নিঃসঙ্গ যাত্রা
এ কেমন স্থানে আজ পা রেখেছি? এ কোন বিরান
জমিন আমাকে গ্রাস করবার জন্যে মুখের গহবর তার
উন্মুক্ত করেছে অকস্মাৎ? গাছপালা নেই, নেই জলাশয়,
পাখিও অনুপস্থিত, বোঝা যায়, বহুকাল থেকে
বন্য জন্তু কোথাও পড়ে না চোখে, তবুও হিংস্রতা চতুর্দিকে
গন্ডারের শৃঙ্গ হয়ে ধেয়ে আসে যেন; রক্ত হিম
করবার আয়োজন অত্যন্ত প্রবল, কিন্তু দৃশ্যত তেমন
ভয়ঙ্কর কিছু নেই সত্যি এ তল্লাটে।
আমাকে একাই হেঁটে যেতে হবে এখনো জানি না
কতদূর, পাড়ি দিতে হবে রুক্ষ পথ
আরো কতক্ষণ,
জানি না কিছুই। এই পথে আমার নিজের
বুকের ঘর্ঘরে কফ, নিষ্প্রভ নজর,
বিশীর্ণ পাঁজর, বুকজোড়া কষ্ট, নড়বড়ে হাত-পা
ছাড়া অন্য কোনো সঙ্গী নেই। পিতা-মাতা
জায়া-পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন
অথবা বান্ধব কেউ নেই। এমনকি যাকে আমি
গৌরী গৌরী ব’লে
আকাশ পাতাল মর্ত্য উথাল পাথাল করি, সে-ও
নয় এই পথে আজ সঙ্গিনী আমার।
নিঃসঙ্গ পথিক আমি সর্বক্ষণ, এই রুক্ষ মাটি
কখন আমাকে গ্রাস ক’রে মুখ
বন্ধ করে নেবে, তারই তীব্র প্রতীক্ষায়
আছে নুড়ি, কর্কশ কাঁকর আর পোকা-মাকড়ের দল।
২৯/১১/৯৫
নিজেকে ভেঙে ভেঙে
নিজেকে ভেঙে ভেঙে ভেঙে
এই তো আমি পড়ি-মরি ক’রে এখানে
এই অনেকগুলো ভাঙা পাথরের
ডেরায় দাঁড়ালাম।
আমার কোথাও কোনো
সুম্পূর্ণতা নেই; স্বেচ্ছাচারী বাটালি আর
হাতুড়ির ঘায়ে
আমার মুখ আর
মুখ নেই। চোখ, কান, নাক, ভাঁজ-পড়া
ললাট, গ্রীবা—সবকিছুই ভাঙাচোরা,
বল্মীকাক্রান্ত কাদার
মূর্তির মতো।
নিজেকে ভেঙে ভেঙে ভেঙে
সম্পূর্ণ ভাঙতে না পারার খেদ
আমাকে তাড়া করে সারাক্ষণ আর বিদ্যুচ্চমকে দীপ্ত
আমি গরল পান করতে করতে
নির্মাণের কথা ভাবি, অথচ
অদূরে মরা জ্যোৎস্নায় শেয়ালের পায়ে
ঝরা পাতার খস্ খস্ আর
চাঁদের দিকে পিঠ দিয়ে ঘাড় ফোলায় প্যাঁচা।
৭/৭/৯৩
নির্জনতার জন্যে প্রার্থনা
আমাদের দুজনের চারপাশে সুদূর
মেঘের মতো নির্জনতা থাক,
এই মতো চেয়েছি কতদিন।
একটি কি দুটি পাখি অথবা প্রজাপতি
সেই নির্জতায়
দোল খেতে পারে সহজে, হাওয়া অন্ধকার
এবং জ্যোৎস্নার প্রবেশাধিকার থাকবে;
আমাদের দুজনের কথা বলা আর
না-বলার মাঝখানে গান গেয়ে
উঠতে পারে কোনো কোমল বুকের পাখি, ক্ষতি নেই।
কাঙ্ঘিত সেই নির্জনতা প্রত্যহ
লুকোচুরি খেলে আমার সঙ্গে। কী এমন
ক্ষতি হতো কার, যদি আমরা,
তুমি আর আমি, দু’দণ্ড
নিরিবিলি বসতে পারতাম কোনো
বকুলতলায় সময়ের নির্জন ঘাটে?
