শহুরে সংলাপ
ঘন বৃষ্টি-আঁচড়ানো দুপুরে তোমার খুব কাছে
ছিলাম নিভৃত ঘরে। সে মুহূর্তে তুমি সাবলীল
প্রফুল্ল প্রতিমা। দেখলাম-
তোমার শরীরে ধানী রঙের তরঙ্গ যাচ্ছে ব’য়ে।
হঠাৎ বল্লাম, ‘চলো এই বন্ধ ঘরে ছেড়ে দূরে
কোথাও বেরিয়ে পড়ি রিক্শায় দুজন।
পুরানো ঢাকায় যাবে? সেখানে আমার
বালক বয়স আর কিশোর বয়স আর যুবা বয়সের
বহুদিন প্রীত উড়ে গিয়ে তোমার শাড়ির
আঁচলের মতো
ছুঁয়েছে নীলিমা অগোচরে। প্রিয়তমা,
চলো না সেখানে যাই সেই সরু গলির ভেতর,
যেখানে একদা আমি বন থেকে অনায়াসে
চিত্রল হরিণ ডেকে আনতাম, মেঘ ডেকে আনতাম ঘরে
নিরালা সংকেতে। দেখতাম বাতিঅলা
আসতো নিঃশব্দে হেঁটে গলির গলায়
পরাতে আলোর মালা, ভিস্তি মশকের ভারে নুয়ে
বিলোতো শীতল জলধারা ঘরে ঘরে। শুনতাম
কান পেতে তারা মসজিদ থেকে ভেসে-আসা ফজরের সুরেলা আজান
আর সন্ধেবেলা মন্দিরের মনকাড়া ঘন্টাধ্বনি।
সত্যি কি আমাকে নিয়ে যাবে আজ পুরনো শহরে,
যেখানে তোমার মন পড়ে থাকে আজো? জানি আজো
স্মৃতিকাতরতা
তোমার দুচোখে ফ্যালে ছায়া, তুমি কোনো কোনো ভোরে
স্বপ্নে জীর্ণ আস্তাবল, বেতো ঘোড়াদের ঘ্রাণ নিয়ে
জেগে ওঠো বিছানায়, ভাবো কবেকার চাখানাকে
সোলেমান বাদশার ধনাগার, কখনো আনন্দে ঝলোমলো
আমাকে শোনাও লালবাগ কেল্লার ভেতরকার
কবরে শায়িতা পরী বিবির কাহিনী। একদিন
বললে তুমি, ‘এই তো সেদিন
অনেক বছর পরে আমাদের প্রাক্তন বাড়ির কাছে গিয়ে
চিনতে পারিনি তাকে, যার পরতে পরতে ছিল
একদা আমার দিনগুলি, রাতগুলি। প্রতি ইটে লেখা ছিল
আমার কৈশোর, যৌবনের গজলের প্রেমাক্ষর।
-চলো যাই গোধূলিতে হাঁটতে হাঁটতে পুনরায়
বুড়িগঙ্গা নদীটির রূপ দেখে আসি একবার। সঙ্গোপনে
আমরা দুজন ঘাটে-ভেড়া বজরার ছাদে ব’সে পাশাপাশি
দেখবো সূর্যাস্ত, খাবো চিনেবাদাম অথবা
ঝালমুড়ি, অন্ধকার গাঢ় হলে মুখচুম্বন করবো
তোমার আবেগভরে, তারপর নেমে এসে বাকল্যান্ডে চোখ
রেখে হেঁটে যাবো পরস্পর হাত ধ’রে কিছুদূর। দেখে নেবো
পুরনো এ শহর কীভাবে
ঈষৎ বদলে যাচ্ছে নতুন যুগের আলিঙ্গনে,
যেমন আমিও সদ্য যুবা হই তোমার নিবিড় বাহুপাশে।
দ্যাখো এই মনোহারী দোকানের জায়গায় একদা
ছিল এক বটগাছ, লুপ্ত সেই বৃক্ষটির ছায়া
