পূর্বাপর
একটু পরেই তুমি অতিকায় ধাতব পাখির
জঠরে নিশ্চুপ ব’সে দেবে আকাশের উড়াল আর
আমি একা ছোট অন্ধকার ঘরে থাকব লুকিয়ে
মুখ, পাছে কেউ দেখে ফ্যালে আমার প্রায়ান্ধ চোখে
জলকণা; মনে পড়ে, বিমানবন্দর থেকে তুমি
শেষবার বললে কথা টেলিফোনে খুব কষ্ট ক’রে।
আমার পাঠানো এক প্রজাপতি তোমার সঙ্গেই
যাচ্ছে, কেউ তা জানুক নাই-বা জানুক অদৃশ্য সে,
আমার নিভৃত রাজদূত। এ মুহূর্তে হোটেলের
বিছানায় আমাকেই ভাবতে ভাবতে শুয়ে আছো,
স্বপ্নন্বেষী, স্বামীর নিবিড় আলিঙ্গনে আর আমি
নিশীথে নিজের সঙ্গে কথা বলি, কবিতায় মগ্ন
হই আর তোমাকেই গ’ড়ে তুলি স্বপ্নের স্থাপত্যে;
আরেকটি প্রত্যূষ ঘোষিত হয় মোরগের ডাকে।
২৫/২/৯৫
প্রবাসে এক কবি
এখানে দিল্লীতে দূর পরবাসে ব’সে ব’সে ভাবি,
প্রবাসী কবির নিজ ঘরে কয়েকটি মেঘ খুব
আসা-যাওয়া করে আর নক্ষত্রেরা অগোচরে উঁকিঝুঁকি দ্যায়,
বসায় রূপালি মেলা। কেউ এলে হঠাৎ উধাও
সব; জোনাকির দল ঘরে
ঢুকবে কি ঢুকবে না ইতস্তত করে। যখন সে
লোকটাই নেই ঘরে তাহলে খামোকা
আমাদের জ্বলা আর নেভা,
ভেবে ওরা ফিরে যায় ঝোপঝাড়ে। কখনো নয়না
খেলাচ্ছলে ঘরে ঢুকে দ্যাখে
ওহো কী সুন্দর পাখি-পরিবার,-‘এসে দেখে যাও’
ব’লে সবাইকে ডেকে এনে
সে-দৃশ্য হারিয়ে ফেলে বড় কষ্ট পায়। শিশুটির
মন কিছুতেই খেই পায় না ছলনা কুহকের।
যখন এখানে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে শুয়ে আছি বিছানায়,
মোগল সম্রাট হুমায়ুন তাঁর সমাধিতে গভীর নিদ্রায়
অচেতন, দিল্লীর অমেয় অস্তরাগে গালিবের গজলের
স্তব করে অমরতা, ইতিহাস দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে,
প্রাচীন নগরী অকস্মাৎ যুগল ঘুঙুর হয়ে বেজে ওঠে,
তখন কি আমার বাড়ির পার্শ্ববর্তী পথ জেগে
আছে ধু ধু চোখে আঁকাবাঁকা হয়ে বেশ কিছু দূর?
যখন এখানে দেয়ালের শূন্যতায় নিবিষ্ট তাকিয়ে আছি,
তখন কি আমার নিজস্ব অন্তর্গত বাগানের ফুলগুলি
নিদ্রাতুর খুব নাকি ধুলায় লুটাচ্ছে বেখেয়াল
যুবতীর কানের দুলের মতো? নিজেকে এমন একা আর কোনোদিন
কখনো হয়নি মনে। পেয়ারা গাছের পাতা, ক্যামেলিয়া আমাকে কি ডাকে?
যাকে আমি দিক্ভ্রষ্ট নাবিকের মতো
ধ্রুবতারা ব’লে প্রাণে করেছি ধারণ, সে কি আসে আমিহীন
ঘরে, চোখ বুলোয় বইয়ের র্যা কে, বিক্ষিপ্ত কাগজে, ফটোগ্রাফে?
নিভৃত শরীরে যার টাঙ্গাইল বিরান বালিশে তার সরু
প্রেমর্দ্রে, শিল্পিত আঙুলের
নম্র, স্পর্শ ঈষৎ বুলিয়ে দ্যায়, কবির স্মৃতির আকর্ষণে?
