে-আসা প্রবল হাওয়ার
কম্পমান নিভু-নিভু দীপ।।

এ কোথায় এসে

এ কোথায় এসে মুখ থুবড়ে পড়েছি, এ কেমন
আতঙ্ককুন্ডের মাঝেখানে?
শুনেছি যে-শহরে একটি খুনী করে বসবাস,
সেখানে তিনটি গাছ ছদ্মবেশী আততায়ী হয়ে
কী শান্ত দাঁড়িয়ে থাকে বুঝি
তাই এ-শহরে ইদানীং
পথশ্রান্ত মানুষের জন্যে ছায়াময়
বৃক্ষতলও নয় আর নিরাপদভূমি। এ-শহরে
প্রতিটি ফুলের মুখ থেকে
লাল ঝরে অবিরল কাঁচা মাংসের লালচে আর
আজরাইলের
তুহিন নিশ্বাস হয়ে হাওয়া ঘোরে আনাচে-কানাচে।

কারুকেই আমি আজ শোকগাথা শোনাতে আসি নি,
বলতে এসেছি শুধু শোনো
আমার নগর-সংকীর্তন; দ্যাখো, দ্যাখো
ভিখারীর দলে এসে কীরকম ভিখারী হয়েছি। ফুটপাতে
ব’সে আমি ক্লান্তিতে ঝিমাই, ক্ষত থেকে তাড়াই সুনীল মাছি,
চা খাই বিবর্ণ মগে মাঝেসাঝে, দেখি
ঝলমলে মানুষের হাটে
কুমারী প্রসব করে শিশু
রক্তরাঙা, দিনের ধুলায়। কোজাগরী পূর্ণিমায়
খুচরো পয়সা গুনে ট্যাঁকে
গুঁজে রাখি, রাত্রিবেলা চট পেতে শুই। চোখ মারে
নীলিমার তারা;
আমার স্বপ্নের ভেতরেও
ধেয়ে আসে উল্লসিত অজস্র উকুন। মাঝে-মাঝে
ঘুম ভেঙে গেলে টের পাই-কী প্রবল গান গায় অন্ধকারে
শিরায় শিরায় গুহামানবের উত্তরাধিকার।

অবৈধ সন্তান যারা, রোদপোড়া, বৃষ্টিভেজা, তারা জড়ো হয়
রাস্তায় রাস্তায়,

মাথা তোলে ক্রমে, থুতু ছিটোয় দেয়ালে,
সভ্যতার করে বাস খুনখারাবির
বর্ধমান ছায়ায়, কলার চেপে ধরে সমাজের
কখনো কখনো, ফের অস্তিত্বে সফেন নেশা নিয়ে
প’ড়ে থাকে অচেতন। আগুন রঙের ঘোড়া ওদের গ্রীবায়
খানিক নিশ্বাস ফেলে চ’লে যায় দূরে
স্বপ্নভেজা মাঠে খুব দবিজ ঘাসের খোঁজে শিল্পিত আঙ্গিকে।
কখনো এমনও ভাবি এ-শহর থেকে
পালিয়ে কোথাও
নদীতীরে জেলেপাড়া কিংবা দূর তাঁতীর পল্লীতে
খুঁজে নিই নিরালা আশ্রয়; কিন্তু হায়,
নিরাশ্রয় পায়ে পায়ে ঘোরে
আমার সর্বদা; তাই শহরেই এক কোণে মাথা গুঁজে থাকি,
স্বপ্ন দেখি, মধ্যরাতে বহুদূর থেকে
নদী এসে আবর্জনাস্তুপ
ত্বরিৎ সরিয়ে
পবিত্র ধুইয়ে দেবে শহরের মুখ।।

এ দূয়ের মধ্যে

অনলে যায় নি পুড়ে ঘর, তবু কেন অনিকেত মনে হয়
নিজেকে সর্বদা? কিছু রঙ
দৃশ্যমান হ’য়ে ফের কোথায় মিলিয়ে যায়, শুধু
স্মৃতি অন্তঃস্রোত চিরদিন। চাই কি না চাই, স্মৃতি
আমাকে দত্তক নিয়ে খেলা করে নিমগাছ অথবা ডুমুর
গাছের তলায়, কখনো-বা হাত ধ’রে
নিয়ে যায় পুরানো সে দিঘির কিনারে
শালুক কুড়াতে কিংবা পোড়ো-বাড়িটার রূপ গোপনে দেখাতে।

কোনো কোনোদিন অকস্মাৎ
জন্ম-জন্মান্তার পাড়ি-দেয়া আশ্চর্য চোখের
পাখি
নেমে আসে আমার প্রাঙ্গণে, জবাফুলে
ঢেলে দ্যায় কত আকাশের নীল, প্রান্তরের ধু ধু;
আশীর্বাদে তার লহমায়
কেমন রঞ্জিত চতুর্দিক, গৃহহীনতার শূন্যতার গুঢ়
কী এক কাঠোমো
স্তরে স্তরে নির্মাণের সখ্য লাভ করে। পাশে থাকে
উজ্জ্বল মগ্নতা;
ছবি ভেঙে ছবি হয়। কোনো ধ্বনি দুপুরকে, কোনো
ঘ্রাণ মধ্যরাত্রির গহন স্তব্ধতাকে
ডেকে আনে; হৃদয়ের ভেতরে নিঝুম শ্রাবণের কোলাহল
কতবার ফিরোজা রঙের এক ঘরের ভেতরে, মনে হয়
দেখেছি তোমাকে;
তখনও ছাড়ো নি ফ্রক। যখন পুতুল
বর-কনে হয়ে যেতো খেলা-খেলা ঘটকালি শেষে, অকস্মাৎ
আবীরে বাসর-ঘর রাঙা
প্রবালপুরীর প্রতিচ্ছবি। সানাই উঠতো বেজে
গোলাপি, বেগনি বৃত্ততৈরি ক’রে ছেলেবেলাকার। দেখতাম,
সরৎকালীন জ্যোৎস্না তুমি ঘরের মুঠোয়।

তোমার প্রথম শাড়ি শরীরে জড়িয়ে তুমি যেদিন চকিতে
আমার স্বমুখে তন্বী গাছের ধরনে
সলাজ দাঁড়ালে এসে, দেখলাম নীলাম্বরী-পরা
আনন্দের অজস্র কনকচাঁপা সাজিয়ে ছিলাম? অভ্যর্থনা
প্রত্যাশী সহজ কুঁড়ি যদি অন্তরালে
ফুল হয়ে ওঠে,
কে পারে নিঃসাড় থেকে যেতে? ভালো ক’রে
দেখার আশায় আমি চক্ষু যুগলকে
তাড়াতাড়ি আরেক ফুলের
বিকাশ দিলাম। তবু বিষাদ আমাকে তার পাশে
বসিয়ে একাকী কারো অন্তর্ধানের কাহিনী খুব
নিবিষ্ট শুনিয়ে
ঝরাপাতাদের কাছে নিয়ে গিয়েছিঁলো।
প্রত্যহ আমাকে ভাগাভাগি ক’রে নেয়
বাস্তব এবং পরাবাস্তব-এই যে কিছু চ’লে-যাওয়া আর
কিছু চলে-আসা,
এ দুয়ের মধ্যে আমি অনিকেত কেমন ধূসর ব’সে থাকি।।

একজন মৃতের একটি বই

একজন মৃতের একটি বই পড়ছি ক’দিন
ধ’রে আমি অত্যন্ত নিবিষ্ট মনে। প্রতিটি অক্ষর
বড় তীক্ষ্ম চোখ হয়ে তাকায় আমার দিকে, টানে
কাছে, যেন মায়াবী অরন্যে নিয়ে যাবে ইসারায়।

এ-বই আমার চোখে পড়েছিলো মৃত তরুণের
পড়ার টেবিলে গোধূলিতে। আমি ওর অনুজের
কাছ থেকে, মনে পড়ে, কিছুকাল পরে দ্বিপ্রহরে
ধার নিয়েছিলাম বইটি প্রায় অপরাধী সেজে।

যখন বইটি পড়ি মধ্যরাতে খুব নিরিবিলি,
কে যেন পেছনে এসে নিঃশব্দে দাঁড়ায়। ঠিক ভয়
নয়, তবে কেমন শিরশিরে অনুভূতি অন্ধ কুপ
থেকে উঠে আমাকে জড়ায় সরীসৃপের ধরনে।

মৃত সে তরুণ বইটি কি আদ্যোপান্ত পড়েছিলো
ছুটির দুপুরে কিংবা রাত জেগে? নাকি কিছু প’ড়ে
রেখেছিলো ফেলে কোনোদিন শেষ করার আশায়?
আমি তার মুখের আদল খুঁজি শ্রাবণ হাওয়ায়।

রাত্তিরে বৃষ্টির ছাঁটে ঘুম ভেঙে। আমার চেয়ারে,
মনে হয়, কে যেন পড়ছে ব’সে গোপনে সে-বই।
ওর দিকে এগোতেই শূন্যতা, কেবল সে পুরানো
পেপার-ব্যাকের পাতা জুড়ে তার আঙুলের দাগ।

প্রত্যহ অফিসে যাই, কখনো কখনো মফঃস্বলে,
কবিদের মৌচাকের মতো আসর কখনো টেনে
নিয়ে যায়; যেখানেই যাই, পাতা ওড়ে, সে বইয়ের
রহস্যের তন্তুময় পাতা ওড়ে মনের ভেতরে।
বইটি আমার পড়া হয়ে গেছে কবে; ভাবি, মৃত
তরুণের অনুজকে ডেকে এখুনি ফেরত দিই,
অথচ হয় না দেয়া। ছলছলে চোখের মতন
একটি পেপার-ব্যাক জেগে থাকে আমার টেবিলে।।

