আমার চোখের জ্যোতি
আমার চোখের জ্যোতি এখনো যায়নি পুরোপুরি
নিভে, কিন্তু ঘোর অমাবস্যার আভাস কী ভীষণ
গাঢ় হচ্ছে ক্রমাগত। সূর্যোদয়, পূর্ণচন্দ্র, বন,
নক্ষত্রের মেলা সবই মনে হবে অন্ধকার পুরী।
কে তস্কর আমার যা কিছু প্রিয় করে আজ চুরি?
নাতি-নাতনি ও মা’র হাসি আর সুপ্রিয়ার মুখ
আস্তে-আস্তে কেড়ে নিচ্ছে ভয়ঙ্কর চোখের অসুখ;
আদ্য কথা পাবো ব’লে নিরন্তর নিজেকেই খুঁড়ি।
আমি কি নিস্তব্ধ রাতে একা একা মিল্টনের মতো
দৃষ্টিহীন শব্দের নন্দন বনে করবো সন্ধান
অবিনাশী জ্যোতি আর ভোরে জেগে উঠে অপেক্ষায়
থাকবো এমন কারো যে ইএ অক্ষম ভাগ্যহত
কবির অন্তরে উৎসারিত অলিখিত কোনো গান
সফেদ কাগজে ধৈর্য ধ’রে টুকে নেবে মমতায়?
২৪/১/৯৫
আরো কিছুকাল
এখনই থামার ইচ্ছে নেই, আরো কিছুদূর হেঁটে
যেতে হবে। থামলেই ঘুম
সহজে আসবে নেমে দুচোখের পাতা জুড়ে। বড়
ক্লান্ত আজ, তবু
কুয়াশায় চাই না হারিয়ে যেতে, যতটুকু পারি
দিকচিহ্ন ঠিক রেখে একটু-একটু
সম্মুখে এগিয়ে যাব। কোনো ভ্রম, কোনো পিছুডাক
বিপক্ষে না টানে যেন, রাখব খেয়াল।
কত প্রেত পথ রোধ ক’রে
হঠাৎ দাঁড়ায়, কত ছলে কত রূপ ধ’রে শেষে
অন্ধকূপে ঠেলে দিতে চায়। আমি রুখে
দাঁড়াই অটল ঋজু। পতনের বিলাসিতা সাজে না আমাকে।
এই তো দোয়েল, চন্দ্রমল্লিকা এবং প্রজাপতি
আমাকে দেখায় পথ আর গৌরীর অভয়বাণী
এগিয়ে চলার দীপ্ত, অফুরন্ত সাহস জোগায়।
আমার গ্রীবায় ঝুলে আছে সূর্যোদয়, সুবাতাস
পথের সকল কাঁটা প্রবল সরায়, হাতে নিয়ে
সপ্তর্ষিমণ্ডল দৃঢ়, পদক্ষেপে আরো কিছুকাল এগোবই।
এ আমার কী হয়েছে
এ আমার কী হয়েছে আজকাল? সব সময়
এক ধন্দ আমাকে নিয়ে
বেশ রগড় করছে; হিমশিম খাচ্ছি হরহামেশা,
অথচ আমার কিছুই করার নেই।
এই যে চোখের সামনে সারি সারি বই,
আমি ওদের শনাক্ত করতে ব্যর্থ, কার কী-যে নাম
বলতে অপারগ। আর ঐ যে রেলিঙ ঘেঁষে পেয়ারা গাছটা
দাঁড়িয়ে আছে ক’বছর ধ’রে,
তার পাতাগুলো নড়ছে কি নড়ছে না
বোঝার উপায় নেই আমার। ঘরের ভেতর
দিনের বেলা আলো জ্বালিয়ে রাখলেও কেমন এক
ছায়ার সবতি গড়ে ওঠে।
আমার নিত্যদিনের চেনা বস্তুসমুদয় আমাকে
মজা দেখাবার খায়েশে
অচেনা ভঙ্গিতে হাজির হয়। হকচকিয়ে আমি
পা হড়কে প’ড়ে যাবার আশঙ্কায়
তড়িঘড়ি ধ’রে ফেলি চেয়ারের হাতল। হঠাৎ হাত
সরিয়েও নিই, কী জানি কোনো অজানা
হিংস্র জন্তুর পিঠ স্পর্শ করিনিতো। টেলিফোন
ধ’রে ভাবি, কার ঠিকানায় বাজাবো আমার অব্যক্ত ধ্বনিমালা?