এখনো আমার মনে ছড়াম সুস্নিগ্ধ ছায়া তার। এই অতি-পুরাতন
মাটিতেই রোদে জ্বলে, জলে ভেজে আমার শিকড়।
৫/৭/৯৫
সে কোনো লাইনে ছিল না
খুব পোড়-খাওয়া এক লোক হেঁটে যাচ্ছে একা-একা
কোথাও সবুজ উপত্যকা আছে ভেবে।
কোনো দিকে দ্যায় না তেমন দৃষ্টি, শুধু
মাঝে-মাঝে একটি কি দুটি
চন্দনা, দোয়েল কিংবা শিমুলের লাল
দ্যাখে, আর ঝরা পাতাদের কান্না শোনে।
অকস্মাৎ, ঢ্যাঁড়া জোর পিটিয়ে বহু লোক একাকী লোকটিকে
ডেকে বলে, ‘কোথাও, চলেছ? এসো এই
লাইনে দাঁড়াও, জোট বাঁধো
আমাদের সঙ্গে, এই দল দেখছইতো বেশ ভারী, জোরদার
এসো এসো মোক্ষ যদি চাও। সেই লোক
কী ভেবে সেখান থেকে স’রে নিজ পথে হেঁটে যায়।
কিয়দ্দূর যেতে না যেতেই সে পথিক
থমকে দাঁড়ায় হৈ-হুল্লোড় শুনে; সারিবন্দী বহু
লোক, ওরা আকাশ ফাটানো গলা ছেড়ে ডাকে তাকে-
‘এখানে দাঁড়াও এসে আমাদের বিরাট কাতারে। এসে তুমি
সব পেয়েছির দেশে পৌছে যাবে সহজে। এ-কথা
লোকটাকে নিজেদের দলে টানবার
মোহন ফিকির। গোধূলির রঙ সর্বত্র মদির।
লোকটা নিজের বাঁশি ইতিমধ্যে হট্ররোলে হারিয়েছে ভেবে
এদিক ওদিক দ্যাখে, তারপর কাউকে কিছুই
না ব’লে সেখান থেকে একা-একা দিব্যি
দুটি লাইনের মধ্য দিয়ে নির্দলীয় চলে যায়।
৮/২/৯৫
সেলিনা পারভীন স্বরণে
তোমার দিকে উদ্যত হয়েছিল নেকড়েদের থাবা,
বারুদের গন্ধে ওরা মুছে দিতে চেয়েছিল
তোমার চৈতন্যপ্রবাহ থেকে ফুলের সৌরভের স্মৃতি,
তোমার দুটি চোখ থেকে ওরা
কেড়ে নিতে চেয়েছিল সকল স্বপ্নের অভ্র-রেণু,
ওরা তোমাকে হত্যা ক’রে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল
পচা, গলিত, দুর্গন্ধময় ভাগাড়ে। একাত্তরে ওদের
দূরচিসন্ধি সকল হ’য়ে মেতে উঠেছিল উলঙ্গ নৃত্যে!
কিন্তু, ওরা জানতো না,
তোমার মৃত্যুর মহিমা ওদের সকল ষড়যন্ত্র,
ওদের কশাইখানার বন্য উল্লাসকে মিথ্যা ক’রে দিয়ে
জেগে থাকবে বিপুল সূর্যোদয়ের মতো।
তোমার শরীরকে ওরা বিকৃত করেছে
বর্বর অস্ত্রাঘাতে; কিন্তু ওদের নোংরা, না-পাক হাত
একটি সামান্য আঁচড়ও কাটতে পারেনি তোমার ভাবমূর্তিতে,
আমরা আজো মুগ্ধাবেশে দেখি সেই মূর্তির গলায় দুলছে অমরত্বের মালা।
২০/১১/৯৫