- বইয়ের নামঃ ঝর্ণা আমার আঙুলে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অধিক একাকী
ঝর ঝর ঝর
এক নাগাড়ে একটানা বর্ষণের পর
সৌভাগ্যবশত কচি রোদ্দুর ছড়ানো ভোরবেলা
কোত্থেকে এসেছে এই পাখি,
নিজেকেই প্রশ্ন করি। ফ্ল্যাটের বারান্দাটায় তাকে
কীভাবে আটকে রাখি ভাবি।
একা-একা পাখিটা দিয়েছে জুড়ে খেলা;
কিছুই না ক’রে কিছুক্ষণ খুব চুপচাপ থাকি।
আমাতে কী যেন ছেয়ে থাকে
পাথরের চতুর্দিকে-ঘেরা গুঢ় রহস্যের মতো। পাখিটাকে কী যে দাবি
আমার নিকট, বোঝা দায়।
ছড়িয়ে নিজস্ব রঙ খেলা করে, নেই কোনো গান
আপাতত কণ্ঠে তার। খানিক খাবার পেতে চায়,
হতে পারে, কিংবা চায় ঈষৎ তৃষ্ণার অবসান।
পারবো কি ধরতে ওকে? যাবে না খাঁচায় তাকে পোরা
কোনোদিন থাক যতক্ষণ
ইচ্ছে ওর এই বারান্দায় থাক বন্ধ ক’রে ওড়া।
মন, ওরে, মন
যদি আমি গম কিংবা ছোলার সন্ধানে গিয়ে ফিরে
আসি, হয়তো দেখবো সে উড়ে
চ’লে গেছে দূরে, অন্ধকারময় দূরে।
নড়ি না চেয়ার থেকে; অকস্মাৎ সেই পাখি
স্তব্ধতার অন্তর্বাস ছিঁড়ে
শিস দিয়ে অন্তর্হিত; ঘরে ব’সে হয়ে যাই অধিক একাকী।।
আমার আয়েশা ফুফু
হঠাৎ কোনো কোনোদিন দুপুরবেলা
কিংবা সুপুরিগাছে ক্রীড়াপরায়ণ রোদের
বিকেলে আমার আয়েশা ফুফুর কথা
মনে পড়ে। কপাল ভেঙে ছিলো তাঁর
যৌবনের উষায়, তারপর আর কস্মিনকালেও
হাতে মেহেদির ছোপ লাগে নি।
থাকতেন তিনি পল্লীর প্রান্ত-সীমায়
বড় একলা ঘরে। কখনো কখনো
তাঁকে দেখা যেতে কুয়োতলায়, কখনো-বা
বাঁশঝাড়ে দাঁড়িয়ে ঘোমটার
অন্তরাল থেকে কি-যেন দেখতেন, দূর আসমানেও
খেতের আলের মতো কিছু আছে কিনা
ভাবতে চাইতেন আমার আয়েশা ফুফু।
এতকাল পরে আজও যখন দেশবাড়িতে যাই, আয়েশা ফুফুর
বাড়ির সামনে দাঁড়াই ভেতরে ডাকে,
ভাবি তিনি, আমার আয়েশা ফুফু,
এক্ষুণি বেরিয়ে আসবেন শাদা গোলাপ-শাড়িটার
আঁচল সামলাতে সামলাতে, চকিতে নাকে
এসে লাগে কবেকার সেমাইয়ের ঘ্রাণ।
এমন খাঁ খাঁ কোনো জায়গা আছে কি কোথাও? এই প্রশ্ন
আমাকে অসীম শূন্যময় সেখান থেকে
দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়,
কোথাও আমি আমার আয়েশা ফুফুকে দেখি না।
মেঘে মেঘে অনেক বেলা হলো। এখনও যখন
গোধূলিতে হঠাৎ আকাশের মুখ কালো হয়ে যায়
মেঘের জটলায়, বৃষ্টি নামে শহর ডুবিয়ে,
অথবা রাতে ঝিল্লীর স্বরে
কিছুতেই ঘুম আসে না, তাকাই শূন্য সুরাইয়ের দিকে,
যখন কান্নায়
ভেঙে পড়ে কোনো পাখি, তখন
আমার আয়েশা ফুফুর বনশিউলি আর
জলবিছুটির গন্ধকোমল মুখ মনে পড়ে।।
আমার পিতার গ্রামে
(একটি প্রাচীন উপকথা মনে রেখে)
আমার পিতার গ্রামে কোনো পাখি শিকারের লোভে
কখনো যাই নি;
যদিও পিতার ছিলো সাওতালি রমনীর গায়ের রঙের
মতো চকচকে এক দোনলা বন্ধুক, তবু আমি
ওর প্রতি কোনোদিন আকর্ষণ বোধ
করেছি, এ-কথা বলা যাবে না; অবিশ্যি মাঝে মাঝে
যখন বন্দুকটিকে পিতা করতেন পরিষ্কার,
সে-দৃশ্য দেখেছি দূর থেকে, মনে পড়ে।
তবু কেন কখনো-সখনো মনে হয় হাতে নিয়ে
পুরানো বন্দুক ঘুরে বেড়াই একাকী
আমার পিতার গ্রামে বিলের কিনারে
বেলা অবেলায়, কেন? পানকৌড়ি, জলপিপি আর
