Site icon BnBoi.Com

ছায়াগণের সঙ্গে কিছুক্ষণ – শামসুর রাহমান

ছায়াগণের সঙ্গে কিছুক্ষণ - শামসুর রাহমান

অনঙ্গ বাউল

একজন বাউলের গান আমাকে দু’টুকরো করে
বিকেলের গৈরিক আলোয়- এক টুকরো প’ড়ে থাকে
বাস্তবের ধূসর মাটিতে, এক খণ্ড আসমানি
হাটে খুঁজে ফেরে তন্ন তন্ন ক’রে হারানো মানিক।

নক্ষত্রের করিডর দিয়ে হেঁটে যাই, নীলিমার
রেণু সমুদয় গায়ে লাগে এবং আমাকে করে
আলিঙ্গন উদার সপ্তর্ষি। কামিজের খুঁটে লাগে
টান, আর আমার বিবাগী অংশ মর্ত্যে নেমে আসে।

চাঁড়ালের দল কবিতার আর দর্শনের বই
পোড়ায় হুল্লোড় ক’রে, সারা গায়ে মাখে ভস্মরাশি,
শোণিত-তৃষ্ণায় উন্মাদের মতো ছোটে দিগ্ধিদিক।
প্রশান্ত নদীর কাছে, বৃক্ষের নিকট প্রজ্ঞা ভিক্ষা
চাই, পাখি দেখি আর ছিন্ন মস্তক এ রুদ্র কালে
গান বাঁধে আমার ভেতরকার অনঙ্গ বাউল।
১২/৮/৯৩

অনন্য উৎসব

কখনো কখনো কারো কারো চোখে থাকে খুব ঘোর;
বিশেষত দর্পণের সম্মুখে দাঁড়ালে কান্তিমান যুবা আর
রূপসী তরুণী বশীভূত হয় দর্পের এবং
তারা ভুলে যায় সময়ের আবর্তনে
দর্পণ দর্পেরই গোর। যে যুবক সুখে
প্রত্যহ কামায় দাড়ি, মুখ ধোয়া সুগন্ধি সাবানে,
গুন গুন গান গায়, ঘন চুলে চালায় চিরুনি
দর্পণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে, প্রীত হয় ক্ষণে ক্ষণে,
ভাবীকালে সে-ই একদিন
একটি বিরলকেশ মাথা, হৃতকান্তি, লোলচর্ম
মুখ দেখে আঁৎকে ওঠে। ভয় তাকে হঠাৎ গ্রেপ্তার
ক’রে ফেলে। দর্পণকে যৌবনের করুণ কবর
ভেবে স’রে আসে, মুখ ঢাকে মনস্তাপে।

অথচ যখন তার জন্মদিনে যৌবনের ঝলকের মতো
তাজা রোদ বেজে ওঠে কবিতার ধূসর খাতায়,
জীবনের শেষ বাঁকে এসে দ্যাখে
সে এক অতুলনীয়া নারী তাকে হৃদয়ের বাণী
বাজিয়ে বরণ করে, তখন বয়েসী জন্মদিন
অপরূপ তরুণ দেয়ালি, বেঁচে থাকা এক অনন্য উৎসব।
৯১/৯/৯৫

অভয়াশ্রমের দিকে

তোমার নিকট থেকে দূরে চলে গিয়ে আরো বেশি
কাছে চলে এসেছি সুপ্রিয়া। আজ এইখানে এই
সরাইখানায় বড় একা-একা সংগীতবিহীন শুয়ে থাকি,
ব’সে ভাবি, পায়চারি করি রাজবন্দীর ধরনে।

শোনা যায় কোলাহল আর বন্য পশুর হুঙ্কার,
মাঝে মাঝে আর্তরব। অসহায় তাকাই দেয়ালে,
যেখানে সম্পূর্ণ তুমি প্রস্ফুটিত; কাছে গিয়ে মুখ
প্রগাঢ় চুম্বন করি, স্তনে রাখি হাত। মনে হয়
স্বপ্নের গভীর নাভিমূলে স্থাপিত আমার ওষ্ঠ।
তবে কি এখন শুধু স্বপ্নের সঙ্গেই সহবাস?

যখন আঁধার ব্যেপে আসে কংক্রিটের মহারণ্যে,
হতাশা পাতালে ঠেলে দেয় আমাকে হ্যাঁচকা টানে;
লালনের মতো কেউ উদাসী হাওয়ার গান গেয়ে
জপান তোমারই নাম পরবাসে। ছলছল করে
স্বচ্ছ জল হৃদয়ের কানায় কানায়। ইন্তেজারি
প্রহরে প্রহরে; আমরা তো সব স্বপ্নেরই সন্তান।

স্বপ্নের চাতাল চুরমার হয়ে গেলে ঝাঁপ দিই
জ্যোৎস্নাচমকিত সরোবরে, শরীরে পানির ফোঁটা
নিয়ে খুব আস্তে সুস্থে ওপারে মসৃণ উঠে পড়ি,
সর্বব্যাপী প্রেমহীনতায় তোমার সোনালী হাত
ধ’রে এক অভয়াশ্রমের দিকে স্বপ্নের ভেতরে
হাঁটি, যাকে লোকে ভালোবাসা ব’লে সুখ্যাত করেছে।

অসাধারণ

(আবুল হাশেমকে)
অসাধারণ বাক্তিদের দেখলে লোকজন কেমন
মুগ্ধ তাকিয়ে থাকে। যারা
অসাধারণ তাদের চলনে বলনে সাধারণ মানুষ
কখনো চমক কখনো মহিমা
খুঁজে পায়। তাদের উপমা ওরা সন্ধান করে
সমুদ্র অথবা আকাশে।
ভাবে, আহা, কী মহৎ তাদের হৃদয়,
কী ঐশ্বর্যময় তাদের চিন্তা-ভাবনা। ধন্য ধন্য ব’লে ওরা
চৌদিকে গুলজার ক’রে তোলে, মনে
বানিয়ে নেয় অনিন্দ্য মূর্তি।

অথচ এই অসাধারণ ব্যক্তিদের কারো কারো মন
এঁদো ডোবা, যেখানে মশা আর
নানা ধরনের কীটের আস্তানা, তাদের সংকীর্ণতার চাপে
সুন্দরের নাভিশ্বাস ওঠে, পশ্চাৎপদ
চিন্তার আবর্তে ঘুরপাক খায় অনেকের জীবন,
তাদের নীচতায় মুখ ঢেকে ফেলে নিম্ন মানের মানুষও।

যারা অতি সাধারণ, যাদের কেউ লক্ষই করে না,
যাদের মুখে ফোটে না
কোনো চমক-লাগানো কথা, যাদের সত্তায় আঁটা
নেই অসাধারণত্বের লেবেল,
তাদের কারো কারো মনের ভেতর আছে
উদার আকাশ, অতল সমুদ্র। তাদের ছায়াকে
প্রণতি জানায় দোয়েল, জোনাকি, পূর্ণিমা
এবং গুচ্ছ গুচ্ছ কনকচাঁপা।
২৯/১১/৯৫

অস্বীকৃত তোমার মৃত্যু

পথ ছিল জলশূন্য, সুনসান, ছায়ারা
চেটে নিচ্ছিল ধুলো, বৃক্ষেরা নির্বাক,
অথচ কাহিনী বর্ণনায় উন্মুখ। একা তুমি
অনেক দূর হেঁটে এসে
দাঁড়ালে পথের মোড়ে। তোমার পদ চুম্বন করল
ঝরা পাতা, ফুলের পাপড়ি, রৌদ্রধারা।

কী ছিল তোমার আহ্বানে,
কোন্‌ সেই ইন্দ্রজাল,
জানা ছিল না।
দেখতে-দেখতে বিরান পথ
হ’য়ে ওঠে জনবহুল। সবার মুখ
তোমারই দিকে উন্মীলিত সূর্যমুখী।

কাতারে কাতারে দাঁড়ালাম আমরা,
সজীব বসন্ত অভিবাদন
জানালো আমাদের ইতিহাস
তোমার ইঙ্গিতে নতুন বাঁক নিলো,
আমরা মুগ্ধ চোখে দেখি,
বহু যুগের বন্ধ দরজা যায় খুলে।

হঠাৎ এক খন্ড কালো মেঘ
ঠাণ্ডা হিংস্রতায় ঢেকে ফেলে তোমাকে।
তোমার নিষ্প্রাণ দেহের সামনে শোকার্ত হৃদয়ে
আমরা দাঁড়ালাম নত মাথায়,
তোমাকে অর্পণ করলাম
ফুলের স্তবক আর প্রতিশ্রুতি।

মনে পড়ল আলোর ঝর্নার মতো
তোমার অঙ্গীকার,
বিদ্যুতের মতো তোমার শপথ,
অন্ধকার রাতে পূর্ণিমার মতো
তোমার বরাভয়।
শোকের মুহূর্তের স্পন্দিত বুকে ধ্বনিত বিজয়-গান।

অস্বীকৃত তোমার মৃত্যু বাংলার মানুষের কাছে;
কেননা, তারা জানে তুমি বেঁচে থাকবে
বসন্তের ফুলসম্ভারে,
তুমি বেঁচে থাকবে তাদের শপথ উচ্চারণে,
তুমি বেঁচে থাকবে মানবিক ভালাবাসায়,
তুমি বেঁচে থাকবে কবির নাক্ষত্রিক পঙ্‌ক্তিমালায়।
১৮/৭/৯৫

 আগুন রঙের বাঘ

তোমাকে কি বলিনি মানবী, দিনভর রাতভর
আগুন রঙের এক বাঘ খুব ঘোরাঘুরি করে
আমার স্বপ্নের সীমানায়, বাস্তবের আস্তানায়?
দুচোখ ঝলসে দিয়ে সে আমাকে কী হিংস্র শাসায়-
‘যতই সতর্ক তুই থাকিস না কেন ব্যুহ তৈরি
ক’রে তোর চতুর্দিকে, শেষে গিলে খাবো, জেনে রাখ।‘

তোমাকে জানাই, শোনো, একদিন মধ্যরাতে সেই
বাঘ এসে আমার স্বপ্নের ঘাড় মটকে দাঁড়ায়
শয্যা পাশে; ওর তাপ আমার শরীর তপ্ত সোনা
ঢেলে দেয় যেন, ধড়ফড় জেগে উঠি, চেয়ে থাকি
দারুবৎ; বাঘ বলে ‘যতদিন তুই স্বপ্ন দেখে
যাবি, শোন্‌ ততদিন তোকে আমি পারব না খেতে।‘

একদিন গোধূলি বেলায় আমি কবিতা লেখায়
নিমগ্ন ছিলাম, অকস্মাৎ ব্যাঘ্র-গন্ধে হুঁশ হয়।
ভাঁটা-চোখ কথা বলে, ‘আজো আমাকে নিষ্ফল ফিরে
যেতে হবে। কবি তুই, চিত্রকল্প, ছন্দের কম্পন
তোকে রাখে টান টান, যতদিন তোর শব্দপ্রেম
থাকবে অটুট, তুই হবি না আহার্য এ বাঘের।

একদিন ভোরবেলা আমার চৌকাঠে দেখি, সেই
বাঘ ব’সে আছে, সে মুহূর্তে আমি তোমার মুখের,
চোখের বুকের কথা ভেবে প্রেমের অর্চনা সেরে নিয়ে
লেখার টেবিলে লগ্ন ছিলাম একাকী। বাঘ বলে
আমার উদ্দেশে, ‘যতদিন তোর বুকে মানবীর, মানবের
ভালবাসা থাকবে, আমাকে ব্যর্থ ফিরে যেতে হবে।

হে মানবী, বলো, এই আগুন রঙের বাঘটিকে
বার বার ক’রে রুখর দিনভর রাতভর?
২৪/৮/৯৫

 আজকাল

আমার ভেতরে কোনো জ্বলজ্বলে বাঘ অকস্মাৎ
অগোচরে ঢুকে পড়েছে কি? নইলে কেন আজকাল
এত গর গর করি? পান থেকে চুন খসলেই
মেজাজ বিগড়ে যায়, মুড়ি-মুড়কির এক দর
দেখেও নিশ্চুপ থাকা মুশকিল; সন্ত্রাসীর ডেরা
ক্রমশ উজ্জ্বল হ’লে ভদ্দরলোকের সমাগমে
আমার মাথায় খুন চেপে যায়, নষ্ট হয় চোখ।
এমনকি, তাকে ভিড়ে দেখলেও গর্জে উঠি খুব।
এখন অসুস্থ আমি, তা ব’লে কিছুই থামবে না।
জমবে বাজার হাট, বইমেলা; সিনেমায় ভিড়
কেবলি বাড়বে আর বন্ধুরা আড্ডায় ফুকো আর
দেরিদাতে নিয়ে মেতে থাকবে কফির পেয়ালায়;
সে-ও যাকে ভালোবাসি, যাবে হেসে বিদেশ ভ্রমণে।
আজকাল নিজের উপরই সর্বক্ষণ রেগে যাই।
১৯/২/৯৫

