খায় ফল মূল
তার কথা পড়ে নি কখনো কেউ ছাপার হরফে
গল্পে কি গাথায়।
আমি তাকে, বলা যায়, চিনতাম; কখনো সখনো
দেখতাম দূরে থেকে। অনূঢ়া যুবতী
অনেক ফুরফুরে প্রজাপতি দিয়ে গড়া উচ্ছ্বসিত
চঞ্চল শরীর তার দূরাগত বিহঙ্গের আনন্দিত গান।
অনেকের চোখের পাতায়
নাচতো সে সুখের প্রহরে আর বৃদ্ধের বরফে
স্তব্ধ হৃদয়ের তটে, শোনো,
জাগাতো ঝর্নার কলতান, যতদূর জানি তার মতিগতি
নিয়ে বলাবলি, কানাকানি চলতো অনেক আর হতো গীত
ছড়া, গান, যাতে থাকতো প্রচুর খিস্তি খেউড়ের টান।
মাঝে-মধ্যে আমাদের গ্রামে গেলে তাকে দেখি;
হয় না কখনো কথা তার সঙ্গে, ছেঁড়া ডুরে শাড়ি ভেসে ওঠে
দৃষ্টিপথে; টুক্কুনি, এটাই
তার নাম, বুঝি-বা রহস্যময়ী। লোকে বলে, দোষ তার চাই তো
সে খেতে
মাছের সালুন দিয়ে পেট পুরে ভাত। তার খোলা
কালো চুল উড়তো হাওয়ায়, কখনো সে খোঁপায় গুঁজতো রাঙা ফুল।
এ-শহরে বেঁচে থাকি আমার একান্ত লেখালে খি,
বইপত্র, ডিজেলের ধোঁয়া, পরাবাস্তবের ছবি নিয়ে, ঠোঁটে
নিয়ে স্বপ্নবীজ; মেলে ঠাঁই
বুদ্ধিজীবীদের আস্তানায়। কানে আসে টুক্কুনি মরেছে মেতে
মধ্যরাতে কাজল দিঘির রূপে দোলা
দিয়ে গাঁয়ে; তার কবরের মাটিতে পাখিরা খায় ফলমূল।।
চার কন্যার কাহিনী
এতকাল পরে অবেলায়
এমন একটি দিন আসবে জীবনে, এরকম
আশা আমি করি নি কখনো। এক ঘরে
তখনো চায়ের পেয়ালায়
দিই নি চুমুক, বিকেলের মুঙ্কুম চৌদিকে, আর
হঠাৎ চমকে দেখি ঘরের ভেতরে
কামরুল হাসানের আশ্চর্য ডাগর তিন কন্যা ঢুকে পড়ে শরীরের
গহীন গাঙের ঢেউ তুলে।
হলদে শাড়ি আমার মাথর শাদা-কালো চুলে চালায় আঙুল
লাল শাড়ি চুমুক গোলাপ
ফোটায় আমার ঠোঁটে, নীল শাড়ি সুডৌল বাহুর
অন্তরঙ্গ মুদ্রায় জড়িয়ে ধরে, যেন
ওরা তিনজন
গ্রামীণ শরম ফেলে রেখে সুদুর দিঘির
ঘাটে মেঘ মেঘালিতে উড়ে উড়ে
এসেছে শহুরে ফ্ল্যাটে এই ছোট ঘরে। কী ক’রে এখানে এসে সব
ওলোট পালট ক’রে দিলো।
অকস্মাৎ তিন কন্যা গেলো চ’লে, যেমন আকাশে
চকিতে মিলিয়ে যায় বিদ্যুল্লতা; ঘরে
রইলো প’ড়ে কাঁখের কলস, আসশ্যাওড়ার ঝোপ,
প্রগাঢ় সবুজ কলাগাছ। ঘরময় নিসর্গের
এ বর্ণালি নিয়ে কী করবো
ভাবছি যখন,
তখুনি আরেক কন্যা, বহু যুগ আগে যেন তার
সঙ্গে হয়েছিলো দেখা, ঘরে এসে ঢোকে, তাকে
গলায় পাপিয়া তার কণ্ঠ ধার দেয়,
বলে সে, দ্যাখো তো পারো কিনা
চিনতে আমাকে এতকাল পরে। তার কণ্ঠ শুনে
বুকের ভেতরে জেগে ওঠে বহুকাল
আগেকার গান
তুমি তো চতুর্থ কন্যা’ ব’লে যে-ই তার দিকে
এগোই, পেছনে স’রে গিয়ে গোধূলির
হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে যেতে বলে, ‘ভুল