মাছরাঙা চোখে পড়ে, বেলেহাঁস নেমে
আসে পাকা ধানের সুগন্ধে। কিন্তু আমি ভারি না কার্তুজ
বন্দুকে কস্মিনকালে, শুধু পাখিদের দেখে দেখে
কাটে বেলা, সূর্যের উনুন
ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে এলে শুই ঘাসে আর পাশে
ঘুমায় বন্দুক নিরিবিলি।
আমাকে দখল করে আচ্ছন্নতা, অকস্মাৎ চোখ
মেলে দেখি বন্দুক ধনুক হয়ে শুয়ে আছে, আমার শরীরে
যুগল কম্বল;
একজন রাজহংসী তার পালকসমেত
গায়ের চামড়াটাকে তারে গোপনে গচ্ছিত রেখে
রমনীর রূপে কাটে সাঁতার বিলের কালো জলে,
তার শরীরের আলোড়নে পানি আনন্দকণার মতো ঝরে
সন্ধেবেলা। আমি তার গায়ের চামড়াটাকে অতি সন্তর্পণে
কোথাও লুকিয়ে রাখি। রূপসী সে নারী
তীরে এসে পালকসমেত ওর গায়ের চামড়া খোঁজে এদিক ওদিক।
বিবাহ বাসরে যাবে এই প্রতিশ্রুতি সঠিক আদায় ক’রে
ফিরিয়ে দিলাম তার পালক-সম্পদ। চুপিসাড়ে
সে আমার পেছনে পেছনে আসে, আমি
তাকে নিয়ে যাই
মাথায় পালক-গোঁজা আমার পিতার সামনে, তাঁর চোখে
অনু মোদনের তারা নেচে ওঠে। আমাদের বিয়ে উপলক্ষে
পিতা দেন জেয়াফত, লোক আসে দলে দলে। ঘর
করি বহুদূর-থেকে-আসা
অলৌকিক রূপসীর সঙ্গে। একদিন
হঠাৎ দুর্ভিক্ষ নামে শত ডাকিনীর খটখটে হাসি আর
ঝাঁক-ঝাঁক শকুনের ছায়ার ধরনে
আমার পিতার গ্রামে। আমার সুন্দরী অপয়ার অপবাদ
নিয়ে অপমানে, ক্ষোভে প্রতিবাদহীন
একদিন গোধূলিবেলায়
পুনরায় রাজহংসী হয়ে উড়ে যায় লাল মেঘে।
তার অন্তর্ধানে
আমার হৃদয় হয় বিধুর বিলাপ;
আমি সেই রাজহংসীটির খোঁজে ঘুরি সারাক্ষণ
বিলের কিনারে বন বাদাড়ে, পাহাড়ে;
লোকালয় ছেড়ে দূরে বহুদূরে চ’লে যাই। কেমন অদ্ভুত
প্রাণীদের সাহায্য করার বিনিময়ে
কেবলি প্রার্থনা করি আমার হারিয়ে-যাওয়া সেই
রাজহংসীটির ঠিকানার খোঁজ। একে একে ওরা
সবাই আমাকে বলে দেয় কোন্ পথে গেলে
পাবো তাকে ফের। ইঁদুরের চামড়ার ভেতরে ঢুকে
খুঁজি তাকে অবিরাম প্রান্তরে, পাহাড়ে;
বুড়ো ঈগলের পরামর্শ ছাড়া খোঁজ পাওয়া ছিলো না সম্ভব।
আখেরে পেলাম তাকে সুদূর আশ্চর্য দেশে ওর
গোত্রের ভেতরে
এবং আমাকে দেখে সমগ্র সত্তায় তার স্মৃতি
স্ফুরিত পালক হয়ে দ্রুত জেগে ওঠে;
আমার পিতার গ্রাম, জলাশয়, লতাগুল্ম, গুগলি শালুক
এবং আমার প্রেম উদ্ভাসিত তার চিদাকাশে।
গোত্রপতি হংসরাজ, ওর পিতা, আমাকে নিলেন
সাদরে বরণ ক’রে, নির্ধারিত হলো ঘর
আমাদের দু’জনার। দিন যায়, রাত কাটে, এবং ক্রমশ
বছর গড়িয়ে যায় ঝর্নার নুড়ির
মতো; অলৌকিক এলাকায় ক্লান্ত হয়ে অবশেষে বিদায়ের
প্রার্থনা জানাই। গোত্রপতি
আমাকে ডানার অন্তরালে বয়ে নিয়ে
যাবার উদ্দেশ্যে হল্দে অপরাহ্নে এক বায়সকে
দিলেন নির্দেশ।
দাঁড়কাক আমাকে নির্বিঘে। বয়ে নিয়ে দিলো ছুঁড়ে
শূন্য চরে আর আমি বেলাশেষে চখা হয়ে উড়ি,
ঘুরি চক্রাকারে আর আমার চিৎকার ক্রমাগত
ছিঁড়ে যায় স্তব্ধতার বেবাক বাকল।
উড়ে উড়ে চখা ঢোকে আমার ভেতরে সাবলীল;
স্মৃতির দেয়ালি জ্বলে এবং আমাকে
ঘিরে থাকে কবেকার হাহাকার। দূর থেকে দেখি
আমার পিতার গ্রাম অতিশয় প্রবীণ আঁধারে,
অনন্তের উৎস থেকে উঠে-আসা প্রবল হাওয়ার
কম্পমান নিভু-নিভু দীপ।।