আমরা দুজন হাঁটি একসঙ্গে

মাঝে মধ্যে আমরা দু’জন হাঁটি একসঙ্গে পথে, ফুটপাথে,
কখনো বা ভিড়ে হাঁটি, তোমার শাড়িতে
থাকে না ঘুমের ঘোর, বাজে জলতরঙ্গ এবং
অন্তর্বাসে কণিকার সুরের লহরী;
আমার ধূসর ট্রাউজারে গীটারের ধ্বনি আর
শার্টে দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠসুর।

আমরা দুজন হাঁটি মেঘে, ফুসফুস ভরে যায়
রঙিন হাওয়ায়, টুক্‌রো টুক্‌রো মেঘ মাথার ভেতর
জমা হয়, চাঁদের রূপালি নায়ে ব’সে
চৌদিকে বেড়াই ভেসে, সপ্তর্ষিমণ্ডল ছুঁই, কালপুরুষের সঙ্গে প্রীত
হ্যাণ্ডশেক করি, নেমে যাই ছায়াপথে
আসমানী রেস্তোরাঁর খোঁজে।

আমরা দুজন নক্ষত্রের সিঁড়ি বেয়ে ওঠে যাই,
কিয়দ্দূরে প্রবালে বানানো এক নিখুঁত রেস্তোরাঁ
চোখে পড়ে শূন্যের মাঝার, ঢুকে দেখি
জ্যোৎস্নালোকে কবিতা চিবিয়ে খাচ্ছে কজন বুর্বক
আর বনহংসীর মতন ওয়েট্রেস
সাজাচ্ছে টেবিল অনাগত গ্রাহকের প্রত্যাশায়।

আমরা দুজন বসি মুখোমুখি একটি টেবিলে
এক কোণে, হাঁসের পালক-মেনু হাতে নিয়ে তুমি
খেলছিলে, অকস্মাৎ কী প্রবল হাওয়া এসে করে
লণ্ডভণ্ড সব কিছু, আমরা দুজন অতি দ্রুত
দুদিকে ছিটকে পড়ি। আমাকে দীঘল ঘাস ঢেকে ফেলে,
দেখি অতিকায় কোলা ব্যাঙ হয়ে পড়ে আছি ঘরে
তাল তাল কাদার ভেতর, ফের একটি সোনালী হাত আস্তে
টেনে তোলে আমাকে, নিবিষ্ট চিত্তে কবিতা লিখতে ব’সে যাই।
২৮/১২/৯৫

আমাকে এখন থেকে

আমাকে এখন থেকে আরেকটু বেশি, আরেকটু
ভালো করে দেখে নাও। কতটা বিবর্ণ হয়ে কত
ক্ষয়ে গেছি, চামড়া কুঁচকে গ্যাছে কত,
কত চুল হলো লীন দূরের হাওয়ায়,
কেমন স্খলিত দাঁত, আমার নিভৃত
দৃষ্টিশক্তি কত শোচনীয় ক্ষীণ আজ ভালো করে দেখে নাও।

বিত্ত নেই, উপরন্তু ধারদেনা আছে কিছু, নিবাসও বন্ধক,
প্রদর্শনযোগ্য কিছু নেই, আছে শুধু
কতিপয় কাব্যগ্রন্থ, বস্তুত যাদের
কানাকড়ি মূল্য নেই অনেকের কাছে। কেউ বইগুলি
পুড়িয়ে উৎসবে মেতে উঠতে উৎসুক অতিশয়;
এরকম পুঁজিহীন কেটে যাবে বেলা পুঁজিতান্ত্রিক সময়ে।

একটি তস্কর আছে খুব কাছে চোখের আড়ালে,
আমাকেই চুরি করবার অব্যর্থ চেষ্টায় আর
আমি বসে থাকি অসহায়। কবিতার
একটি কি দুটি পংক্তি গাছের পাতার মতো
নড়ে ওঠে, বেজে চলে নর্তকীর নূপুর যেমন।
মাঝে মাঝে চিত্রকল্প সৃষ্টি হয় অবচেতনের
গহন আঁধার স্তর ফুঁড়ে। তদুপরি
একটি সোনালি মুখ জেগে থাকে হৃদয়ের নিভৃত জ্যোৎস্নায়।

আমাকে এখন থেকে আরেকটু বেশি, আরেকটু
ভালো ক’রে দেখে নাও। এই যে হাঁটছি
এখনো গলিতে, যাচ্ছি গায়ে
পাঞ্জাবি চাপিয়ে কবিদের সভায় এবং কথা
বলছি সোফার ব’সে, গিলছি আগুন
ঘন ঘন, বমি করে ফেলে দিই রক্তমণি, সীসা-
এই সব দেখতে পাবে না;
আমি তো অধিককাল থাকব না আর, চলে যাব খুব একা।
৮/৪/৯৫

আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি

আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি চন্দ্রালোকে হামাগুড়ি দিয়ে
আস্তাবলে ঢুকে খড়বিচুলি চিবোয়, মাথা কোটে
কী অন্ধ আক্রোশে। ঠেলাগাড়িটিতে আমার স্বপ্নেরা
স্তূপ স্তূপ ময়লা কাপড় শুধু; ভাবনারা ডানা
পেয়েও আকাশে কিছু পাক খেয়ে পড়ে গলিতেই,
ওদের নিমেষে গিলে ফ্যালে আবর্জনা। মাঝে মাঝে
তুমি এসে দ্যাখো রোগশয্যায় একাকী পড়ে আছি।
বুঝি বা কাফন তৈরি; মৃত্যু দ্রুত লিখছে রসিদ।

ঈষৎ ঘাবড়ে গিয়ে তুমি আমার কপালে হাত
রাখো, স্পর্শ করো বুক, বলো, ‘জাগো, জেগে ওঠো কবি,
এই তো এসেছি আমি। আমার নিষ্প্রভ দু’টি চোখ
অস্পষ্ট তোমাকে দেখে আরো বেশি আলোপ্রার্থী হয়;
আবার জীবনানন্দে মেতে ক্ষীণ কণ্ঠে প্রশ্ন করি-
‘বিদেশ ভ্রমণ থেকে কবে ফিরে এলে রাজেন্দাণী ?
২৫/২/৯৫

আমার চোখের জ্যোতি

আমার চোখের জ্যোতি এখনো যায়নি পুরোপুরি
নিভে, কিন্তু ঘোর অমাবস্যার আভাস কী ভীষণ
গাঢ় হচ্ছে ক্রমাগত। সূর্যোদয়, পূর্ণচন্দ্র, বন,
নক্ষত্রের মেলা সবই মনে হবে অন্ধকার পুরী।
কে তস্কর আমার যা কিছু প্রিয় করে আজ চুরি?
নাতি-নাতনি ও মা’র হাসি আর সুপ্রিয়ার মুখ
আস্তে-আস্তে কেড়ে নিচ্ছে ভয়ঙ্কর চোখের অসুখ;
আদ্য কথা পাবো ব’লে নিরন্তর নিজেকেই খুঁড়ি।

আমি কি নিস্তব্ধ রাতে একা একা মিল্টনের মতো
দৃষ্টিহীন শব্দের নন্দন বনে করবো সন্ধান
অবিনাশী জ্যোতি আর ভোরে জেগে উঠে অপেক্ষায়
থাকবো এমন কারো যে ইএ অক্ষম ভাগ্যহত
কবির অন্তরে উৎসারিত অলিখিত কোনো গান
সফেদ কাগজে ধৈর্য ধ’রে টুকে নেবে মমতায়?
২৪/১/৯৫

 আরো কিছুকাল

এখনই থামার ইচ্ছে নেই, আরো কিছুদূর হেঁটে
যেতে হবে। থামলেই ঘুম
সহজে আসবে নেমে দুচোখের পাতা জুড়ে। বড়
ক্লান্ত আজ, তবু
কুয়াশায় চাই না হারিয়ে যেতে, যতটুকু পারি
দিকচিহ্ন ঠিক রেখে একটু-একটু
সম্মুখে এগিয়ে যাব। কোনো ভ্রম, কোনো পিছুডাক
বিপক্ষে না টানে যেন, রাখব খেয়াল।

কত প্রেত পথ রোধ ক’রে
হঠাৎ দাঁড়ায়, কত ছলে কত রূপ ধ’রে শেষে
অন্ধকূপে ঠেলে দিতে চায়। আমি রুখে
দাঁড়াই অটল ঋজু। পতনের বিলাসিতা সাজে না আমাকে।

এই তো দোয়েল, চন্দ্রমল্লিকা এবং প্রজাপতি
আমাকে দেখায় পথ আর গৌরীর অভয়বাণী
এগিয়ে চলার দীপ্ত, অফুরন্ত সাহস জোগায়।
আমার গ্রীবায় ঝুলে আছে সূর্যোদয়, সুবাতাস
পথের সকল কাঁটা প্রবল সরায়, হাতে নিয়ে
সপ্তর্ষিমণ্ডল দৃঢ়, পদক্ষেপে আরো কিছুকাল এগোবই।

এ আমার কী হয়েছে

এ আমার কী হয়েছে আজকাল? সব সময়
এক ধন্দ আমাকে নিয়ে
বেশ রগড় করছে; হিমশিম খাচ্ছি হরহামেশা,
অথচ আমার কিছুই করার নেই।

এই যে চোখের সামনে সারি সারি বই,
আমি ওদের শনাক্ত করতে ব্যর্থ, কার কী-যে নাম
বলতে অপারগ। আর ঐ যে রেলিঙ ঘেঁষে পেয়ারা গাছটা
দাঁড়িয়ে আছে ক’বছর ধ’রে,
তার পাতাগুলো নড়ছে কি নড়ছে না
বোঝার উপায় নেই আমার। ঘরের ভেতর
দিনের বেলা আলো জ্বালিয়ে রাখলেও কেমন এক
ছায়ার সবতি গড়ে ওঠে।

আমার নিত্যদিনের চেনা বস্তুসমুদয় আমাকে
মজা দেখাবার খায়েশে
অচেনা ভঙ্গিতে হাজির হয়। হকচকিয়ে আমি
পা হড়কে প’ড়ে যাবার আশঙ্কায়
তড়িঘড়ি ধ’রে ফেলি চেয়ারের হাতল। হঠাৎ হাত
সরিয়েও নিই, কী জানি কোনো অজানা
হিংস্র জন্তুর পিঠ স্পর্শ করিনিতো। টেলিফোন
ধ’রে ভাবি, কার ঠিকানায় বাজাবো আমার অব্যক্ত ধ্বনিমালা?

এই যে রাস্তাটা এখন কোনো সরীসৃপের মতো
ঘুমিয়ে রয়েছে, তা আমার চোখে
স্পষ্ট নয়। এখন আমার হৃদয়ে এক দীর্ঘ পথ
চলে গ্যাছে বহু দূর, যার দু’ধারে
সারি সারি গাছ আমি দেখতে পাচ্ছি হাওয়ায়
ঝরা পাতাদের ঘূর্ণি নাচ। কে যেন হেঁটে যাচ্ছে
আঁচল উড়িয়ে, পাথরে ঠেস দিয়ে বসে একজন বাজাচ্ছে বাঁশি।
এই দু’জনের মধ্যে কোনো সংযোগ নেই, অথচ
পরস্পরের মধ্যে ওদের অজান্তেই পদ্মের মতো ফুটে উঠেছে
মমত্ব বোধ। এর পথ চলা, ওর বংশীধ্বনি কোনো দিনই থামবে
আমি বুঝতেই পারি নি, কখন থেকে আমার মধ্যে
এক পরিবর্তনের ঢেউ জেগেছে। এখন আমি
বাইরের সামগ্রী ইত্যাদি চেয়ে আমার ভেতরকার অনেক কিছুই,
অধিকতর স্পষ্ট দেখতে পাই। তাকে আমি
অনেক দিন দেখি না। এই মুহূর্তে যখন আমি একরাশ
ধূসরতার মধ্যেও একটি ধ্রুপদী রাগ সৃষ্টিতে চেষ্টাশীল,
সে এখন কোথায়, কী করছে, জানি না। কিন্তু আমার দৃষ্টির
অস্পষ্টতা সত্ত্বেও তাকে অন্তরে দেখতে পাচ্ছি জ্যোতির্ময় স্পষ্টতায়
১৯/২/৯৫

