- বইয়ের নামঃ গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অগ্নিবর্ণ এক ঘোড়া
গভীর রাতে অগ্নিবর্ণ এক ঘোড়া উন্মুক্ত প্রান্তরে বেধড়ক
দৌড়ুতে থাকে এদিক সেদিক। কেউ দেখুক আর না-ই দেখুক,
সেদিকে বন্দুমাত্র দৃষ্টি নেই তার। তার এই দৌড়ে ছন্দ আছে কি
নেই, এ নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। ছুটতে তো ছুটছেই।
কখন যে সে নিখুঁত চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করেছে মোহন
এক বাগানের পাশে, সেদিকে ওর খেয়াল নেই। এই ঘোরাতেই
সে আনন্দের ঝিলিক উপভোগ করছে প্রতিটি মুহূর্তে।
সে কি ইতিমধ্যে ক্লান্তির কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েনি?
ওর শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কি ব্যথা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে না?
সে কি এই মুহূর্তেই স্বেদাক্ত শরীরে লুটিয়ে পড়বে না ধুলোয়?
না, তার তেজী আকাঙ্ক্ষাকে এখনও ম্লান করতে পারেনি
এই শ্রম। যতই স্বেদ ঝরুক ওর শরীর থেকে, ক্লান্তি যতই
থাবা সবাক ওর সত্তায়, দমে কুঁকড়ে যাওয়ার পাত্র সে
নয়। এখনও ওর শরীরে প্রতিটি রন্ধ্রে ঘোরার বাসনা চঞ্চল।
অন্ধকার নয়, আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জের সঞ্জীবনী আলো ঘোড়াকে
টগবগে করে তোলে আরও। মৃত্তিকাবিহারী অশ্ব মুহূর্তে
চলে যায় আসমানে তারার মেলায়। সেখানে মহানন্দে
বেশ কিছুক্ষণ উড়ে বেড়ানোর পর মাটির টান তাকে নিচে
নেমে আসার জন্যে উতলা করে তোলে। টগবগে ঘোড়া মর্ত্যে নেমে আসে।
১২.০৪.২০০৪
অচেনা নয়
নিজেকে শিক্ষিত বলে দাবি
করতে পারি কি এই বয়সেও? যদি
বলি, দু’তিনটি
ভাষার কতক বাক্য অর্থসমেত বলতে পারি,
লিখতেও পারি, মিথ্যা উক্তি হবে না তা। সমাজের
কোনও কোনও স্তরে সম্মানের কিছু উপঢৌকন মিলবে বটে।
অথচ আমার প্রতিবেশী না হ’লেও
অচেনাও নয় যে পাখিটা
আমার নিঝুম বারান্দায় এসে বসে, চিঁড়া মুড়ি
দিলে মুখে তুলে নেয়, উড়ে চলে যায়
আমার অজানা কোনও জায়গায়। গায়ক পাখির
গীতসুধা পান করে তৃপ্ত হই, যদিও সুরের ভাষা নেই।
অথচ করোনি মাথা নত
(হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে)
তিমির-বিলাসী যারা তারা অন্ধকারে মাথা গুঁজে
থাকে সর্বক্ষণ। তুমি বন্ধু, আলোপ্রিয়,-
বুঝি তাই জীবনের প্রায়
সকল প্রহর কাটিয়েছো জ্ঞান আহরণে আর
বিভিন্ন খাতার পাতা সাজিয়েছো সৃজন-মুখর
পঙ্ক্তিমালা দিয়ে। এভাবেই কেটে গেছে কত না বিনিদ্র রাত।
অথচ করোনি অবহেলা কোনওদিন ছাত্রদের,
দিয়েছো উজাড় ক’রে জ্ঞানের ভাণ্ডার। ওরা সব
তোমার উৎসুক, প্রিয় শিক্ষার্থী সবাই নিবেদন
করেছে সশ্রদ্ধ ভালোবাসা। ধন্য তুমি; জানলে না
যদিও এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাজপথে, চায়ের দোকানে,
এবং পণ্ডিতদের প্রতিটি আসরে, কবি-সংঘে,
গ্রামে-গঞ্জে, উদ্দীপ্ত মিছিলে আজ হচ্ছে উচ্চারিত
তোমার হীরার মতো জ্বলজ্বলে নাম। এই নাম
স্বদেশের সীমানা পেরিয়ে
এখন তো প্রস্ফুটিত দেশ-দেশান্তরে।
তুমি যে অম্লান অবদান রেখেছো গচ্ছিত
জাতির ভাণ্ডারে তার বিনিময়ে কতিপয়
সন্ত্রাসীর দাগাবাজ অস্ত্রাঘাতে হয়েছো ভীষণ জর্জরিত
অথচ করোনি মাথা নত, রেখেছো উন্নত সর্বক্ষণ।
তোমার সুপ্রিয়া কোহিনূর, জীবন সঙ্গিনী, কন্যাদ্বয় মৌলি,
স্মিতা, পুত্র অনন্য এখন
তোমাকে হারিয়ে দিশেহারা; শূন্যতার নিপীড়নে
দূর দিগন্তের দিকে দৃষ্টি মেলে দিচ্ছে বারবার। হায়, আজ
তাদের প্রশস্ত সেই তোমার বুকেই টেনে নাও। অতীতের
ধরনে স্নেহের জ্যোৎস্না ওদের অস্তিত্বে মেখে দাও, দাও আজও।
দেবে নাকি মেঘ থেকে কিংবা আলগোছে
গোধূলির অপসৃয়মাণ আভা থেকে চুম্বনের ছাপটুকু?