১/২/৯৫
প্রেমের দেবতা আমাকে
প্রেমের দেবতা অকার্পণ্যে আমাকে দান করেছিলেন
অসামান্য এক উত্তরাধিকার। আমি ফতুর জুয়াড়ির মতো
অপচয় করেছি সেই সম্পদ। আখেরে
পরিণত হয়েছিলাম করুণ ছায়ায়। কালের হিংস্র কুকুর
আমাকে তাড়াতে তাড়াতে
জখম করেছে চরম নির্দয়তায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
আমার মুখ দেখে নিজেই চম্কে উঠেছি-‘কে এ ক্ষয়া প্রেত?’
আমার শরীর থেকে সব সময়
বেরুচ্ছিল গোরস্তানের পুরনো কবরের গন্ধ। ভূতুড়ে অন্ধকারকে
প্রবেশ করতে দিয়েছি নিজের ভেতর।
ঠিক সেই সময় দৈবাৎ তার সঙ্গে দেখা। এর আগে
সে আমার কাছে কোনো নামও ছিল না,
তার অস্তিত্ব বিষয়ে ক্ষীণতম সচেতনতা থাকা তো দূরের কথা।
অথচ তাকে দেখেই মনে হলো, তার চকিতে চাউনি,
মৃদু হাসি, তার রূপ আমার জন্মের ওপার থেকে চেনা।
তার বসে-থাকা, উঠে দাঁড়ানো, পথ চলা,
চুলের বিন্যাস তাকে দেখার অনেক আগে থেকেই
আমার মুখস্থ।
আর সবচেয়ে আশ্চর্য, সে এই ঘাটোর্ধ কান্তিবর্জিত,
অসুস্থ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল
তারও ভালোবাসার উত্তাল জলে। তার হৃদয় থেকে
একটি সোনালী প্রজাপতি বেরিয়ে এসে
আমার সত্তায় ছড়িয়ে দিল অপরূপ আবীর,
আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, ‘ভালোবাসি’।
তক্ষুণি আমার শরীর থেকে গোরস্তানের গন্ধ লুপ্ত,
এবং সজীব গোলাপ বাগানের সৌরভে
ভরে গেল আমার অস্তিত্বের মূল মৃত্তিকা। রুদ্ধ দরোজা ভেদ ক’রে
আমার চোখ দেখতে পেলো এক পুষ্পিত, শূন্য পথ।
প্রেমের দেবতার কাছে কৃতজ্ঞতায়
মাথা নুয়ে এলো আমার। তিনি তাঁর অনিন্দ্য সুন্দর
উত্তরাধিকারের সবটুকু প্রত্যাহার করে নেননি এখনো। আমি
এই সম্পদ যক্ষের মতো আগলে রাখবো আমরণ।
২৪/২/৯৫
প্রেরণার প্রতীক্ষায়’
কবিতা কখনো ছিপছিপে নাও, গহীন গাঙের
ঢেউ ছুঁয়ে ছুঁয়ে কী সহজে ব’য়ে যায়। কখনো-বা সেই নাও
ধূসর চড়ায় ঠেকে হয় রুদ্ধ গতি। কিছুতেই
চালানো যায় না লগি, বৈঠা
বাওয়া ভার, পাল খাটাবার
ইচ্ছা নিরর্থক; নিচে নেমে শত ঠেলাঠেলি ক’রে
শ্রান্ত হওয়া ছাড়া উদ্যমের অন্য কোনো
পরিণতি নেই। কবিতার মতিগতি বোঝা দায়।
ভালো ফলনের পর কৃষক যেমন উল্লাসের ডানা পেয়ে
আকাশে উড়তে থাকে, তেমনি কবিও
বেশ ক’টি কবিতা সহজে লিখে ফেলে
আনন্দে বিভোর। প্রেরণার অনটনে কবি তার
লেখার টেবিলে ব’সে থাকেন সর্বক্ষণ,
যদি সরস্বতী ডানা-অলা পরী হ’য়ে মধ্যরাতে
মাথার পিছনে তার উড়ে আসে, যদি অতীতের
কোনো কবি তার কানে-কানে জপান সিদ্ধির মন্ত্র।
প্রেরণা নারীর মতো লাস্যময়ী এবং চঞ্চলা,
যখন তখন তার নূপুরের ধ্বনি
কোথাও ওঠে না বেজে। কে যেন কোথায় বলেছেন-
প্রেরণার প্রতীক্ষায় তুমি ব’সে থেকো না অনড়, আশা জ্বেলে
চোখের ভেতর তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে পড়ো,
হঠাৎ বিজন পথে বিংবা ভিড়াক্রান্ত ফুটপাথে তার সাথে
দেখা হ’য়ে যেতে পারে দৈববলে, যেমন গৌরীর
সঙ্গে হলো মিলন তোমার সিকি শতাব্দীর পর।
১৪/১২/৯৫