 এই যে ক’দিন থেকে

ঐ যে ক’দিন থেকে লিখছি না কবিতা, তাতে কি
সমাজের চোখে ঘুম নেই? ফ্ল্যাট বাড়ির সুন্দরী
তরুণীর প্রেমে পড়েছে কি ভাটা এতটুকু? ফুল
ফোটা, তাজা রোদের আবীর ঝরা বন্ধ হয়েছে কি?
কেউ কি বিষাদে আছে লিখছি না বলে? ভালো করে
জানি, কেউ নয় আজ সামান্য অসুখী আমার এ
নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ ক’রে। বরং পাঠক, অধ্যাপক,
রাজনীতিবিদ আর আমলা, সমালোচক আর
সবচেয়ে বেশি কবিকুল উল্লসিত। ‘বাচাঁ গেলো,
এই লোক জ্বালিয়েছে খুব শব্দের ফোয়ারা খুলে’,
ব’লে ওরা সোৎসাহে বাজান ডুগডুগি। না লেখার
দুঃখ বুকে ব’য়ে চলি দিনরাত্রি বড় একা একা।
একজন আছে যে আমার কবিতার জন্যে খুব
ব্যাকুল, উন্মুখ হ’য়ে থাকে সর্বক্ষণ; যদি আমি
লেখনীকে অধিক বিশ্রাম দিই, তার মনে মেঘ
জমে আর আমাকে জাগিয়ে তোলে মোহন ঝাঁকুনি
দিয়ে; আমি তার প্রেরণায় জ্বলে উঠি বার বার।
২২/৫/৯৫

 একজন বুজুর্গের কাছে

একদিন একজন রূপালি-চুল বুজুর্গের কাছে এলো
একটি লোক। তার হাতে কয়েকটি
ম্লান খাতা। খাতাগুলো সে ধ’রে আছে মমতায়,
যেন পরম ধন তার। সে তাজিমের সঙ্গে
খাতা কটি বুজুর্গের হাতে অর্পণ ক’রে
বলল, ‘যদি মেহেরবাণী ক’রে আমার এই কবিতাগুলো
প’ড়ে আপনার অভিমত দেন, কৃতজ্ঞ থাকব।‘ লোকটির চোখে
প্রত্যাশায় দীপ জ্বলজ্বল করছিল সেই মুহূর্তে।

লোকটি অভিমান মেশানো স্বরে বলল, ‘একজন কবির কাছে
নিয়ে গিয়েছিলাম আমার খাতাগুলো।
তিনি কয়েক পাতা উল্টেপাল্টে জানালেন, ‘কী লাভ
জঞ্জাল জড়ো ক’রে? বরং চাষবাস করুন গে,
দোকানদারিতে মন দিন। এসব লিখে নিজের জীবনটাকে
বরবাদ করবেন না! একজন সমালোচকও প্রায়
একই ধরনের কথা শুনিয়ে দিলেন। আখেরে
আপনার কাছে এলাম সত্যের সন্ধানে।‘

বুজুর্গের আলখাল্লার আস্তিনে ঝুলছিল সূর্যোদয়;
তিনি ধৈর্য ধ’রে পাঠ করলেন
বেশ কয়েকটি পদ্য
লোকটির দিকে উদার দৃষ্টি
মেলে দিয়ে বললেন গাঢ় কণ্ঠস্বরে, “অনেকে
অনেক গাছই লাগায়, কিন্তু সব গাছে ফুল ধরে না।
বহু সাধক, বহু সুফী আছেন, কিন্তু একমাত্র মনসুর হাল্লাজই
অকুণ্ঠ বলতে পারেন, ‘আমিই খোদা।‘ তুমি যা’ লিখেছ
তার প্রশংসা শোনার বাসনা ত্যাগ ক’রে লিখে
যে-আনন্দ পেয়েছ, সেই সঞ্চয়টুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকো।“

লোকটি বিদায় নেওয়ার পর রূপালি-চুল বুজুর্গ
নিজস্ব সাধনা এবং সিদ্ধির দূরত্বের ধূসরতায় নিমগ্ন হলেন।
১৬/১১/৯৫

একটি পরিবার

‘সাতসকালে নাশ্‌তা নাকে মুখে গুঁজে
তুই কই ছুটলিরে খোকা? একটু সবুর কর,
আরেকটি রুটি খেয়ে নে।‘
‘মা, আমার বড় তাড়া আছে আজ’, বলল সেই সতেজ তরুণ।

আলনা থেকে পাঞ্জাবি নামিয়ে পরার সময়
ওর অনূঢ়া বড় আপা বললেন, ‘দাঁড়া, তোর
পাঞ্জাবির ছেঁড়া জায়গাটা একটু মেরামত ক’রে দিই।‘
‘অপেক্ষা করার মতো সময় আমার নেই আপা’, ব’লে সে
ছেঁড়া জামা গায়ে চাপাতে চাপাতে
বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল।

বারান্দায় ওর বাবা, বর্ষীয়ান উপার্জন-অক্ষম এক প্রাক্তন রাজনীতিক,
চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে
মাঝে-মাঝে দেখে নিচ্ছিলেন নাগরিক আকাশ।
ছেলেকে প্রায় দৌড়ুতে দেখে নিজের পক্ষে বেমানান
এক বাক্য উচ্চারণ করলেন, ‘তোর কি এই
মিটিং-মিছিলে নিজেকে না জড়ালেই নয়?’

ধাবমান তরুণ ওর বাবার দিকে তাকিয়ে
হাসি-উদ্ভাসিত মুখে দরজা পেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়ায়।

সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে প্রায় সন্ধেবেলা,
মা ভাবছেন, খোকা কেন আসছে না? একটা অশুভ চিন্তা
ওকে দখল ক’রে ফেলছে ক্রমাগত। তরুণের
বড় আপা মনে-মনে বলছে, কী জেদী ছেলেরে বাবা,
কোনো বাধাই মানতে চায় না। আর বয়েসী পিতা, ঈষৎ ত্রস্ত
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছেন তাঁর ভবিষ্যৎ অস্তগোধূলিতে মিলিয়ে যাচ্ছে।
২০/২/৯৫

একটি শোকগাথার জন্যে

নদীর চককচে তরতাজা
মাছগুলো ছটফটিয়ে মরে যাচ্ছে,
গাছের পাতা ধুলো হ’য়ে ঝরছে,
গাছের কংকাল দেখে পাখিরা বোবা,
ভুলে গেছে গান। কান খাড়া
করে থাকলেও কোকিল কি দোয়েল
কারো সুর শোনা যাচ্ছে না আর।
ফুল ফোটে না কোথাও,
উধাও পায়রা, কাঠবিড়ালি, খরগোশ। বসন্ত
আসে না দশ দিগন্ত রাঙিয়ে।

যেখানে একদা নদী ব’য়ে যেতো
তরুণীর উচ্ছলতার মতো,
এখন সেখানে ধু ধু বালি, খালি গায়
ক্লান্ত লোকজন ধিকিয়ে ধিকিয়ে হাঁটে।
ফসলের ক্ষেত পুড়ে গেছে, বীজতলা শ্মশান।
কৃষকের মাথায় হাত, টগবগিয়ে ভাত ফোটে না হাঁড়িতে।

শুটিকয় মানুষ সুন্দরের কথা,
আলোর কথা বলায় চেষ্টাশীল,
লোকগুলো ওদের মাড়িয়ে
পায়ের তলায় থেঁৎলে
দলে দলে দৌড়ুচ্ছে পূর্ণিমা ছেড়ে
অমাবস্যার দিকে।
অনেকেই লেখা ছেড়ে না-লেখার দিকে চলে গেছেন।
হাতে গোণা কজন বিষণ্ন, অথচ
জেদী কবি রক্তজবাপ্রতিম
সূর্যোদয়ের দিকে মুখ রেখে
একটি মর্মস্পর্শী শোকগাথা রচনার জন্যে
বিষপাত্র দূরে সরিয়ে
আঁকিবুঁকিময় পাতার পর পাতা ক্রমাগত
ছিঁড়ে চলেছেন প্রহরে প্রহরে।

একাকী সত্যের কাছে

এ আমি কেমন দ্বন্দ্বে খাচ্ছি পাক গহীন গাঙের
ঘূর্ণীজলে নাওয়ের ধরনে? ঘন
কুয়াশা ছড়ানো চর্তুদিকে। মাঝে-মাঝে
কান ঘেঁষে পাখি উড়ে যায়
কোন্‌ দিকে, কিছুতে পাই না টের। তা’হলে কি শেষে
ভরাডুবি হবে আজ? আমার মাংসের ভোজে তৃপ্ত হবে মাছ?

এরা বলে, এদিকে ভেড়াও নাও, যত শীঘ্র পারো,
পরিত্রাণ পাবে, দ্যাখো, সবাই তোমার
জন্যে তীরে সাজিয়ে অজস্র ডালা হাতে
মালা নিয়ে অধীর অপেক্ষমাণ, এসো।

ওরা বলে, আমাদের তীরে তাড়াতাড়ি
তরী এনে বাঁধো;
আমরা তোমার জন্যে বিপুল বর্ণাঢ্য উৎসবের
আয়োজন নিয়ে মেতে আছি।

আলোর তীরের ঘায়ে কুয়াশার জাল ছিন্ন হ’লে
দ্বন্দ্বের আবর্ত থেকে বেরিয়ে প্রবল দু’দলের
কারো্‌ ডাকে কোনো সাড়া না দিয়ে নৌকোর
মুখ পুরোপুরি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে খাটাই পাল।
মনে মনে বলি-
এই মূর্খ কোলাহল, সেই নির্বোধ উৎসব থেকে
দূরে, বহুদূরে খুব আলাদা মানব সম্মেলনে যোগ দিয়ে
নিজের ভেতরে ডুবে একাকী সত্যের কাছে চলে যেতে চাই।
৭/১২/৯৫

কবির ভাবনা

লেখার টেবিল থেকে এক টুকরো রুটি নিয়ে যায়
চতুর ইঁদুর এক, রক্তিম আপেল নিদ্রাতুর
তসতরিতে, সদ্যলেখা কবিতার পাণ্ডুলিপি কোনো
নগ্নিকার মতো আলস্যের জালে ঘুমে ঢুলু ঢুলু।
দাঁড়ানো নিঃসঙ্গ কবি জানালার ধারে, উদাসীন
দৃষ্টি তার শূন্য পথে, দূরের আকাশে, যার কোলে
মেঘ-শিশুগুলি খেলা করে, পাখি ওড়ে; অকস্মাৎ
দেখা দেন পল এলুয়ার আর লালন ফকির।

লেখার টেবিলে ফিরে এসে কবি ভাবে, আজকাল
শুধু ভঙ্গিসর্বস্ব পদ্যের ঠমকের তালে তালে
নেচে ওঠে, চৈনিক সুপের মতো করে পান খুব
তৃপ্তিতে চটকদার পঙ্‌ক্তিমালা, কাচের জৌলুশে
ম’জে থাকে হীরক কাদায় ফেলে, তবুও হৃদয়
ছিঁড়ে খুঁড়ে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে আরো লিখে যেতে হবে।
৩০/১২/৯৫

 কলমের কালির স্রোত

রজকের ধরনে নিজেকে নিঙড়ে আমি লিখি কবিতা,
কয়েকটি পঙ্‌ক্তি লেখার জন্যে
আকাশে উড়ি, পাতালে ডুব দিই,
কত যে রাত্রি আমার কাটে আত্মপীড়নে, অনিদ্রায়।

যে ছেলেটা পাচন হাতে গোরু চরায়
ঘাসবনে, মাঠে, বাঁশি বাজায় গাছের ছায়ায় ব’সে
কিংবা যে মেয়েটি ঢেঁকিতে পাড় দেয়, মাথার ঘাম
পায়ে ঝরায় ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে, যে-তরুণ
অন্তর্গত আলোড়নে স্বদেশকে
একটি বাগানের মতো গড়ে তোলার জন্যে
উপর-অলার পা-চাটা বদরগী আমলা
আর পুলিশের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে,
আমার লেখনী তাদের কথা বলে আর
অবিরাম বলে একজন গৌরীর কথা।

শোনো, আমার লেখনী থেকে মাস্তানের বুলেট বেরোয় না,
কোনো সন্ত্রাসীর ছোরার ফলাও
মুখ খিঁচিয়ে ওঠে না আমার কলম থেকে,
তবু ওরা চায় স্তব্ধ হয়ে যাক আমার লেখনী।

যে আনপড় মহাপুরুষ রুক্ষ মরুভূমিতে
আবে হায়াতের ধারা বইয়ে দিয়েছিলেন একদা,
তিনিই তো উচ্চারণ করেছিলেন, কলমের কালি
শহীদের রক্তের চেয়েও অধিক পবিত্র,
তবে কেন তাঁর ভণ্ড, কূপমণ্ডুক অনুসারীরা
আমার লেখনীর মসীর স্রোত রোধ করতে হন্যে হ’য়ে অসি নাচায়?
২০/১১/৯৫

কৃষিকাজ

এখানো আমার মন বাস করে আনন্দ-কাননে;
বিদেশী অনেক মহাজন থেকে ধার দেনা করে
বাড়াতে চেয়েছে দীন খাঁচার জৌলুশ; আনন্দের
বীজ খুঁজে বেড়িয়েছি ঘাটে ঘাটে। আপন জমিন
বিশদ পতিত রেখে দেখি শেষে বীজতলা নেই।
ফতুর চাষীর মতো ব’সে থাকি খরার দুপুরে
হাঁটুর বিবরে মুখ রেখে আমি বিষণ্ন খাতক।
তবে আশা পূর্ণ হবে কবে ভেবে দিন যাবে?