একজন রোগী

তাকে ওরা হাসপাতালের একটা বীজাণুধ্বংসী গন্ধময়
ঝকঝকে তকতকে কেবিনে এনে
শুইয়ে দিলো। ওর হৃৎপিন্ডের ক্রিয়া বেশ ভালো,
প্লীহা কিংবা যকৃতেও কোনো গোলমাল নেই,
অন্ত্রে ক্ষত কামড় বসায় নি, রক্তচাপ স্বাভাবিক।
মোটকথা, ওর শরীর
ষোলআনা নীরোগ। তবু সে এখন হাসপাতালের বেডে।

সে যে-রাষ্ট্রের বাসিন্দা, সেখান কারো
কোনো নাম নেই; প্রত্যেককে শনাক্ত করা হয়
ভিন্ন-ভিন্ন নস্বরে।
সেখানকার বিজ্ঞানীরা আবেগ-বিতাড়নী বীটকা আবিষ্কার
ক’রে বাজ্যের অবাল-বৃদ্ধ-বনিতার
অস্থিমজ্জা থেকে আবেগ নিংড়ে নিয়েছেন, যেরকম হয়
আখ-মাড়াইয়ের কলে। আকাশে চাঁদ উঠতে
কিংবা তারা ফুটতে দেখলে কারো মনে
ঢেউ জাগে না, ঝুঁকে-থাকা ডালে গোলাপে দেখে
কেউ আর বলে না ‘সুন্দর,। কোনো সুন্দরীর মুখোমুখি
হলে কারো মনে তারার মতো
কেঁপে ওঠে না কবিতার পংক্তিমালা। বারংবার
সুপ্রযুক্ত ইনজেকশনে
মানুষী দুর্বলতাগুলো একে-একে উপড়ে ফেলা হয়েছে।

৩৩৩৩৩৩৩, রাজ্যের
কর্ণধারদের ধন্দে ফেলে দিয়েছে। ওকে প্রচুর অব্যর্থ
আবেগ-বিতাড়নী বটিকা
সেবন করানো হয়েছে, বারবার ইনজেকশন
ঠেলে দেয়া হয়েছে
ওর শিরায়-শিরায়। তবুও সারিয়ে তোলা যায় নি
তার সুন্দরকে সুন্দর বলবার ব্যামো।
হাসপাতালে দু’দিন কাটাতে-না কাটাইতেই
একজন নার্স কর্তৃপক্ষের কাছে ওর বিরুদ্ধে
রুজু করলো নালিশ। সোবকাকে
ওর মনে ধরেছে, এ-ধরনের কথা নাকি রোগী বলেছে
কণ্ঠস্বরে হ্রদের ছলছলানি এনে। ফলে,
সেই নার্সকে বদলি করা হলো ওর কেবিন থেকে
আর ঘন ঘন ইনজেকশন
ঠেলে দেয়া হলো৩৩৩৩৩৩৩-এর শরীরের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে।

একরাতে রাজ্যের তিন কর্ণধার ওকে দেখতে এলেন
হাসপাতালে। শুয়ে ছিলো সে।
ধবধবে বালিশে মাথা রেখে। ‘কেমন আছেন’ প্রশ্ন করলেন
ভাবলেশহীন একজন। ‘ভালো আছি, বেশ ভালো …
এই বালিশটাকে মনে হচ্ছে একটা রাজহাঁস
যে আটকা পড়েছে
তুষার-ঢাকা হ্রদে’- ব’লে সে বাইরে দৃষ্টি মেলে দিলো
যেখানে থইথই করছে জ্যোৎস্না
রাজ্যের কর্ণধারগণ তাকালেন
পরস্পর, তারপর পরবর্তী কর্মপহ্নার কথা তুখোড়
চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ করতে করতে
করিডোর দিয়ে হেঁটে গেলেন তিনটি রোবটের ধরনে।

এখন কেবল

কত কিছুই তো আজকাল
আমার হয় না করা। প্রকাশ্য রাস্তায় ফল খেতে
নিদ্বির্ধায় পারি না এখন। কান লাল
হয়ে যাবে, যদি পথে যেতে
কেউ শুনে ফ্যালে আমি বাজিয়েছি সিটি
খুব জোরে। কৈশোরে আমার রাত্রিবেলা
বাঁশি বাজাবার ছিলো শখ। আজ দেখি, মিটিমিটি
দৃষ্টি নিয়ে বাঁশি প’ড়ে থাকে
ধুলিময় এক কোণে, চুকে-বুকে গেছে কত খেলা-
আড্ডার দুর্বার লোভে বন্ধুদের সঙ্গে আর বসি না রোয়াকে।
দৌড়ে গিয়ে চল্‌তি বাসে উঠতে পারার বাহাদুরি
দেখাতে পারি না আদৌ; সে-কৌশল বয়স নিয়েছে ক’রে চুরি।

এখনও কেবল
সতেজ আঠারো বছরের কোনো যুরকের মতো
ক্রমাগত
শুন্যে ছুঁড়ে দিতে পারি অলৌকিক বল।

এখন কোথায় আমি

এখন কোথায় আমি এই ভরা ভাদ্রে? দোতলার
জানলার কাছে
দাঁড়িয়ে রাত্তিরে বিস্ফারিত চোখে দেখি
শহুরে বানের পানি। শিরায় শিরায়
জ্বর কীর্তনের সুর, ক্রমাগত কাশির দমকে
বস্তুত জীবন ক্ষয়ে যায়। রোমান্টিক কাব্যে স্নাত
মধ্যবিত্ত মন খোঁজে চাঁদ,
খোঁজে তোমাকেই বারবার। কিয়দ্দুর থেকে চিম্‌রে কুকুরের
কান্না ভেসে আসে, লোকে বলে অলক্ষুনে, আর মেঘের নেকাব
ছিঁড়ে হাঁসফাঁস করে জলবন্দী চাঁদ।

গ্রাম গ্রামান্তরে সারি সারি ঘরবাড়ি, গাছপালা
এখন পানির নিচে, পানির কবরে
শস্যের ঘুমায়
ভাবলেশহীন; দিকে দিকে রাত্রিদিন
ভাসে কত গ্রাম্য বধু, তরুণী পোয়াতি, ক্ষেত মজুর, কুমোর
আর চালচুলোহীন বিষণ্ন বয়াতী।
আদম সন্তান, হাঁস মুর্গী, গরু ছাগল মহিষ
কারো কোনো নিরাপত্তা নেই, বিধাতার কেমন খেয়াল,
এখন যায় না শোনা এমন কি শেয়ালের ডাক।
আজরাইলের কালো ডানা
ছায়া ফেলে যত্রতত্র, ইতস্তত মড়কের লীল।

কী ভীষণ আক্রোশে ফুঁসছে নদী নালা, গলাডোবা
জল থেকে দ্যাখে দুর্গতরা
ঘুর্ণ্যমান হেলিকপ্টার শান, যেন অতিকায়
স্বর্গীয় পাখির আবির্ভাব। এক হাতা
খিচুড়ি অথবা
একটি রুটির জন্যে পষুর্দস্ত নারী পুরুষেরা
কোলাহল করে, প্রায় উন্মাদিনী জননী কোথাও
সিক্ত বেশে মৃত সন্তানকে বুকে চেপে
শোনায় করুণ সুরে ঘুমপাড়ানিয়া
গান; নক্ষত্রেরা আড্ডা মারে শূন্যতায় সুখে দূরের আকাশে।

৮,৯,৮৮

কালি

সে কবে তোমার হাত
লেগে অকস্মাৎ কালো পেলিক্যান কালির দোয়াত
উল্টে গিয়ে পড়ার টেবিলটায় আর
বক-শাদা খাতার পাতায় অন্ধকার
ক’রে দিয়েছিলো খুব তোমার সোনালি মুখটিকে।
ইশারায় ঠিকে
ঝিকে এনেছিলে ডেকে ঘরে মুছে নিয়ে
যেতে তার মেয়েলী মুদ্রায় কালো দাগ। সেই ভয়ে
বুঝি তুমি হে চেনা অচেনা
এখনো আমার হাতে স্পর্শ করলে না।।

 কোনো গায়িকার জন্যে

উপকার ভুলি না ব’লেই এই উপহার আমি
সযত্নে সাজিয়ে রাখি তোমার উদ্দেশে। যদি নাও,
তবে ঘন শারদ আকাশ হবে অদৃশ্য বৈভবে।
বস্তুত ধ্রুপদ নয়, বিস্তারে খেয়ালও নয় কোনো,
ইন্দ্রিয়বিলাসে বুঁদ-হয়ে-থাকা ঠুমরির মতো
একটি কবিতা লিখে ক্রমশ ভরিয়ে তুলি পাতা,
এইসব অক্ষর উঠুক দুলে তোমার গলায়
চাঁদের লকেটময় নক্ষত্রের নেকলেস হয়ে।

আমার হৃদয়ে শত শত উন্মাতাল বুলবুলি
মৃত্যুর দিঘিতে চঞ্চু ডোবালে এবং সর্পাঘাতে
লক্ষবার লখিন্দর ভাসলে ভেলায় গাঙুরের
বিষকালো ঢেউয়ে ঢেউয়ে, আমার একটি পংক্তি জাগে
লাল কমলের মতো এবং এ-ও তো জানি তুমি
দিনরাত পুড়লে অমোঘ আগুনের স্বরগ্রামে
তোমার অমর্ত্য কণ্ঠে অন্তর্লোকে ছড়িয়ে পড়েন
কাজী নজরুল, কান্ত কবি, অতুলপ্রসাদ সেন।।

খায় ফল মূল

তার কথা পড়ে নি কখনো কেউ ছাপার হরফে
গল্পে কি গাথায়।
আমি তাকে, বলা যায়, চিনতাম; কখনো সখনো
দেখতাম দূরে থেকে। অনূঢ়া যুবতী
অনেক ফুরফুরে প্রজাপতি দিয়ে গড়া উচ্ছ্বসিত
চঞ্চল শরীর তার দূরাগত বিহঙ্গের আনন্দিত গান।

