বাড়ি নিয়ে ঘরে ফেরা
তোমার সৌজন্যে আমি কীটস্-এর হ্যাম্পস্টীডের দোতলা বাড়ি
পেয়ে গেছি চায়ের বাটিতে। তাড়াতাড়ি
যাচ্ছিলাম চ’লে, তুমি ‘এটা তোমার জন্যেই আনা
শ্বেতদ্বীপ থেকে’ ব’লে টানা
দু’টি কালো চোখ
রাখলে আমার চোখে। ঊনবিংশ শতাব্দীর হৈমন্তী আলোক
ছিলো চোখে, এবং আমার
রক্তের ভেতরে বুলবুলি গেয়ে ওঠে, কণ্ঠে যার
যুগযুগান্তের ফুল্ল ধ্বনি। মর্মমূলে ধন্যবাদ
জানাবার সাধ
মঞ্জরিত হয়, তবু কিছুই না ব’লে ঘরে থেকে
বিকেল শরীরে মেখে চকিতে বেরিয়ে পড়ি। তীক্ষ্ম যায় ডেকে
একটা কেমন পাখি, তুমি সেই প্রফুল্ল বিকেলে
কিছু পথ হেঁটে এসে কী ভেবে আবার ফিরে গেলে
শূন্যতায় ঢেউ তুলে,
যেন কিছু কোথাও এসেছো ফেলে ভুলে।
করতলে বাদামি কাগজে মোড়া কীটস,-এর বাড়ি নিয়ে ফিরি
ঘরে একা, সিঁড়ি
বেয়ে উঠি কালের কয়েদী; সত্তাময় শেকলের শব্দহীন
ধ্বনি বাজে; আর কতদিন
এভাবে কাটবে বলো তুমি হীনতায়? যদি বনে
গিয়ে করি বসবাস, তবে কি তোমাকে পাবো নিজের গহনে?
আমাদের দু’জনের কত রাত্রিদিন কত বাস হলো গত,
অথচ তোমাকে আমি এমনকি সৌজন্যবশত
হে সুন্দরীতমা, শোনো,
আমার ভাড়াটে ফ্ল্যাটে ডাকি না কখনো।।
বেহালা
উত্থানপতনে উচ্চাবচ
এই শতাব্দীর মধ্যপাদে জ্যোৎস্না-চমকিত রাতে
খাদের কিনারে আমি একাকী দাঁড়ানো
অসহায়, সম্বলবিহীন। চেয়ে থাকি দিগন্তের
দিকে, তালগাছের মাথায়
চাঁদ, যেন বরের টোপর। ‘আনো কিছু
পাহাড়ের অন্তরাল থেকে’
ব’লে প্রার্থী হই নতজানু। কার কাছে? পলাশের
ডাল কিংবা পার্শ্ববর্তী নদী
বলে না কিছুই; হাওয়া নাচে,
ক্ষ্যাপাটে বাউল; অকস্মাৎ
ফুল নেমে আসে, নেই যার কোনো মূল।
মাটিতে কেবলি ঝরে ফুল,
সৌরভ ব্যাধির বীজ বোনে শরীরে আমার,
রৌরবের আঁচ লাগে, আরোগ্যের আশা কম জেনেও দাঁড়িয়ে
থাকি ঠায়, দম বন্ধ হয়ে আসে, তবু অস্তিত্বের
রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাজে
আকাঙ্ক্ষার সুর। দূর থেকে চ’লে আসে
হাতে মেহগনি
কাঠের বেহালা, সকলের অবহেলা
স’রে যায়, যেতে থাকে। এসো এসো ব’লে
ডাকে নানাজন।
কে দেয় আগুন ঘরে ঘরে
ঘুমন্ত প্রহরে? ঘুণ-ধরা খুঁটি পোড়ে, পুড়ে যায়
আসবাব, গ্রন্থাবলী, বিছানাপত্তর। গেরস্তের
কুকুর পালায় আর ইঁদুরের দল
মরীয়া লাফিয়ে প’ড়ে নর্দমায় এবং পুকুরে;
ডোবে, ক্ষোভে কেউ
কেউ ছেঁড়ে চুল উন্মাদের মতো। দমকাল কই?
অতঃপর আপাদমস্তক
শরীর পুড়িয়ে আমি বেহালা এবং
ছড়টিকে অক্ষত জড়িয়ে বুকে দাউদাউ আগুনের তীর
লোলুপতা থেকে চকিতে বেরিয়ে আসি। বেহালার ছড়
পারবে কি নেভাতে
আগুনের ঝড় কোনোকালে??
