আগুন রঙের বাঘ
তোমাকে কি বলিনি মানবী, দিনভর রাতভর
আগুন রঙের এক বাঘ খুব ঘোরাঘুরি করে
আমার স্বপ্নের সীমানায়, বাস্তবের আস্তানায়?
দুচোখ ঝলসে দিয়ে সে আমাকে কী হিংস্র শাসায়-
‘যতই সতর্ক তুই থাকিস না কেন ব্যুহ তৈরি
ক’রে তোর চতুর্দিকে, শেষে গিলে খাবো, জেনে রাখ।‘
তোমাকে জানাই, শোনো, একদিন মধ্যরাতে সেই
বাঘ এসে আমার স্বপ্নের ঘাড় মটকে দাঁড়ায়
শয্যা পাশে; ওর তাপ আমার শরীর তপ্ত সোনা
ঢেলে দেয় যেন, ধড়ফড় জেগে উঠি, চেয়ে থাকি
দারুবৎ; বাঘ বলে ‘যতদিন তুই স্বপ্ন দেখে
যাবি, শোন্ ততদিন তোকে আমি পারব না খেতে।‘
একদিন গোধূলি বেলায় আমি কবিতা লেখায়
নিমগ্ন ছিলাম, অকস্মাৎ ব্যাঘ্র-গন্ধে হুঁশ হয়।
ভাঁটা-চোখ কথা বলে, ‘আজো আমাকে নিষ্ফল ফিরে
যেতে হবে। কবি তুই, চিত্রকল্প, ছন্দের কম্পন
তোকে রাখে টান টান, যতদিন তোর শব্দপ্রেম
থাকবে অটুট, তুই হবি না আহার্য এ বাঘের।
একদিন ভোরবেলা আমার চৌকাঠে দেখি, সেই
বাঘ ব’সে আছে, সে মুহূর্তে আমি তোমার মুখের,
চোখের বুকের কথা ভেবে প্রেমের অর্চনা সেরে নিয়ে
লেখার টেবিলে লগ্ন ছিলাম একাকী। বাঘ বলে
আমার উদ্দেশে, ‘যতদিন তোর বুকে মানবীর, মানবের
ভালবাসা থাকবে, আমাকে ব্যর্থ ফিরে যেতে হবে।
হে মানবী, বলো, এই আগুন রঙের বাঘটিকে
বার বার ক’রে রুখর দিনভর রাতভর?
২৪/৮/৯৫
আজকাল
আমার ভেতরে কোনো জ্বলজ্বলে বাঘ অকস্মাৎ
অগোচরে ঢুকে পড়েছে কি? নইলে কেন আজকাল
এত গর গর করি? পান থেকে চুন খসলেই
মেজাজ বিগড়ে যায়, মুড়ি-মুড়কির এক দর
দেখেও নিশ্চুপ থাকা মুশকিল; সন্ত্রাসীর ডেরা
ক্রমশ উজ্জ্বল হ’লে ভদ্দরলোকের সমাগমে
আমার মাথায় খুন চেপে যায়, নষ্ট হয় চোখ।
এমনকি, তাকে ভিড়ে দেখলেও গর্জে উঠি খুব।
এখন অসুস্থ আমি, তা ব’লে কিছুই থামবে না।
জমবে বাজার হাট, বইমেলা; সিনেমায় ভিড়
কেবলি বাড়বে আর বন্ধুরা আড্ডায় ফুকো আর
দেরিদাতে নিয়ে মেতে থাকবে কফির পেয়ালায়;
সে-ও যাকে ভালোবাসি, যাবে হেসে বিদেশ ভ্রমণে।
আজকাল নিজের উপরই সর্বক্ষণ রেগে যাই।
১৯/২/৯৫
আমরা দুজন হাঁটি একসঙ্গে
মাঝে মধ্যে আমরা দু’জন হাঁটি একসঙ্গে পথে, ফুটপাথে,
কখনো বা ভিড়ে হাঁটি, তোমার শাড়িতে
থাকে না ঘুমের ঘোর, বাজে জলতরঙ্গ এবং
অন্তর্বাসে কণিকার সুরের লহরী;
আমার ধূসর ট্রাউজারে গীটারের ধ্বনি আর
শার্টে দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠসুর।
আমরা দুজন হাঁটি মেঘে, ফুসফুস ভরে যায়
রঙিন হাওয়ায়, টুক্রো টুক্রো মেঘ মাথার ভেতর
জমা হয়, চাঁদের রূপালি নায়ে ব’সে
চৌদিকে বেড়াই ভেসে, সপ্তর্ষিমণ্ডল ছুঁই, কালপুরুষের সঙ্গে প্রীত
হ্যাণ্ডশেক করি, নেমে যাই ছায়াপথে
আসমানী রেস্তোরাঁর খোঁজে।
আমরা দুজন নক্ষত্রের সিঁড়ি বেয়ে ওঠে যাই,
কিয়দ্দূরে প্রবালে বানানো এক নিখুঁত রেস্তোরাঁ