অনেকের চোখের পাতায়
নাচতো সে সুখের প্রহরে আর বৃদ্ধের বরফে
স্তব্ধ হৃদয়ের তটে, শোনো,
জাগাতো ঝর্নার কলতান, যতদূর জানি তার মতিগতি
নিয়ে বলাবলি, কানাকানি চলতো অনেক আর হতো গীত
ছড়া, গান, যাতে থাকতো প্রচুর খিস্তি খেউড়ের টান।

মাঝে-মধ্যে আমাদের গ্রামে গেলে তাকে দেখি;
হয় না কখনো কথা তার সঙ্গে, ছেঁড়া ডুরে শাড়ি ভেসে ওঠে
দৃষ্টিপথে; টুক্কুনি, এটাই
তার নাম, বুঝি-বা রহস্যময়ী। লোকে বলে, দোষ তার চাই তো
সে খেতে

মাছের সালুন দিয়ে পেট পুরে ভাত। তার খোলা
কালো চুল উড়তো হাওয়ায়, কখনো সে খোঁপায় গুঁজতো রাঙা ফুল।

এ-শহরে বেঁচে থাকি আমার একান্ত লেখালে খি,
বইপত্র, ডিজেলের ধোঁয়া, পরাবাস্তবের ছবি নিয়ে, ঠোঁটে
নিয়ে স্বপ্নবীজ; মেলে ঠাঁই
বুদ্ধিজীবীদের আস্তানায়। কানে আসে টুক্কুনি মরেছে মেতে
মধ্যরাতে কাজল দিঘির রূপে দোলা
দিয়ে গাঁয়ে; তার কবরের মাটিতে পাখিরা খায় ফলমূল।।

চার কন্যার কাহিনী

এতকাল পরে অবেলায়
এমন একটি দিন আসবে জীবনে, এরকম
আশা আমি করি নি কখনো। এক ঘরে
তখনো চায়ের পেয়ালায়
দিই নি চুমুক, বিকেলের মুঙ্কুম চৌদিকে, আর
হঠাৎ চমকে দেখি ঘরের ভেতরে
কামরুল হাসানের আশ্চর্য ডাগর তিন কন্যা ঢুকে পড়ে শরীরের
গহীন গাঙের ঢেউ তুলে।

হলদে শাড়ি আমার মাথর শাদা-কালো চুলে চালায় আঙুল
লাল শাড়ি চুমুক গোলাপ
ফোটায় আমার ঠোঁটে, নীল শাড়ি সুডৌল বাহুর
অন্তরঙ্গ মুদ্রায় জড়িয়ে ধরে, যেন
ওরা তিনজন
গ্রামীণ শরম ফেলে রেখে সুদুর দিঘির
ঘাটে মেঘ মেঘালিতে উড়ে উড়ে
এসেছে শহুরে ফ্ল্যাটে এই ছোট ঘরে। কী ক’রে এখানে এসে সব
ওলোট পালট ক’রে দিলো।

অকস্মাৎ তিন কন্যা গেলো চ’লে, যেমন আকাশে
চকিতে মিলিয়ে যায় বিদ্যুল্লতা; ঘরে
রইলো প’ড়ে কাঁখের কলস, আসশ্যাওড়ার ঝোপ,
প্রগাঢ় সবুজ কলাগাছ। ঘরময় নিসর্গের
এ বর্ণালি নিয়ে কী করবো
ভাবছি যখন,
তখুনি আরেক কন্যা, বহু যুগ আগে যেন তার
সঙ্গে হয়েছিলো দেখা, ঘরে এসে ঢোকে, তাকে
গলায় পাপিয়া তার কণ্ঠ ধার দেয়,
বলে সে, দ্যাখো তো পারো কিনা
চিনতে আমাকে এতকাল পরে। তার কণ্ঠ শুনে
বুকের ভেতরে জেগে ওঠে বহুকাল
আগেকার গান
তুমি তো চতুর্থ কন্যা’ ব’লে যে-ই তার দিকে
এগোই, পেছনে স’রে গিয়ে গোধূলির
হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে যেতে বলে, ‘ভুল
কেন বলো, আমিই প্রথম’।।

 ঝর্না আমার আঙুলে

স্তব্ধতাকে এতটুকু জব্দ করি নি বলা যায়
আয়নায় মুখ দেখলাম ধরি নি
কাটা-ঘুড়ি হাত বাড়িয়ে
কিছুক্ষণ দু’গালে সাবান ঘ’ষে দাড়ি
কামালাম শাওয়ার খুলে পুরোনো গান
গোসল
টলটলে পানি বালতিতে চুল আঁচড়িয়ে
জানলার বাইরে তাকাই অনেক দূর থেকে-আসা
পাখি ছাদের কার্নিশে বসে
হাওয়ার ঝলক মাঝে মাঝে পাতা খসে গাছের দুপুরের
খাওয়া শেষ কত্থক নাচের
স্মৃতির রেডিওতে নজরুল গীতি
পারফিউমের ঘ্রাণ ইলেকট্রনের উড়াল
তুমি এলে না মগজে পপি ফুলের উন্মীলন
আমার হাত ক্লান্ত ঝিমোই বেলার
হুঁশ নেই আমার হাত পরিশ্রান্ত ঢেলা যেন ক্ষুৎকাতর
মানুষ ঘুমায় পাথার
অব্যক্ত অস্পষ্ট গোঙানি

উসকোখুসকো চুল গজিয়ে-ওঠা দাড়ি
ঘন ঘাস দুপুর চড়া
নাওয়া-খাওয়া নদারৎ ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজে
আমজাদী গৎ
পাশের ঘরে খুঁটিনাটি কাজের টুংটাং
ভেতরে ফিসফিস কিসের দরজার পর্দায়
মেরুন রঙ দোল খায় প্রজাপতি
ওড়ে ঘরময় চেয়ার ছেড়ে উঠি আবার বসি
বুকের ভেতর কারখানার বয়লার
ঘোরাঘুরি ক্রমাগত পর্দা সরিয়ে
হঠাৎ তুমি নুড়ি ঠেলে বেরিয়ে-আসা ঝর্না
আমার আঙুলে।।

তার আগেই যদি

আরো দশদিন তোমার কঙ্গে আমার
দেখা হবে না। ভরা আষাঢ়ের
পুরো দশ দশটি দিন
আমার কাটবে শূন্যতায়।
আকাশে
মেঘের ভেজা কাঁথা,
মাঝে-মাঝে বিদ্যুতের জরি,
আমার ভেতরে একটা অসহায়
আশ্রয়হীন পাখি
ডেকে উঠলো বার বার, তুমি নেই।
বৃষ্টি বন্দী শহরের রাস্তায়
বেবী ট্রাক্সিতে যেতে-যেতে
ট্রাউজারে ঢাকা আমার উরুতে আঙুল
বুলিয়ে তুমি জাগিয়ে দিচ্ছিলে
বিসমিল্লা খানের মানাই।
আলিঙ্গন আর চুম্বনের আশ্বাস
আমার সত্তায় ছড়িয়ে বলেছিলে-
দশদিন পরে আবার দেখা হবে আমাদের।
বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছিলো
তোমার মুখে;
গ্রীক পুরাণের কোনো দেবীর ধরনে
তুমি মুছে নিচ্ছিলে
পানির বিন্দু সমুদয়,
দেখছিলাম মুগ্ধাবেশে।

হঠাৎ মধ্য দুপুরে নেমেছিলো
দৃষ্টি ঝাপ্‌সা ক’রে দেয়া বৃষ্টি।
আমরা দু’জন
এমন ঘন ঘোর বর্ষায়
দোকানপাট আর
মানুষের ভিড়ে আট্‌কা প’ড়ে
হাঁসফাঁস; বৃষ্টি আর দরস্ত
তাতারী হাওয়া,
পথঘাট ঘোলা জলে সরলাব।
একটু পরেই
বেবী ট্যাক্সি, যেন একটা জলচয় পাখি
থমকে দাঁড়ালো ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে।

আরো দশদিন তোমাকে দেখবো না,
কী দীর্ঘ আর অন্তহীন এই সময়। ভাবলেই
মৃত্যু তার ঠান্ডা হাত বাড়াতে থাকে
আমার হৃৎপিন্ডের দিকে। কী ভাবে,
কোন্‌ জাদু বলে
পার হবো তুমিহীনতার মরুভূমি? আমার
অস্তিত্ব কি ঝল্‌সে যাবে না
সূর্যের ক্ষমাহীন উত্তাপে?
মরু শেয়ালেরা কি খর জিহ্বায়
ভীষণ চেটে চেটে
নিশ্চিহ্ন ক’রে ফেলবে না
আমার মাংসের দেয়াল?