এবার করব কৃষি মন দিয়ে এ ভবসংসারে;
পূর্বপুরুষের উপেক্ষিত গোলা থেকে আহরণ
করে বীজ বুনে যাব ভাঁজময় কপালের মতো
রুক্ষ মাঠে। আনন্দ-সাগরে ভেসে করব আবাদ।
শস্য পেয়ে রাশি রাশি অতঃপর নিজস্ব জমিনে
দাঁড়িয়ে অগ্রজদের সগৌরবে জানাব সালাম।
২৪/৭/৯৫

কেন যে এলাম

কেন যে এলাম ফিরে নিস্তরঙ্গ নিষ্প্রাণ শহরে
ছটফট ক’রে, কেন? সমস্ত শহর নিষ্প্রদীপ,
ফুলের সৌরভ নেই কোনোখানে, পক্ষী-সম্প্রদায়
সঙ্গীতবিহীন আজ। যেন আমি জনশূন্যতায়
কোনো মরুসঙ্কটে পড়েছি। প্যান্থপাদপের চিহ্ন
পড়ে না আহত চোখে। উপদ্রুত সময়ের মোড়ে
দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল যার, তারই দেখা নেই;
তাহ’লে এলাম কেন এই নিরানন্দ বসতিতে?

আজ আমি বড় একা, অতিশয় মানোকষ্টে আছি;
নিজের কষ্টের কথা বলতে পারি না কাউকেই,
অথচ সে-কথা উঁচু স্বরগ্রামে নিসর্গ, মানুষ
সবাইকে ভীষণ জানাতে ইচ্ছে হয় হৃদয়ের
মূল ভাষা সম্পূর্ণ উজাড় ক’রে। আমার তৃষিত
প্রতীক্ষায় খরা আর স্বপ্নের দেউলে জমে কাদা।

 ছায়াগণের সঙ্গে কিছুক্ষণ

ক’জন ছায়া আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন
নৈশ ভোজে এক গুহায়, যার দেয়ালে ক্ষ্যাপা
কোনো শিল্পী মনের খেয়ালে ভয়ঙ্কর সব চিত্র
এঁকে রেখেছেন। কালো পাথরের গোল টেবিলে
আমরা বসলাম কিছু দূরত্ব বজায় রেখে স্থূলকায় মোমবাতির আলোয়;
টেবিলে সাজানো বিচিত্র খাবার আর পানীয়।

ছায়াগণের কারো চক্ষুকোটরে কোনো চোখ নেই,
কারো বুকের ভেতর হৃৎপিন্ড নেই,
কারো নাক মুখ কিছুই নেই, কারো বা সারা শরীর জুড়ে
ধারালো অস্ত্রের আঘাত, কারো
দুটো হাতই কাটা এবং একজনের মাথার খুলির
অর্ধেকটাই গায়েব। আমার পায়ের কাছ ঘেঁষে
একটা হোঁৎকা ইঁদুর কোথায়
ঢুকে গেলো চোখের পলকে। দেখি মাথার ওপর
ঝুলে আছে এক ঝাঁক রক্তচোষা বাদুড়।
আমার ছায়া স্থির হয়ে রয়েছে
গুহার দেয়ালে। আমি কি ভয় পাচ্ছি? নাকি
লুপ্ত হয়েছে এই অদ্ভুত পরিবেশে আমার বোধশক্তি?

একজন ছায়া, যার চক্ষুকোটর শূন্যতায় খাঁ খাঁ,
বললেন ক্ষতার্ত স্বরে, “আমি মানুষের অসুস্থ চোখ
সারিয়ে তোলার সাধনায় মগ্ন ছিলাম,
অথচ ওরা আমার জ্বলজ্বলে দুটি চোখ উপড়ে ফেলে
হত্যা করেছে আমাকে। কিন্তু আজ ওরা তোমাদের
চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আস্ফালন করছে যত্রতত্র।
তোমরা ওদের প্রশ্রয় দিয়ে চলেছ ক্রমাগত।“ আমি
তাঁর কথার জবাব না দিতেই
আরেকজন ছায়া, যাঁর মুখ শনাক্ত করা যাচ্ছিল না,
কিন্তু কণ্ঠস্বর খুবই চেনা, “আমি অনেককে
সাহিত্য পড়িয়েছি বিশ্বাবিদ্যালয়ে; সত্য, শিব এবং সুন্দরের
তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছি। দ্যাখো, আমাকে ওরা হত্যা করেছে
তরুণ তরুণীদের মনে সত্য, কল্যাণ এবং সুন্দরের আলো
পৌঁছে দেওয়ার অপরাধে। অথচ তোমরা,
হ্যাঁ তোমরা ওদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছ কী সহজে, কথা বলছ
এক টেবিলে ব’সে। তুমি কবি, তুমি আমার,
আমাদের মনোবেদনা উপলদ্ধি করবে। দ্যাখো, ভালো ক’রে দ্যাখো,
কী হাল ওরা করেছে আমাদের পঁচিশ বছর আগে।“

হঠাৎ আমি নিজেই যেন ছায়া হ’য়ে ছায়া-ছায়া স্বরে
সেই অতি পরিচিত কণ্ঠস্বরের উদ্দেশে বলি,
“আমি সামান্য এক কবি, কী সাধ্যি আমার
দুর্জনদের দমন করার। হে গুরু, হে ভ্রাতা আমার,
আপনি তো ভালোই জানেন ঘাতকের মারণাস্ত্রের মুখে
কবির কলম কত অসহায়। নিজের প্রাণ দিয়েই তো আপনি
সেই সত্য জেনে গেলেন। আপনার
হাতেও তো ছিল নন্দিত লেখনী, বিশিষ্ট কণ্ঠে দীপ্ত ভাষণ।
যাদের ওপর ইতিহাসের চাকা ঘোরানোর ভার,
তারাই যখন বিস্মৃতির ডোবায় ডুবিয়েছে আপনাদের আত্মদান,
তখন এই আমি, যার রথের চাকা দেবে গ্যাছে
কাদায়, কী আর করতে পারি অরণ্যে রোদন ছাড়া?”

বেশ কিছুক্ষণ পর সেই গুহায় ব্যেপে আসে ক্ষমাহীন বিস্তব্ধতা,
স্থুলকায় মোমবাতিগুলো গ’লে গ’লে
নিঃশেষিত-প্রায়, একটি প্যাঁচা ড্যাবড্যাবে চোখে
তাকিয়ে আছে আমার দিকে, ছায়াগণ আগেই
করেছেন প্রস্থান। এখন আমার পুঞ্জীভূত ব্যর্থতা
আমাকে ঘিরে জুড়ে দিয়েছে
প্রেতনৃত্য, পাখা ঝাপটাচ্ছে বাদুঁড় আর আমার
চোখের নিচে বাটিতে পঁচিশ বছরের শ্যাওলার স্যুপ জুড়িয়ে বরফপানি!
১১/১২/৯৫

টুকরো টুকরো স্বপ্ন

সকাল নম্রতা দ্রুত হারিয়ে ফেলেছে। বাসি মুখে
টুকরো টুকরো স্বপ্ন জোড়াতালি দিয়ে কী একটা ছবি
বানাতে চাইছে খুব একাগ্র নিষ্ঠায়
শাহেদ লতিফ।

পাড়ায় ভীষণ হল্লা, অমুকের কল্লা চাই ব’লে
কিছু ডাকাবুকো লোক হাতে
মারণাস্ত্র নাচাতে নাচাতে মাটি সদর্পে কাঁপিয়ে
চলে যায়। শাহেদ লতিফ সত্তা থেকে
আতংকের কাঁকর সরিয়ে
টুকরো টুকরো স্বপ্ন জোড়াতালি দিতে থাকে।

কখন যে সন্ধ্যা ঘরে আহত জন্তুর মতো ঢোকে
সহজে পায় না টের শাহেদ লতিফ।
টুকরো টুকরো স্বপ্নগুলি স্পষ্ট কোনো ছবি
হয়নি তখনো। কার মৃত্যুর খবর
রটে যায় হাওয়ায় হাওয়ায়। উদাসীন
শাহেদ লতিফ ছেঁড়া স্বপ্ন নিয়ে শুয়ে থাকে একা।

সন্ধ্যা মধ্যরাতের বাহুতে ঠাঁই নেয়, ভোরবেলা
প্রতীক্ষা-কাতর; নিদ্রাহীন
শাহেদ লতিফ টুকরো টুকরো স্বপ্ন জড়ো ক’রে ক’রে
বড় ক্লান্ত, টকরোগুলো সমগ্রের রূপটান পায়নি তখনো।

 ডাক

কনকনে হাওয়া চাবকাচ্ছে শহরটাকে
দারুণ আক্রোশে। রাত্রির পাখিরা নিশ্চুপ; আমার ঘরে
বাতি নেভানো। টেলিফোনের
ডায়াল ঘোরাতে ঘোরাতে অঙুল
টনটন করছে। জানি, ইচ্ছে ক’রেই তুমি
রিসিভার তুলছো না, যেন ভুলেই গ্যাছো
টেলিফোনের ব্যবহার। আমার হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রী
তোমাকে ডাকছে, তুমি নিঃসাড়।

মাঝে-মাঝে তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই,
সর্বক্ষণ কেন পাই না, এ আক্ষেপ আমাকে
কাতর করেছে কতোদিন।
কিন্তু আজ রাতে
একটি বারও তোমার কণ্ঠস্বর বীণা হ’য়ে
বেজে উঠলো না আমার কানে। আমার ব্যাকুল আহ্বান
মুখ থুবড়ে পড়ছে ইথারে; তোমার
একরোখা রিসিভার কানে সজোরে
আঙুল চেপে ধরেছে।

অবাধ্য আমার মন আহত ঈগলের মতো
রক্তাপ্লুত ডানা ঝাপটাচ্ছে তোমার সাড়া না পেয়ে।
পার্বত্য এলাকার নির্যাতিত আদিবাসীদের বিষাদ
আমাকে দখল করেছে। আমার
বেদনার কূলকিনার এই মুহূর্তে দিশেহারা, মনে হচ্ছে আমি
পদ্মার চরে ক্ষ্যাপা বাউলের মতো
ছেঁড়া একতারা নিয়ে গেয়ে বেড়াচ্ছি
অবোধ লালন একবার দেখ নয়ন খুলে’
সুপ্রিয়া, আজ তুমি রিসিভার তুলছো না,
অথচ একদিন আমাকে টেলিফোন করে জানতে চাইবে,
‘কেমন আছো কেমন চলছে লেখালেখি?’ ও-পার থেকে
ভিন্ন কণ্ঠস্বর উচ্চারণ করবে, ‘আপনি খবরের কাগজ
পড়েননি? তিনি গত রাতে…’ বাক্য শেষ না হতেই
তোমার হাত থেকে ঝরে পড়বে রিসিভার। তখন আমাকে এই শহরের
রাস্তায়, কাফেতে, বইয়ের দোকানে পঞ্চভূতে-
কোথাও ডেকে ডেকে কোনো সাড়া পাবে না।
২৫/১/৯৫

ঢাকা কলেজকে নিবেদিত পঙ্‌ক্তিমালা

অর্ধ শতাব্দী আগে তোমার সঙ্গে আমার
প্রথম চক্ষুমিলন হয়েছিল;
তখন তুমি কাদায় পড়ে-থাকা
এক মুক্তো। সেই তুমিই আমার চোখের তারা কাঁপিয়ে দিলে
নতুন যুগের ঝলকে। তোমার আলোয়-ভরা
বুকে আশ্রয় নিলাম কুণ্ঠার কুয়াশা ছিঁড়ে।
দুটি হৈ-হল্লাময় বছর
তুমি আমাকে লালন করেছ দাইমার মতো।

আমি যে তোমার স্নেহার্দ্র ছায়ায়
বেড়ে উঠেছি, এতগুলো দিন কাটিয়েছি আনন্দের ঢেউয়ে
দুলে দুলে, কী ক’রে ভুলব সে-কথা?
তোমার বাইরের দীন দশা আমাকে বিষণ্ন আর
পীড়িত করেছে; কিন্তু এ-ও তো আমার জানা ছিল
তোমার অন্তর কত ঐশ্বর্যশীলা, যার আভা
যুগ যুগ সঞ্চারিত হয়েছে
তোমার অগণিত পালিত সন্তানের সত্তায়।

কোনো কোনোদিন তোমাকে ফাঁকি দিয়ে
তোমার ছায়া থেকে পালিয়ে
বাইরে বেরিয়ে পড়তাম ঝাঁ ঝাঁ রোদ কিংবা বৃষ্টিতে।
আবার চুপিসারে ফিরে আসতাম তোমারই কাছে,
তুমি মমতা-মাখা আঁচল দিয়ে আমার কপালের ঘাম
আর এক মাথা সপসপে চুল থেকে
বৃষ্টির পানি মুছে বুকে টেনে নিয়েছ
প্রগাঢ় ভালোবাসায়।

