ফতোয়া
নির্দেশ অমান্য ক’রে পুনরায় আজ
এই ঘোর তমসায় কে জ্বালায় মঙ্গল প্রদীপ?
যাও, যাও, ওকে বেঁধে আনো।
দারুণ খরায় পুড়ে পতিত জমিন
কে করে আবাদ? কার এমন সাহস?
কারাগারে হোক ওর ঠাঁই।
আড়ালে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কে ফোটায় ফুল?
ওকে জব্দ করো।
এমন নিশুত রাতে বেহালায় ছড় টেনে তোলে
সুর, কে সে? এখুনি পোড়াও তার ঘর।
কার পায়ে উতরোল বেজে ওঠে নিষিদ্ধ নূপুর?
এ মুহূর্তে পরাও শেকল তার পায়ে।
কে তরুণ বিবাহের আগে জ্যোৎস্না রাতে
তরুণীর হাতে রাখে হাত? কেটে ফেলো তার হাত।
কে একেলা ঘরে ব’সে না পড়ে খোদার
কালাম, সেজদাহীন কেবলি কাসিদা
লেখে সুন্দরের
লহমায় তার বাস্তুভিটায় চরিয়ে দাও ঘুঘু।
১০/১১/৯৩
বদলাতে থাকে
ত্রয়ী কথাশিল্পী রশীদ করীম, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং
সৈয়দ হকের সঙ্গে আমার বন্ধুতা দীর্ঘকালের, অথচ
তাঁরা উপন্যাস লেখার সময় মূল কাহিনী একটু-আধটু ক’রে
বদলে ফেলেন কিনা, এতদিনেও তাঁদের জিগ্যেস করা হয়নি।
কত কথাইতো হয় আমাদের, হয়তো
এই কথাটি ঢাকা প’ড়ে থাকবে অনেক কথার আড়ালে। তবু
অনুমান করি, তাঁরা সম্ভবত লিখতে লিখতে ভাবেন,
ভাবতে ভাবতে লেখেন আর বদলে ফেলেন অনেক কিছু।
জীবন সব সময় একই রকম থাকে না,
আমাদের সবারই জীবন কমবেশি, কারো অতি শ্লথ, কারো খুব দ্রুত
বদলাতে থাকে। কখনো কখনো টের পাওয়াই ভার।
তোমরা আমার দিকেই তাকাতে পারো, তোমরা যারা
আমার বিষয়ে অল্পবিস্তর জানো (সবটুকু কে-ই বা জানতে পারে?)
তারা বলতে পারবে কী রকম বদলে গিয়েছি আমি। আমার
শারীরিক ভূগোলের পরিবর্তন এত বেশি
দৃষ্টিগোচর যে, অনেকেই কেমন নজরে তাকায়, যেন ওরা কোনো
কাকতাড়ুয়া দেখছে! আমার যৌবনের জামাকাপড়
এখন আমার গায়ে লাগবে না, হবে না মানানসই।
বহুকাল আমি খোলামকুচি আর কাচের টুকরো নিয়ে
খেলায় মেতে থেকেছি, এইতো কিছুদিন আগে
এক আশ্চর্য মণিরত্ন দেখা দিয়েছে আমার চলার পথে আর
আমার জীবন বদলে গ্যাছে সম্পূর্ণভাবে। আমার মধ্যে
ভালোবাসার সেই দ্যুতি ঝিকিয়ে উঠেছে যা, মানবতার অনুপম
ঐশ্বর্যের সন্ধান দেয়, ঝর্নাতলার নুড়িকে নক্ষত্রে
রূপান্তরিত করার ক্ষমতা ধরে। আজ সহজেই বিশ্বের
সর্বকালের মহাকবিদের আসর ব’সে যায়
আমার দহলিজে। কেউ কেউ আমাকে লক্ষ করেন ঈষৎ কৌতূহলে,
কেউ কেউ আমার কবিতার খাতা নিয়ে খানিক
নাড়াচাড়া ক’রে রেখে দেন টেবিলে। কেউ হেসে
দেখিয়ে দেন ক্রটিগুলো।
একজন শ্বেত শ্মশ্রুমণ্ডিত অমিতকান্তি কবি
আমাকে একপাশে এনে
চুপিসারে বলেন, “তোমার কাব্যভাষায় সেই স্পর্শ আনতে
চেষ্টাশীল হও যা’ সমকালীন বাংলা কবিতায় গরহাজির।
“কী ক’রে আনবো আমি কি পারবো, হে কবিগুরু ?