তোমাকে না দেখে, তোমার কণ্ঠস্বর না শুনে
তোমাকে একবারও না ছুঁয়ে
কী ক’রে কাটবে আমার সময়?
কবিতা লেখা আর না লেখার
কানামাছি খেলায় কি
ভেসে যাবে দিনগুলি, রাতগুলি? যখন ঘুম থেকে
জেগে উঠবো ভোরবেলা কি সোনায়
মূড়ে দিতে পারবে
আমার আকাঙ্ক্ষার মুকুলগুলোকে?
যখন কিছুতেই ঘুমোতে পারবো না,
রাত্রি কি পারবে আমার সময়কে
সাজিয়ে দিতে
স্বপ্নের পাপড়িতে? কী ক’রে সইবো
আসন্ন বিচ্ছেদের স্বৈরাচার?
কেন এমন হয় না যে রোজ তোমাকে দেখতে পাবো
অন্তত একবার?
যত ক্ষণস্থায়ী হোক সেই সাক্ষাৎ
ক্ষতি নেই; প্রত্যহ তোমাকে এক ঝলক
দেখে নেবার পর,
তোমার হাত আর চুল নিয়ে
কিছুক্ষণ খেলা করার পর, ওষ্ঠে
তোমার চুম্বনের
প্রসাদ নেবার পর
মেনে নেবো পৃথিবীর যে কোনো রুক্ষতা, বিরুনতা।

প্রতি মুহূর্তে তোমার কাছেই আমার যাওয়া,
অথচ চৌদিকে উঁচানো বাধার সঙিন,
প্রহরীদের চাবুকের সপাং সপাং।
বন্দী, তৃষ্ণার্ত বেনহুরের মুখ থেকে
যেমন অত্যাচারীরা পানপাত্র সরিয়ে
নিয়ে গিয়েছিলো চরম তাচ্ছিল্যে, তেমনি কেউ কেউ
আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে চায়
তোমার সান্নিধ্য থেকে। ওদের ক্রোধ আর হিংসা
আমার সত্তার মাটি খুঁড়তে থাকে
লাশসন্ধানী কুকুরের মতো।

যদি ওরা তোমার আমার মধ্যে কাঁটা
বিছিয়ে রাখে, সেই বিষাক্ত কাঁটাকে ফুল ভেবে
হেঁটে যাবো তোমার দিকে। যদি ওরা
আমার হাতে হাতকড়া আর পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেয়,
আমি সেই নিষ্ঠুর বন্ধনের উৎপীড়ন
উপেক্ষা ক’রে যাত্রা করবো
তোমার উদ্দেশে আর
লোহার শেকল ঝন্‌ঝনিয়ে
গেয়ে উঠবে ভালোবাসার গান,
ভালোবাসা রক্তগোলাপের মতো উন্মীলিত আমার বুকে।
দশদিন পর তোমার সঙ্গে আমার দেখা
হবার কথা। আজ থেকে দশদিন পর।
সেই কাঙ্ক্ষিত দিনের প্রতীক্ষার করাত
আমাকে কেটে চলেছে মুহূর্তে মুহূর্তে। শুধু
তোমাকে দেখার জন্যে, দুশো চল্লিশ ঘন্টার পর
শিরায় শিরায় তোমার দৃষ্টির সম্মোহন
অনুভব করার জন্যে বেঁচে আছি।
কিন্তু তার আগেই যদি মৃত্যু
নাছোড় পাওনাদারের মতো এসে দাঁড়ায়
আমার দোরগোড়ায়, তবে কী হবে?

৬,৭,৮৮

তিন যুবার গল্প

যে-গল্প আমি বলতে যাচ্ছি
সেটি উঠে এসেছে আমার শৈশবের প্রাচীন
দিঘির তল আর
অশথ গাছের সবুজের গহনতা থেকে।
এঁ-গল্পের শুরু এবং শেষ, বলা যায়,
তিনজন যুবাকে করেছিলো নিয়ে,
যারা একদা যাত্রা করেছিলো এক সঙ্গে,
কিন্তু শেষ অব্দি ওরা তিনজন
চ’লে গেল তিন দিকে তেজী ঘোড়া ছুটিয়ে,
শরীরে বিস্তর ধুলো মেখে।

তাদের যাবার ধরন অনেকটা
স্যার গ্যালাহেডের মতো, চোখে-মুখে সংকল্প রেখায়িত,
হৃদয়ে নিবেদনের দ্যুতি।
লক্ষ্য ওদের অভিন্ন, অথচ ওরা
বেছে নিলো তিনটি আলাদা পথ। এখন
যা বলছি তা আগেই
বলা উচিত ছিলো। যাত্রা শুরু হবার আগে
এক সরোবর উগরে দিলো
ওদের উদ্দেশে হীরে-খচিত তলোয়ার,
সোনালি কুঠার আর মুক্তোর ঘুঙুর-পরা
বল্লম। নির্বাচন করতে হয় নি,
নিজে থেকেই
একেকটি অস্ত্র উঠে এলো একেক জনের হাতে।

দিন যায়, রাত যায়। ওদের ঘোড়া ছুটছে তো ছুটছেই
তিন দিকের তিন পথে, যদিও
গন্তব্য তাদের অভিন্ন।
লোকজন কান পেতে থাকে, জানতে চায় ওদের
ঘোড়ার পায়ের শব্দ কেমন ক’রে
মিলিয়ে যায় দিগস্ত থেকে দিগন্তে, আর
ওরা অপেক্ষা করে সেই দিনটির জন্যে
যে-দিন বন্দী হয়ে আছে ময়দানের লোমশ মুঠোয়।
তিন পরিত্রাতার প্রত্যাবর্তনের পথে
ওরা কান পেতে রাখে।

ওদের কানে আসে মুক্তোর ঘুঙুর-পার বল্লম
ডুবে গেছে ডোবায়,
সোনালি কুঠার হারিয়ে গেছে বনবাদাড়ে,
কেবল ওদের আশার মতো হীরে-খচিত তরবারি
ধাবমান ময়দানবের রাজ্যের দিকে। সেই তরবারির
ঝল কানি লেগে অন্ধ হয়েছে
ময়দানব, হুড়মুড় ক’রে ভেঙে পড়ছে ওর মায়াপুরী।

 দৃশ্য

ফ্ল্যাটের এক চিলতে ব্যালকনিতে বিকেলবেলা
রম্য সাপ্তাহিকীতে ঢেলে দিয়েছে মন
কলেজ-ফেরতা তরুণী।
ট্রাকগুলো অ্যালশেসিয়ানের মতো গজরাতে গজরাতে
ছোটে; উচ্ছিষ্টের দখল নিয়ে দিশি লড়াকু
কুকুরে কুকুরে কামড়াকামড়ি। ড্রেনের দুর্গন্ধ
বিবমিষা আনে, ডাস্টবিনের আশেপাশে কেবল গোঙায়
একটা আহত বেড়াল।

তিনি বসেছিলেন শান্তিনিকেতনী মোড়ায়
চুপচাপ, চোখ জোড়া তাঁর
পর্যটক নক্ষত্রের চন্ডীমন্ডপে। কতলোক কত
মন্ত্র জপে, কেউ কেউ তর্ক জুড়ে
গরম করে কান, কেউ-বা গলা খাদে এনে
প্রতিবাদ জানায় কোনো উক্তির,
তিনি শুধু নীরবতার ভেতরকার সূক্তি থেকে
ধ্বনি আহরণ করেন আর হঠাৎ
মেঘে মেঘে নক্ষত্রে থইথই আকাশে ভাসতে থাকেন,
যেমন দেখা যায় শাগালের ছবিতে।
সবাই হাত বাড়িয়ে ধরতে যায় তাকে, যেন
পৌষসংক্রান্তির
কাটা-ঘুড়ির দিকে
ক্রমাগত ধাবমান উৎসবলোভী এক-ভিড় বালক।।

দ্বিতীয় দৃষ্টির জাগরণ

আপাতদৃষ্টির অন্তরালে
দ্বিতীয় দৃষ্টির জাগরণ থাকে, একটি পায়ের
শব্দকে ছাপিয়ে ওঠে ভিন্ন পদধবনি। ভোরবেলা
প্রজাপতি কলমদানিতে
উড়ে এসে বসে, দূর বাগানের পলায়নপর
গোলাপের কথা
শোনাতে শোনাতে মৃত্যু দিয়ে জীবনের
একটি নিরালা ভঙ্গি নিঃশব্দে ফোটায়।

কুকুর-কান্নায় আর্ত গহন রাত্তিরে ফ্ল্যাটবাড়িতে যে-যুবা
ঝুলেছিলো ফাঁসির দড়িতে,
মনে হলো, শাগালের ছবির ধরনে
ভেসে ভেসে এলো সে আমার
ঘরের ভেতরে, দিলো বাড়িয়ে আমার দিকে হেসে
একটি ডালিম। মৃতেরা কি জীবিতের
হাতে এরকম
ফল তুলে দেয়? ওরা এরকম হাসতে
পারে অনাবিল? চার দেয়ালে ভোরের
তুলির রঙিন স্পর্শ, দেখি
করতলে ফল নয় কবিতার কিছু বীজ নিয়ে
ব’সে আছি লেখার টেবিলে।

মৃত প্রজাপতিটিকে বাজে কাগজের
ঝুড়িতে গচ্ছিত রাখি। অকস্মাৎ মিসিমার তরবারি-চেরা
পেট উদ্ভাসিত, ক্যালেন্ডার
রক্তবমি করে, রক্তচক্ষু মাল্যবিভূষিত মহিষের মুন্ড খোঁজে
বুকসেল্‌ফে কবিতার বই, প্রস্রাবের তীব্র কটু
গন্ধ রেখে ঘরময় চ’লে যায় লেজ নেড়ে নেড়ে,
মেঘের আড়াল থেকে উড়ন্ত বিবাগী
দরবেশ নেমে এসে পুলিশকে অস্তগামী চাঁদ
দেখিয়ে আবার
মেঘের কপাট খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন।

পারমাণবিক মেঘ ফেটে, মনে হলো,
আত্মা-দাহ-করা
তেজের ভীষণ বিকিরণ দশদিকে।

স্বপ্নে দেখি, একটি দেয়াল ধ’সে যার জরাগ্রস্ত
মানুষের মতো আর্তনাদ ক’রে, চাপা
পড়ে এক ঝাঁক কবুতর, শাদা, কালো, পীত,
বেগনি, বাদামি, স্বপ্নে দেখি
পায়রার মৃত্যু, ঘোড়াদের মৃত্যু দেখি। মৃত সব
ঘোড়ার কঙ্কাল ফুঁড়ে, পোকা মাকড়ের
দঙ্গল ছাপিয়ে সূর্যমুখী
বুকে নিয়ে সূর্যোদয় জেগে ওঠে রাশি-রাশি। স্বপ্নে দেখি,
নর্দমার গাদে
বালিকার হাত ভাসে কাগজের নৌকার ধরনে। পূর্ণিমার
চাঁদ ঝুলে থাকে স্টেনগান
দানবের চুম্বনের মতো;
পরিত্যক্ত বুটের ভেতরে ক্রমাগত কোলাহল
করে ব্যাঙ, সায়াহ্নের কর্দমাক্ত, ভগ্নকণ্ঠ ব্যাঙ; যেন কবি
অনস্তকে ঠোকরায় শুধু
দ্বিতীয় দৃষ্টির জাগরণে, ঠোকরায়, ঠোকরায়।।

