তিন যুবার গল্প
যে-গল্প আমি বলতে যাচ্ছি
সেটি উঠে এসেছে আমার শৈশবের প্রাচীন
দিঘির তল আর
অশথ গাছের সবুজের গহনতা থেকে।
এঁ-গল্পের শুরু এবং শেষ, বলা যায়,
তিনজন যুবাকে করেছিলো নিয়ে,
যারা একদা যাত্রা করেছিলো এক সঙ্গে,
কিন্তু শেষ অব্দি ওরা তিনজন
চ’লে গেল তিন দিকে তেজী ঘোড়া ছুটিয়ে,
শরীরে বিস্তর ধুলো মেখে।
তাদের যাবার ধরন অনেকটা
স্যার গ্যালাহেডের মতো, চোখে-মুখে সংকল্প রেখায়িত,
হৃদয়ে নিবেদনের দ্যুতি।
লক্ষ্য ওদের অভিন্ন, অথচ ওরা
বেছে নিলো তিনটি আলাদা পথ। এখন
যা বলছি তা আগেই
বলা উচিত ছিলো। যাত্রা শুরু হবার আগে
এক সরোবর উগরে দিলো
ওদের উদ্দেশে হীরে-খচিত তলোয়ার,
সোনালি কুঠার আর মুক্তোর ঘুঙুর-পরা
বল্লম। নির্বাচন করতে হয় নি,
নিজে থেকেই
একেকটি অস্ত্র উঠে এলো একেক জনের হাতে।
দিন যায়, রাত যায়। ওদের ঘোড়া ছুটছে তো ছুটছেই
তিন দিকের তিন পথে, যদিও
গন্তব্য তাদের অভিন্ন।
লোকজন কান পেতে থাকে, জানতে চায় ওদের
ঘোড়ার পায়ের শব্দ কেমন ক’রে
মিলিয়ে যায় দিগস্ত থেকে দিগন্তে, আর
ওরা অপেক্ষা করে সেই দিনটির জন্যে
যে-দিন বন্দী হয়ে আছে ময়দানের লোমশ মুঠোয়।
তিন পরিত্রাতার প্রত্যাবর্তনের পথে
ওরা কান পেতে রাখে।
ওদের কানে আসে মুক্তোর ঘুঙুর-পার বল্লম
ডুবে গেছে ডোবায়,
সোনালি কুঠার হারিয়ে গেছে বনবাদাড়ে,
কেবল ওদের আশার মতো হীরে-খচিত তরবারি
ধাবমান ময়দানবের রাজ্যের দিকে। সেই তরবারির
ঝল কানি লেগে অন্ধ হয়েছে
ময়দানব, হুড়মুড় ক’রে ভেঙে পড়ছে ওর মায়াপুরী।
দৃশ্য
ফ্ল্যাটের এক চিলতে ব্যালকনিতে বিকেলবেলা
রম্য সাপ্তাহিকীতে ঢেলে দিয়েছে মন
কলেজ-ফেরতা তরুণী।
ট্রাকগুলো অ্যালশেসিয়ানের মতো গজরাতে গজরাতে
ছোটে; উচ্ছিষ্টের দখল নিয়ে দিশি লড়াকু
কুকুরে কুকুরে কামড়াকামড়ি। ড্রেনের দুর্গন্ধ
বিবমিষা আনে, ডাস্টবিনের আশেপাশে কেবল গোঙায়
একটা আহত বেড়াল।
তিনি বসেছিলেন শান্তিনিকেতনী মোড়ায়
চুপচাপ, চোখ জোড়া তাঁর
পর্যটক নক্ষত্রের চন্ডীমন্ডপে। কতলোক কত
মন্ত্র জপে, কেউ কেউ তর্ক জুড়ে
গরম করে কান, কেউ-বা গলা খাদে এনে
প্রতিবাদ জানায় কোনো উক্তির,
তিনি শুধু নীরবতার ভেতরকার সূক্তি থেকে
ধ্বনি আহরণ করেন আর হঠাৎ
মেঘে মেঘে নক্ষত্রে থইথই আকাশে ভাসতে থাকেন,
যেমন দেখা যায় শাগালের ছবিতে।
সবাই হাত বাড়িয়ে ধরতে যায় তাকে, যেন
পৌষসংক্রান্তির
কাটা-ঘুড়ির দিকে
ক্রমাগত ধাবমান উৎসবলোভী এক-ভিড় বালক।।
দ্বিতীয় দৃষ্টির জাগরণ
আপাতদৃষ্টির অন্তরালে
দ্বিতীয় দৃষ্টির জাগরণ থাকে, একটি পায়ের
শব্দকে ছাপিয়ে ওঠে ভিন্ন পদধবনি। ভোরবেলা
