শ্বেতপদ্ম
অস্ত্র নেই হাতে আর দাঁড়িয়ে রয়েছি বর্মহীন, সঙ্গীহীন,
অবেলায় সেই কবে থেকে। ছুটে আসে
সড়কি, বল্লম, ট্যাটা, ঝাঁক ঝাঁক, কখনো পাথর
আমার উদ্দেশে। কেউ লাফ
দিয়ে ঘাড়ে পড়ে, চেপে ধরে টুঁটি, কেউ
চুল টেনে হি’চড়ে হি’চড়ে
নিয়ে যায় থকথকে বর্ষার কাদায়, কাদা চেটে
খেতে বলে লাথির ভাষায়।
এ ব্যাপক আঁধিঝড়ে ডানে বাঁয়ে,
যেটুকু সম্ভব দেখি, দেখি চোখ মেলে
এলেবেলে মুখগুলি। সকলেই
খুব চেনা, অথচ কী ভীষণ অচেনা মনে হয়। কারো মুখে
ভালুকের মুখ ব’সে গেছে, কারো চোখে
হায়েনার চোখের আদল,
ডোরাকাটা জ্বলজ্বলে বাঘের প্রচ্ছদ
কারো গায়ে সাঁটা, চোখ আগুনের ভাঁটা।
থমথমে এখানে এখন আসে যদি কেউ পাবে সে দেখতে
আমার রক্তের দাগ, দেখবে রয়েছে
প’ড়ে ছেঁড়া ত্বকের মাংসের
টুকরো ইতস্তত
এবং দেখবে সেই থকথকে কাদায়, রক্তের
দাগ জুড়ে গোধূলিবেলায়
শ্বেতপদ্ম কী একাগ্র নৃত্যপর, অপরিকল্পিত,
শিশুদের খেলার বিষয়।।
সময় না শীত না গ্রীষ্ম
সময়টা না শীত না গ্রীষ্ম, শরতের বলা যায়,
সুনীল সানাই বাজে শ্বেতপদ্ম হয়ে আকাশে আকাশে।
‘এ জায়গায় শান্তি ফুটে আছে, ভেজা ঘাস, কাল
রাতে কিছু বৃষ্টি হয়েছিলো হয়তো’, ব’লে
তিনি তাকালেন দূরে পাহাড়ি টিলার দিকে দুটি
অত্যন্ত প্রসন্ন চোখে? আকন্দগাছের পাতা থেকে ফোঁটা ফোঁটা
পানি ঝরে, যেন
আনন্দের বিন্দু কিছু। মনে পড়ে তাঁর অতিদূর শৈশবের
সর্ষেখেত, মাঠে ছুটে-বেড়ানো একটি
সফেদ বাছুর, বেতফল খেতে খেতে ঘরে ফেরা
সন্ধেবেলা, ডুমুর পাতায়
জ্যোৎস্নালতা পাকা ধান খেতে-আসা বালি-হাঁসের সাঁতার।
শিকারে এসেছিলেন, আপাতত ভৃত্যের সস্নেহ হেফাজতে
বন্দুক বিশ্রামরত। পাখিদের বুক
কার্তুজে রক্তাক্ত করবার
বদলে বরং
ওদের পাখার রঙ , ময়ূরের পেখমের মতো
আসমানে ওড়াউড়ি ভালো লাগে তাঁর। অকস্মাৎ
খরগোশের দৌড় ঝোপ থেকে ঝোপান্তরে, ‘থাক থাক,
বেঁচে থাক,’ ব’লে নিসর্গের কাছ থেকে বুকভরা
শান্তিও কল্যাণ ধার ক’রে
উঠলেন তিনি
ঘাতক-বুলেট-প্রুফ ক্যাডিলাকে, পদ্যের কুসুম
ঝাঁকে আসে তার ঠোঁটে, দ্যাখেন দু’চোখ ভ’রে শত কু’ড়েঘর।
সান্ত্রীঘেরা সুরম্য ভবনে ফিরে এসে ঠান্ডা ঘরে
সোফায় সোপর্দ ক’রে নিজেকে ভাবেন
আকাশ পাতাল, টেলিফোন
বাজে ঘন ঘন, কেউ কেউ কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে
প্রবেশ করেন ঘরে, চলে আলোচনা গুরুত্বের খাপে মোড়া
নানা খাতে। কানে কানে মন্ত্র তন্ত্র ষড়যন্ত্র, কান্তিমান চোয়ালটা তার
ক্রমে শক্ত হয়ে ওঠে, চোখে
ফোটে রক্তজবা, নিসর্গের কাছ থেকে বর্জ-ক’রে আনা
শান্তি ও কল্যাণ খ’সে যায়,
যেমন দেয়াল থেকে জীর্ণ পলেস্তারা। গর্জমান কণ্ঠস্বর,
কাকে কাকে করবেন বরখাস্ত, পাঠাবেন দূর বনবাসে,
ক’জনকে পুরবেন কয়েদখানায়
তালিকা প্রস্তুত
করেন অলক্ষ্যে, হাতে উঠে আসে চকচকে নলের বন্দুক
যা তিনি একটু আগে করেন নি ব্যবহার পাখির বিরুদ্ধে।।
হে নির্বোধ
হে নির্বোধ, কেন তুমি পান ক’রে ভীষণ গরল
নীলকণ্ঠ থেকে অবিরল
আগুন ঝরিয়ে ছিলে প্রহরে প্রহরে
গ্রামে ও শহরে
ময়লা গলির মোড়ে, পৌরপথে, লঞ্চ টার্মিনালে,
হাটে মাঠে? কেন আগুনের উন্দ্রজালে
আনতে নিজের কাছে টেনে
রাস্তা-উপ্চানো ভিড়? দূর-থেকে-আসা বেনে
বউ পাখিটাও তার উড়াল থামিয়ে
উঠতো গাছের ডালে মেতে সেই আগুনের ফুলঝুরি নিয়ে।
ইদানীং নির্জনতা করেছো চয়ন, চুপিসাড়ে
হেঁটে যাও বনের কিনারে,
নদীতীরে একা-একা আর
বারবার
কিছু চন্দ্রমল্লিকা করবী কিংবা জুঁই
ফোটাও শুধুই
ডিমের খোলের মতো মনোনীত নিজস্ব জগতে;
তোমাকে যায় না দেখা এখন সহজে পৌরপথে।
তোমার ভেতরে হোমশিখা
জ্বলুক অথবা না-ই জ্বলুক, তবুও অগ্নিটিকা
নিয়ত কপালে জ্বেলে হাটে
বিপুল ঝরাতে হবে আগুনের ফুল, নইলে মাঠে
পন্ড হবে মস্ত জনসভা,
শত শত ইট পাটকেল ফোটাবে তোমার বুকে রক্তজবা;
কেউ কেউ মাথা নত ক’রে ফিরে যাবে
ঘরে আর দক্ষযজ্ঞে তুমি সংজ্ঞাহীন নোংরা ধুলায় গড়াবে।।