পরে কোনোদিন

কী আশ্চর্য, দু’মাসও হয় নি
অথচ আবার তুমি হঠাৎ হাজির হ’লে ফ্ল্যাট-বাড়িটায়
আমার শোবার ঘরে। তোমার কি আসলে সময়জ্ঞান ব’লে
কিছু নেই? কেন তুমি এমন বাগড়া দিচ্ছো আমার কবিতা
লেখায়? এভাবে দরজায়
দাঁড়িয়ে থাকলে রক্ত-হিম-করা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে,
কেউ কি বিপুল রহস্যের ঝাঁপিময়
হিস্‌হিস্‌ শব্দ নিয়ে সাপুড়ের মতো
খেলায় থাকতে পারে মেতে? ব্যর্থ ভেঁপু খেলা শেষ
হয় নি এখনো, বারবার
তোমার দিকেই দৃষ্টি নিবব্ধ আমার। একদিন
একথা নিশ্চিত জানি, তোমার সঙ্গেই যেতে হবে
ভ্রমণে, তাব’লে আজই এই মধ্যরাতে
হানা দিতে হবে ঘরে আগে ভাগে এত্তেলা না দিয়ে?
দেখছো তো জ্যোৎস্না ফ্ল্যাট-বাড়িটাকে স্নান
করাচ্ছে সস্নেহে, যেন প্রিয় সখী কনের শরীরে প্রীতিবশে
গায়ে হলুদের দিনে ঢেলে দেয় পানি, দ্যাখো দ্যাখো,
প্রতিবেশী ছাদে
কী ডাগর ফুটে আছে গোলাপ, রজনীগন্ধা, ঐ তো
কিছুদূরে যে-আছে দাঁড়িয়ে ভোরবেলা যাকে গাছে ব’লে জানি,
এখন সে কুয়াশা ও জ্যোৎস্নার মিশ্রণে অপরূপ ব্যালেরিনা
এবং পাশের ঘরে আমার কনিষ্ঠা কন্যা ঘুমিয়ে রয়েছে,
কাল ভোরে ওর সঙ্গে কিছু
কথা বলবার আছে, প্রতিদিন সকালে চায়ের
পেয়ালার স্মৃতি ধরনে
নিরিবিলি সানন্দ চুমুক দিই, পৃথিবীতে আবীর ছড়িয়ে
পড়ার এখনো ঢের দেরি আছে। যাও,
তুমি ফিরে যাও; দেখছো তো আমার কবিতা
আধ-গড়া প্রতিমার মতো প’ড়ে আছে, বাকি আছে
এখনো অনেক কিছু। নিজের মনের মতো ক’রে
আজ অব্দি সাজানো হলো না
কিছুই; সমুদ্রে গিয়ে জলপরীদের ঠোঁট থেকে
মুক্তো আনবার কথা ছিলো,
কথা ছিলো চেনা পাকদন্ডি থেকে দূরে বহুদূরে
সম্পূর্ণ নতুন পথ কেটে
এগিয়ে যাবার, না, না কিছুই হলো না।

শোনো হে তোমার যাবতীয়
ব্যাপার-স্যাপার, সত্যি বলতে কী, বেখাম্পা ভীষণ।
তোমার নীরক্ত ঠোঁটে হাসি
ফোটে না কখনো
এবং যমজ পাথরের মতো চোখ
ভুলেও করেছে ছলছল কোনোদিন
কোনো দৃশ্য দেখে সূর্যাস্তে কি সূর্যোদয়ে,
একথা শোনে নি কেউ কস্মিনকালেও।

যদি ইচ্ছে হয় কিছুক্ষণ এই ঘরে কোনো এক খেলা খেলে
সময় কাটাতে পারো। বার্গম্যান, মনে পড়ে, তাঁর
একটি ছবিতে
তোমার এবং একজন নাইটের মধ্যে দাবা
প্রতিযোগিতার আয়োজন ক’রে
চমকে দিয়েছিলেন; কিন্তু আমি, হায়,
দাবার তুখোড় চাল দিতে কিংবা তাস
পিটতে শিখি নি, এসো শব্দ শব্দ খেলা খেলে
আজকের মতো ফিরে যাও,
পরে, আরো পরে কোনোদিন কুয়াশা ও মেঘে মিশে সঙ্গী হবো
ভ্রমণে তোমার।

পুনরাবিষ্কার

বেশি নয়, এই কিছুদিন থেকে হয়েছে কী জানেন, ঘন্টার
পর ঘন্টা আমি চেয়ে থাকি জানালার
বাইরে, আমার চোখে পড়ে
কত কিছু-একটা বেড়াল রোদ পোহায়, হাওয়ায় মৃদু নড়ে
আকন্দগাছের পাতা, পাখি
এসে বসে ছাদের কার্নিশে আর কে লোক একাকী
পথ হাঁটে, কেউ
অনেক পুরানো গান গেয়ে চ’লে যায়, অথচ জাগে না ঢেউ
মনের অগাধ জলে। দুটি চোখ বুজে,
কিছুক্ষণ বুঝে
নিতে চাই, কোনো অপরূপ ছবি ফোটে কিনা অন্ধকারে, শুধু
তিমিরের মরুভূমি দোর-আঁটা চোখে জ্বলে ধু ধু।

এই তো সেদিনও কাটা ঘুড়ি
হাওয়ায় ভাসার ছন্দে দুলে দুলে যাচ্ছে দেখে তুড়ি
মেরেছি মনের সুখে। কেউ চোখ তুলে
তাকালে সুহাস কোনো আঙ্গিকে, হৃদয় রঙ বেরঙের ফুলে
গেছে ছেয়ে লহমায়। কী-যে
হলো, আজ মেঘলা বেলায় চিল ডেকে উঠলেও চোখ ভিজে
ওঠে না আমার। দশদিক থেকে দশজন এসে
কাঁধে হাত রেখো, দিব্যি হেসে
বোঝায় বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে ছড়িয়ে হাজার
পুথির ধুসর গন্ধ, ‘এটা তো ভালোই হলো, বারংবার
তুমি আর বেহুদা যাবে না
ভেসে আবেগের তোড়ে কুটোর ধরনে। হাস্নাহেনা
বাগানে ফুটেছে থরে থরে ব’লে আর
তুমি বাজবে না, যেন বেলায়েত খানের সেতার।
ওদের অমন প্রবোধের শুকনো খড়
মনে হলো বাস্তবিক গাড়লের ফিচেল রগড়।
কিছুটা আশ্বস্ত হতে জমকালো ডিগ্রী-খচিত সমাজে ছুটে
যাই বিদ্যাপীঠে পান্ডিত্যের ভারানত ধীমানেরা নখ খুঁটে,
চোখ পিটপিট ক’রে বলেন তাতে
জ্ঞানরাজ্য আমার দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে বিলক্ষণ। মধ্যরাতে
বাতি জ্বেলে গ্রহ্ন থেকে সে-জ্ঞানের কণা
কিছু কিছু করা যায় আহরণ শুধু সে-সঞ্চয়ে কোনোদিন পারবো না
তৃপ্ত হতে। বহু ভেবে, দেখেছি যাচাই
ক’রে বহু কিছু, আমি আমার বিস্ময়বোধ ফিরে পেতে চাই।

অকস্মাৎ রাস্তায় বেরিয়ে দেখি একটি বালক
সাবানের রঙিন বুদ্বুদ নিয়ে মেতে আছে খেলায় নিছক,
আর কোনো কিছুর দিকেই নেই তার
খেয়াল, অবাক হয়ে ভাবি, জ্ঞানের ভান্ডার
নিয়ে যাঁরা অনেক উঁচুতে সমাসীন,
তাঁরা এই দীন
অভাজনটিকে পারেন নি যা দিতে, পথের
ক্রীড়পরারণ সে-বাকল দাতা তার চেয়ে ঢের
বেশি দিয়ে আমাকে তন্ময়
করে দিলো, উজাড় বাগানে ফোটে নিরিবিলি অজস্র বিস্ময়।

এ ক’দিন পরে কী জানেন, পুনরায় আমি বালকের মতো
এক রঙধনু থেকে অন্য রঙধনুর মন্ডলে ক্রমাগত
লাফ দিয়ে যেতে
পারি। পারি গৃহবলিভুকদের নিয়ে মেতে
থাকতে অনেকক্ষণ, কারো গাঢ় চোখ
চোখের পলকে দিতে পারে আমাকে আনন্দলোক।।

প্রতিটি মুহূর্ত যদি

আমাদের দু’জনের ওপর আহত কোকিলের
কণ্ঠস্বর ঝরে; রাত্রিস্রোত
গহন প্রবেশ করে সত্তার উন্মুখ তন্তুজালে।
সাপের মণির মতো
টিপ জ্বলে তোমার কপালে।
মহাশ্চর্য একটি নৃত্যকে তুমি শরীরে রেখেছো
লুকিয়ে, তোমার

গরম সোনার মতো ত্বকে
দূর শতাব্দীর রহস্যের বিচ্ছুরণ

কোনো কোনো রাত্রির ভেতরে এরকম কিছু থাকে
যা মনকে লতাগুল্মসমেত বাইরে
টেনে আনে এবং তখন
ক্রমাগত কী প্রচন্ড ওলটপালট হতে থাকে, অদৃশ্য ঝাপটে
হাত-পাখি ওড়ে