প্রজাপতি কলমদানিতে
উড়ে এসে বসে, দূর বাগানের পলায়নপর
গোলাপের কথা
শোনাতে শোনাতে মৃত্যু দিয়ে জীবনের
একটি নিরালা ভঙ্গি নিঃশব্দে ফোটায়।
কুকুর-কান্নায় আর্ত গহন রাত্তিরে ফ্ল্যাটবাড়িতে যে-যুবা
ঝুলেছিলো ফাঁসির দড়িতে,
মনে হলো, শাগালের ছবির ধরনে
ভেসে ভেসে এলো সে আমার
ঘরের ভেতরে, দিলো বাড়িয়ে আমার দিকে হেসে
একটি ডালিম। মৃতেরা কি জীবিতের
হাতে এরকম
ফল তুলে দেয়? ওরা এরকম হাসতে
পারে অনাবিল? চার দেয়ালে ভোরের
তুলির রঙিন স্পর্শ, দেখি
করতলে ফল নয় কবিতার কিছু বীজ নিয়ে
ব’সে আছি লেখার টেবিলে।
মৃত প্রজাপতিটিকে বাজে কাগজের
ঝুড়িতে গচ্ছিত রাখি। অকস্মাৎ মিসিমার তরবারি-চেরা
পেট উদ্ভাসিত, ক্যালেন্ডার
রক্তবমি করে, রক্তচক্ষু মাল্যবিভূষিত মহিষের মুন্ড খোঁজে
বুকসেল্ফে কবিতার বই, প্রস্রাবের তীব্র কটু
গন্ধ রেখে ঘরময় চ’লে যায় লেজ নেড়ে নেড়ে,
মেঘের আড়াল থেকে উড়ন্ত বিবাগী
দরবেশ নেমে এসে পুলিশকে অস্তগামী চাঁদ
দেখিয়ে আবার
মেঘের কপাট খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন।
পারমাণবিক মেঘ ফেটে, মনে হলো,
আত্মা-দাহ-করা
তেজের ভীষণ বিকিরণ দশদিকে।
স্বপ্নে দেখি, একটি দেয়াল ধ’সে যার জরাগ্রস্ত
মানুষের মতো আর্তনাদ ক’রে, চাপা
পড়ে এক ঝাঁক কবুতর, শাদা, কালো, পীত,
বেগনি, বাদামি, স্বপ্নে দেখি
পায়রার মৃত্যু, ঘোড়াদের মৃত্যু দেখি। মৃত সব
ঘোড়ার কঙ্কাল ফুঁড়ে, পোকা মাকড়ের
দঙ্গল ছাপিয়ে সূর্যমুখী
বুকে নিয়ে সূর্যোদয় জেগে ওঠে রাশি-রাশি। স্বপ্নে দেখি,
নর্দমার গাদে
বালিকার হাত ভাসে কাগজের নৌকার ধরনে। পূর্ণিমার
চাঁদ ঝুলে থাকে স্টেনগান
দানবের চুম্বনের মতো;
পরিত্যক্ত বুটের ভেতরে ক্রমাগত কোলাহল
করে ব্যাঙ, সায়াহ্নের কর্দমাক্ত, ভগ্নকণ্ঠ ব্যাঙ; যেন কবি
অনস্তকে ঠোকরায় শুধু
দ্বিতীয় দৃষ্টির জাগরণে, ঠোকরায়, ঠোকরায়।।
পরে কোনোদিন
কী আশ্চর্য, দু’মাসও হয় নি
অথচ আবার তুমি হঠাৎ হাজির হ’লে ফ্ল্যাট-বাড়িটায়
আমার শোবার ঘরে। তোমার কি আসলে সময়জ্ঞান ব’লে
কিছু নেই? কেন তুমি এমন বাগড়া দিচ্ছো আমার কবিতা
লেখায়? এভাবে দরজায়
দাঁড়িয়ে থাকলে রক্ত-হিম-করা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে,
কেউ কি বিপুল রহস্যের ঝাঁপিময়
হিস্হিস্ শব্দ নিয়ে সাপুড়ের মতো
খেলায় থাকতে পারে মেতে? ব্যর্থ ভেঁপু খেলা শেষ
হয় নি এখনো, বারবার
তোমার দিকেই দৃষ্টি নিবব্ধ আমার। একদিন
একথা নিশ্চিত জানি, তোমার সঙ্গেই যেতে হবে
ভ্রমণে, তাব’লে আজই এই মধ্যরাতে
হানা দিতে হবে ঘরে আগে ভাগে এত্তেলা না দিয়ে?