দাইমা, ওগো দাইমা আমার,
তোমার বুকের দুধ খেয়ে তোমার কত সন্তান
এখনো হাঁটছে পৃথিবীর নানা পথে,
অনেকে হয়ে গ্যাছে ছায়ারও অধিক ছায়া,
অনেকে পাণ্ডিত্যের কৈলাশ চূড়ায় উঠেছে,
অনেকে শিল্পের মানস-সরোবরে
সাঁতার কাটছে, অনেকে অত্যাচারী শাসকের
সান্ত্রীদের গুলিবিদ্ধ হয়ে বাংলা ভাষাকে পরিয়েছে
গৌরব মুকুট, অনেকে লড়াই করেছে একাত্তরে,
অনেকে জনগণের সংসারে জ্যোতি ছড়াবার
আকাঙ্ক্ষায় কারাবরণ করেছে বার বার,
এখনো রক্তে ভেজাচ্ছে শার্ট, এখনো লড়ছে স্বৈরতন্ত্র,
ধর্মান্ধতার মন্ত্র, অবিচার, অনাচার আর
কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে।

দাইমা, ওগো দাইমা আমার,
তোমার উদার স্তনের অমিয়ধারা কখনো শুকোবার নয়।
২০/১১/৯৫

তার আগে

সারা দিনমান এই শ্রমক্লিষ্ট দু’হাতে পাথর
সরাতে সরাতে আমি অবসাদে খুব নুয়ে পড়েছি, পিপাসা-
কাতর আমার বুকে জ্বালা ধরিয়েছে
এক মরুভূমি, রক্ত ঝরছে দু’হাত থেকে, তবু
একটু বিরাম নেই, ক্লেশ অনুভব করবার
মতো বোধ হারিয়ে ফেলেছি, মনে হয়।
দুচোখে কুয়াশা গাঢ় থেকে গাঢ়তর। মাঝে মাঝে
অদৃশ্য পাখির ডাকে সচকিত, চৌদিকে পূর্ণিমা
নাকি অমাবস্যা, বোঝা দায়। শুধু কিছু
পাথর সরিয়ে
এখনো এগোতে থাকি, পূর্বপুরুষেরা ঘাসজমিতে কীভাবে
বীজতলা গড়তেন, তার খোঁজে এই পথ চলা।

কখনো হোঁচট খাই, কখনোবা দড়ি ভ্রমে কোনো
সাপকেই হাতে তুলে নিই।
বস্তুত আমার দৃষ্টি চিতায় উঠেছে, কিছুকাল
পরে ছাই শুধু ছাই এদিক ওদিক
উপেক্ষিত রইবে প’ড়ে তার আগে পূর্বপুরুষের
বীজতলা থেকে কিছু কণা নিয়ে দুঃখ শোক ভুলে
মিত্রদের আনন্দ উৎসবে
নতুন তারার মতো শব্দের ফোয়ারা খুলে দিয়ে যেতে চাই।
৭/২/৯৫

 তোমাকে যেতেই হলো

শেষ অব্দি তোমাকে যেতেই হলো সেখানে
হৈ হৈ ভিড়ে, ধূলায়, আলো-আঁধারিতে আমাকে ছাড়াই?
ভেবেছিলাম, তুমি যাবে না ঐ হট্ররোলে,
কতিপয় খ্যাতিশিকারীর আশেপাশে
দাঁড়াবে না, নিজের শরীরকে চাটতে দেবে না
লালসা-লোলুপ কোনো কোনো দৃষ্টিকে। ভেবেছিলাম,
কী নির্বোধ আমি, ঘর থেকে পা বাড়াবার আগে
তোমার চোখে ভেসে উঠবে একটি কাতর, বিড়ম্বিত মুখ।

রোগা, ক্ষীণদৃষ্টি ঈগলের মতো একা
প’ড়ে থাকি এক কোণে। কুঁদুলে
গৌণ কিছু পাখি আমাকে উত্যক্ত করে, একটি কি দুটি
নেংটি ইঁদুর ভেংচি কেটে দূরে সরে যায়। এই আমাকে তুমি
নিয়ে যেতে চাইলে শত শত মানুষের
দঙ্গলে, এক ধরনের আদিখ্যেতার প্রদর্শনীতে।

আমাকে আঁকড়ে-ধরা বিষাদকে অগ্রাহ্য ক’রে, না বুঝে
তুমি দিব্যি চলে গেলে, আমি
অসহায়, আর্ত, নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম শূন্য পথের দিকে;
ভাবলাম, কেউ করো জন্যেই
অপেক্ষা করতে চায় না, নিজের ইচ্ছার মুকুল সমুদয়
ফোটানোর জন্যে ব্যগ্র হ’য়ে পড়ে।

বেশ রাত ক’রে ফিরে এলে আমার নিরানন্দ ঘরে
আনন্দে উদ্ভাসিত; তোমার ভেতর থেকে
বেরিয়ে-আসা বীণার ঝংকার স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম।
তোমার চোখে মুখে এক ধরনের জয়োল্লাস। আমি নিস্তব্ধ
মমির মতো শয্যাগত। অস্ফুট কোনো শব্দও
উচ্চারণ করতে ব্যর্থ আমি শুধু দেখলাম উৎফুল্ল তোমাকে।

আমার অন্তর্জ্বালা বিষয়ে অসচেতন, উদাসীন তুমি
শোনালে কিছু টুকরো গল্প, কিছু অন্যের, কিছু
তোমার শিল্পিত কার্যবিবরণী। সেই মুহূর্তে আমার
অন্তর্গত রোগা, প্রায়ান্ধ ঈগল আর্তনাদ
করতে করতে আকাশে উড়তে চেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল পাথরে এবং তুমি
তার শুশ্রূষায় আগ্রহী হয়েও নিষ্ক্রিয়তায় ডুবে রইলে।
২৪/২/৯৫

 নিঃসঙ্গ যাত্রা

এ কেমন স্থানে আজ পা রেখেছি? এ কোন বিরান
জমিন আমাকে গ্রাস করবার জন্যে মুখের গহবর তার
উন্মুক্ত করেছে অকস্মাৎ? গাছপালা নেই, নেই জলাশয়,
পাখিও অনুপস্থিত, বোঝা যায়, বহুকাল থেকে
বন্য জন্তু কোথাও পড়ে না চোখে, তবুও হিংস্রতা চতুর্দিকে
গন্ডারের শৃঙ্গ হয়ে ধেয়ে আসে যেন; রক্ত হিম
করবার আয়োজন অত্যন্ত প্রবল, কিন্তু দৃশ্যত তেমন
ভয়ঙ্কর কিছু নেই সত্যি এ তল্লাটে।

আমাকে একাই হেঁটে যেতে হবে এখনো জানি না
কতদূর, পাড়ি দিতে হবে রুক্ষ পথ
আরো কতক্ষণ,
জানি না কিছুই। এই পথে আমার নিজের
বুকের ঘর্ঘরে কফ, নিষ্প্রভ নজর,
বিশীর্ণ পাঁজর, বুকজোড়া কষ্ট, নড়বড়ে হাত-পা
ছাড়া অন্য কোনো সঙ্গী নেই। পিতা-মাতা
জায়া-পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন
অথবা বান্ধব কেউ নেই। এমনকি যাকে আমি
গৌরী গৌরী ব’লে
আকাশ পাতাল মর্ত্য উথাল পাথাল করি, সে-ও
নয় এই পথে আজ সঙ্গিনী আমার।

নিঃসঙ্গ পথিক আমি সর্বক্ষণ, এই রুক্ষ মাটি
কখন আমাকে গ্রাস ক’রে মুখ
বন্ধ করে নেবে, তারই তীব্র প্রতীক্ষায়
আছে নুড়ি, কর্কশ কাঁকর আর পোকা-মাকড়ের দল।
২৯/১১/৯৫

 নিজেকে ভেঙে ভেঙে

নিজেকে ভেঙে ভেঙে ভেঙে
এই তো আমি পড়ি-মরি ক’রে এখানে
এই অনেকগুলো ভাঙা পাথরের
ডেরায় দাঁড়ালাম।

আমার কোথাও কোনো
সুম্পূর্ণতা নেই; স্বেচ্ছাচারী বাটালি আর
হাতুড়ির ঘায়ে
আমার মুখ আর
মুখ নেই। চোখ, কান, নাক, ভাঁজ-পড়া
ললাট, গ্রীবা—সবকিছুই ভাঙাচোরা,
বল্মীকাক্রান্ত কাদার
মূর্তির মতো।
নিজেকে ভেঙে ভেঙে ভেঙে
সম্পূর্ণ ভাঙতে না পারার খেদ
আমাকে তাড়া করে সারাক্ষণ আর বিদ্যুচ্চমকে দীপ্ত
আমি গরল পান করতে করতে
নির্মাণের কথা ভাবি, অথচ
অদূরে মরা জ্যোৎস্নায় শেয়ালের পায়ে
ঝরা পাতার খস্‌ খস্‌ আর
চাঁদের দিকে পিঠ দিয়ে ঘাড় ফোলায় প্যাঁচা।
৭/৭/৯৩

নির্জনতার জন্যে প্রার্থনা

আমাদের দুজনের চারপাশে সুদূর
মেঘের মতো নির্জনতা থাক,
এই মতো চেয়েছি কতদিন।
একটি কি দুটি পাখি অথবা প্রজাপতি
সেই নির্জতায়
দোল খেতে পারে সহজে, হাওয়া অন্ধকার
এবং জ্যোৎস্নার প্রবেশাধিকার থাকবে;
আমাদের দুজনের কথা বলা আর
না-বলার মাঝখানে গান গেয়ে
উঠতে পারে কোনো কোমল বুকের পাখি, ক্ষতি নেই।

কাঙ্ঘিত সেই নির্জনতা প্রত্যহ
লুকোচুরি খেলে আমার সঙ্গে। কী এমন
ক্ষতি হতো কার, যদি আমরা,
তুমি আর আমি, দু’দণ্ড
নিরিবিলি বসতে পারতাম কোনো
বকুলতলায় সময়ের নির্জন ঘাটে?

আমরা দুজন বসে থাকি নিশ্চুপ,
আমাদের নীরবতার চোখ ঘষে দ্যায়
দুটি কি তিনটি শাড়ি, একটি কি দুটি
সাফারি স্যুট। অনর্গল কলরব আমাদের
দুজনের সাহচর্যকে ঠোকরাতে থাকে
উন্মত্ত বাজপাখির মতো।

প্রতিদিনের এই কলরবে
তোমাকে নিজের মতো ক’রে পাওয়ার আমার ব্যাকুলতা
তোমার কোলে মাথা রেখে
বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে তৃষিত। এই ভিড়ে
আমি তোমাকে স্পর্শ করতে পারি না।
কিন্তু আমার অস্তিত্বের
পরাগগুলো তোমার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে
শুভেচ্ছা ঝরায়। আমার স্বপ্নগুলো তোমার
মুখ চুম্বন করে, আমার অকথিত নিরাশ্রয় শব্দমালা
সোনালি ত্রাণশিবির তোমার হৃদয়ের তন্তুজালে।

আমরা দুজন ঘন্টার পর ঘন্টা ব’সে থাকি
ড্রইংরুমে অথবা
খোলা বারান্দায়। বিভিন্ন কণ্ঠস্বর কোলাহল করে
জ্যাজের ধরনে।আমি প্রায়
কিছুই বলি না, বলতে গেলেও হোঁচট খাই,
আমার দুচোখ গড়িয়ে যায় সবার উপর।

সমবায়ী কথার ফাঁকে ফাঁকে প্রত্যেকে
তুলে নেয় স্ন্যাক্‌স আর চায়ের পেয়ালা।
তুমি আমার দিকে এগিয়ে দাও স্যান্ডুইচ
এবং যখন তুমি আমার চোখে
চোখ রাখো সপ্রেম,
আমার অনুভূতিমালা প্রবল কেঁপে ওঠে,
যেন ঝোড়ো ঢেউয়ে ফুলদল;
কিছুতে চোখ ফেরাতে পারি না।

রাত বাড়তে থাকে দ্রুত, অতিথিদের অবস্থান
যখন ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করতে উদ্যত,
তখন শুরু হয় বিদায়ের পালা। আমি
গুলিবদ্ধ পাখির মতো অভিমান লুকিয়ে
সৌজন্যের মোড়কে বেরিয়ে আমি ড্রইংরুম থেকে
অন্ধকারে পা বাড়াবার সময় দেখি,
তুমি দাঁড়িয়ে আছো দরজায়, সৌন্দর্যের আভাময়ী। তোমার
অভিমান আমার অভিমানের সঙ্গে মিলিত হ’য়ে
একটি মায়াবী পাখি হ’য়ে নিঝুম যাত্রা করে
দূরের ছায়াপথ আর নক্ষত্র-নীড়ে।

এবং সেই উধাও পাখি
নির্জনতার জন্যে প্রার্থনারূপে অবিরাম
চক্রাকারে ঘুরতে থাকে
আমাদের দুজনের তৃষিত মর্মমূলে।
৩১/৮/৯৫