নীড়ের উদ্দেশ্য;
হৃদয়ে বৈশাখী-হাওয়া, ঠোঁটে
প্রলম্বিত স্পর্শ কাতরতা।

তোমার কপালে শিশুচুল গাছের পাতার মতো
ক্রীড়াপরায়ণ, ইচ্ছে হলো
ঈষৎ গুছিয়ে দিই, হৃদয়ে কেমন কোলাহল
স্তব্ধতায় শুয়ে আছে, বারবার সুলুক সন্ধান
ক’রে কথা কিছুই না পেয়ে বলে ফেলি
অন্ধকারে ফিসফিসের স্বরে-
‘তুমি কি পেয়েছো এই জীবনের মানে? আমি কিন্তু এখনও পাই নি।
রাত্রির চেয়েও
অধিক প্রগাঢ় কালো এবং ডাগর
চোখে তুমি আমাকে কয়েদ ক’রে কণ্ঠস্বরে হ্রদ
এনে বললে, ‘তাকাও আমার চোখে হৃদয়ের চোখ।
আলো অন্ধকারে কুহকিনী নাম্নী এক
অর্থময়তার কাছে পরাজয় মেনে ব’সে থাকি
ভীষণ নিশ্চুপ।
বিদায়ের আগে তুমি হঠাৎ যখন
আমার হাতকে দিলে তোমার মুঠোয়
গোপন আশ্রয়, ভাবলাম অনির্বচনীয় ঘোরে
প্রতিটি মুহূর্ত যদি দশ হাজার বছর হতো।।

বন্ধু সঙ্গে কথা বার্তা

আমার ধীমান খ্যাতনামা নিষ্ঠাবান
নন্দনতাত্ত্বিক বন্ধু অ্যাসট্রেতে চুরুটের ছাই
ঝেড়ে, হাই তুলে পুরু লেন্সের আড়ালে-রাখা চোখে
কৌতুকের কলাপ ছড়িয়ে
বল্লেন, “এবার ছেড়ে দিন বেচারীকে,
ঢের হলো ঢলাঢলি। আপনার চুলে বহুদিন
আগেই ধরেছে পাক, চোখে ছানি পড়বার দেরি
নেই, আর তিনিও যে কচি খুকী,
এ-কথা যাবে না বলা। ইতিমধ্যে তাকে যথারীতি
সবাই ষোড়শী ব’লে ডাকে। দয়া ক’রে
এবার ছাড়ুন তার কস্তাপেড়ে শাড়ির আঁচল। আর শুনতে চাই না
আপনার মুখে-
‘স্বপ্নের সমুদ্র থেকে উঠে-আসা নারী
আমার সকল গান মঞ্জরিত তোমারই উদ্দেশে। যযাতিকে
মানায় না, সত্যি বলতে কী, তবুণীর নীলাম্বরী
ধ’রে টানাটানি, এই আচরণ ছাড়ুন এখন।“
আমি তো ছেড়েই দিতে চাই। সবক্ষণ তাকে পুঁজি
ক’রে যারা নিজেদের কপাল ফেরায়,
সংখ্যায় নগণ্য নয় তারা। অপদার্থ এই আমি
রাতারাতি সম্পদ অর্জনকারী মন্ডলীর কেউ
নই; দেখি মাস্তানেরা সকল সময়
ওৎ পেতে থাকে,
কখন বসাবে তার গালে কামার্ত কামড় নোংরা
দাঁতে; হাতে ছোরা
ঘোরাতে ঘোরাতে ওরা চেপে ধরে তার দু’টি স্তন
দিন দুপুরেই। তার শাড়ি
কাঁচুলি খোলার জন্যে এক-পায়ে রয়েছে দাঁড়িয়ে
দশদিকে দশজন। আমি তাকে শ্বাপদের ধারালো দঙ্গলে
ফেলে রেখে মাথা হেঁট ক’রে
চ’লে যাবো? বলুন হে বন্ধু, এ তরুণী হরিণীকে
কী ক’রে বাঘের মুখে ফেলে শুধু নন্দনতত্ত্বের বেল পাকা
দেখে যাবো কাকের ধরনে? আমি তার
পাশে থেকে অন্যরকমের প্রেমসংহিতা লিখে
যেতে পারি কিনা
এ নিয়ে প্রকাশ্যে অবহেলা আর যন্ত্রণাকে নিয়েছি দত্তক।।

 বাড়ি নিয়ে ঘরে ফেরা

তোমার সৌজন্যে আমি কীটস্‌-এর হ্যাম্পস্টীডের দোতলা বাড়ি
পেয়ে গেছি চায়ের বাটিতে। তাড়াতাড়ি
যাচ্ছিলাম চ’লে, তুমি ‘এটা তোমার জন্যেই আনা
শ্বেতদ্বীপ থেকে’ ব’লে টানা
দু’টি কালো চোখ
রাখলে আমার চোখে। ঊনবিংশ শতাব্দীর হৈমন্তী আলোক
ছিলো চোখে, এবং আমার
রক্তের ভেতরে বুলবুলি গেয়ে ওঠে, কণ্ঠে যার
যুগযুগান্তের ফুল্ল ধ্বনি। মর্মমূলে ধন্যবাদ
জানাবার সাধ
মঞ্জরিত হয়, তবু কিছুই না ব’লে ঘরে থেকে
বিকেল শরীরে মেখে চকিতে বেরিয়ে পড়ি। তীক্ষ্ম যায় ডেকে
একটা কেমন পাখি, তুমি সেই প্রফুল্ল বিকেলে
কিছু পথ হেঁটে এসে কী ভেবে আবার ফিরে গেলে
শূন্যতায় ঢেউ তুলে,
যেন কিছু কোথাও এসেছো ফেলে ভুলে।

করতলে বাদামি কাগজে মোড়া কীটস,-এর বাড়ি নিয়ে ফিরি
ঘরে একা, সিঁড়ি
বেয়ে উঠি কালের কয়েদী; সত্তাময় শেকলের শব্দহীন
ধ্বনি বাজে; আর কতদিন
এভাবে কাটবে বলো তুমি হীনতায়? যদি বনে
গিয়ে করি বসবাস, তবে কি তোমাকে পাবো নিজের গহনে?

আমাদের দু’জনের কত রাত্রিদিন কত বাস হলো গত,
অথচ তোমাকে আমি এমনকি সৌজন্যবশত
হে সুন্দরীতমা, শোনো,
আমার ভাড়াটে ফ্ল্যাটে ডাকি না কখনো।।

বেহালা

উত্থানপতনে উচ্চাবচ
এই শতাব্দীর মধ্যপাদে জ্যোৎস্না-চমকিত রাতে
খাদের কিনারে আমি একাকী দাঁড়ানো
অসহায়, সম্বলবিহীন। চেয়ে থাকি দিগন্তের
দিকে, তালগাছের মাথায়
চাঁদ, যেন বরের টোপর। ‘আনো কিছু
পাহাড়ের অন্তরাল থেকে’
ব’লে প্রার্থী হই নতজানু। কার কাছে? পলাশের
ডাল কিংবা পার্শ্ববর্তী নদী
বলে না কিছুই; হাওয়া নাচে,
ক্ষ্যাপাটে বাউল; অকস্মাৎ
ফুল নেমে আসে, নেই যার কোনো মূল।

মাটিতে কেবলি ঝরে ফুল,
সৌরভ ব্যাধির বীজ বোনে শরীরে আমার,
রৌরবের আঁচ লাগে, আরোগ্যের আশা কম জেনেও দাঁড়িয়ে
থাকি ঠায়, দম বন্ধ হয়ে আসে, তবু অস্তিত্বের
রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাজে
আকাঙ্ক্ষার সুর। দূর থেকে চ’লে আসে
হাতে মেহগনি
কাঠের বেহালা, সকলের অবহেলা
স’রে যায়, যেতে থাকে। এসো এসো ব’লে
ডাকে নানাজন।

কে দেয় আগুন ঘরে ঘরে
ঘুমন্ত প্রহরে? ঘুণ-ধরা খুঁটি পোড়ে, পুড়ে যায়
আসবাব, গ্রন্থাবলী, বিছানাপত্তর। গেরস্তের
কুকুর পালায় আর ইঁদুরের দল
মরীয়া লাফিয়ে প’ড়ে নর্দমায় এবং পুকুরে;
ডোবে, ক্ষোভে কেউ
কেউ ছেঁড়ে চুল উন্মাদের মতো। দমকাল কই?
অতঃপর আপাদমস্তক
শরীর পুড়িয়ে আমি বেহালা এবং
ছড়টিকে অক্ষত জড়িয়ে বুকে দাউদাউ আগুনের তীর
লোলুপতা থেকে চকিতে বেরিয়ে আসি। বেহালার ছড়
পারবে কি নেভাতে
আগুনের ঝড় কোনোকালে??

ভাস্কর্যই বলা যায়

ভাস্কর্যই বলা যায় এর্নেস্ত ক্রিস্তফ-গড়া প্রায়,
পার্কের কিনারে প’ড়ে আছে,
কয়েকটি দ্রোণ কাক দূরবর্তী গাছে
স্তব্ধতাকে ভীষণ কর্কশ ঠোকরায়।

ভাস্কর্যের পাশে
খুচরো ওয়সা কিছু, দরগার খইয়ের মতন
ছড়ানো ছিটোনো; লোক আসে
যায় প্রথামতো, কেউ কেউ কিছুক্ষণ
দাঁড়িয়ে সেখানে সিগারেট
ফোঁকে, ধোঁয়া ওড়ে; অনেকেই দূর থেকে দৃষ্টি দিয়ে
ছুঁয়ে চ’লে যায় ছিমছাম, কারো মুঠো ভেট
ছুঁড়ে দ্যায় ছেঁড়া কাঁথাটায়। যেন দিয়েছে নিবিয়ে
দিনের সুসভ্য আলো কেউ লহমায়
মনে হয়, যখন আমিও সে-ভাস্কর্যে খুঁজে পাই
নারীর আভাস; বুকে কী যেন লাফায়
অচিন পাখির মতো, তাড়াতাড়ি ভিড়ে মিশে যাই।