দেখছো তো জ্যোৎস্না ফ্ল্যাট-বাড়িটাকে স্নান
করাচ্ছে সস্নেহে, যেন প্রিয় সখী কনের শরীরে প্রীতিবশে
গায়ে হলুদের দিনে ঢেলে দেয় পানি, দ্যাখো দ্যাখো,
প্রতিবেশী ছাদে
কী ডাগর ফুটে আছে গোলাপ, রজনীগন্ধা, ঐ তো
কিছুদূরে যে-আছে দাঁড়িয়ে ভোরবেলা যাকে গাছে ব’লে জানি,
এখন সে কুয়াশা ও জ্যোৎস্নার মিশ্রণে অপরূপ ব্যালেরিনা
এবং পাশের ঘরে আমার কনিষ্ঠা কন্যা ঘুমিয়ে রয়েছে,
কাল ভোরে ওর সঙ্গে কিছু
কথা বলবার আছে, প্রতিদিন সকালে চায়ের
পেয়ালার স্মৃতি ধরনে
নিরিবিলি সানন্দ চুমুক দিই, পৃথিবীতে আবীর ছড়িয়ে
পড়ার এখনো ঢের দেরি আছে। যাও,
তুমি ফিরে যাও; দেখছো তো আমার কবিতা
আধ-গড়া প্রতিমার মতো প’ড়ে আছে, বাকি আছে
এখনো অনেক কিছু। নিজের মনের মতো ক’রে
আজ অব্দি সাজানো হলো না
কিছুই; সমুদ্রে গিয়ে জলপরীদের ঠোঁট থেকে
মুক্তো আনবার কথা ছিলো,
কথা ছিলো চেনা পাকদন্ডি থেকে দূরে বহুদূরে
সম্পূর্ণ নতুন পথ কেটে
এগিয়ে যাবার, না, না কিছুই হলো না।
শোনো হে তোমার যাবতীয়
ব্যাপার-স্যাপার, সত্যি বলতে কী, বেখাম্পা ভীষণ।
তোমার নীরক্ত ঠোঁটে হাসি
ফোটে না কখনো
এবং যমজ পাথরের মতো চোখ
ভুলেও করেছে ছলছল কোনোদিন
কোনো দৃশ্য দেখে সূর্যাস্তে কি সূর্যোদয়ে,
একথা শোনে নি কেউ কস্মিনকালেও।
যদি ইচ্ছে হয় কিছুক্ষণ এই ঘরে কোনো এক খেলা খেলে
সময় কাটাতে পারো। বার্গম্যান, মনে পড়ে, তাঁর
একটি ছবিতে
তোমার এবং একজন নাইটের মধ্যে দাবা
প্রতিযোগিতার আয়োজন ক’রে
চমকে দিয়েছিলেন; কিন্তু আমি, হায়,
দাবার তুখোড় চাল দিতে কিংবা তাস
পিটতে শিখি নি, এসো শব্দ শব্দ খেলা খেলে
আজকের মতো ফিরে যাও,
পরে, আরো পরে কোনোদিন কুয়াশা ও মেঘে মিশে সঙ্গী হবো
ভ্রমণে তোমার।