 নীল কুয়াশায়

শূন্যতা আমার দিকে রাতের প্যাঁচার মতো খুব
একাগ্র তাকিয়ে থাকে। নিভৃতে যা করি উচ্চারণ
নিটোল তন্ময়তায়, শ্রোতা তার চাঁদ নক্ষত্রের
স্রোত আর গাছপালা। কাদাজল থেকে উঠে প’ড়ে
সপ্তর্ষিমন্ডলে হাত বাড়াই কিসের প্রত্যাশায়
নিজেই জানি না; দেখি কবন্ধের দল রাস্তা জুড়ে
বিক্ষোভ মিছিলে মাতে কল্যাণ এবং সুষমার
বিরুদ্ধে প্রত্যহ বড় বেশি সরে গিয়ে ডান দিকে।

আমার রথের চাকা শোচনীয় ভাবে দেবে গ্যাছে
আঁঠালো কাদায়, আর অকাল মেঘের বোরখায়
নিমেষে পড়েছে ঢাকা সূর্য, হৃতশক্তি, অসহায়
একলা দাঁড়িয়ে আছি, আমার উদ্দেশে ছুটে আসে
রক্তলিপ্সু বাণ, সহযোদ্ধা সব দিয়েছে গা ঢাকা,
বিপ্লবের মুখ হারিয়ে গিয়েছে নীল কুয়াশায়।
২১/৫/৯৫

পূর্ণতার প্রতীক্ষায়

বুঝিনা অনাদিকাল থেকে
হাত দুটো প’ড়ে আছে বনাঞ্চলে বিশুদ্ধ জ্যোৎস্নায়
পা দুটি জলের স্নেহ পাচ্ছে নদী তীরে, রাত্রিদিন
আমার স্পন্দিত বুক কাজল মাটিতে বাউলের
একতারা এবং আমার মাথা পাহাড় চূড়ায়
ঈগলের ডানার ছায়ায় জপ করে
সৌন্দর্যের; আমি
খণ্ড খণ্ড হ’য়ে সম্পূর্ণতা খুঁজি গূঢ় তপস্যায়।

আমার নিবিড় ধ্যান ঘাসের ডগায়
এক ফোঁটা প্রসন্ন শিশির
অথবা ফুলের মধু, হরিণের মুখে লেগে-থাকা
তৃণমূল, নিজের ভেতর থেকে চকিতে বেরিয়ে
নিজেকেই দেখি
নানা কোণ থেকে, চেনা দায় থিতু বুদ্ধের আঙ্গিকে।

আমাদের দেশ এক পাগলা গারদ। বাসিন্দারা
কখনো চেঁচায়, কখনো বা হাসে, কাঁদে
কখনো অন্যের স্বরে কথা বলে বেবাক উদ্ভট,
কখনো এতই স্বাভাবিক ভিন্ন মুখচ্ছদে, দেখে
নিজেকেই খুব প্রতারিত মনে হয়। নিজেকে সরিয়ে নিয়ে
নিরালায় আমিই আমার ধ্যান হই।

হাত দুটো পানি-ধোওয়া পায়ের অম্লান পাতা আর
পদতল বুক আর বুক আমার মাথাকে দ্যাখে
দিনরাত। তারপর নেত্রপাতহীন
নীলিমায় ভাষাতীত স্তোত্র ভেসে যায়। সেই স্তোত্রে সুনিশ্চিত
হাজার বছর আগেকার ছায়া ফিস্‌ ফিস্‌ করে,
ক্রমাগত নৈঃশব্দ্যের পাঠ নিই মেঘেদের কাছে।

সারাদিন দাঁড়ে-খাটা মাঝির মতোই
দিনান্তে ঘুমাই পাটাতনে নিশ্চেতন,
বিকলাঙ্গ প্রহরের স্বপ্নের ভেতরে
পূর্ণতা দাঁড়ের ঘায়ে গুঁড়ো কিছু ঢেউ।

 পূর্বাপর

একটু পরেই তুমি অতিকায় ধাতব পাখির
জঠরে নিশ্চুপ ব’সে দেবে আকাশের উড়াল আর
আমি একা ছোট অন্ধকার ঘরে থাকব লুকিয়ে
মুখ, পাছে কেউ দেখে ফ্যালে আমার প্রায়ান্ধ চোখে
জলকণা; মনে পড়ে, বিমানবন্দর থেকে তুমি
শেষবার বললে কথা টেলিফোনে খুব কষ্ট ক’রে।
আমার পাঠানো এক প্রজাপতি তোমার সঙ্গেই
যাচ্ছে, কেউ তা জানুক নাই-বা জানুক অদৃশ্য সে,

আমার নিভৃত রাজদূত। এ মুহূর্তে হোটেলের
বিছানায় আমাকেই ভাবতে ভাবতে শুয়ে আছো,
স্বপ্নন্বেষী, স্বামীর নিবিড় আলিঙ্গনে আর আমি
নিশীথে নিজের সঙ্গে কথা বলি, কবিতায় মগ্ন
হই আর তোমাকেই গ’ড়ে তুলি স্বপ্নের স্থাপত্যে;
আরেকটি প্রত্যূষ ঘোষিত হয় মোরগের ডাকে।
২৫/২/৯৫

প্রবাসে এক কবি

এখানে দিল্লীতে দূর পরবাসে ব’সে ব’সে ভাবি,
প্রবাসী কবির নিজ ঘরে কয়েকটি মেঘ খুব
আসা-যাওয়া করে আর নক্ষত্রেরা অগোচরে উঁকিঝুঁকি দ্যায়,
বসায় রূপালি মেলা। কেউ এলে হঠাৎ উধাও
সব; জোনাকির দল ঘরে
ঢুকবে কি ঢুকবে না ইতস্তত করে। যখন সে
লোকটাই নেই ঘরে তাহলে খামোকা
আমাদের জ্বলা আর নেভা,
ভেবে ওরা ফিরে যায় ঝোপঝাড়ে। কখনো নয়না
খেলাচ্ছলে ঘরে ঢুকে দ্যাখে
ওহো কী সুন্দর পাখি-পরিবার,-‘এসে দেখে যাও’
ব’লে সবাইকে ডেকে এনে
সে-দৃশ্য হারিয়ে ফেলে বড় কষ্ট পায়। শিশুটির
মন কিছুতেই খেই পায় না ছলনা কুহকের।

যখন এখানে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে শুয়ে আছি বিছানায়,
মোগল সম্রাট হুমায়ুন তাঁর সমাধিতে গভীর নিদ্রায়
অচেতন, দিল্লীর অমেয় অস্তরাগে গালিবের গজলের
স্তব করে অমরতা, ইতিহাস দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে,
প্রাচীন নগরী অকস্মাৎ যুগল ঘুঙুর হয়ে বেজে ওঠে,
তখন কি আমার বাড়ির পার্শ্ববর্তী পথ জেগে
আছে ধু ধু চোখে আঁকাবাঁকা হয়ে বেশ কিছু দূর?
যখন এখানে দেয়ালের শূন্যতায় নিবিষ্ট তাকিয়ে আছি,
তখন কি আমার নিজস্ব অন্তর্গত বাগানের ফুলগুলি
নিদ্রাতুর খুব নাকি ধুলায় লুটাচ্ছে বেখেয়াল
যুবতীর কানের দুলের মতো? নিজেকে এমন একা আর কোনোদিন
কখনো হয়নি মনে। পেয়ারা গাছের পাতা, ক্যামেলিয়া আমাকে কি ডাকে?

যাকে আমি দিক্‌ভ্রষ্ট নাবিকের মতো
ধ্রুবতারা ব’লে প্রাণে করেছি ধারণ, সে কি আসে আমিহীন
ঘরে, চোখ বুলোয় বইয়ের র্যা কে, বিক্ষিপ্ত কাগজে, ফটোগ্রাফে?
নিভৃত শরীরে যার টাঙ্গাইল বিরান বালিশে তার সরু
প্রেমর্দ্রে, শিল্পিত আঙুলের
নম্র, স্পর্শ ঈষৎ বুলিয়ে দ্যায়, কবির স্মৃতির আকর্ষণে?
১/২/৯৫

প্রেমের দেবতা আমাকে

প্রেমের দেবতা অকার্পণ্যে আমাকে দান করেছিলেন
অসামান্য এক উত্তরাধিকার। আমি ফতুর জুয়াড়ির মতো
অপচয় করেছি সেই সম্পদ। আখেরে
পরিণত হয়েছিলাম করুণ ছায়ায়। কালের হিংস্র কুকুর
আমাকে তাড়াতে তাড়াতে
জখম করেছে চরম নির্দয়তায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
আমার মুখ দেখে নিজেই চম্‌কে উঠেছি-‘কে এ ক্ষয়া প্রেত?’
আমার শরীর থেকে সব সময়
বেরুচ্ছিল গোরস্তানের পুরনো কবরের গন্ধ। ভূতুড়ে অন্ধকারকে
প্রবেশ করতে দিয়েছি নিজের ভেতর।

ঠিক সেই সময় দৈবাৎ তার সঙ্গে দেখা। এর আগে
সে আমার কাছে কোনো নামও ছিল না,
তার অস্তিত্ব বিষয়ে ক্ষীণতম সচেতনতা থাকা তো দূরের কথা।
অথচ তাকে দেখেই মনে হলো, তার চকিতে চাউনি,
মৃদু হাসি, তার রূপ আমার জন্মের ওপার থেকে চেনা।
তার বসে-থাকা, উঠে দাঁড়ানো, পথ চলা,
চুলের বিন্যাস তাকে দেখার অনেক আগে থেকেই
আমার মুখস্থ।

আর সবচেয়ে আশ্চর্য, সে এই ঘাটোর্ধ কান্তিবর্জিত,
অসুস্থ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল
তারও ভালোবাসার উত্তাল জলে। তার হৃদয় থেকে
একটি সোনালী প্রজাপতি বেরিয়ে এসে
আমার সত্তায় ছড়িয়ে দিল অপরূপ আবীর,
আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, ‘ভালোবাসি’।

তক্ষুণি আমার শরীর থেকে গোরস্তানের গন্ধ লুপ্ত,
এবং সজীব গোলাপ বাগানের সৌরভে
ভরে গেল আমার অস্তিত্বের মূল মৃত্তিকা। রুদ্ধ দরোজা ভেদ ক’রে
আমার চোখ দেখতে পেলো এক পুষ্পিত, শূন্য পথ।

প্রেমের দেবতার কাছে কৃতজ্ঞতায়
মাথা নুয়ে এলো আমার। তিনি তাঁর অনিন্দ্য সুন্দর
উত্তরাধিকারের সবটুকু প্রত্যাহার করে নেননি এখনো। আমি
এই সম্পদ যক্ষের মতো আগলে রাখবো আমরণ।
২৪/২/৯৫

প্রেরণার প্রতীক্ষায়’

কবিতা কখনো ছিপছিপে নাও, গহীন গাঙের
ঢেউ ছুঁয়ে ছুঁয়ে কী সহজে ব’য়ে যায়। কখনো-বা সেই নাও
ধূসর চড়ায় ঠেকে হয় রুদ্ধ গতি। কিছুতেই
চালানো যায় না লগি, বৈঠা
বাওয়া ভার, পাল খাটাবার
ইচ্ছা নিরর্থক; নিচে নেমে শত ঠেলাঠেলি ক’রে
শ্রান্ত হওয়া ছাড়া উদ্যমের অন্য কোনো
পরিণতি নেই। কবিতার মতিগতি বোঝা দায়।

ভালো ফলনের পর কৃষক যেমন উল্লাসের ডানা পেয়ে
আকাশে উড়তে থাকে, তেমনি কবিও
বেশ ক’টি কবিতা সহজে লিখে ফেলে
আনন্দে বিভোর। প্রেরণার অনটনে কবি তার
লেখার টেবিলে ব’সে থাকেন সর্বক্ষণ,
যদি সরস্বতী ডানা-অলা পরী হ’য়ে মধ্যরাতে
মাথার পিছনে তার উড়ে আসে, যদি অতীতের
কোনো কবি তার কানে-কানে জপান সিদ্ধির মন্ত্র।

প্রেরণা নারীর মতো লাস্যময়ী এবং চঞ্চলা,
যখন তখন তার নূপুরের ধ্বনি
কোথাও ওঠে না বেজে। কে যেন কোথায় বলেছেন-
প্রেরণার প্রতীক্ষায় তুমি ব’সে থেকো না অনড়, আশা জ্বেলে
চোখের ভেতর তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে পড়ো,
হঠাৎ বিজন পথে বিংবা ভিড়াক্রান্ত ফুটপাথে তার সাথে
দেখা হ’য়ে যেতে পারে দৈববলে, যেমন গৌরীর
সঙ্গে হলো মিলন তোমার সিকি শতাব্দীর পর।
১৪/১২/৯৫

 ফতোয়া

নির্দেশ অমান্য ক’রে পুনরায় আজ
এই ঘোর তমসায় কে জ্বালায় মঙ্গল প্রদীপ?
যাও, যাও, ওকে বেঁধে আনো।
দারুণ খরায় পুড়ে পতিত জমিন
কে করে আবাদ? কার এমন সাহস?
কারাগারে হোক ওর ঠাঁই।