সে, ভাস্কর্য, গ্রাম ছেড়ে খুঁজেছে আশ্রয় এ-শহরে।
বন-দোয়েলের শিসে সে কি অকস্মাৎ
এখনো চমকে ওঠে? বেওয়ারিশ রাতের প্রহরে
নক্ষত্রের আকর্ষণ বোধ করে? হাত
তার অন্য কারো হাত স্পর্শ করবার
বিনম্র লাজুক কাতরতা
করে কি কখনো অনুভব? চোখ শিউলি ফোটার
অপেক্ষা থাকে? কোনো কথা
এখনো আছে কি বাকি কাউকে বলার? অতিশয়
নিশ্চুপ সে, নাক মুখ বরাবর
মাছি ভন্‌ভন্‌ করলেও তাড়াবার তাড়া নেই, লোকলাজ কিংবা ভয়
কিচ্ছু নেই, আজ খোলা পথই তার একমাত্র ঘর।
পার্কের কিনারে প্রায় ক্রিস্তফের গড়া ভাস্কর্যের প্রদর্শনী
দেখে ফুর্তিবাজ আড্ডা দিই, কফি খাই,
ফ্ল্যাটে ফিরি রাত ক’রে, খানিক সময় ব্যালকনি
থেকে তারা গুনি, কবিতার কিছু অক্ষর সাজাই
মনে মনে । হঠাৎ অক্ষরগুলো, কুলোপানা চক্করের সাপের ধরনে
ফু’সে ওঠে, ভীষণ গর্জন
করে আফ্রিকার অরণ্যের সিংহের মতন; বারবার মনে
দেয় হানা সে-ভাস্কর্য, রুক্ষ ফুটপাতে প’ড়ে-থাকা আসিরন।।

মাঘের দুপুরে

মেঘঢাকা সেই মাঘের দুপুরে
ছিলো না খেয়াল নাওয়া কি খাওয়ার।
শরীর ডুবিয়ে মেরুন সোফায়
পড়ছিলে তুমি শোপেনহাওয়ার।

অভ্যাস আর আলস্য থেকে
ছিনিয়ে নিজেকে এনেছি এখানে।
হঠাৎ তাকালে কেমন আলতো,
বললে কী যেন অবছায়া টানে।

তারপর এলো খাবারের ট্রালি;
চায়ের পেয়ালা কানায় কানায়
ভ’রে ওঠে আর হাসলে এভাবে
যে-হাসি তোমাকে নিখুঁত মানায়।

দুই জগতের মধ্যে রয়েছি,
অন্তরালের ছবি আসে যায়।
কোন্‌ সে জগৎ অধিক প্রকৃত-
এ নিয়ে ঈষৎ ডুবি ভাবনায়।

এ জগৎ শুধু ধারণা এবং
সংকল্পের দ্বিত্ব ভেবেই
রয়েছো মগ্ন মাঘের দুপুরে।
আমি সমাহিত নিরুক্তিতেই।

আপাতত এই হৃদয়ে আমার
ঝরে বাসনার প্রফুল্ল চেরি।
যখন তোমার চোখ পড়ে চোখে,
বলি, পড়েছো কি জন ত্র্যাশবেরী?

আমার ভেতরে জাগলো হঠাৎ
মেঘফাটা রোদ, দুর্বার ক্ষুধা।
শরীরিণি তুমি বলেছিলে হেসে-
দাঁড়াও আনছি পাবলো নেরুদা।

‘না থাক এখন বরং আমার
হাতে তুলে দাও তোমার ও-হাত,
ব’লে আমি চির নশ্বরতার
স্বরে আওড়াই সুধীন্দ্রনাথ।

দ্বন্দ্ব প্রসৃত যন্ত্রণা বাজে
হৃদয়ে আমার। কী আছে চাওয়ার?
পেঙ্গুইনের প্রচ্ছদ জুড়ে
গভীর তাকান শোপেনহাওয়ার।।

মাঝখানে

ভ্রাতৃত্ববোধের সল্‌তেটাকে আরো একটু
উস্‌কি দিতে মাঝে-মধ্যে
গ্রীনরোডে অনুজের বাড়ি যাই। তাছাড়া সময় তো আর
ব’সে নেই। এই যে আমি আজ আছি কি কাল নেই।

বহুদিন পর সন্ধেবেলা আমার অনুজের দোতলা বাড়ির
সিংদরজায় থমকে দাঁড়ালাম, খুব কাছেই
শেকল-বাঁধা এক অ্যালশেসিয়ান ব’সে আছে চারপাশে
আভিজাত্যের শান্ত আভা ছড়িয়ে, বনেদী
হিংস্রতাকে উদাসীন ক্যামোফ্লেজ ক’রে। গেট পেরিয়ে ভেতরে
ঢুকবো কি ঢুকবো না এই দ্বিধার
চঞ্চুতে বিদ্ধ আমার দুরু দুরু বুক। আমার ভেতরকার
দোটানা ওর নজরে পড়তেই
গা ঝাড়া দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায় বহুজাতিক
ফার্মের ডাকসাইটে মেজো কর্তার ধরনে।
ওর চোখ দুটো দামি রত্নের মতো
ধ্বকধ্বক করছিলো জিভ উঠলো লকলকিয়ে। ওর
গর্জমান গলা বাড়ির ভেতর থেকে
টেনে আনলো
দুজন পরিচারককে। ভাগ্যিস ওরা এলো, নইলে অনুজের
অন্দর মহলে প্রবেশ করবার সাহসই হতো না।

আমার অনুজ বাড়িতে ছিলো না,
আজ দুপুরেই নাকি সে উড়োজাহাজে পাড়ি জমিয়েছে
য়ুরোপে তেজারতির কাজে। থাকলে নিশ্চয়
সেই ডাকাবুকো কুকুরটার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে
বলতো, ‘খামোকাই ভয় পাও,
ও কেছুই করবে না, তাছাড়া বরাবরই তুমি
ভারি ভীভু, ভাইয়া। যদ্দুর জানি,
এরকম উক্তি হয় হামেশা উচ্চারিত হয় সে-সব গৃহকর্তার মুখে,
যারা কুকুর পোষেন শখ ক’রে
অথবা চোর-ডাকাতের উপদ্রব থেকে শত হন্ত দূরে থাকার জন্যে
বাড়িতে অনুজ ছিলো না, কিন্তু আমার
আস্মা ছিলেন, সবে মগরেবের নামাজ আদায়
ক’রে উঠেছেন; জায়নামাজ গোটাতে গোটাতে আমাকে
সস্নেহ আপ্যায়ন করার জন্য
ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, ডাকলেন পরিচারিকাকে। আমি
চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে
আস্মাকে বল্লাম, কিছুকাল আগেও অ্যালশেসিয়ানটা
ছিলো খুবই ছোট,
অথচ এখন কেমন তাগড়া আর জবরদস্ত হয়ে উঠেছে’।
‘দু সের গোস্ত রোজ বরাদ্দ
ওর জন্যে, আরো রকমারি খাদ্য, যা-যা
উপযোগী কুকুরটার স্বাস্থ্যের পক্ষে’ আম্মা জানালেন
ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে। আমি একটু
অস্বস্তি বোধ করলাম, অজান্তেই উসখুস ক’রে উঠলাম।

সেই মুছুর্তে আম্মার হাসিতে তেরশো পঞ্চাশের
মন্বন্তর আর সেই অতিদূর দুপুরকে
দেখলাম, যে-দুপুরে তিনি আমাদের বাজরার রুটি
ভাগ করে দিচ্ছিলেন
এবং আমাদের বৈঠকখানার জানালায় ভেসে উঠেছিলো
এক কঙ্কালসার মানুষের
ক্ষুধার্ত দুটি চোখ। সেই হাসিতে জয়নুল আবেদীনের
ঝাঁক ঝাঁক, কাক, উজাড় ডাস্টাবিনের পাশে
শূন্য অ্যালমুনিয়মের থালা, মাটির সান্‌ কি আর
সভ্যতার দিকে পা মেলে চোখ উল্টিয়ে ফুটপাতে প’ড়ে-থাকা
অসংখ্য আদম সন্তান। আম্মার হাসিতে
পোষা পশুর প্রতি প্রশ্রয়মিশ্রিত কৌতুক, কিছুটা গর্ববোধ
নাকি চকচকে ব্লেডের মতো
শ্লেষ ছিলো, ঠিক বুঝতে পারি নি।

পাশ কাটিয়ে পেরিয়ে এলাম
আমার অনুজের বাড়ির সিংদরজা।

যখনই অনুজের বাড়িতে যাবার কথা ভাবি,
তখনই মনে প’ড়ে যায়
আমাদের স্নেহপ্রীতি, কুশল-সংলাপ আর সম্পর্কের সেতুর
মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে
শৃঙ্খলিত এক অ্যালশেসিয়ান এবং সবসময়
আমি খুব ভয়ে থাকি,
যদি কোনোদিন সে হঠাৎ তার
গলয় শেকলটা ছিঁড়ে ফ্যালে এক ঝটকায়!