কেন বলো, আমিই প্রথম’।।
ঝর্না আমার আঙুলে
স্তব্ধতাকে এতটুকু জব্দ করি নি বলা যায়
আয়নায় মুখ দেখলাম ধরি নি
কাটা-ঘুড়ি হাত বাড়িয়ে
কিছুক্ষণ দু’গালে সাবান ঘ’ষে দাড়ি
কামালাম শাওয়ার খুলে পুরোনো গান
গোসল
টলটলে পানি বালতিতে চুল আঁচড়িয়ে
জানলার বাইরে তাকাই অনেক দূর থেকে-আসা
পাখি ছাদের কার্নিশে বসে
হাওয়ার ঝলক মাঝে মাঝে পাতা খসে গাছের দুপুরের
খাওয়া শেষ কত্থক নাচের
স্মৃতির রেডিওতে নজরুল গীতি
পারফিউমের ঘ্রাণ ইলেকট্রনের উড়াল
তুমি এলে না মগজে পপি ফুলের উন্মীলন
আমার হাত ক্লান্ত ঝিমোই বেলার
হুঁশ নেই আমার হাত পরিশ্রান্ত ঢেলা যেন ক্ষুৎকাতর
মানুষ ঘুমায় পাথার
অব্যক্ত অস্পষ্ট গোঙানি
উসকোখুসকো চুল গজিয়ে-ওঠা দাড়ি
ঘন ঘাস দুপুর চড়া
নাওয়া-খাওয়া নদারৎ ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজে
আমজাদী গৎ
পাশের ঘরে খুঁটিনাটি কাজের টুংটাং
ভেতরে ফিসফিস কিসের দরজার পর্দায়
মেরুন রঙ দোল খায় প্রজাপতি
ওড়ে ঘরময় চেয়ার ছেড়ে উঠি আবার বসি
বুকের ভেতর কারখানার বয়লার
ঘোরাঘুরি ক্রমাগত পর্দা সরিয়ে
হঠাৎ তুমি নুড়ি ঠেলে বেরিয়ে-আসা ঝর্না
আমার আঙুলে।।
তার আগেই যদি
আরো দশদিন তোমার কঙ্গে আমার
দেখা হবে না। ভরা আষাঢ়ের
পুরো দশ দশটি দিন
আমার কাটবে শূন্যতায়।
আকাশে
মেঘের ভেজা কাঁথা,
মাঝে-মাঝে বিদ্যুতের জরি,
আমার ভেতরে একটা অসহায়
আশ্রয়হীন পাখি
ডেকে উঠলো বার বার, তুমি নেই।
বৃষ্টি বন্দী শহরের রাস্তায়
বেবী ট্রাক্সিতে যেতে-যেতে
ট্রাউজারে ঢাকা আমার উরুতে আঙুল
বুলিয়ে তুমি জাগিয়ে দিচ্ছিলে
বিসমিল্লা খানের মানাই।
আলিঙ্গন আর চুম্বনের আশ্বাস
আমার সত্তায় ছড়িয়ে বলেছিলে-
দশদিন পরে আবার দেখা হবে আমাদের।
বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছিলো
তোমার মুখে;
গ্রীক পুরাণের কোনো দেবীর ধরনে
তুমি মুছে নিচ্ছিলে
পানির বিন্দু সমুদয়,
দেখছিলাম মুগ্ধাবেশে।
হঠাৎ মধ্য দুপুরে নেমেছিলো
দৃষ্টি ঝাপ্সা ক’রে দেয়া বৃষ্টি।
আমরা দু’জন
এমন ঘন ঘোর বর্ষায়
দোকানপাট আর
মানুষের ভিড়ে আট্কা প’ড়ে
হাঁসফাঁস; বৃষ্টি আর দরস্ত
তাতারী হাওয়া,
পথঘাট ঘোলা জলে সরলাব।
একটু পরেই
বেবী ট্যাক্সি, যেন একটা জলচয় পাখি
থমকে দাঁড়ালো ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে।
আরো দশদিন তোমাকে দেখবো না,
কী দীর্ঘ আর অন্তহীন এই সময়। ভাবলেই
মৃত্যু তার ঠান্ডা হাত বাড়াতে থাকে
আমার হৃৎপিন্ডের দিকে। কী ভাবে,
কোন্ জাদু বলে
পার হবো তুমিহীনতার মরুভূমি? আমার
অস্তিত্ব কি ঝল্সে যাবে না
সূর্যের ক্ষমাহীন উত্তাপে?