এই যে রাস্তাটা এখন কোনো সরীসৃপের মতো
ঘুমিয়ে রয়েছে, তা আমার চোখে
স্পষ্ট নয়। এখন আমার হৃদয়ে এক দীর্ঘ পথ
চলে গ্যাছে বহু দূর, যার দু’ধারে
সারি সারি গাছ আমি দেখতে পাচ্ছি হাওয়ায়
ঝরা পাতাদের ঘূর্ণি নাচ। কে যেন হেঁটে যাচ্ছে
আঁচল উড়িয়ে, পাথরে ঠেস দিয়ে বসে একজন বাজাচ্ছে বাঁশি।
এই দু’জনের মধ্যে কোনো সংযোগ নেই, অথচ
পরস্পরের মধ্যে ওদের অজান্তেই পদ্মের মতো ফুটে উঠেছে
মমত্ব বোধ। এর পথ চলা, ওর বংশীধ্বনি কোনো দিনই থামবে
আমি বুঝতেই পারি নি, কখন থেকে আমার মধ্যে
এক পরিবর্তনের ঢেউ জেগেছে। এখন আমি
বাইরের সামগ্রী ইত্যাদি চেয়ে আমার ভেতরকার অনেক কিছুই,
অধিকতর স্পষ্ট দেখতে পাই। তাকে আমি
অনেক দিন দেখি না। এই মুহূর্তে যখন আমি একরাশ
ধূসরতার মধ্যেও একটি ধ্রুপদী রাগ সৃষ্টিতে চেষ্টাশীল,
সে এখন কোথায়, কী করছে, জানি না। কিন্তু আমার দৃষ্টির
অস্পষ্টতা সত্ত্বেও তাকে অন্তরে দেখতে পাচ্ছি জ্যোতির্ময় স্পষ্টতায়
১৯/২/৯৫
এই যে ক’দিন থেকে
ঐ যে ক’দিন থেকে লিখছি না কবিতা, তাতে কি
সমাজের চোখে ঘুম নেই? ফ্ল্যাট বাড়ির সুন্দরী
তরুণীর প্রেমে পড়েছে কি ভাটা এতটুকু? ফুল
ফোটা, তাজা রোদের আবীর ঝরা বন্ধ হয়েছে কি?
কেউ কি বিষাদে আছে লিখছি না বলে? ভালো করে
জানি, কেউ নয় আজ সামান্য অসুখী আমার এ
নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ ক’রে। বরং পাঠক, অধ্যাপক,
রাজনীতিবিদ আর আমলা, সমালোচক আর
সবচেয়ে বেশি কবিকুল উল্লসিত। ‘বাচাঁ গেলো,
এই লোক জ্বালিয়েছে খুব শব্দের ফোয়ারা খুলে’,
ব’লে ওরা সোৎসাহে বাজান ডুগডুগি। না লেখার
দুঃখ বুকে ব’য়ে চলি দিনরাত্রি বড় একা একা।
একজন আছে যে আমার কবিতার জন্যে খুব
ব্যাকুল, উন্মুখ হ’য়ে থাকে সর্বক্ষণ; যদি আমি
লেখনীকে অধিক বিশ্রাম দিই, তার মনে মেঘ
জমে আর আমাকে জাগিয়ে তোলে মোহন ঝাঁকুনি
দিয়ে; আমি তার প্রেরণায় জ্বলে উঠি বার বার।
২২/৫/৯৫
একজন বুজুর্গের কাছে
একদিন একজন রূপালি-চুল বুজুর্গের কাছে এলো
একটি লোক। তার হাতে কয়েকটি
ম্লান খাতা। খাতাগুলো সে ধ’রে আছে মমতায়,
যেন পরম ধন তার। সে তাজিমের সঙ্গে
খাতা কটি বুজুর্গের হাতে অর্পণ ক’রে
বলল, ‘যদি মেহেরবাণী ক’রে আমার এই কবিতাগুলো
প’ড়ে আপনার অভিমত দেন, কৃতজ্ঞ থাকব।‘ লোকটির চোখে
প্রত্যাশায় দীপ জ্বলজ্বল করছিল সেই মুহূর্তে।
লোকটি অভিমান মেশানো স্বরে বলল, ‘একজন কবির কাছে
নিয়ে গিয়েছিলাম আমার খাতাগুলো।
তিনি কয়েক পাতা উল্টেপাল্টে জানালেন, ‘কী লাভ
জঞ্জাল জড়ো ক’রে? বরং চাষবাস করুন গে,
দোকানদারিতে মন দিন। এসব লিখে নিজের জীবনটাকে
বরবাদ করবেন না! একজন সমালোচকও প্রায়
একই ধরনের কথা শুনিয়ে দিলেন। আখেরে
আপনার কাছে এলাম সত্যের সন্ধানে।‘
বুজুর্গের আলখাল্লার আস্তিনে ঝুলছিল সূর্যোদয়;
তিনি ধৈর্য ধ’রে পাঠ করলেন
বেশ কয়েকটি পদ্য
লোকটির দিকে উদার দৃষ্টি
মেলে দিয়ে বললেন গাঢ় কণ্ঠস্বরে, “অনেকে
অনেক গাছই লাগায়, কিন্তু সব গাছে ফুল ধরে না।
বহু সাধক, বহু সুফী আছেন, কিন্তু একমাত্র মনসুর হাল্লাজই
অকুণ্ঠ বলতে পারেন, ‘আমিই খোদা।‘ তুমি যা’ লিখেছ
তার প্রশংসা শোনার বাসনা ত্যাগ ক’রে লিখে
যে-আনন্দ পেয়েছ, সেই সঞ্চয়টুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকো।“
লোকটি বিদায় নেওয়ার পর রূপালি-চুল বুজুর্গ
নিজস্ব সাধনা এবং সিদ্ধির দূরত্বের ধূসরতায় নিমগ্ন হলেন।
১৬/১১/৯৫