চোখে পড়ে শূন্যের মাঝার, ঢুকে দেখি
জ্যোৎস্নালোকে কবিতা চিবিয়ে খাচ্ছে কজন বুর্বক
আর বনহংসীর মতন ওয়েট্রেস
সাজাচ্ছে টেবিল অনাগত গ্রাহকের প্রত্যাশায়।
আমরা দুজন বসি মুখোমুখি একটি টেবিলে
এক কোণে, হাঁসের পালক-মেনু হাতে নিয়ে তুমি
খেলছিলে, অকস্মাৎ কী প্রবল হাওয়া এসে করে
লণ্ডভণ্ড সব কিছু, আমরা দুজন অতি দ্রুত
দুদিকে ছিটকে পড়ি। আমাকে দীঘল ঘাস ঢেকে ফেলে,
দেখি অতিকায় কোলা ব্যাঙ হয়ে পড়ে আছি ঘরে
তাল তাল কাদার ভেতর, ফের একটি সোনালী হাত আস্তে
টেনে তোলে আমাকে, নিবিষ্ট চিত্তে কবিতা লিখতে ব’সে যাই।
২৮/১২/৯৫
আমাকে এখন থেকে
আমাকে এখন থেকে আরেকটু বেশি, আরেকটু
ভালো করে দেখে নাও। কতটা বিবর্ণ হয়ে কত
ক্ষয়ে গেছি, চামড়া কুঁচকে গ্যাছে কত,
কত চুল হলো লীন দূরের হাওয়ায়,
কেমন স্খলিত দাঁত, আমার নিভৃত
দৃষ্টিশক্তি কত শোচনীয় ক্ষীণ আজ ভালো করে দেখে নাও।
বিত্ত নেই, উপরন্তু ধারদেনা আছে কিছু, নিবাসও বন্ধক,
প্রদর্শনযোগ্য কিছু নেই, আছে শুধু
কতিপয় কাব্যগ্রন্থ, বস্তুত যাদের
কানাকড়ি মূল্য নেই অনেকের কাছে। কেউ বইগুলি
পুড়িয়ে উৎসবে মেতে উঠতে উৎসুক অতিশয়;
এরকম পুঁজিহীন কেটে যাবে বেলা পুঁজিতান্ত্রিক সময়ে।
একটি তস্কর আছে খুব কাছে চোখের আড়ালে,
আমাকেই চুরি করবার অব্যর্থ চেষ্টায় আর
আমি বসে থাকি অসহায়। কবিতার
একটি কি দুটি পংক্তি গাছের পাতার মতো
নড়ে ওঠে, বেজে চলে নর্তকীর নূপুর যেমন।
মাঝে মাঝে চিত্রকল্প সৃষ্টি হয় অবচেতনের
গহন আঁধার স্তর ফুঁড়ে। তদুপরি
একটি সোনালি মুখ জেগে থাকে হৃদয়ের নিভৃত জ্যোৎস্নায়।
আমাকে এখন থেকে আরেকটু বেশি, আরেকটু
ভালো ক’রে দেখে নাও। এই যে হাঁটছি
এখনো গলিতে, যাচ্ছি গায়ে
পাঞ্জাবি চাপিয়ে কবিদের সভায় এবং কথা
বলছি সোফার ব’সে, গিলছি আগুন
ঘন ঘন, বমি করে ফেলে দিই রক্তমণি, সীসা-
এই সব দেখতে পাবে না;
আমি তো অধিককাল থাকব না আর, চলে যাব খুব একা।
৮/৪/৯৫
আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি
আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি চন্দ্রালোকে হামাগুড়ি দিয়ে
আস্তাবলে ঢুকে খড়বিচুলি চিবোয়, মাথা কোটে
কী অন্ধ আক্রোশে। ঠেলাগাড়িটিতে আমার স্বপ্নেরা
স্তূপ স্তূপ ময়লা কাপড় শুধু; ভাবনারা ডানা
পেয়েও আকাশে কিছু পাক খেয়ে পড়ে গলিতেই,
ওদের নিমেষে গিলে ফ্যালে আবর্জনা। মাঝে মাঝে
তুমি এসে দ্যাখো রোগশয্যায় একাকী পড়ে আছি।
বুঝি বা কাফন তৈরি; মৃত্যু দ্রুত লিখছে রসিদ।
ঈষৎ ঘাবড়ে গিয়ে তুমি আমার কপালে হাত
রাখো, স্পর্শ করো বুক, বলো, ‘জাগো, জেগে ওঠো কবি,
এই তো এসেছি আমি। আমার নিষ্প্রভ দু’টি চোখ
অস্পষ্ট তোমাকে দেখে আরো বেশি আলোপ্রার্থী হয়;
আবার জীবনানন্দে মেতে ক্ষীণ কণ্ঠে প্রশ্ন করি-
‘বিদেশ ভ্রমণ থেকে কবে ফিরে এলে রাজেন্দাণী ?
২৫/২/৯৫