আড়ালে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কে ফোটায় ফুল?
ওকে জব্দ করো।
এমন নিশুত রাতে বেহালায় ছড় টেনে তোলে
সুর, কে সে? এখুনি পোড়াও তার ঘর।
কার পায়ে উতরোল বেজে ওঠে নিষিদ্ধ নূপুর?
এ মুহূর্তে পরাও শেকল তার পায়ে।

কে তরুণ বিবাহের আগে জ্যোৎস্না রাতে
তরুণীর হাতে রাখে হাত? কেটে ফেলো তার হাত।
কে একেলা ঘরে ব’সে না পড়ে খোদার
কালাম, সেজদাহীন কেবলি কাসিদা
লেখে সুন্দরের
লহমায় তার বাস্তুভিটায় চরিয়ে দাও ঘুঘু।
১০/১১/৯৩

বদলাতে থাকে

ত্রয়ী কথাশিল্পী রশীদ করীম, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং
সৈয়দ হকের সঙ্গে আমার বন্ধুতা দীর্ঘকালের, অথচ
তাঁরা উপন্যাস লেখার সময় মূল কাহিনী একটু-আধটু ক’রে
বদলে ফেলেন কিনা, এতদিনেও তাঁদের জিগ্যেস করা হয়নি।
কত কথাইতো হয় আমাদের, হয়তো
এই কথাটি ঢাকা প’ড়ে থাকবে অনেক কথার আড়ালে। তবু
অনুমান করি, তাঁরা সম্ভবত লিখতে লিখতে ভাবেন,
ভাবতে ভাবতে লেখেন আর বদলে ফেলেন অনেক কিছু।

জীবন সব সময় একই রকম থাকে না,
আমাদের সবারই জীবন কমবেশি, কারো অতি শ্লথ, কারো খুব দ্রুত
বদলাতে থাকে। কখনো কখনো টের পাওয়াই ভার।
তোমরা আমার দিকেই তাকাতে পারো, তোমরা যারা
আমার বিষয়ে অল্পবিস্তর জানো (সবটুকু কে-ই বা জানতে পারে?)
তারা বলতে পারবে কী রকম বদলে গিয়েছি আমি। আমার
শারীরিক ভূগোলের পরিবর্তন এত বেশি
দৃষ্টিগোচর যে, অনেকেই কেমন নজরে তাকায়, যেন ওরা কোনো
কাকতাড়ুয়া দেখছে! আমার যৌবনের জামাকাপড়
এখন আমার গায়ে লাগবে না, হবে না মানানসই।

বহুকাল আমি খোলামকুচি আর কাচের টুকরো নিয়ে
খেলায় মেতে থেকেছি, এইতো কিছুদিন আগে
এক আশ্চর্য মণিরত্ন দেখা দিয়েছে আমার চলার পথে আর
আমার জীবন বদলে গ্যাছে সম্পূর্ণভাবে। আমার মধ্যে
ভালোবাসার সেই দ্যুতি ঝিকিয়ে উঠেছে যা, মানবতার অনুপম
ঐশ্বর্যের সন্ধান দেয়, ঝর্নাতলার নুড়িকে নক্ষত্রে
রূপান্তরিত করার ক্ষমতা ধরে। আজ সহজেই বিশ্বের
সর্বকালের মহাকবিদের আসর ব’সে যায়
আমার দহলিজে। কেউ কেউ আমাকে লক্ষ করেন ঈষৎ কৌতূহলে,
কেউ কেউ আমার কবিতার খাতা নিয়ে খানিক
নাড়াচাড়া ক’রে রেখে দেন টেবিলে। কেউ হেসে
দেখিয়ে দেন ক্রটিগুলো।
একজন শ্বেত শ্মশ্রুমণ্ডিত অমিতকান্তি কবি
আমাকে একপাশে এনে
চুপিসারে বলেন, “তোমার কাব্যভাষায় সেই স্পর্শ আনতে
চেষ্টাশীল হও যা’ সমকালীন বাংলা কবিতায় গরহাজির।
“কী ক’রে আনবো আমি কি পারবো, হে কবিগুরু ?
আমি প্রশ্ন দুটি শেষ করতে না করতেই মহাকবিদের আসর
মিলিয়ে যায় শূন্যতায়। আমি বদলে যাওয়ার প্রত্যাশায়,
প্রতীক্ষায় কম্পমান কোনো বয়স্ক মৎস্য শিকারীর মতো।
নিউইয়র্ক ৩/১০/৯৫

বেঁচে থাকতে চাই

আমার দেহঘরে ধেড়ে ইঁদুরের মতো গর্ত খুঁড়ছে
নানা ব্যাধি; দৃষ্টিহীন বাদুড়ের
ডানার সৃষ্টিছাড়া ছায়া ঘনাচ্ছে আমার দুচোখে।
অস্তিত্বের তন্তুজালে মাঝে-মধ্যে যে-উৎসব
জ্বলজ্বল করে তার স্থায়িত্বের সীমা ক্রমশ সঙ্কুচিত,
মাথার ভেতরকার দুঃস্বপ্নের দাঁত-নখের
ভয়ানক আঁচড়ে আমাকে বার বার দাঁড় করিয়ে দেয়
খাদের কিনারে, তবু বেঁচে থাকতে চাই।

শক্ররা তূণ থেকে একের পর এক শর নিক্ষেপ করছে
আমার দিকে, আমাকে সুনামের
শিখর থেকে ধুলোয় ফেলে পদদলিত করার অভিলাষে
মত্ত কিছু ধর্মান্ধ, কুসংস্কার-পসারী,
আমার প্রাণ হরণের জন্যে ওদের জিভ লক লক করছে
নেকড়ের মতো; যাতে আমার
মুক্ত কণ্ঠস্বর বিজন হাওয়ায় হারিয়ে যায়, সেজন্যে ওদের
ষড়যন্ত্রের অন্ত নেই; তবু আমার বাচাঁর সাধ সতেজ।

যে পাখিটি এইমাত্র রেলিঙ-এ উড়ে এসে বসল তার জন্যে,
বাগানের ফুলগুলোর জন্যে,
যে গাছের ছায়া আমার বারান্দায় নমিত প্রার্থনার মতো,
তার জন্যে, বাঁশবাগানের বৃষ্টির গন্ধ, গরুর বাথানের
সদ্যেজাত বাছুরের ঘ্রাণ আর দীঘির ঘাটে তরুণীর
ভাসমান কলসের জন্যে, ধানের ক্ষেতে কৃষকের
রৌদ্রঝলসিত কাস্তের জন্যে, গাঁয়ের বাড়ির বৈঠকখানায় দুপুরে
খাটে শুয়ে ঘুঘুর ডাকে ডুব দেওয়ার জন্যে, গহীন গাঙে
পালতোলা নাওয়ের জন্যে, রঙিলা নায়ের মাঝির
গানের জন্যে, সর্ষেক্ষেতের প্রজাপতির জন্যে বাঁচতে চাই।

আমার মায়ের মুখের প্রসন্নতার জন্যে,
আমার জীবনসঙ্গিনী, সন্তান-সন্ততি, আমার সকল
ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের জন্যে,
আমার চার বছরের পৌত্রী নয়নার কালো চোখের চাওয়া
আর ফুটফুটে হাসির জন্যে,
যাকে ভালোবাসি, তার জীবনের রৌদ্রজ্যোৎস্না
অনুভব করার জন্যে, তাকে আরো বেশি দেখার জন্যে
বেশ কিছুকাল বাঁচার আনন্দে বেঁচে থাকতে চাই।

শীতের দুপুরে আকাশে চিলের চক্করের জন্যে,
ফুটপাথের পাশে দাঁড়ানো নিঃসঙ্গ মানুষের জন্যে,
ঘরেতে ভ্রমরের গুঞ্জরণের জন্যে, নিশুত রাতে
কালপুরুষের উপস্থিতির জন্যে,
রবীন্দ্রনাথের গানের জন্যে, লালন-গীতিকার জন্যে আর
আমার এখনো লিখতে না-পারা কবিতার জন্যে,
বাংলা কবিতার নতুন বাঁকে দাঁড়ানোর জন্যে,
আমার বেঁচে থাকার স্পৃহা ক্রমাগত বাড়তে থাকে।

প্রতিবাদী মিছিল থেকে সন্ধেবেলা ফিরে-আসা
ছোট ভাইয়ের মাথায় বড় আপার
হাত বুলিয়ে দেওয়ার অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্যে,
কারাগার থেকে জনগণনন্দিত রাজবন্দী মুক্তির জন্যে,
সংখ্যালঘুদের নীরব দেশত্যাগ বন্ধ হয়েছে,
পাহাড়ী তরুণ তরুণীর উৎপীড়িত বেদনার্ত দিনগুলি, রাতগুলি
অবসিত হয়েছে, মাতৃভূমিতে নির্যাতিত আদিবাসীদের
অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এই সংবাদ
শোনার জন্যে, দেশ ধুরন্ধর ফতোয়াবাজদের
দন্তনখর থেকে মুক্ত হয়েছে, ঘাতকদের অন্ত্রময় ডেরা
বিলুপ্ত হয়েছে জানার জন্যে, মানবতার বিজয়োৎসব দেখার জন্যে
ফিনিক্‌স পাখির মতো বার বার বেঁচে উঠতে চাই।
১৯/১২/৯৫

বেজে ওঠে আলোর ঝংকার

কোন্‌ তীর্থে যাব আজ? কোথাও যাবার পথ নেই।
এই দম-আটকানো অন্ধকারে। হাত্‌ড়ে
হাত্‌ড়ে পথ চলি সারাক্ষণ, এগিয়েছি
ভেবে দেখি পিছিয়ে গিয়েছি বহুদূর,
যাত্রাই করিনি যেন, এরকম স্থানু
এখানে আমরা সব পচাগলা শবের মতোই।

এই মাত্র এ কাকে করেছি আলিঙ্গন
ভরাট ব্যাকুলতায়? মানুষের মতো, তবু কেন
মানব হয় না মনে অনুভবে? সর্বাঙ্গে কর্কশ
লোম তার, নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে তীব্র গন্ধকের ঘ্রাণ।

বন্‌ বন্‌ লাঠি ঘোরে চতুর্দিকে, অস্ত্র শানানোর
শব্দে ঘুম নেই চোখে বস্তুত ব্যাপক
কারাগারে; মোহান্ত ও শাস্ত্রীদের মুখে
সর্বদা ধর্মের বুলি, অথচ শহজে মাতে ওরা নরবলি
এবং বীভৎস কোলাহলে। সুন্দরের
দিকে দাঁত খিঁচিয়ে সদলে তেড়ে আসে বার বার।

পূর্ণিমা, প্রেমের গান আর নৃত্যকলা
আর মুক্তপক্ষ মননকে ওরা বেআইনী
করেছে সদর্পে, কবিদের মিথ্যাবাদী আখ্যা দিয়ে
ঝরিয়েছে লানতের বৃষ্টি অবিরাম।
অকস্মাৎ কার কণ্ঠে বেজে ওঠে আলোর ঝংকার
‘তীর্থের কী প্রয়োজন এবার গা ঝাড়া দাও একত্রে সবাই,
হাতকড়া খসে যাবে চোখের পলকে,
খুলে যাবে সকলের পায়ের শেকল অচিরেই,
সূর্যোদয় বিছাবে গালিচা তোমাদের খোলা পথে।
২২/৮/৯৫

ভ্রমণ

চড়ায় ঠেকেছে নাও আগে দাঁড়, বৈঠা কোথায় উধাও।
মাছ খেলা করে চার পাশে,
দমকা হাওয়ায় নড়ে ছেঁড়া পাল। ‘জড়ো করো
দড়িদড়া ভাঙা কাঠ। আবার বানাও নাঙা গায়
নতুন আঙ্গিকে নাও’ ব’লে দীর্ঘদেহী
পল এলুয়ার
এলেন নৌকোয় উঠে, ধরলেন হাল; মাঝিবেশে
তাঁকে দেখে একস্মাৎ মৃতকল্প সর্পিনীর মতো শুক্‌নো খাল
ফুঁসে ওঠে, নদী হয়, জল চিরে নৌকো
চলে প্রায় অক্ষরবৃত্তের টানে অজানার পানে।

আরো কিছু কথা এলুয়ার
জলের মতন স্বরে বলেন, সেসব কথার
মানে বোধাতীতে থেকে যায় একঝাঁক
পাখির ডানার অন্তরালে। দেখি নিই তিনি এই
গলুইয়ে, স্তম্ভিত আমি। নৌকো পাক খায় সীমাহীন
নদীর আবর্তে, ভেসে চলি বড় একা
অসহায় কুহকের মতো কুয়াশায়।