১৭.০৮.২০০৪
অন্ধকারের কেল্লা হবে বিলীন
তা’হলে আমি কি আমার একালা ছেড়ে একলা
কোথাও চলে যাবো? বহুদূরে
খোলা মাঠে কিংবা উপবনে? গাছপালা দেখে,
পাখির গান শুনে কাটিয়ে দেবো সারা বেলা?
এভাবেই কি মানুষের মুখ না দেখে প্রকৃতির
সৌন্দর্যে মজে থাকতে পারবো ? কী ক’রে আমার
ছয় বছরের দৌহিত্রীর মুখ না দেখে থাকবো
বহুকাল? না, এই শহরের ভিড়ভাট্রা, চুরি-চামারি, ডাকাতি
যতই হোক এই স্থান ত্যাগ করে অন্য কোথাও।
ভুলেও কোনও আস্তানা বাঁধবো না কখনও।
কখনও কখনও ক্লান্তির সবগুলো নাছোড়
আঙুল চেপে ধরে গলা রাত দুপুরে,
যখন আমি তখনকার মতো লেখার পাট চুকিয়ে তিমিরে
শয্যায় আশ্রয় খুঁজি। দম বন্ধ হয়ে আসতে
চায়; উঠে বসে স্যুইচবোর্ড হাতড়াতে থাকি। স্যুইচ
চকিতে আঙুলের দখলে আসে, আলোকিত হয় কামরা।
কে বা কারা আমার পথে বিস্তর কাঁটা বিছিয়ে
আমাকে রক্তাক্ত দেখে বিকট
ভঙ্গিতে নাচতে থাকে, ছড়া কাটে, থুতু ছিটোয়
আমার দিকে। নিশ্চুপ আমি হেঁটে যেতে থাকি উঁচিয়ে
মাথা অন্য কোনওখানে। অন্ধকারের কেল্লা নিশ্চিত
একদিন সুশীল, সুগঠিত, বিশাল মিছিলের স্লোগানে হবে বিলীন।
২২.১০.২০০৪
অপরূপ হাত
প্রিয় এই শহরের কোনও পথ দিয়ে
হেঁটে যাই যখন একাকী
ভোরবেলা হাওয়ার আদর উপভোগ করতে করতে আর
বিরান বাগান ব’লে মনে হয় পরিবেশ,
আর কেন যেন হাহাকার হু হু ক’রে জেগে ওঠে
বারবার; নিজেকে কবরস্তানে অনুভব করি।
কিছুক্ষণ পরে রোদ শিশুর হাসির মতো জেগে
উঠে চুমো খায় সঙ্গীহীন
এই পথচ্চারীটিকে। ভাবনার গোরস্তান দ্রুত উবে যায়,
মানুষের সাড়া জাগে নানা দিকে আর
কার যেন জ্বলজ্বলে ডাক আমাকে আচ্ছন্ন করে।
এদিক সেদিক দৃষ্টি মেলে দিই আর কান পাতি।
না, কেউ আমাকে ডাকছে না কোনও গলি
অথবা কাছের চা-খানায়
আপ্যায়ন করার উদ্দেশে। তবু কেন মনে হয়
কে যেন ব্যাকুল কণ্ঠস্বরে আমন্ত্রণ ক্রমাগত
জানাচ্ছে আমাকে। তাকে অবহেলা করে
চলে যাওয়া অনুচিত হবে ব’লে সেদিকে বাড়াই পদযুগ।
হায়, এগোতেই দৃষ্টি থেকে ঘরবাড়ি, মুক্ত পার্ক
এবং দোকানপাট বেবাক উধাও
চতুর্দিকে বালি, শুধু বালি আর আমি ক্রমাগত
ডুবে যাচ্ছি বড় দ্রুত বালির ভেতরে। ক্ষণকাল
পরে যেন কার, সম্ভবত কোনও কল্যাণ কামিনী
তার অপরূপ হাতে মুক্ত করেন আমাকে অনাবিল হেসে।
২৯.১০.২০০৪