আমরা দুজন বসে থাকি নিশ্চুপ,
আমাদের নীরবতার চোখ ঘষে দ্যায়
দুটি কি তিনটি শাড়ি, একটি কি দুটি
সাফারি স্যুট। অনর্গল কলরব আমাদের
দুজনের সাহচর্যকে ঠোকরাতে থাকে
উন্মত্ত বাজপাখির মতো।
প্রতিদিনের এই কলরবে
তোমাকে নিজের মতো ক’রে পাওয়ার আমার ব্যাকুলতা
তোমার কোলে মাথা রেখে
বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে তৃষিত। এই ভিড়ে
আমি তোমাকে স্পর্শ করতে পারি না।
কিন্তু আমার অস্তিত্বের
পরাগগুলো তোমার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে
শুভেচ্ছা ঝরায়। আমার স্বপ্নগুলো তোমার
মুখ চুম্বন করে, আমার অকথিত নিরাশ্রয় শব্দমালা
সোনালি ত্রাণশিবির তোমার হৃদয়ের তন্তুজালে।
আমরা দুজন ঘন্টার পর ঘন্টা ব’সে থাকি
ড্রইংরুমে অথবা
খোলা বারান্দায়। বিভিন্ন কণ্ঠস্বর কোলাহল করে
জ্যাজের ধরনে।আমি প্রায়
কিছুই বলি না, বলতে গেলেও হোঁচট খাই,
আমার দুচোখ গড়িয়ে যায় সবার উপর।
সমবায়ী কথার ফাঁকে ফাঁকে প্রত্যেকে
তুলে নেয় স্ন্যাক্স আর চায়ের পেয়ালা।
তুমি আমার দিকে এগিয়ে দাও স্যান্ডুইচ
এবং যখন তুমি আমার চোখে
চোখ রাখো সপ্রেম,
আমার অনুভূতিমালা প্রবল কেঁপে ওঠে,
যেন ঝোড়ো ঢেউয়ে ফুলদল;
কিছুতে চোখ ফেরাতে পারি না।
রাত বাড়তে থাকে দ্রুত, অতিথিদের অবস্থান
যখন ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করতে উদ্যত,
তখন শুরু হয় বিদায়ের পালা। আমি
গুলিবদ্ধ পাখির মতো অভিমান লুকিয়ে
সৌজন্যের মোড়কে বেরিয়ে আমি ড্রইংরুম থেকে
অন্ধকারে পা বাড়াবার সময় দেখি,
তুমি দাঁড়িয়ে আছো দরজায়, সৌন্দর্যের আভাময়ী। তোমার
অভিমান আমার অভিমানের সঙ্গে মিলিত হ’য়ে
একটি মায়াবী পাখি হ’য়ে নিঝুম যাত্রা করে
দূরের ছায়াপথ আর নক্ষত্র-নীড়ে।
এবং সেই উধাও পাখি
নির্জনতার জন্যে প্রার্থনারূপে অবিরাম
চক্রাকারে ঘুরতে থাকে
আমাদের দুজনের তৃষিত মর্মমূলে।
৩১/৮/৯৫
নীল কুয়াশায়
শূন্যতা আমার দিকে রাতের প্যাঁচার মতো খুব
একাগ্র তাকিয়ে থাকে। নিভৃতে যা করি উচ্চারণ
নিটোল তন্ময়তায়, শ্রোতা তার চাঁদ নক্ষত্রের
স্রোত আর গাছপালা। কাদাজল থেকে উঠে প’ড়ে
সপ্তর্ষিমন্ডলে হাত বাড়াই কিসের প্রত্যাশায়
নিজেই জানি না; দেখি কবন্ধের দল রাস্তা জুড়ে
বিক্ষোভ মিছিলে মাতে কল্যাণ এবং সুষমার
বিরুদ্ধে প্রত্যহ বড় বেশি সরে গিয়ে ডান দিকে।
আমার রথের চাকা শোচনীয় ভাবে দেবে গ্যাছে
আঁঠালো কাদায়, আর অকাল মেঘের বোরখায়
নিমেষে পড়েছে ঢাকা সূর্য, হৃতশক্তি, অসহায়
একলা দাঁড়িয়ে আছি, আমার উদ্দেশে ছুটে আসে
রক্তলিপ্সু বাণ, সহযোদ্ধা সব দিয়েছে গা ঢাকা,
বিপ্লবের মুখ হারিয়ে গিয়েছে নীল কুয়াশায়।
২১/৫/৯৫
পূর্ণতার প্রতীক্ষায়
বুঝিনা অনাদিকাল থেকে
হাত দুটো প’ড়ে আছে বনাঞ্চলে বিশুদ্ধ জ্যোৎস্নায়
পা দুটি জলের স্নেহ পাচ্ছে নদী তীরে, রাত্রিদিন
আমার স্পন্দিত বুক কাজল মাটিতে বাউলের
একতারা এবং আমার মাথা পাহাড় চূড়ায়
ঈগলের ডানার ছায়ায় জপ করে
সৌন্দর্যের; আমি
খণ্ড খণ্ড হ’য়ে সম্পূর্ণতা খুঁজি গূঢ় তপস্যায়।
আমার নিবিড় ধ্যান ঘাসের ডগায়
এক ফোঁটা প্রসন্ন শিশির
অথবা ফুলের মধু, হরিণের মুখে লেগে-থাকা
তৃণমূল, নিজের ভেতর থেকে চকিতে বেরিয়ে
নিজেকেই দেখি
নানা কোণ থেকে, চেনা দায় থিতু বুদ্ধের আঙ্গিকে।
আমাদের দেশ এক পাগলা গারদ। বাসিন্দারা
কখনো চেঁচায়, কখনো বা হাসে, কাঁদে
কখনো অন্যের স্বরে কথা বলে বেবাক উদ্ভট,
কখনো এতই স্বাভাবিক ভিন্ন মুখচ্ছদে, দেখে
নিজেকেই খুব প্রতারিত মনে হয়। নিজেকে সরিয়ে নিয়ে
নিরালায় আমিই আমার ধ্যান হই।
হাত দুটো পানি-ধোওয়া পায়ের অম্লান পাতা আর
পদতল বুক আর বুক আমার মাথাকে দ্যাখে
দিনরাত। তারপর নেত্রপাতহীন
নীলিমায় ভাষাতীত স্তোত্র ভেসে যায়। সেই স্তোত্রে সুনিশ্চিত
হাজার বছর আগেকার ছায়া ফিস্ ফিস্ করে,
ক্রমাগত নৈঃশব্দ্যের পাঠ নিই মেঘেদের কাছে।
সারাদিন দাঁড়ে-খাটা মাঝির মতোই
দিনান্তে ঘুমাই পাটাতনে নিশ্চেতন,
বিকলাঙ্গ প্রহরের স্বপ্নের ভেতরে
পূর্ণতা দাঁড়ের ঘায়ে গুঁড়ো কিছু ঢেউ।