 রাত তিনটের

ইদানিং রাত তিনটের কিংবা সাড়ে-তিনটের
ঘুম ভেঙে যায়।
মশারী সরিয়ে উঠি, জগ থেকে ঢেলে পানি খাই
দু’তিন গেলাস, নির্নিমেষ
তাকাই বাইরে কিছুক্ষণ, রাত্রিমাখা স্তব্ধ ক্যাম্পে
মলিন প্রহরারত সৈনিকের মতো গাছগুলি
দেখি আর মনে প’ড়ে যায় শাদা-লাল তোমার বাড়ির কথা।

তোমাকে করাচ্ছে স্নান ঘুম। এ মুহূর্তে নিরিবিলি
তোমার বাগানে অন্ধকারে
জেগে আছে গোলাপের দ্যুতি। যে-আঁধার গোলাপকে
ঘিরে রাখে, আমি সেই অন্ধকারকেই
হৃদয়ে ধারণ ক’রে, ইচ্ছে হয়, তোমার বাড়ির
চতুর্দিক প্রদক্ষিণ করি, মনে মনে বলি অসময় হোক
সুসময়। ভাবি ভোর না হতেই যদি
তুমি এসে বাগানে দাঁড়াও ভোর হবে লহমায়।

একা ডাল নুয়ে আছে দিঘিতে, যেমন
আমার আগ্রহ ঝুঁকে থাকে তোমার স্বপ্নের প্রতি-
এবং আমার রাত তিনটের এই
জেগে-থাকা তোমাকেই ডাকে বারবার। হাওয়ার আঙুলগুলি
তোমার রেশমি চুলে, ঠোঁটে
আর নাভিমূলে
নিবিড় গোপনে গুঁজে দিয়ে আসে আমার প্রখর চেয়ে-থাকা
আমার আনন্দ আর আমার বিষাদ।।

রূপালি জাল

এই যে শুনছেন , একা-একা সেই কবে থেকে
রাত্রি জেগে যে-জাল বুনছেন,
সেটা একটু একটু ক’রে কেটে ফেলছে
ইঁদুর। সেদিকে আপনার নজরই নেই আর
আপনার চোখে ঘুম নেই এক ফোঁটা,
অথচ নিঝুম আকাশের সিঁথিতে সূর্য পরিরে দিচ্ছে সিঁদুর।

এবার জালটা গুটিয়ে
অপেক্ষমাণ শয্যায় শুয়ে পড়ুন। নইলে রক্তের চাপ
যাবে বেড়ে, তেড়ে আসবে বীজাণুর ঝাঁক
আপনার অস্তিত্বের দিকে। তিনদিন আগে কাচা
গেঞ্জি ঘামে জ্যাবজেবে, দেখুন
কেমন ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে আছে একটা পাখি।
এভাবে ঘুমকে দিলে ফাঁকি, যৌবন তো অকালে
কবেই গেছে অস্তাচলে, প্রাণ-ভোমরাকেও
হবে হারাতে। আপাতত চতুর আর চেষ্টাশীল
ইঁদুরটাকে তাড়াতে লেগে যান
আর রূপালি জালটা তুলে রাখুন সিন্দুকে।
পাড়ার পাঁচ নিন্দুকে উল্টোপাল্টা যা কিছুই রটাক,
দেবেন না কান, গান গেয়ে আর
জাল বুনে রুখে দিন বেবাক কুৎসা কেচ্ছার বান।

কিন্তু কী-যে হলো, আপনি নিজে
কেমন জড়িয়ে পড়ছেন নিজেরই জালে। ইঁদুরের
শ্রমকে তাচ্ছিল্যের ফুৎকারে উড়িয়ে
দৈর্ঘে-প্রস্থে বেড়ে চলেছে নকশাময় রূপালি জাল।
আপনি যত আটকা পড়ছেন তাতে,
ততই আপনার চোখে মুখে থইথই
করছে কিসের উদ্ভাসন। উইয়ের ঢিবিতে
আপাদমস্তক ঢাকা প’ড়ে কি
বাল্মীকির মুখমন্ডল ধারণ করেছিলো
এমন অনাবিল মঞ্জিমা??

শ্বেতপদ্ম

অস্ত্র নেই হাতে আর দাঁড়িয়ে রয়েছি বর্মহীন, সঙ্গীহীন,
অবেলায় সেই কবে থেকে। ছুটে আসে
সড়কি, বল্লম, ট্যাটা, ঝাঁক ঝাঁক, কখনো পাথর
আমার উদ্দেশে। কেউ লাফ
দিয়ে ঘাড়ে পড়ে, চেপে ধরে টুঁটি, কেউ
চুল টেনে হি’চড়ে হি’চড়ে
নিয়ে যায় থকথকে বর্ষার কাদায়, কাদা চেটে
খেতে বলে লাথির ভাষায়।

এ ব্যাপক আঁধিঝড়ে ডানে বাঁয়ে,
যেটুকু সম্ভব দেখি, দেখি চোখ মেলে
এলেবেলে মুখগুলি। সকলেই
খুব চেনা, অথচ কী ভীষণ অচেনা মনে হয়। কারো মুখে
ভালুকের মুখ ব’সে গেছে, কারো চোখে
হায়েনার চোখের আদল,
ডোরাকাটা জ্বলজ্বলে বাঘের প্রচ্ছদ
কারো গায়ে সাঁটা, চোখ আগুনের ভাঁটা।

থমথমে এখানে এখন আসে যদি কেউ পাবে সে দেখতে
আমার রক্তের দাগ, দেখবে রয়েছে
প’ড়ে ছেঁড়া ত্বকের মাংসের
টুকরো ইতস্তত
এবং দেখবে সেই থকথকে কাদায়, রক্তের
দাগ জুড়ে গোধূলিবেলায়
শ্বেতপদ্ম কী একাগ্র নৃত্যপর, অপরিকল্পিত,
শিশুদের খেলার বিষয়।।

সময় না শীত না গ্রীষ্ম

সময়টা না শীত না গ্রীষ্ম, শরতের বলা যায়,
সুনীল সানাই বাজে শ্বেতপদ্ম হয়ে আকাশে আকাশে।
‘এ জায়গায় শান্তি ফুটে আছে, ভেজা ঘাস, কাল
রাতে কিছু বৃষ্টি হয়েছিলো হয়তো’, ব’লে
তিনি তাকালেন দূরে পাহাড়ি টিলার দিকে দুটি
অত্যন্ত প্রসন্ন চোখে? আকন্দগাছের পাতা থেকে ফোঁটা ফোঁটা
পানি ঝরে, যেন
আনন্দের বিন্দু কিছু। মনে পড়ে তাঁর অতিদূর শৈশবের
সর্ষেখেত, মাঠে ছুটে-বেড়ানো একটি
সফেদ বাছুর, বেতফল খেতে খেতে ঘরে ফেরা
সন্ধেবেলা, ডুমুর পাতায়
জ্যোৎস্নালতা পাকা ধান খেতে-আসা বালি-হাঁসের সাঁতার।

শিকারে এসেছিলেন, আপাতত ভৃত্যের সস্নেহ হেফাজতে
বন্দুক বিশ্রামরত। পাখিদের বুক
কার্তুজে রক্তাক্ত করবার
বদলে বরং
ওদের পাখার রঙ , ময়ূরের পেখমের মতো
আসমানে ওড়াউড়ি ভালো লাগে তাঁর। অকস্মাৎ
খরগোশের দৌড় ঝোপ থেকে ঝোপান্তরে, ‘থাক থাক,
বেঁচে থাক,’ ব’লে নিসর্গের কাছ থেকে বুকভরা
শান্তিও কল্যাণ ধার ক’রে
উঠলেন তিনি
ঘাতক-বুলেট-প্রুফ ক্যাডিলাকে, পদ্যের কুসুম
ঝাঁকে আসে তার ঠোঁটে, দ্যাখেন দু’চোখ ভ’রে শত কু’ড়েঘর।

সান্ত্রীঘেরা সুরম্য ভবনে ফিরে এসে ঠান্ডা ঘরে
সোফায় সোপর্দ ক’রে নিজেকে ভাবেন
আকাশ পাতাল, টেলিফোন
বাজে ঘন ঘন, কেউ কেউ কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে
প্রবেশ করেন ঘরে, চলে আলোচনা গুরুত্বের খাপে মোড়া
নানা খাতে। কানে কানে মন্ত্র তন্ত্র ষড়যন্ত্র, কান্তিমান চোয়ালটা তার
ক্রমে শক্ত হয়ে ওঠে, চোখে
ফোটে রক্তজবা, নিসর্গের কাছ থেকে বর্জ-ক’রে আনা
শান্তি ও কল্যাণ খ’সে যায়,
যেমন দেয়াল থেকে জীর্ণ পলেস্তারা। গর্জমান কণ্ঠস্বর,
কাকে কাকে করবেন বরখাস্ত, পাঠাবেন দূর বনবাসে,
ক’জনকে পুরবেন কয়েদখানায়
তালিকা প্রস্তুত
করেন অলক্ষ্যে, হাতে উঠে আসে চকচকে নলের বন্দুক
যা তিনি একটু আগে করেন নি ব্যবহার পাখির বিরুদ্ধে।।

হে নির্বোধ

হে নির্বোধ, কেন তুমি পান ক’রে ভীষণ গরল
নীলকণ্ঠ থেকে অবিরল
আগুন ঝরিয়ে ছিলে প্রহরে প্রহরে
গ্রামে ও শহরে
ময়লা গলির মোড়ে, পৌরপথে, লঞ্চ টার্মিনালে,
হাটে মাঠে? কেন আগুনের উন্দ্রজালে
আনতে নিজের কাছে টেনে
রাস্তা-উপ্‌চানো ভিড়? দূর-থেকে-আসা বেনে
বউ পাখিটাও তার উড়াল থামিয়ে
উঠতো গাছের ডালে মেতে সেই আগুনের ফুলঝুরি নিয়ে।

ইদানীং নির্জনতা করেছো চয়ন, চুপিসাড়ে
হেঁটে যাও বনের কিনারে,
নদীতীরে একা-একা আর
বারবার
কিছু চন্দ্রমল্লিকা করবী কিংবা জুঁই
ফোটাও শুধুই
ডিমের খোলের মতো মনোনীত নিজস্ব জগতে;
তোমাকে যায় না দেখা এখন সহজে পৌরপথে।

তোমার ভেতরে হোমশিখা
জ্বলুক অথবা না-ই জ্বলুক, তবুও অগ্নিটিকা
নিয়ত কপালে জ্বেলে হাটে
বিপুল ঝরাতে হবে আগুনের ফুল, নইলে মাঠে
পন্ড হবে মস্ত জনসভা,
শত শত ইট পাটকেল ফোটাবে তোমার বুকে রক্তজবা;
কেউ কেউ মাথা নত ক’রে ফিরে যাবে
ঘরে আর দক্ষযজ্ঞে তুমি সংজ্ঞাহীন নোংরা ধুলায় গড়াবে।।

Exit mobile version