আমি প্রশ্ন দুটি শেষ করতে না করতেই মহাকবিদের আসর
মিলিয়ে যায় শূন্যতায়। আমি বদলে যাওয়ার প্রত্যাশায়,
প্রতীক্ষায় কম্পমান কোনো বয়স্ক মৎস্য শিকারীর মতো।
নিউইয়র্ক ৩/১০/৯৫
বেঁচে থাকতে চাই
আমার দেহঘরে ধেড়ে ইঁদুরের মতো গর্ত খুঁড়ছে
নানা ব্যাধি; দৃষ্টিহীন বাদুড়ের
ডানার সৃষ্টিছাড়া ছায়া ঘনাচ্ছে আমার দুচোখে।
অস্তিত্বের তন্তুজালে মাঝে-মধ্যে যে-উৎসব
জ্বলজ্বল করে তার স্থায়িত্বের সীমা ক্রমশ সঙ্কুচিত,
মাথার ভেতরকার দুঃস্বপ্নের দাঁত-নখের
ভয়ানক আঁচড়ে আমাকে বার বার দাঁড় করিয়ে দেয়
খাদের কিনারে, তবু বেঁচে থাকতে চাই।
শক্ররা তূণ থেকে একের পর এক শর নিক্ষেপ করছে
আমার দিকে, আমাকে সুনামের
শিখর থেকে ধুলোয় ফেলে পদদলিত করার অভিলাষে
মত্ত কিছু ধর্মান্ধ, কুসংস্কার-পসারী,
আমার প্রাণ হরণের জন্যে ওদের জিভ লক লক করছে
নেকড়ের মতো; যাতে আমার
মুক্ত কণ্ঠস্বর বিজন হাওয়ায় হারিয়ে যায়, সেজন্যে ওদের
ষড়যন্ত্রের অন্ত নেই; তবু আমার বাচাঁর সাধ সতেজ।
যে পাখিটি এইমাত্র রেলিঙ-এ উড়ে এসে বসল তার জন্যে,
বাগানের ফুলগুলোর জন্যে,
যে গাছের ছায়া আমার বারান্দায় নমিত প্রার্থনার মতো,
তার জন্যে, বাঁশবাগানের বৃষ্টির গন্ধ, গরুর বাথানের
সদ্যেজাত বাছুরের ঘ্রাণ আর দীঘির ঘাটে তরুণীর
ভাসমান কলসের জন্যে, ধানের ক্ষেতে কৃষকের
রৌদ্রঝলসিত কাস্তের জন্যে, গাঁয়ের বাড়ির বৈঠকখানায় দুপুরে
খাটে শুয়ে ঘুঘুর ডাকে ডুব দেওয়ার জন্যে, গহীন গাঙে
পালতোলা নাওয়ের জন্যে, রঙিলা নায়ের মাঝির
গানের জন্যে, সর্ষেক্ষেতের প্রজাপতির জন্যে বাঁচতে চাই।
আমার মায়ের মুখের প্রসন্নতার জন্যে,
আমার জীবনসঙ্গিনী, সন্তান-সন্ততি, আমার সকল
ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের জন্যে,
আমার চার বছরের পৌত্রী নয়নার কালো চোখের চাওয়া
আর ফুটফুটে হাসির জন্যে,
যাকে ভালোবাসি, তার জীবনের রৌদ্রজ্যোৎস্না
অনুভব করার জন্যে, তাকে আরো বেশি দেখার জন্যে
বেশ কিছুকাল বাঁচার আনন্দে বেঁচে থাকতে চাই।
শীতের দুপুরে আকাশে চিলের চক্করের জন্যে,
ফুটপাথের পাশে দাঁড়ানো নিঃসঙ্গ মানুষের জন্যে,
ঘরেতে ভ্রমরের গুঞ্জরণের জন্যে, নিশুত রাতে
কালপুরুষের উপস্থিতির জন্যে,
রবীন্দ্রনাথের গানের জন্যে, লালন-গীতিকার জন্যে আর
আমার এখনো লিখতে না-পারা কবিতার জন্যে,
বাংলা কবিতার নতুন বাঁকে দাঁড়ানোর জন্যে,
আমার বেঁচে থাকার স্পৃহা ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
প্রতিবাদী মিছিল থেকে সন্ধেবেলা ফিরে-আসা
ছোট ভাইয়ের মাথায় বড় আপার
হাত বুলিয়ে দেওয়ার অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্যে,
কারাগার থেকে জনগণনন্দিত রাজবন্দী মুক্তির জন্যে,
সংখ্যালঘুদের নীরব দেশত্যাগ বন্ধ হয়েছে,
পাহাড়ী তরুণ তরুণীর উৎপীড়িত বেদনার্ত দিনগুলি, রাতগুলি
অবসিত হয়েছে, মাতৃভূমিতে নির্যাতিত আদিবাসীদের
অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এই সংবাদ
শোনার জন্যে, দেশ ধুরন্ধর ফতোয়াবাজদের
দন্তনখর থেকে মুক্ত হয়েছে, ঘাতকদের অন্ত্রময় ডেরা
বিলুপ্ত হয়েছে জানার জন্যে, মানবতার বিজয়োৎসব দেখার জন্যে
ফিনিক্স পাখির মতো বার বার বেঁচে উঠতে চাই।
১৯/১২/৯৫