ভাস্কর্যই বলা যায়
ভাস্কর্যই বলা যায় এর্নেস্ত ক্রিস্তফ-গড়া প্রায়,
পার্কের কিনারে প’ড়ে আছে,
কয়েকটি দ্রোণ কাক দূরবর্তী গাছে
স্তব্ধতাকে ভীষণ কর্কশ ঠোকরায়।
ভাস্কর্যের পাশে
খুচরো ওয়সা কিছু, দরগার খইয়ের মতন
ছড়ানো ছিটোনো; লোক আসে
যায় প্রথামতো, কেউ কেউ কিছুক্ষণ
দাঁড়িয়ে সেখানে সিগারেট
ফোঁকে, ধোঁয়া ওড়ে; অনেকেই দূর থেকে দৃষ্টি দিয়ে
ছুঁয়ে চ’লে যায় ছিমছাম, কারো মুঠো ভেট
ছুঁড়ে দ্যায় ছেঁড়া কাঁথাটায়। যেন দিয়েছে নিবিয়ে
দিনের সুসভ্য আলো কেউ লহমায়
মনে হয়, যখন আমিও সে-ভাস্কর্যে খুঁজে পাই
নারীর আভাস; বুকে কী যেন লাফায়
অচিন পাখির মতো, তাড়াতাড়ি ভিড়ে মিশে যাই।
সে, ভাস্কর্য, গ্রাম ছেড়ে খুঁজেছে আশ্রয় এ-শহরে।
বন-দোয়েলের শিসে সে কি অকস্মাৎ
এখনো চমকে ওঠে? বেওয়ারিশ রাতের প্রহরে
নক্ষত্রের আকর্ষণ বোধ করে? হাত
তার অন্য কারো হাত স্পর্শ করবার
বিনম্র লাজুক কাতরতা
করে কি কখনো অনুভব? চোখ শিউলি ফোটার
অপেক্ষা থাকে? কোনো কথা
এখনো আছে কি বাকি কাউকে বলার? অতিশয়
নিশ্চুপ সে, নাক মুখ বরাবর
মাছি ভন্ভন্ করলেও তাড়াবার তাড়া নেই, লোকলাজ কিংবা ভয়
কিচ্ছু নেই, আজ খোলা পথই তার একমাত্র ঘর।
পার্কের কিনারে প্রায় ক্রিস্তফের গড়া ভাস্কর্যের প্রদর্শনী
দেখে ফুর্তিবাজ আড্ডা দিই, কফি খাই,
ফ্ল্যাটে ফিরি রাত ক’রে, খানিক সময় ব্যালকনি
থেকে তারা গুনি, কবিতার কিছু অক্ষর সাজাই
মনে মনে । হঠাৎ অক্ষরগুলো, কুলোপানা চক্করের সাপের ধরনে
ফু’সে ওঠে, ভীষণ গর্জন
করে আফ্রিকার অরণ্যের সিংহের মতন; বারবার মনে
দেয় হানা সে-ভাস্কর্য, রুক্ষ ফুটপাতে প’ড়ে-থাকা আসিরন।।
মাঘের দুপুরে
মেঘঢাকা সেই মাঘের দুপুরে
ছিলো না খেয়াল নাওয়া কি খাওয়ার।
শরীর ডুবিয়ে মেরুন সোফায়
পড়ছিলে তুমি শোপেনহাওয়ার।
অভ্যাস আর আলস্য থেকে
ছিনিয়ে নিজেকে এনেছি এখানে।
হঠাৎ তাকালে কেমন আলতো,
বললে কী যেন অবছায়া টানে।
তারপর এলো খাবারের ট্রালি;
চায়ের পেয়ালা কানায় কানায়
ভ’রে ওঠে আর হাসলে এভাবে
যে-হাসি তোমাকে নিখুঁত মানায়।
দুই জগতের মধ্যে রয়েছি,
অন্তরালের ছবি আসে যায়।
কোন্ সে জগৎ অধিক প্রকৃত-
এ নিয়ে ঈষৎ ডুবি ভাবনায়।
এ জগৎ শুধু ধারণা এবং
সংকল্পের দ্বিত্ব ভেবেই
রয়েছো মগ্ন মাঘের দুপুরে।
আমি সমাহিত নিরুক্তিতেই।
আপাতত এই হৃদয়ে আমার
ঝরে বাসনার প্রফুল্ল চেরি।
যখন তোমার চোখ পড়ে চোখে,
বলি, পড়েছো কি জন ত্র্যাশবেরী?
আমার ভেতরে জাগলো হঠাৎ
মেঘফাটা রোদ, দুর্বার ক্ষুধা।
শরীরিণি তুমি বলেছিলে হেসে-
দাঁড়াও আনছি পাবলো নেরুদা।
‘না থাক এখন বরং আমার
হাতে তুলে দাও তোমার ও-হাত,
ব’লে আমি চির নশ্বরতার
স্বরে আওড়াই সুধীন্দ্রনাথ।
দ্বন্দ্ব প্রসৃত যন্ত্রণা বাজে
হৃদয়ে আমার। কী আছে চাওয়ার?
পেঙ্গুইনের প্রচ্ছদ জুড়ে
গভীর তাকান শোপেনহাওয়ার।।