একটি পরিবার
‘সাতসকালে নাশ্তা নাকে মুখে গুঁজে
তুই কই ছুটলিরে খোকা? একটু সবুর কর,
আরেকটি রুটি খেয়ে নে।‘
‘মা, আমার বড় তাড়া আছে আজ’, বলল সেই সতেজ তরুণ।
আলনা থেকে পাঞ্জাবি নামিয়ে পরার সময়
ওর অনূঢ়া বড় আপা বললেন, ‘দাঁড়া, তোর
পাঞ্জাবির ছেঁড়া জায়গাটা একটু মেরামত ক’রে দিই।‘
‘অপেক্ষা করার মতো সময় আমার নেই আপা’, ব’লে সে
ছেঁড়া জামা গায়ে চাপাতে চাপাতে
বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল।
বারান্দায় ওর বাবা, বর্ষীয়ান উপার্জন-অক্ষম এক প্রাক্তন রাজনীতিক,
চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে
মাঝে-মাঝে দেখে নিচ্ছিলেন নাগরিক আকাশ।
ছেলেকে প্রায় দৌড়ুতে দেখে নিজের পক্ষে বেমানান
এক বাক্য উচ্চারণ করলেন, ‘তোর কি এই
মিটিং-মিছিলে নিজেকে না জড়ালেই নয়?’
ধাবমান তরুণ ওর বাবার দিকে তাকিয়ে
হাসি-উদ্ভাসিত মুখে দরজা পেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়ায়।
সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে প্রায় সন্ধেবেলা,
মা ভাবছেন, খোকা কেন আসছে না? একটা অশুভ চিন্তা
ওকে দখল ক’রে ফেলছে ক্রমাগত। তরুণের
বড় আপা মনে-মনে বলছে, কী জেদী ছেলেরে বাবা,
কোনো বাধাই মানতে চায় না। আর বয়েসী পিতা, ঈষৎ ত্রস্ত
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছেন তাঁর ভবিষ্যৎ অস্তগোধূলিতে মিলিয়ে যাচ্ছে।
২০/২/৯৫
একটি শোকগাথার জন্যে
নদীর চককচে তরতাজা
মাছগুলো ছটফটিয়ে মরে যাচ্ছে,
গাছের পাতা ধুলো হ’য়ে ঝরছে,
গাছের কংকাল দেখে পাখিরা বোবা,
ভুলে গেছে গান। কান খাড়া
করে থাকলেও কোকিল কি দোয়েল
কারো সুর শোনা যাচ্ছে না আর।
ফুল ফোটে না কোথাও,
উধাও পায়রা, কাঠবিড়ালি, খরগোশ। বসন্ত
আসে না দশ দিগন্ত রাঙিয়ে।
যেখানে একদা নদী ব’য়ে যেতো
তরুণীর উচ্ছলতার মতো,
এখন সেখানে ধু ধু বালি, খালি গায়
ক্লান্ত লোকজন ধিকিয়ে ধিকিয়ে হাঁটে।
ফসলের ক্ষেত পুড়ে গেছে, বীজতলা শ্মশান।
কৃষকের মাথায় হাত, টগবগিয়ে ভাত ফোটে না হাঁড়িতে।
শুটিকয় মানুষ সুন্দরের কথা,
আলোর কথা বলায় চেষ্টাশীল,
লোকগুলো ওদের মাড়িয়ে
পায়ের তলায় থেঁৎলে
দলে দলে দৌড়ুচ্ছে পূর্ণিমা ছেড়ে
অমাবস্যার দিকে।
অনেকেই লেখা ছেড়ে না-লেখার দিকে চলে গেছেন।
হাতে গোণা কজন বিষণ্ন, অথচ
জেদী কবি রক্তজবাপ্রতিম
সূর্যোদয়ের দিকে মুখ রেখে
একটি মর্মস্পর্শী শোকগাথা রচনার জন্যে
বিষপাত্র দূরে সরিয়ে
আঁকিবুঁকিময় পাতার পর পাতা ক্রমাগত
ছিঁড়ে চলেছেন প্রহরে প্রহরে।
একাকী সত্যের কাছে
এ আমি কেমন দ্বন্দ্বে খাচ্ছি পাক গহীন গাঙের
ঘূর্ণীজলে নাওয়ের ধরনে? ঘন
কুয়াশা ছড়ানো চর্তুদিকে। মাঝে-মাঝে
কান ঘেঁষে পাখি উড়ে যায়
কোন্ দিকে, কিছুতে পাই না টের। তা’হলে কি শেষে
ভরাডুবি হবে আজ? আমার মাংসের ভোজে তৃপ্ত হবে মাছ?