মরু শেয়ালেরা কি খর জিহ্বায়
ভীষণ চেটে চেটে
নিশ্চিহ্ন ক’রে ফেলবে না
আমার মাংসের দেয়াল?
তোমাকে না দেখে, তোমার কণ্ঠস্বর না শুনে
তোমাকে একবারও না ছুঁয়ে
কী ক’রে কাটবে আমার সময়?
কবিতা লেখা আর না লেখার
কানামাছি খেলায় কি
ভেসে যাবে দিনগুলি, রাতগুলি? যখন ঘুম থেকে
জেগে উঠবো ভোরবেলা কি সোনায়
মূড়ে দিতে পারবে
আমার আকাঙ্ক্ষার মুকুলগুলোকে?
যখন কিছুতেই ঘুমোতে পারবো না,
রাত্রি কি পারবে আমার সময়কে
সাজিয়ে দিতে
স্বপ্নের পাপড়িতে? কী ক’রে সইবো
আসন্ন বিচ্ছেদের স্বৈরাচার?
কেন এমন হয় না যে রোজ তোমাকে দেখতে পাবো
অন্তত একবার?
যত ক্ষণস্থায়ী হোক সেই সাক্ষাৎ
ক্ষতি নেই; প্রত্যহ তোমাকে এক ঝলক
দেখে নেবার পর,
তোমার হাত আর চুল নিয়ে
কিছুক্ষণ খেলা করার পর, ওষ্ঠে
তোমার চুম্বনের
প্রসাদ নেবার পর
মেনে নেবো পৃথিবীর যে কোনো রুক্ষতা, বিরুনতা।
প্রতি মুহূর্তে তোমার কাছেই আমার যাওয়া,
অথচ চৌদিকে উঁচানো বাধার সঙিন,
প্রহরীদের চাবুকের সপাং সপাং।
বন্দী, তৃষ্ণার্ত বেনহুরের মুখ থেকে
যেমন অত্যাচারীরা পানপাত্র সরিয়ে
নিয়ে গিয়েছিলো চরম তাচ্ছিল্যে, তেমনি কেউ কেউ
আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে চায়
তোমার সান্নিধ্য থেকে। ওদের ক্রোধ আর হিংসা
আমার সত্তার মাটি খুঁড়তে থাকে
লাশসন্ধানী কুকুরের মতো।
যদি ওরা তোমার আমার মধ্যে কাঁটা
বিছিয়ে রাখে, সেই বিষাক্ত কাঁটাকে ফুল ভেবে
হেঁটে যাবো তোমার দিকে। যদি ওরা
আমার হাতে হাতকড়া আর পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেয়,
আমি সেই নিষ্ঠুর বন্ধনের উৎপীড়ন
উপেক্ষা ক’রে যাত্রা করবো
তোমার উদ্দেশে আর
লোহার শেকল ঝন্ঝনিয়ে
গেয়ে উঠবে ভালোবাসার গান,
ভালোবাসা রক্তগোলাপের মতো উন্মীলিত আমার বুকে।
দশদিন পর তোমার সঙ্গে আমার দেখা
হবার কথা। আজ থেকে দশদিন পর।
সেই কাঙ্ক্ষিত দিনের প্রতীক্ষার করাত
আমাকে কেটে চলেছে মুহূর্তে মুহূর্তে। শুধু
তোমাকে দেখার জন্যে, দুশো চল্লিশ ঘন্টার পর
শিরায় শিরায় তোমার দৃষ্টির সম্মোহন
অনুভব করার জন্যে বেঁচে আছি।
কিন্তু তার আগেই যদি মৃত্যু
নাছোড় পাওনাদারের মতো এসে দাঁড়ায়
আমার দোরগোড়ায়, তবে কী হবে?
৬,৭,৮৮