 যখন কবিতা পড়ি

যখন কবিতা পড়ি প্রাতঃস্মরণীয় কবিদের
একটি কি দুটি চিত্রকল্প কিংবা দুর্লভ উপমা
দেখি, পাই অমোঘ পঙ্‌ক্তির দেখা, তখন নিজেকে
বড় বেশি ব্যর্থ মনে হয়। কবি ব’লে খ্যাতি রটে,
অথচ নিজেই জানি এই অভিধার যোগ্য নই
আমি, শামুকের মতো নিজের ভেতর সর্বক্ষণ
সংকুচিত থাকি, অন্তর্গত বিষণ্ণতা ব’য়ে নিয়ে
মানুষের হাটে ঘুরি, নানা ছলে ব্যর্থতাকে ঢাকি।

তবু কেন শব্দের ভ্রমর গুন্‌গুনিয়ে যায় এই
অবেলায়? কেন নক্ষত্রেরা কবিতার পঙ্‌ক্তি হ’য়ে
লুকোচুরি খেলে? কেন ঘাসের উপর শিশিরের
বিন্দুগুলি আমাকেই লক্ষ্য ক’রে হয় জ্বলজ্বলে?
আমার পথের ধারে কে এক রহস্যময়ী হাতে
পুষ্পময় ডালা নিয়ে আশ্চর্য মুদ্রায় উপস্থিত?
৭/৭/৯৩

যখন তুমি শোকের বাড়ি থেকে ফিরে এলে

তখন তুমি বিষাদে আছো, তখন তোমাকে
লেহন করছে শোকের বাড়ির ভারী ছায়া, তখন তোমার
সত্তায় লোবানের ঘ্রাণ, সদ্য কেনা মার্কিন
কাপড়ের কেমন গন্ধ, কোরানের
আয়াতের সুর, অনেকের বিলাপধ্বনি; তখন সেই
দুপুরে জলধারা,
কোনো মৃত মুখ দেখতে তোমার ভালো লাগে না।

শোকের বাড়ি থেকে ফিরে এসে তুমি
আমার সঙ্গে কথা বললে টেলিফোনে। তোমার
কণ্ঠস্বরে আমি বিষাদের মুখ দেখলাম,
শুনতে পেলাম চাপা হাহাকার। সেই মুহূর্তে তুমি
মৃত্যুর ছায়ার দাঁত-নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত।
আমি তোমাকে ক্যামেলিয়া আর
থালাভর্তি স্বর্ণচাঁপা আর সযত্নে গাঁথা
বেলফুলের মালার কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম।
তোমার চেতনার প্রান্তরে ছুটিয়ে দিলাম এক পাল
হরিণ, তোমাকে স্নাত করলাম
ঝর্ণাতলার গানে, আমি তোমার মতো ক’রে
তোমাকে ভালোবাসার কথা শোনালাম।

মৃত্যুর থাবার নিচে ছিল যে-বাড়ি, যে বাড়ি আমি
কখনো দেখব না, যে বাড়ির প্রতিটি ঘরে
কলরব করছিল শোকের কালো অক্ষরসমুদয়,
সে বাড়ির ছায়া তোমার মন থেকে
সরিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে আমি তোমার কানে
অর্পণ করলাম জীবনের স্তব। আখেরে
সব কিছুই মৃত্যু আর অবলুপ্তির অধীন ভেবে
তুমি বিষাদকেই প্রাধান্য দিলে সেই প্রাণবন্ত দুপুরে।
২১/৫/৯৫

শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া

যখন পাখিরা সব ম্লান গোধূলিতে আসমানে
রহস্য ছড়িয়ে ফিরছিলো নীড়ে আর
জনসভা থেকে লোকজন
যে যার আপন ঘরে ফেরার তাগিদে মশগুল,
তখন পথের ধারে একজন লোক
পড়ে ছিল একাকী নিঃসাড়। তাকে ঘিরে
একটি জটলা গড়ে ওঠে
নিমেষেই, কেউ কেউ খুব ঝুঁকে দেখে নেয় তাকে
জরিপ করার ভঙ্গিমায়। লোকটার
চোখের পাতায় মৃত্যু তার শেষ চিহ্ন রেখে গেছে।

কেমন গুঞ্জন ওঠে চতুর্দিকে-একজন বলে,
“লোকটা কি কট্রর জামাতপন্থী ছিল
“আরে তোবা তোবা কোনকালে ঘাতকের
সংশ্রবে সে আসেনি ভুলেও”, অন্যজন
সোজাসাপটা জানায়। তাহ’লে

“সে কি জাতীয়তাবাদী, জাতীয়তাবাদী ব’লে শধু
ফাটিয়েছে গলা নিত্যদিন?”

“না, তেমন কিছু নয়” একজন সুস্পষ্ট মন্তব্য
ছুঁড়ে দিয়ে সাত তাড়াতাড়ি
দূরে সরে যায়।

“তবে কি লোকটা
আওয়ামী লীগের নিষ্ঠাবান কর্মী কোনো” ব’লে কেউ
এক উপভাষার আবীর মুঠোমুঠো ছড়ায় প্রস্থানকালে।
“এ লোক আওয়ামী লীগের কেউ নয় সুনিশ্চিত।

“তা’হলে যে পড়ে আছে রাস্তার ধুলায় বড় একা
সে কি কম্যুনিস্ট একজন?” ভিড় থেকে
একজন গুঞ্জনের নিরাসক্ত ক্যানভাসে কিছু
আঁকা জোঁকা করে জানালেন
উদাসীন, “মার্ক্সবাদে দীক্ষা তার হয়নি কখনো।

“ওসব কিছুই নয়, বস্তুত সে কবি, প্রকৃত মানুষ একজন।
১৭/২/৯৫

শহুরে সংলাপ

ঘন বৃষ্টি-আঁচড়ানো দুপুরে তোমার খুব কাছে
ছিলাম নিভৃত ঘরে। সে মুহূর্তে তুমি সাবলীল
প্রফুল্ল প্রতিমা। দেখলাম-
তোমার শরীরে ধানী রঙের তরঙ্গ যাচ্ছে ব’য়ে।
হঠাৎ বল্লাম, ‘চলো এই বন্ধ ঘরে ছেড়ে দূরে
কোথাও বেরিয়ে পড়ি রিক্‌শায় দুজন।
পুরানো ঢাকায় যাবে? সেখানে আমার
বালক বয়স আর কিশোর বয়স আর যুবা বয়সের
বহুদিন প্রীত উড়ে গিয়ে তোমার শাড়ির
আঁচলের মতো
ছুঁয়েছে নীলিমা অগোচরে। প্রিয়তমা,
চলো না সেখানে যাই সেই সরু গলির ভেতর,
যেখানে একদা আমি বন থেকে অনায়াসে
চিত্রল হরিণ ডেকে আনতাম, মেঘ ডেকে আনতাম ঘরে
নিরালা সংকেতে। দেখতাম বাতিঅলা
আসতো নিঃশব্দে হেঁটে গলির গলায়
পরাতে আলোর মালা, ভিস্তি মশকের ভারে নুয়ে
বিলোতো শীতল জলধারা ঘরে ঘরে। শুনতাম
কান পেতে তারা মসজিদ থেকে ভেসে-আসা ফজরের সুরেলা আজান
আর সন্ধেবেলা মন্দিরের মনকাড়া ঘন্টাধ্বনি।

সত্যি কি আমাকে নিয়ে যাবে আজ পুরনো শহরে,
যেখানে তোমার মন পড়ে থাকে আজো? জানি আজো
স্মৃতিকাতরতা
তোমার দুচোখে ফ্যালে ছায়া, তুমি কোনো কোনো ভোরে
স্বপ্নে জীর্ণ আস্তাবল, বেতো ঘোড়াদের ঘ্রাণ নিয়ে
জেগে ওঠো বিছানায়, ভাবো কবেকার চাখানাকে
সোলেমান বাদশার ধনাগার, কখনো আনন্দে ঝলোমলো
আমাকে শোনাও লালবাগ কেল্লার ভেতরকার
কবরে শায়িতা পরী বিবির কাহিনী। একদিন
বললে তুমি, ‘এই তো সেদিন
অনেক বছর পরে আমাদের প্রাক্তন বাড়ির কাছে গিয়ে
চিনতে পারিনি তাকে, যার পরতে পরতে ছিল
একদা আমার দিনগুলি, রাতগুলি। প্রতি ইটে লেখা ছিল
আমার কৈশোর, যৌবনের গজলের প্রেমাক্ষর।

-চলো যাই গোধূলিতে হাঁটতে হাঁটতে পুনরায়
বুড়িগঙ্গা নদীটির রূপ দেখে আসি একবার। সঙ্গোপনে
আমরা দুজন ঘাটে-ভেড়া বজরার ছাদে ব’সে পাশাপাশি
দেখবো সূর্যাস্ত, খাবো চিনেবাদাম অথবা
ঝালমুড়ি, অন্ধকার গাঢ় হলে মুখচুম্বন করবো
তোমার আবেগভরে, তারপর নেমে এসে বাকল্যান্ডে চোখ
রেখে হেঁটে যাবো পরস্পর হাত ধ’রে কিছুদূর। দেখে নেবো
পুরনো এ শহর কীভাবে
ঈষৎ বদলে যাচ্ছে নতুন যুগের আলিঙ্গনে,
যেমন আমিও সদ্য যুবা হই তোমার নিবিড় বাহুপাশে।
দ্যাখো এই মনোহারী দোকানের জায়গায় একদা
ছিল এক বটগাছ, লুপ্ত সেই বৃক্ষটির ছায়া
এখনো আমার মনে ছড়াম সুস্নিগ্ধ ছায়া তার। এই অতি-পুরাতন
মাটিতেই রোদে জ্বলে, জলে ভেজে আমার শিকড়।
৫/৭/৯৫

সে কোনো লাইনে ছিল না

খুব পোড়-খাওয়া এক লোক হেঁটে যাচ্ছে একা-একা
কোথাও সবুজ উপত্যকা আছে ভেবে।
কোনো দিকে দ্যায় না তেমন দৃষ্টি, শুধু
মাঝে-মাঝে একটি কি দুটি
চন্দনা, দোয়েল কিংবা শিমুলের লাল
দ্যাখে, আর ঝরা পাতাদের কান্না শোনে।

অকস্মাৎ, ঢ্যাঁড়া জোর পিটিয়ে বহু লোক একাকী লোকটিকে
ডেকে বলে, ‘কোথাও, চলেছ? এসো এই
লাইনে দাঁড়াও, জোট বাঁধো
আমাদের সঙ্গে, এই দল দেখছইতো বেশ ভারী, জোরদার
এসো এসো মোক্ষ যদি চাও। সেই লোক
কী ভেবে সেখান থেকে স’রে নিজ পথে হেঁটে যায়।

কিয়দ্দূর যেতে না যেতেই সে পথিক
থমকে দাঁড়ায় হৈ-হুল্লোড় শুনে; সারিবন্দী বহু
লোক, ওরা আকাশ ফাটানো গলা ছেড়ে ডাকে তাকে-
‘এখানে দাঁড়াও এসে আমাদের বিরাট কাতারে। এসে তুমি
সব পেয়েছির দেশে পৌছে যাবে সহজে। এ-কথা
লোকটাকে নিজেদের দলে টানবার
মোহন ফিকির। গোধূলির রঙ সর্বত্র মদির।
লোকটা নিজের বাঁশি ইতিমধ্যে হট্ররোলে হারিয়েছে ভেবে
এদিক ওদিক দ্যাখে, তারপর কাউকে কিছুই
না ব’লে সেখান থেকে একা-একা দিব্যি
দুটি লাইনের মধ্য দিয়ে নির্দলীয় চলে যায়।
৮/২/৯৫

 সেলিনা পারভীন স্বরণে

তোমার দিকে উদ্যত হয়েছিল নেকড়েদের থাবা,
বারুদের গন্ধে ওরা মুছে দিতে চেয়েছিল
তোমার চৈতন্যপ্রবাহ থেকে ফুলের সৌরভের স্মৃতি,
তোমার দুটি চোখ থেকে ওরা
কেড়ে নিতে চেয়েছিল সকল স্বপ্নের অভ্র-রেণু,
ওরা তোমাকে হত্যা ক’রে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল
পচা, গলিত, দুর্গন্ধময় ভাগাড়ে। একাত্তরে ওদের
দূরচিসন্ধি সকল হ’য়ে মেতে উঠেছিল উলঙ্গ নৃত্যে!

কিন্তু, ওরা জানতো না,
তোমার মৃত্যুর মহিমা ওদের সকল ষড়যন্ত্র,
ওদের কশাইখানার বন্য উল্লাসকে মিথ্যা ক’রে দিয়ে
জেগে থাকবে বিপুল সূর্যোদয়ের মতো।

তোমার শরীরকে ওরা বিকৃত করেছে
বর্বর অস্ত্রাঘাতে; কিন্তু ওদের নোংরা, না-পাক হাত
একটি সামান্য আঁচড়ও কাটতে পারেনি তোমার ভাবমূর্তিতে,
আমরা আজো মুগ্ধাবেশে দেখি সেই মূর্তির গলায় দুলছে অমরত্বের মালা।
২০/১১/৯৫

Exit mobile version