এরা বলে, এদিকে ভেড়াও নাও, যত শীঘ্র পারো,
পরিত্রাণ পাবে, দ্যাখো, সবাই তোমার
জন্যে তীরে সাজিয়ে অজস্র ডালা হাতে
মালা নিয়ে অধীর অপেক্ষমাণ, এসো।
ওরা বলে, আমাদের তীরে তাড়াতাড়ি
তরী এনে বাঁধো;
আমরা তোমার জন্যে বিপুল বর্ণাঢ্য উৎসবের
আয়োজন নিয়ে মেতে আছি।
আলোর তীরের ঘায়ে কুয়াশার জাল ছিন্ন হ’লে
দ্বন্দ্বের আবর্ত থেকে বেরিয়ে প্রবল দু’দলের
কারো্ ডাকে কোনো সাড়া না দিয়ে নৌকোর
মুখ পুরোপুরি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে খাটাই পাল।
মনে মনে বলি-
এই মূর্খ কোলাহল, সেই নির্বোধ উৎসব থেকে
দূরে, বহুদূরে খুব আলাদা মানব সম্মেলনে যোগ দিয়ে
নিজের ভেতরে ডুবে একাকী সত্যের কাছে চলে যেতে চাই।
৭/১২/৯৫
কবির ভাবনা
লেখার টেবিল থেকে এক টুকরো রুটি নিয়ে যায়
চতুর ইঁদুর এক, রক্তিম আপেল নিদ্রাতুর
তসতরিতে, সদ্যলেখা কবিতার পাণ্ডুলিপি কোনো
নগ্নিকার মতো আলস্যের জালে ঘুমে ঢুলু ঢুলু।
দাঁড়ানো নিঃসঙ্গ কবি জানালার ধারে, উদাসীন
দৃষ্টি তার শূন্য পথে, দূরের আকাশে, যার কোলে
মেঘ-শিশুগুলি খেলা করে, পাখি ওড়ে; অকস্মাৎ
দেখা দেন পল এলুয়ার আর লালন ফকির।
লেখার টেবিলে ফিরে এসে কবি ভাবে, আজকাল
শুধু ভঙ্গিসর্বস্ব পদ্যের ঠমকের তালে তালে
নেচে ওঠে, চৈনিক সুপের মতো করে পান খুব
তৃপ্তিতে চটকদার পঙ্ক্তিমালা, কাচের জৌলুশে
ম’জে থাকে হীরক কাদায় ফেলে, তবুও হৃদয়
ছিঁড়ে খুঁড়ে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে আরো লিখে যেতে হবে।
৩০/১২/৯৫
কলমের কালির স্রোত
রজকের ধরনে নিজেকে নিঙড়ে আমি লিখি কবিতা,
কয়েকটি পঙ্ক্তি লেখার জন্যে
আকাশে উড়ি, পাতালে ডুব দিই,
কত যে রাত্রি আমার কাটে আত্মপীড়নে, অনিদ্রায়।
যে ছেলেটা পাচন হাতে গোরু চরায়
ঘাসবনে, মাঠে, বাঁশি বাজায় গাছের ছায়ায় ব’সে
কিংবা যে মেয়েটি ঢেঁকিতে পাড় দেয়, মাথার ঘাম
পায়ে ঝরায় ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে, যে-তরুণ
অন্তর্গত আলোড়নে স্বদেশকে
একটি বাগানের মতো গড়ে তোলার জন্যে
উপর-অলার পা-চাটা বদরগী আমলা
আর পুলিশের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে,
আমার লেখনী তাদের কথা বলে আর
অবিরাম বলে একজন গৌরীর কথা।
শোনো, আমার লেখনী থেকে মাস্তানের বুলেট বেরোয় না,
কোনো সন্ত্রাসীর ছোরার ফলাও
মুখ খিঁচিয়ে ওঠে না আমার কলম থেকে,
তবু ওরা চায় স্তব্ধ হয়ে যাক আমার লেখনী।
যে আনপড় মহাপুরুষ রুক্ষ মরুভূমিতে
আবে হায়াতের ধারা বইয়ে দিয়েছিলেন একদা,
তিনিই তো উচ্চারণ করেছিলেন, কলমের কালি
শহীদের রক্তের চেয়েও অধিক পবিত্র,
তবে কেন তাঁর ভণ্ড, কূপমণ্ডুক অনুসারীরা
আমার লেখনীর মসীর স্রোত রোধ করতে হন্যে হ’য়ে অসি নাচায়?
২০/১১/৯৫